গৌর (মালদা) – বাংলার চিত্তাকর্ষক ইতিহাস
বাংলার চিত্তাকর্ষক ইতিহাস সম্পর্কে জানার সময়, গৌরের মতো আর কিছু গন্তব্য হতে পারে না।…..
জাপানের তোহোকু বিশ্ববিদ্যালয়ে এতোগুলো বছর কী করে যে কাটিয়ে দিয়েছি টেরই পাইনি। আমার বসবাস ছিল জাপানের উত্তরে অবস্থিত তোহোকু অঞ্চলে। তোহোকুর প্রধান জেলা মিয়াগি। মিয়াগি জেলার প্রধান শহর সেন্দাই। তোহোকু বিশ্ববিদ্যালয়টি এ শহরেই। আর এ শহরে শিশুর বেড়ে ওঠার মতোই লালিত হয়েছি আমি।
মিয়াগির একপাশে প্রশান্ত মহাসাগর, আরেক পাশে মাইলের পর মাইল বিস্তৃত ‘যায়ো’ নামক পর্বতমালা। জাপানের উত্তরাঞ্চল মানেই শীতকালে হাড় কাঁপানো শীত। যায়ো পর্বতগুলো আমাদের আগলে রাখতো শীতের হাত থেকে। কনকনে শীতের হাওয়া মিয়াগিতে ঢোকার পথে বাধা পেতো যায়ো পর্বতমালায়, আমরা বেঁচে যেতাম তীব্র শীতের হাত থেকে।
জাপানের তিনটি সেরা দর্শনীয় স্থান হচ্ছে মিয়াজিমা, আমানোহাশিদাতে এবং মাৎসুশিমা। এর মধ্যে মাৎসুশিমার অবস্থান মিয়াগি জেলায়। প্রশান্ত মহাসাগরের পারে এ মাৎসুশিমা। মহাসাগরের বুক থেকে বেরিয়ে আসা ছোট ছোট পাহাড়ের সৌন্দর্য দেখতে মাৎসুশিমায় ছুটে আসেন হাজার হাজার পর্যটক।
মিয়াগির পাহাড় আর প্রশান্ত মহাসাগর হাতছানি দিয়ে ডাকতো আমাকে, সে ডাক উপেক্ষা করতে পারিনি আমি। কিন্তু আরো অনেক আগে এই মিয়াগিতে আমাকে হাতছানি দিয়ে ডেকেছিলেন এক মহান হৃদয়ের জাপানী প্রফেসর, নাম, নাওফুমি ইয়াৎস্কি।
প্রফেসর নাওফুমির সঙ্গে আমার প্রথম দেখা ১৯৯৮ সালের এপ্রিলে। নারিতা বিমানবন্দর থেকে কীভাবে মিয়াগিতে আসতে হবে, আগে থেকেই আমাকে জানিয়ে রেখেছিলেন তিনি। সে মোতাবেক নারিতা থেকে টোকিও, টোকিও থেকে অতি দ্রুতগামী ট্রেন ‘শিন্কান্সেন’ এ চড়ে সরাসরি মিয়াগি অভিমুখে যাত্রা। যেদিন মিয়াগির সেন্দাই স্টেশনে পা রেখেছিলাম, সেদিন জাপানের সাপ্তাহিক ছুটি বলে বিশ্ববিদ্যালয়ে আসেননি প্রফেসর নাওফুমি, ফলে তোহোকু বিশ্ববিদ্যালয়ের অদূরে সেন্দাই স্টেশন থেকে আমাকে আনতে পাঠিয়েছিলেন ডেন্টাল ফ্যাকাল্টির একজন লেকচারারকে। তাই প্রফেসর নাওফুমির সঙ্গে সেদিন দেখা হলো না, দেখা হলো পরদিন।
প্রফেসর নাওফুমি তোহোকু বিশ্ববিদ্যালয়ের ডেন্টাল ফ্যাকাল্টির অ্যানাস্থেসিওলজী বিভাগের প্রধান। আমার পরিকল্পনা হলো, ডেন্টাল অ্যানাস্থেসিওলজী বিষয়ে এক বছরের ক্লিনিক্যাল ট্রেনিং করবো। এরপর ভর্তি হবো সুবিধাজনক কোনো এক বিষয়ে পিএইচডি কোর্সে। আমার এ ইচ্ছার কথা আগে থেকেই জানতেন প্রফেসর নাওফুমি। সে মোতাবেক আমার ভর্তির সব ব্যবস্থা ঠিকঠাক করে ফেললেন তিনি। তবে সমস্যা ছিল একটি, আমার স্কলারশীপের কোনো ব্যবস্থা হয়নি তখনো। আপাততঃ আমাকে নিজ খরচে পড়তে হবে। এরই সঙ্গে স্কলারশীপের আবেদনও করতে হবে সময়ে সময়ে। আমাকে স্কলারশীপের সুপারিশ করবেন বলেও কথা দিয়েছিলেন তিনি।
আমার বিশ্বাস ছিল, জাপানে যাওয়ার কিছুদিনের মধ্যেই স্কলারশীপ জোগাড় হয়ে যাবে। তার আগ পর্যন্ত একটু কষ্ট করে পড়ার খরচটি চালিয়ে নিতে পারলে আর পেছনে ফিরে তাকাতে হবে না। জাপানের উদ্দেশে দেশ ত্যাগের আগে সঞ্চিত টাকাগুলো দিয়ে ডলার কিনে নিয়েছিলাম বেশ কিছু। নো রিস্ক, নো গেইন, এ সত্যটিতে বিশ্বাসী হয়ে সাহস সঞ্চয় করলাম। কিছুদিন পর স্কলারশীপ নামের সেই সোনার হরিণের দেখা পেয়ে যাবো, ভুল নেই।
তখনো জাপানের রেসিডেন্স পারমিট (জাপানী ভাষায়, গাইককু জিন তরুকু সমেশো) হাতে পাইনি। ব্যাংকে অ্যাকাউন্ট খোলা সম্ভব হচ্ছিল না তাই। আমার থাকার ব্যবস্থা হয়েছিল যে ডরমিটরিতে, সেখানে বিছানার তোষকের নিচে গোপনে লুকিয়ে রেখেছিলাম ডলারগুলো। স্কলারশীপ পাওয়ার আগ পর্যন্ত ওগুলো আমার চালিকাশক্তি।
জাপানে এসেছি চার মাস হয়ে গেলো। স্কলারশীপ জোগাড় করতে পারিনি এখনো। ইউনিভার্সিটিতে ভর্তি ফী, মাসিক টিউশান ফী, বাধ্যতামূলক স্বাস্থ্যবীমার অর্থ পরিশোধ, ডরমিটরির ভাড়া মেটানো, খাবার খরচ- সব কিছু মিলিয়ে হুহু করে কমতে লাগলো তোষকের তলে লুকিয়ে রাখা ডলারের ভাণ্ডার। প্রতিদিন ইউনিভার্সিটি থেকে রুমে ফিরে এসে প্রথমেই তোষক উল্টিয়ে দেখি ডলারগুলো ঠিকমতো আছে কিনা। ডলার ভাঙিয়ে জাপানী মুদ্রা ইয়েন কিনতে কত খরচ হলো, আরো ক’মাস চলতে হলে আর কতো ইয়েন লাগবে, আদৌ স্কলারশীপ পাবো কিনা- এসব নিয়ে ভাবতে ভাবতে মনটা কেমন অজানা আশঙ্কায় ভরে যেতো।
ইতোমধ্যে AIEJ (Association for International Education, Japan) নামক প্রতিষ্ঠানের স্কলারশীপের জন্য আবেদন করলাম। প্রফেসর নাওফুমি প্রশংসাপত্র লিখে দিলেন যথারীতি। কিন্তু যতই দিন যেতে লাগলো, ততোই আমার কাছে পরিষ্কার হতে লাগলো যে জাপানের ভেতর থেকে স্কলারশীপ পাওয়া এতো সোজা নয়। কারণ, এ দেশে নিজ খরচে পড়াশোনা করতে এসেছে অনেক চায়নিজ ও কোরিয়ান ছাত্র-ছাত্রী। ফলে স্কলারশীপের জন্য প্রতিযোগিতাও বেশি। তবুও বিশ্বাসে বুক বেঁধে আছি। কথায় বলে, বিশ্বাসে মিলায় বস্তু।
AIEJ এর স্কলারশীপ পেলাম না। হতাশায় বুকের ভেতরটা ভারী হয়ে উঠতে লাগলো। জাপানে গ্রীষ্মকাল চলছে। আমাদের সেন্দাই শহরে শুরু হয়েছে ‘তানাবাতা’ উৎসব। স্বল্প সময়ের এ গ্রীষ্মকে বরন করার উৎসবে মেতে উঠেছে শহরবাসী। ডাউন টাউনের ক্লিস রোড সাজানো হয়েছে রঙিন কাগজের ঝালর দিয়ে। কিমোনো (জাপানী মেয়েদের ঐতিহ্যবাহী পোশাক) পরে তানাবাতা দেখতে এসেছে সুন্দরী জাপানী মেয়েরা। ‘সুযুমে ওদোরী’, অর্থাৎ, চড়ুই নাচ করতে করতে শহরের প্রধান সড়ক ধরে এগিয়ে চলেছে একদল তরুণ-তরুণী, হাতে জাপানী পাখা, পরনে ‘হাপ্পি’ (এক ধরণের জাপানী পোশাক), রং মেখেছে গালে, শব্দ করে বলছে নাচের বোল- ‘হেই সোরে সোরে সোরে’। শহরের ভেতর দিয়ে যে নদীটি বয়ে গেছে, নাম তার হিরোসে গাওয়া, অর্থাৎ হিরোসে নদী। আজ সন্ধ্যায় এ নদীর পারে জমে উঠবে আতশবাজি উৎসব (জাপানী ভাষায়, হানাবি)। এতো আনন্দ চারদিকে! কিন্তু আমার কোথাও যেতে ইচ্ছে হলো না। এ তানাবাতা উৎসব যেনো আমার জন্য নয়। বুকভরা অনিশ্চয়তার বেদনা নিয়ে কি উৎসবের আনন্দ উপলব্ধি করা যায়?
দ্বিতীয়বার আরেকটি স্কলারশীপের জন্য আবেদন করলাম। টোকিও ফাউন্ডেশনের স্কলারশীপ। প্রফেসর নাওফুমি প্রতিবারই আমাকে স্কলারশীপ দেয়ার জন্য জোড়ালো সুপারিশ জানান কর্তৃপক্ষের কাছে। এবারও তাই করলেন। সঙ্গে আরেকটি সুপারিশপত্র জোগাড় করে দিলেন তাঁর বিভাগের এসোসিয়েট প্রফেসরের কাছ থেকে।
ইন্টারভিউর জন্য টোকিও ফাউন্ডেশনের চিঠি পেলাম। যেতে হবে রাজধানী টোকিওতে। যদিও প্রথমবার সেন্দাইতে আসার সময় দ্রুতগামী ট্রেন ধরেছিলাম টোকিও থেকে, তখন মূল টোকিও শহরে ঢোকার সুযোগ হয়নি। এবার সত্যিকার অর্থেই যেতে হচ্ছে রাজধানী টোকিওতে। টোকিওতে যাওয়ার জন্য উচ্চমূল্যে ‘শিনকানসেন’ এর টিকিট কাটার আর্থিক অবস্থা এখন আর নেই। তাই ধরতে হলো রাতের বাস, ভাড়া শিনকানসেন এর প্রায় অর্ধেক। স্কলারশীপের ইন্টারভিউ শেষ করে সে রাতেই চড়লাম সেন্দাইগামী বাসে। গত রাতে বাসে ভাল ঘুম হয়নি, রাতের বাসে আমি কখনোই ভাল ঘুমাতে পারি না। দ্বিতীয় রাতটিও বাসের ভেতর নির্ঘুম কাটবে। রাতটা কোনো হোটেলে কাটালেই ভাল হতো। কিন্তু টোকিওর মতো খরচবহুল শহরে উচ্চমূল্যে একরাত হোটেলে কাটানোর চেয়ে বাসের ভেতর নির্ঘুম রাত কাটানো অনেক বেশি শ্রেয় মনে হলো। সেন্দাইতে ফিরে এলাম। আরো কয়েক মাস কেটে গেলো এরপর।
আমি যে ডরমিটরিতে বসবাস করতাম, সেটি ডেন্টাল ফ্যাকাল্টি থেকে অনেকটা পথ দূরে, হিগাশি সেন্দাই (অর্থাৎ পূর্ব সেন্দাই) নামক স্থানে। ডরমিটরির বৃদ্ধ কেয়ারটেকার অনুদেরা সান। সান মানে মিস্টার, মিসেস বা মিস; জাপানীদের নামের সঙ্গে সন্মানবশত সান শব্দটি ব্যবহার করা হয়। অনুদেরা সাহেব তাঁর ব্যবহৃত পুরোনো একটি বাইসাইকেল আমাকে দিয়েছিলেন। এতদিন ফ্যাকাল্টিতে যেতাম বাসে, এখন যাই অনুদেরা সানের দেয়া বাইসাইকেলে, বাস ভাড়া বেঁচে যায়।
শরৎকাল এসে গেছে জাপানে। গাছের পাতাগুলো লাল হতে লাগলো। সাইকেলে চড়ে ফ্যাকাল্টিতে যাওয়ার পথে একটি পার্কের পাশ দিয়ে যেতে হয়, পার্কের নাম কাৎসুয়ামা কোয়েন। কোয়েন মানে, পার্ক। কয়েক মাস আগেই যে পার্কটিকে দেখেছিলাম সবুজ, সেটি কেমন রঙিন হয়ে উঠেছে এখন। মমিজি (মমিজি মানে, ম্যাপ্ল গাছ) পাতায় যেনো আগুন লেগেছে। মনটা খুব ফুরফুরে লাগছিল তখন। আজ কি কোনো ভাল খবর অপেক্ষা করছে আমার জন্য? ফ্যাকাল্টিতে এসে প্রথমেই গেলাম স্টুডেন্টস অ্যাফেয়ার বিভাগে। টোকিও ফাউন্ডেশনের স্কলারশীপের কি ফলাফল, জানতে চাইলাম। স্টুডেন্টস অ্যাফেয়ার অফিসার ইতস্তত বোধ করছিলেন কথাটা বলতে। শেষ পর্যন্ত বলেই ফেললেন, ‘গোমেন নাসাই, দামে দেশ্তা, যান্নেন দেশ্তা’। অর্থাৎ, দুঃখিত, হয়নি, খুব দুর্ভাগ্যজনক।
আমাদের ডিপার্টমেন্টের অ্যাসিস্ট্যান্ট প্রফেসর ডাঃ মিনোরু সাতো। তাকে দায়িত্ব দেয়া হয়েছে আমাকে সার্বক্ষণিকভাবে গাইড করার জন্য। আমি তাকে সাতো সেন্সেই বলে ডাকি। সেন্সেই মানে শিক্ষক। যে কোনো শিক্ষককে সম্বোধন করতে হলে ‘সেন্সেই’ শব্দটি ব্যবহার করতে হয়। সাতো সেন্সেই পড়াশোনার তদারকির পাশাপাশি আমার জীবন যাপন, সুবিধা-অসুবিধা বিষয়েও খোঁজ খবর নিতেন। প্রায়ই তিনি তাঁর বাড়ির বাগানে লাগানো টমেটো গাছ থেকে ছোট ছোট লাল হলুদ টমেটো নিয়ে আসতেন আমার জন্য। হয়তো, আমার নিত্যদিনের অন্নসংস্থানে কিছুটা হলেও সহযোগিতার হাত বাড়াতে চাইতেন। টোকিও ফাউন্ডেশনের স্কলারশীপটিও হয়নি, জানতে পেরে ব্যথিত হলেন সাতো সেন্সেই। জিজ্ঞেস করলেন, যদি একদমই স্কলারশীপ না পাও, কি করবে তখন? বললাম, দেশে ফিরে যাবো। আমার দিকে করুণ চোখে তাকালেন সাতো সেন্সেই।
স্কলারশীপ পাইনি বলে প্রফেসর নাওফুমি আমাকে পার্টটাইম চাকরী খোঁজার উপদেশ দিলেন। কিন্তু আমাদের সেন্দাই শহরটি শিল্প-কারখানাসমৃদ্ধ নয় বলে এখানে পার্টটাইম চাকরী পাওয়া দুস্কর। জাপানের টোকিও, ওসাকা, চিবা, গুন্মা বা ইওকোহামা শহরের বাসিন্দা হলে পার্টটাইম চাকরী পাওয়া সোজা হতো। কিন্তু আমাদের শহরটি একেবারে ভিন্ন। কাজের সুযোগ যদি কোনো বিদেশী ছাত্র পেয়ে থাকে সৌভাগ্যক্রমে, এরা মূলত চায়নিজ। চেষ্টা অবশ্য চালিয়েছিলাম একটি চাকরী জোগাড় করতে, তখনো জাপানী ভাষাটি ভালো রপ্ত করতে পারিনি বলে চাকরীর বদলে ব্যর্থতা ছাড়া আর কিছুই জোটেনি।
১৯৯৯ সালের এপ্রিল থেকে শুরু হবে আমার পিএইচডি কোর্স। তার আগে এ কোর্সের ভর্তি পরীক্ষায় পাশ করতে হবে। আমার ভর্তি পরীক্ষা হয়ে গেছে ইতোমধ্যেই, পাশও করেছি। অনেক ব্যর্থতার মাঝে একটু সাফল্যের ছোঁয়া। কিন্তু স্কলারশীপ না পেলে দীর্ঘ চারটি বছর পিএইচডি কোর্সে পড়বো কিভাবে, ভাবনাগুলো ক্রমাগত গ্রাস করতে লাগলো আমাকে।
ডেন্টাল ফ্যাকাল্টির অর্থোডন্টিকস বিভাগে পিএইচডি তৃতীয় বর্ষে পড়তো ফিলিপিন থেকে আসা মারলন মলদেজ। ইউনিভার্সিটির ক্যান্টিনে তার সাথে দেখা হয় প্রায়ই। মলদেজ জানালো, এ মাসেই জাপান সরকারের মন্বুশো স্কলারশীপের আবেদনপত্র আসবে ডেন্টাল ফ্যাকাল্টিতে। মন্বুশো স্কলারশীপ হচ্ছে জাপানের সেরা। যারা পিএইচডি তৃতীয় বর্ষে পড়ে, তারাই অগ্রাধিকার পায় এ স্কলারশীপের আবেদন করতে, এটাই বিশ্ববিদ্যালয়ের নিয়ম। এ বছর আমাদের ডেন্টাল ফ্যাকাল্টি থেকে একজন মাত্র আবেদনকারীকে নির্বাচন করবেন ফ্যাকাল্টির ডীন, এরপর চূড়ান্ত মনোনয়নের জন্য পাঠাবেন মন্বুশো কর্তৃপক্ষের কাছে। আমি যেহেতু পিএইচডি তৃতীয় বর্ষে উঠিনি, আগামী এপ্রিল থেকে প্রথম বর্ষে পড়ার ভর্তি পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়েছি মাত্র। এ অবস্থায় মন্বুশো স্কলারশীপের আবেদন করার অগ্রাধিকার নেই আমার।
এক দুপুরে ডিপার্টমেন্টে অলস বসে আছি। ভাবছি দেশের কথা। বৃদ্ধ বাবার কথা মনে পড়ছে খুব। স্কলারশীপের সোনার হরিণ হয়তো ধরা দেবে না আর। পিএইচডি করার স্বপ্ন নিয়ে পারি জমিয়েছিলাম জাপানে, স্বপ্নভঙ্গের বেদনা নিয়ে আবার ফিরে যাবো সগৃহে? ডিপার্টমেন্টের কাচের জানালা দিয়ে দৃষ্টি চলে যায় বাইরে। সারি সারি পাইন গাছ দাঁড়িয়ে আছে ফ্যাকাল্টির দেয়াল ঘেঁষে। গাছে বাসা বেঁধেছে দাঁড়কাক। প্রতিদিনই ডাকে কাকগুলো, আজো ডাকছে। আমার সব সময়ই মনে হচ্ছিল, বাংলাদেশের কাকের আওয়াজের সঙ্গে জাপানের কাকের আওয়াজের একটু তফাৎ রয়েছে। জাপানের কাকের ডাক মোটেও কর্কশ বলে মনে হয়নি, কী যেনো, হয়তো জাপানী কাক বলেই। কিন্তু আজ দুপুরে কাকগুলোর কণ্ঠস্বর মনে হচ্ছে কেমন একটু অন্যরকম, কেমন একটু ভারি ভারি, একটু বেদনাময়। তাহলে কাকগুলো কি আমারই মতো কোনো নিরব বেদনা ধরে রেখেছে মনে? এমন সময় খবর পেলাম, প্রফেসর নাওফুমি ডেকে পাঠিয়েছেন আমাকে।
প্রফেসরের রুমের সামনে হাজির হলাম। দরজা নক্ করেই বললাম, ‘শিৎসুরেই শিমাস’, বিরক্ত করছি। কারো রুমে প্রবেশের অনুমতি নেয়ার জন্য ‘শিৎসুরেই শিমাস’ বা ‘ওজামা শিমাস’- এ জাতীয় বাক্যগুলো ব্যবহার করা হয়। ভেতর থেকে বেরিয়ে এলেন প্রফেসর নাওফুমি। বললাম, কোন্নিচি ওয়া। ওগেন্কি দেসকা? অর্থাৎ, শুভ দিন। কেমন আছেন? প্রফেসর আমাকে বসতে বললেন। এরপর চমকে ওঠার মতো একটি খবর জানালেন। বললেন, প্রফেসর মিতানি’র সঙ্গে আলাপ করেছি তোমার ব্যাপারে। আমি তাঁর কাছ থেকে কথা আদায় করে নিয়েছি, তিনি যেনো এ বছর শুধু তোমাকেই নির্বাচন করেন
মন্বুশো স্কলারশীপের আবেদন করার জন্য। প্রফেসর মিতানি নিজেও আগ্রহ প্রকাশ করেছেন তোমার ব্যাপারে।
ডেন্টাল ফ্যাকাল্টির ডীন প্রফেসর হিদেও মিতানি। অর্থোডন্টিকস বিভাগের প্রধান তিনি। প্রফেসর নাওফুমির পাশের রুমটিই ডীন হিদেও মিতানি’র। প্রতিবেশী বলেই হয়তো আমার ব্যাপারে প্রফেসর নাওফুমির অনুরোধ উপেক্ষা করতে পারেননি তিনি। আমি জানি, স্কলারশীপ ছাড়াই পিএইচডি কোর্সে পড়ছে অনেক চায়নীয় ছাত্র। এদের কেউ কেউ পড়ছে তৃতীয় বর্ষে। আমাকে সুযোগ দেয়ার জন্য সবার আবেদন অগ্রাহ্য হয়েছে। কারণ, আমাকে মন্বুশো স্কলারশীপ পাইয়ে দেয়ার জন্য নাছোড়বান্দার মতো প্রফেসর মিতানিকে ধরেছিলেন মহানুভব অধ্যাপক নাওফুমি ইয়াৎস্কি। প্রফেসর নাওফুমির কাছ থেকে বিদায় নেয়ার আগে মাথা নিচু করে প্রফেসরকে বললাম, সেন্সেই, ইমা মাদে তাক্সান ওসেওয়া নি নারিমাস্তা, অর্থাৎ, স্যার, এখন পর্যন্ত অনেকবার আপনার কাছে কৃতজ্ঞ হয়েছি। ‘হন্তোনি আরিগাতো গোযাইমাস্’, সত্যি আপনাকে ধন্যবাদ।
স্টুডেন্টস অ্যাফেয়ার বিভাগ থেকে মন্বুশো স্কলারশীপের আবেদনপত্র তুলে নিয়ে এলাম। মহাউৎসাহে জাপানী ভাষায় আবেদনপত্রটি পূরণ করতে লাগলেন সাতো সেন্সেই। তিনি আমার রিসার্চ প্রোটোকলও লিখে ফেললেন প্রফেসর নাওফুমির নির্দেশ মতো।
জানুয়ারী ১৯৯৯। শীত জাকিয়ে নেমেছে আমাদের সেন্দাই শহরে। সকাল থেকে হালকা তুষার পড়ছে। মোটা জ্যাকেট, হাতমোজা, কানটুপি পরেছি। ফ্যাকাল্টিতে যাচ্ছি কাৎসুইয়ামা পার্কের পাশ দিয়ে সাইকেল চালিয়ে, অনুদেরা সাহেবের দেয়া সেই বাইসাইকেল। পার্কের গাছগুলোর সব পাতা ঝরে পড়েছে। যেনো তুষারকে বরন করার জন্য অপেক্ষা করছে পাতাহীন ডালপালাগুলো। যথারীতি ডিপার্টমেন্টে শুরু হলো আমার আরেকটি কর্মব্যস্ত দিন। তুষারপাত বাড়তে লাগলো ক্রমাগত। জানালার বাইরে চোখ যায়, তুলোর মতো ভেসে ভেসে নামছে তুষার আর তুষার।
বিকেলে স্টুডেন্টস অ্যাফেয়ার বিভাগে গেলাম। আজ মন্বুশো স্কলারশীপের ফল জানা যাবে। মাথা নিচু করে কাজ করছিলেন স্টুডেন্টস অ্যাফেয়ার অফিসার। ক্ষীণ গলায় জিজ্ঞেস করলাম, ‘সুমিমাসেন, দো দেস্কা?’- ‘এক্সকিউয মি, কী খবর?’ চেয়ার ছেড়ে দ্রুত উঠে এলেন অফিসার। বললেন, ওমেদেতো, গোকাকু শিমাস্তা। অর্থাৎ, অভিনন্দন, তুমি সফল হয়েছো।
মন্বুশো স্কলারশীপ পেয়েছি, একটু আগেই জানতে পেরেছি তা। চোখের পাতা ভিজে আসছে আমার। বাইরে তুমুল তুষার পড়ছে তখন। তুষারপাত না থামা পর্যন্ত ঘরে ফিরতে পারছি না। ফ্যাকাল্টির লাইব্রেরীতে বসে থাকলাম দীর্ঘ সময়। রাত হয়ে এলো। তুষারপাত থেমে গেছে। বাইরে বেরিয়ে এলাম। তুষারে ঢাকা পড়েছে সারা শহর। কী অদ্ভুত! জোছনা ছলকে পড়ছে তুষারের ওপর। চাঁদটা এতো গোল মনে হচ্ছে কেন? আজ কি তাহলে পূর্ণিমা? অনুদেরা সাহেবের বাইসাইকেল তুষারের নিচে চাপা পড়েছে। এই তুষারের স্তুপ ঠেলে কী করে ঘরে ফিরবো আজ? জানিনা। শুধু এটুকু জানি, এ শ্বেত শুভ্র তুষারের শহরে এখন আমি এক অলৌকিক রাজপুত্র।
বাংলার চিত্তাকর্ষক ইতিহাস সম্পর্কে জানার সময়, গৌরের মতো আর কিছু গন্তব্য হতে পারে না।…..
স্মৃতি খুব বিশ্বস্ত সঙ্গী। দূরে সরে গেলেও চলে যায় না পুরোপুরি। কোনো মানুষই তাই কখনো…..
৭১ এর মুক্তিযোদ্ধের গল্প বাঙালি প্রত্যেক পরিবারের মধ্যে কিছুনাকিছু জানার ইতিহাস রয়েছে।তখনকার বাংলাদেশের সাড়ে সাত…..
আগের পর্ব পড়ুন এখানে >>> রনির ফোনটা বেজে বেজে থেমে গেল কিন্তু কেউ উত্তর করল…..