ঝরা শিউলি
এক মেয়েটা মুঠো মুঠো জ্যোৎস্না কুড়িয়ে অপরের মুখমন্ডলে চাঁদ দেখত। মানুষের উপকার করার ক্ষেত্রে,…..
ছেলেটার মুখের দিকে ঠিকমতো চাইতে পারছিলেন না সুলতানা। তার জঠরেই জন্ম নিয়েছে এক অভিশপ্ত অসুখ নিয়ে। আজ জন্মদাতা বাবা থাকতেও নেই; আর নিজেকে বেশ অপাঙক্তেয় মনে হচ্ছে বারবার, তাকে দিয়ে কিচ্ছুটি হওয়ার নয়।
মাসতিনেক হলো সুলতানা তার বাবারবাড়িতে উঠেছেন। ৯ বছরের সন্তানটিকে তার বাবা দাদাবাড়িতে রেখেছেন; সেখানকার একটা সউলে ভর্তিও করে দেওয়া হয়েছে। এই বয়সে প্রাণোচ্ছ্বল, চঞ্চল হয়ে থাকার কথা। অথচ, একরাশ ক্লান্তি ভর করে তার গোটা অবয়বে। মায়ের স্নেহ ভালবাসা থেকে কতদূরে থাকতে হচ্ছে; প্রতিনিয়ত শুনতে হয় নানা গঞ্জনা। আর শরীরে বয়ে বেড়াতে হচ্ছে বাবার অসুখটা।
আজ ছেলেটি এসেছে নানাবাড়ি, তার মায়ের কাছে।
মাকে পেয়েই এক দৌঁড়ে সোজা তার বুকের ভেতরে আশ্রয়। মুখটি গুঁজে একটু প্রশান্তি খোঁজে সে।
সন্তানটিকে পেয়ে সুলতানাও বেশ আবেগপ্রবণ হয়ে পড়েন। তার পরাণটা জ্বলে যাচ্ছে….
সংসারের নানা জটিলতা- এখনও বোঝার ক্ষমতা হয়নি শিশুটির। তবে, বুঝতে শিখেছে, মাকে ছাড়াই তাকে একা একা থাকতে হবে।
সুলতানা সইতে পারেন না… এই পৃথিবীতে এখন এই সন্তানটি একমাত্র তার অবলম্বন। কিন্তু তার জন্যে কিছুই করতে পারছেন না।
এই এতটুকু বাচ্চা, কিন্তু কী দারুণ তার অভিব্যক্তি। বুকের ভেতর থেকে মাথাটা একটু বের করে মায়ের চোখে চোখ রেখে বলে, মা- তুমি ছোট একটা চাকরি করো। ছোট্ট একটা বাসা নেবে, সেখানে আমরা দু’জন থাকবো। বেশি খাবারের দরকার নেই, একবেলা খেয়েও থাকতে পারবো। কোনও খেলনা দেওয়া লাগবে না। দাদিবাড়ি খুব পঁচা; ওরা তোমার নামে খুব খারাপ কথা বলে। তিনবেলা গালি দেয়; মরতে বলে।
সুলতানার দু’চোখ দিয়ে বর্ষার অঝোরাধারা গড়িয়ে যায়। কিছুই বলতে পারেন না; ছেলেটিকে বুকের ভেতর জাপটে ধরে কাঁদতে থাকেন। আহারে! সোনামাণিক আমার…
২.
বছর ১২ আগে মাস্টার্সের রেজাল্ট বেরুনোর আগে চাকরিজীবী ছেলে দেখে বাবা-মা তাকে বিয়ে দেন। নিজেদের পারিবারিক অবস্থা তেমন একটা সুবিধের না। তিন-ভাইবোনের সংসারে মা-বাবা তাকে হয়তো খুব তাড়াতাড়িই দূর করতে চাইছিলেন।
হা-কপাল! উনারা চাইলেই তো আর বিধি তা মানবে না। আজ বিধির বিধান- নাকি তার কর্মফল; সংশয় কাজ করে ভাবনায়।
সেই ফেলে আসা দিন, সোনালী পাখি হয়ে চোখের সামনে তার ডানা ঝাপটাতে থাকে।
রাজধানীতে নয়া স্বামীর সঙ্গে বেশ ভালই কাটছিল সময়। উনি সারাদিন অফিসে সময় কাটিয়ে সন্ধ্যে নাগাদ বাসায় ফেরেন, সুলতানা ঘরকন্না করেন। তার পছন্দের খাবার রান্না করেন। উনার পথ চেয়ে বসে পরিপাটি হয়ে থাকেন। বাসায় ঢুকলে ব্যাগটা হাত থেকে নিয়ে সযতনে রাখেন, লুঙিখানা, গামছাখানা এগিয়ে দেন; টেবিলে ঢেকে রাখা গ্লাসের পানিটা সামনে ধরেন। যাকে বলে পতিপরায়ণ!
আরিফ সাহেবের পারিবারিক অবস্থা বেশ ভাল। চাকরির টাকার প্রয়োজন পড়ে না। তবুও চাকরি করেন।
ভাড়া বাসাটা সুলতানা পরিপাটি করে গুছিয়ে রাখেন; ঝকঝকে তকতকে!
কিন্তু, সময় বড়ই বেরহম! একদিন বাসাতে ঢুকেই ব্যথায় কুঁকড়ে যান আরিফ। খাটে শুয়ে জবাই করা গরুর মতো ছটফট করতে থাকেন।
কী করবেন- ভেবে পান না সুলতানা। স্বামীর সারাশরীরে বিষবেদনা। গা-হাত-পা টিপে দিতে থাকেন; ব্যথায় আরও বেশি কাতর হয়ে পড়েন আরিফ।
পরে প্রতিবেশীদের সহায়তায় ক্লিনিকে নিয়ে যান; চিকিৎসাশেষে বাড়ি ফিরতে ফিরতে দু’তিনদিন লেগে যায়।
আরিফ সাহেবের শরীরের হাড়ে সমস্যা। প্রতিটি জয়েন্টে সমস্যা। ডাক্তাররা জানিয়েছেন, এ রোগ সারবার নয়। যতদিন বেঁচে আছেন, ওষুধ আর ওষুধ খেয়েই চলতে হবে।
এরই মধ্যে কনসিভ করেছেন সুলতানা। তাদের ঘরে আসছে সন্তান। বেশ উৎফুল্ল থাকেন তিনি। স্বামীর চাকরি, বাসায় একা থাকার যাতনা থেকে অন্তত মুক্তির স্বপ্ন দেখেন তিনি।
কোল আলো করে ছেলেটি পৃথিবীতে আসে।
চলতে থাকে তাদের সংসার। প্রথমদিকে টের না পেলেও বছর তিন পর ছেলেটির শরীরেও ওই রোগের উপসর্গ লক্ষ্য করেন এই দম্পতি। ডাক্তাররা চিকিৎসা দেন; কিছুটা কমে। আবারও দেখা দেয়।
পরে জানতে পারেন, বাবার জিন থেকে পেয়েছে রোগটি। সারাজীবন বয়ে বোতে হবে বাবারই মতো।
সুলতানার বুক ভেঙে যায়; হতাশা বাসা বাঁধে তার মনে।
৩.
ছেলেটিকে নিয়ে বড় আশা করেছিলেন সুলতানা। তাকে মনের মতো করে মানুষ করবেন। স্কুলে দিয়েছেন সম্প্রতি।
বাচ্চাটিকে স্কুলে দিয়ে অভিভাবক শেডে বসেন। টুকটাক কথা বলেন অন্য অভিভাবকদের সঙ্গে। সার্বক্ষণিক বিষাদের চিহ্নটা মুখায়বে লেগেই থাকে।
এক অভিভাবকের মাধ্যমে ফেসবুকে একটি অ্যাকাউন্ট ওপেন করেন সুলতানা।
৪.
এখন বেশ সময় কাটে সুলতানার। ফেসবুকের বন্ধুদের সঙ্গে অনেককিছু শেয়ার করতে পারেন। নিঃসঙ্গতার যে আবরণ তাদের সামনে ছিল প্রাচিরের মতো, তা আস্তে আস্তে সরে যায়।
নতুন বন্ধু হয়েছেন আবরার। তিনি একটি প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রভাষক।
ইঞ্জিনিয়ার হলেই যে লোহা-রড-কাঠ-সিমেন্টের মতো শক্ত হতে হবে; আবরারের লেখা পড়লে তা মনেই হয় না। বরং, তাকে বাংলাসাহিত্যের শিক্ষক হিসেবে বেশি মানায়।
তার লেখার দারুণ ভক্ত হয়ে যায় সুলতানা। প্রথমদিকে কিছু কমেন্ট আর রিঅ্যাকশান- এভাবেই চলছিল। এরপর দুজনের কথোপকথন, পছন্দ-অপছন্দ, ভাললাগা-মন্দলাগার আলাপন।
৫.
সুলতানার বেঁচে থাকার অবলম্বন হয়ে দাঁড়িয়েছেন আবরার। তার একটা ফোনকল কিংবা ইনবক্সে টেক্সট- এটুকু পাওয়ার জন্যে চাতকের ন্যায় প্রতীক্ষা করতেন সুলতানা। তার সান্নিধ্য পাওয়ার জন্যেও ব্যাকুল হয়ে যান। একদিন স্বামী অফিসে থাকার সুযোগে আবরারের সঙ্গ পান তিনি। সে এক রোমাঞ্চ! সুলতানা ভাবেন, এই মানুষটার স্পর্শের জন্যে তিনি এতকাল প্রতীক্ষা করেছিলেন!
এভাবে কখন যে তিনটে বছর পার হয়ে যায়!
তিনি আবরারের কাছে একটি সন্তান প্রত্যাশা করেছিলেন। কিন্তু সেটি আর সম্ভবপর হয়ে ওঠেনি। কেননা কোনও এক দুর্ঘটনায় আবরারের বাবা হওয়ার ক্ষমতা বিনষ্ট হয়ে যায়। তিনি কখনোই আবরারকে বিয়ে করতে চাননি; চাননি নতুন কোনও সংসার। শুধু একটাই আকাঙ্ক্ষা, তিনি যেন এক সুস্থ-সুন্দর বাচ্চা উপহার দেন। কিন্তু সেই চাওয়াটাও পূরণ হয় না।
৬.
একদিন আরিফ সাহেব টেবিলে নাস্তা করছেন; সুলতানা রান্নাঘরে। ওইসময় একটি এসএমএস আসে সুলতানার সেলফোনে। আবরার তাকে সুন্দর প্রেমময় একটি টেক্সট করেন। আরিফ সেটি হাতে তুলে নিয়ে দেখেন। এরপর সেলফোনে তাদের কথোপকথনের পুরো স্ট্যাটাস পড়তে থাকেন।
আজ আর অফিসে যাওয়া হয় না আরিফের।
রান্নাঘর থেকে ফেরার পর তাকে প্রশ্নবাণে জর্জরিত করতে থাকেন। সবকিছু জেনে নেন কৌশলে। তাদের শারীরিক সম্পর্কের বিষয়টিও লুকোন না সুলতানা।
৭.
তালাক দেননি আরিফ। তবে, ঢাকা সোজা থেকে বাপেরবাড়ি পাঠিয়ে দিয়েছেন স্ত্রীকে; শ্বশুরবাড়িতে তার সব হিস্ট্রি শেয়ার করেছেন।
আজ শ্বশুরবাড়ি কিংবা নিজের বাবা-মায়ের বাড়িতেও সর্বক্ষণ এক অসহনীয় যন্ত্রণায় দগ্ধ হচ্ছেন সুলতানা। তার সামনে ধূসর হয়ে আসছে পৃথিবী!
এক মেয়েটা মুঠো মুঠো জ্যোৎস্না কুড়িয়ে অপরের মুখমন্ডলে চাঁদ দেখত। মানুষের উপকার করার ক্ষেত্রে,…..
শেষ থেকে শুরু। আমি রজকিনী রামী,ধোপার বংশে জন্ম আমার।ঘাটে সখিদের সঙ্গে কাপড় কাচি। একাজটা আমি…..
মালঞ্চার পথে ভোরবেলা। সূর্য সবে উঠছিল। বৈশালী দূর থেকে দেখতে পেল,বুনিয়াদপুর বাসস্ট্যান্ডে বালুরঘাটের দিকে মুখ…..
আমার বাবা ছিলেন অত্যন্ত সাহসী একজন লড়াকু মনের মানুষ।শত অভাব অভিযোগেও তাকে কোনোদিন ভেঙ্গে…..