সন্ত জোয়ান অফ আর্ক আর বিচারের বাণী
কবিশেখর কালিদাস রায়ের চাঁদ সদাগর কবিতার একটা পংক্তি ছিল, ‘মানুষই দেবতা গড়ে, তাহারই কৃপার পরে,…..
সকাল থেকেই চারদিক আঁধার করে মেঘ জমছিলো। ট্রেনটা ষ্টেশনের গায়ে লাগতেই গুঁড়ি গুঁড়ি বৃষ্টি শুরু হয়ে গেলো। বৃষ্টি মাথায় করে ষ্টেশন থেকে বেরিয়ে এলো কাছাকাছি বয়সের পঞ্চাশোর্ধ দুজন মানুষ। একজন পুরুষ, একজন মহিলা। দামী ফ্রেমের চশমায়, হ্যাংলা পাতলা গড়নের পুরুষটি দীর্ঘদেহী। পরনে লিনেনের শার্ট আর গাবারডিনের প্যান্ট। মহিলাটি মাঝারি স্বাস্থ্যের। নীলচে রঙের ছাপা প্রিন্টের তাঁতের শাড়ি আর টাইট করে বাঁধা খোপায়, এক রকমের দৃঢ় চেতা ভঙ্গি আছে। তিনি চোখ নামিয়ে রাস্তার দিকে তাকিয়ে হাঁটেন না। গ্রীবা উঁচু, সোজা তাকিয়ে হাঁটেন। চলা ফেরায় আভিজাত্য আছে। দুজনের কাঁধেই হালকা দুটো ব্যাগ ঝুলছে। দীর্ঘ পথ যাত্রার ক্লান্তি তাঁদের স্পর্শ করেনি। ষ্টেশন থেকে বেরিয়ে পিচ ঢালা রাস্তাটা ধরে উত্তর দিকে খানিক এগুলেই একলা দাঁড়িয়ে থাকা একটা বরই গাছের কোল ঘেঁষে যাত্রী ছাউনি। আলাপ করতে করতে তাঁরা সেদিকে হাঁটছেন। খানিক এগুতেই মুশলধারে বৃষ্টি শুরু হয়ে গেলো। তাঁরা দ্রুত পা চালিয়ে জনশূন্য যাত্রী ছাউনিতে ঢুকে গেলেন। মহিলাটি ব্যাগ থেকে রুমাল বের করে বসার যায়গাটা মুছে দিলেন। দুজন পাশাপাশি বসলেন। বোঝাই যায় তাঁরা পূর্ব পরিচিত।
“সেদিনও বৃষ্টি ছিলো খুব, মনে পড়ে? কোমর পানিতে থৈ থৈ করছিলো আমাদের গলিটা। অথচ, তুমি অপেক্ষা করছো, তোমার সাথে দেখা না করলেই নয়। কি যে অস্থির লাগছিলো!”
“কি জানো, আগেরদিন হাতে পাওয়া স্কলারশিপের সব কাগজ হাতে নিয়ে আমি সেদিন সে রেস্তোরাঁয় বসেছিলাম সারাটা দুপুর। মনে মনে আমাদের আগামী দিনগুলোর ছবি আঁকছিলাম। কি ভীষণ উৎকণ্ঠায় কেটেছে প্রতিটা সেকেন্ড, প্রতিটা মিনিট! খানিক পরপর দরজার দিকে তাকাচ্ছিলাম। কেবলই মনে হচ্ছিলো, ঝড় জলে ভিজতে ভিজতে তুমি ঢুকলে বুঝি।“
“তোমার চুল বেশ পাতলা হয়ে গেছে!”
“হুম…বয়সটা দেখবে না? মাঝখানটা প্রায় ফাঁকা হয়ে আসছে।“
“এই বয়সে এটাই মানায়। বোধ করি, ঝাঁকড়া চুল আর লম্বা জুলফিতে পঞ্চাশ পেরুনো তোমাকে দেখতে ভালোও লাগতো না।“
“তুমি মুটিয়েছো!”
“হু… থাইরয়েড।“
“তোমরা কি এখনো ধোপার দীঘির পারেই আছো?”
“ হ্যাঁ … পলেস্তারা খসা সে একতলা বাড়িটাতেই আছি। এতো পুরনো শেকড়, সহজে ছাড়ানো যায়!”
“তোমাদের বাড়ির দেয়াল ঘেঁষে একটা কৃষ্ণচূড়া গাছ ছিলোনা? ওটা আছে এখনো?”
“নাহ! ঝড়ে পড়ে গেছে সেও বছর পনেরো হবে। বোধ করি, আমাদের সব রঙ নিয়ে চলে গেছে ওটা।“
“আচ্ছা, সাতাশ বছর আগে, সেদিন অমন বৃষ্টি না হলে, আমাদের জীবনের গল্প অন্যরকমভাবে কিছু হতো, তাই না?”
“হয়তো।“
“আমি মাঝে মাঝেই এরকম একটা স্বপ্ন দেখি জানো? আঁকাবাঁকা একটা পথ ধরে পাশাপাশি হাঁটছি। অনেক দূরে একটা টলটলে পানির ডোবা দেখা যায়। ওটার ওপর একটা কাঠের সাঁকো। আমরা ওটার দিকে যেতে থাকি। ঠিক সাঁকোটার কাছে আসতেই আমার ঘুম ভেঙ্গে যায়। আমরা কখনোই সাঁকোটা পার হতে পারিনি।“
“বেশ হয়েছে! সাঁকো পার হতে ভয় করে আমার। চাচা কেমন আছেন?”
“তিনি নেই।“
“ওহ! কি হয়েছিলো?”
“যেদিন তুমি এলে না, সেদিন সে রেস্তোরাঁয় বিকেল অব্দি অপেক্ষা করেছিলাম। বৃষ্টি কিছুতেই ধরছিলো না। আমি আর বসে থাকতে পারিনি। অদ্ভুত একটা ঘোরের মধ্যে বৃষ্টিতে ভিজতে ভিজতে ঘরে ফিরেছিলাম। ঘরে ফিরতে ফিরতে বুঝতে পারি জ্বরে গা পুড়ে যাচ্ছে আমার। ভেজা কাপড় ছেড়ে বিছানায় শুয়ে পড়ি। বাবারও শরীরটা ভালো লাগছিলো না বলে তিনিও সকাল সকাল শুয়ে পড়েন। ঘরেতো আর কেউ ছিলো না। মানুষ বলতে আমরা দুজনই। আমরা কেউ কিছু খেলাম না সে রাতে। ভোর রাতের দিকে বাবা স্ট্রোক করেন। সারারাতের জ্বরে কাহিল আমি সকালে ঘুম ভেঙ্গে দেখেছিলাম বাবা কাত হয়ে পড়ে আছেন বিছানায়।“
“আমাদের রতনটা ঘর ছেড়েছে জানো।“
“সে কি! কেনো? মানসিকভাবে ঠিক সুস্থও ছিলো না ও, তাই না? কবিতাও লিখত বোধ হয়!”
“হ্যাঁ। সিজোফ্রেনিক ছিলো। লেখাপড়া বিশেষ করলো না। পকেটে কবিতা নিয়ে পত্রিকা অফিসগুলোতে ঘুরতো। বছর পাঁচেক আগে, এক নবমীর রাতে আচানক বেরিয়ে গেলো… আজও ফিরলো না।“
“আমার চিঠিগুলোর জবাব দাও নি কোনদিন…”
“ইচ্ছেটাই মরে গেছিলো, জানো … বাবা বিছানা নিলেন। সবার ছোট নূপুরটা পালিয়ে গিয়ে বিয়ে করে, এক বছরের মাথায় বাচ্চা কোলে নিয়ে ঘরে ফিরে এলো। ওদিকে কবিতা পকেটে করে ভবঘুরের মতো ঘুরে বেড়াচ্ছিলো রতন। ওরা সবাই আমার দিকেই তাকিয়ে ছিলো।“
“সব বোঝা তুমি একাই বয়ে নিয়ে বেড়ালে…আমি কি তোমার পাশে দাঁড়াতে পারতাম না? আমার প্রতি এতোটাই অভিমান জমিয়েছিলে তুমি?”
“বাদ দাও না ওসব। আচ্ছা, তুমিওতো কখনো দেখতে আসো নি… আমি কেমন আছি, কিভাবে আছি, ……… কখনো ইচ্ছে করেনি?”
“ইচ্ছে করেনি আবার? বাবা মারা যাবার পর আরও মাস দুয়েক ছিলাম এ শহরে। কিছুতেই মন বসছিলো না। কতদিন নিজের অজান্তেই তোমাদের পাড়ার দিকে হেঁটে গেছি! শেষ অব্দি পারিনি। কি যেন একটা আড়ষ্টতা, একটা লজ্জা, অদ্ভুত এক অভিমানে ফিরে এসেছি।“
“দেশে এসেছো কবে?”
“মাস তিনেক হলো।“
“কদিন আছো?”
“আগামী সপ্তাহে ফিরছি।“
“বিয়ে করলেনা কেনো?”
“তোমাকে ভুলতে পারিনি তাই…”
“যাও! এই বুড়ো বয়সে আর ভোলাতে এসো না।“
“মিথ্যে বলিনিতো! তুমি করোনি কেনো?”
“ও বাবা! আমার কি সে অবসর হয়েছে! …”
“শহর ছেড়ে অতদুরে চাকরি করছো কেনো? এ শহরেই অনেক কলেজ তোমাকে লুফে নেবে।“
“এ শহরের প্রতিটা মোড়ে তোমার স্মৃতি দাঁড়িয়ে আছে। আমার অস্থির লাগে।“
“তাই শহর ছেড়ে পালিয়ে গেলে? পালাতে পেরেছো? আমাকে ভুলতে পেরেছো?”
“সব ভুলতে পারলে কি আর এভাবে ফিরে ফিরে আসতাম? কি জানি! না ফিরলে হয়তো আজ এভাবে আমাদের দেখাও হতো না…”
“হয়তো… সে যাক গে। নিয়তির শোধ নিয়তি নিয়েছে। বরং চলো, বুড়িয়ে যাবার আগে খানিক বৃষ্টিতে ভিজি, সেই পুরনো দিনগুলোর মতো।“
“তোমার পাগলামো এখনো গেলো না। আমাদের বাসা কাছেই। চলো বাসার দিকেই হাঁটি তাহলে…”
“চলো…”
বৃষ্টির ছাঁটে এমনিতেই ভিজে যাচ্ছিলো ওরা। এবার বৃষ্টিতে গা ভিজিয়ে ওরা হাঁটতে থাকে। পুরনো দিনগুলোর মতো, পাশাপাশি, কাছাকাছি। তুমুল বৃষ্টির উচ্ছাস ওদের চোখে পরিচিত এক স্বপ্নের আবীর মেখে দেয়। সাতাশ বছর পর আচানক একই ট্রেনে পাশাপাশি সিটে ওদের দুজনের এই দেখা হয়ে যাওয়া, নিয়তির অদৃশ্য কোন ইশারা হলেও হতে পারে। তবে, জীবনের অপরাহ্ণে এসে, ওদের আর তাড়াহুড়া নেই কোন। অনেক অনেক বছর আগে, এরকম একটা বৃষ্টি ওদের বিচ্ছেদের বীজ বুনেছিলো। আজ হয়তো সে বৃষ্টিই ফিরে এসেছে। ওদের ঘিরে গজিয়ে ওঠা বিচ্ছেদের মহীরুহ উপড়ে নিতে প্রাণান্ত প্রয়াস চালাচ্ছে ওটা।
কবিশেখর কালিদাস রায়ের চাঁদ সদাগর কবিতার একটা পংক্তি ছিল, ‘মানুষই দেবতা গড়ে, তাহারই কৃপার পরে,…..
গুলশান এক থেকে দুইয়ের দিকে যাওয়ার পথে চৌরাস্তার পঞ্চাশ গজ দক্ষিণে পঁচিশতলা আর্কেডিয়া টাওয়ারের তেরতলায়…..
রবি স্কুলে এসে প্রথমে সই করতে যায় হেডমাস্টারমশাই এর ঘরে।হেডমাস্টারমশাই বললেন,রবি আমি আজ একটু কাজে…..
কাঁটায় কাঁটায় বিকেল চারটা পঞ্চান্নতে ডাইনিং রুমের উত্তরের দেয়ালে কাঠের ফ্রেমে বাঁধাই করা ফুলদানিতে বর্ণিল…..