সে রাত শুধু আমার ছিল না

সোনিয়া কাদির
ছোটগল্প
Bengali
সে রাত শুধু আমার ছিল না

ছুটির দিনগুলিতে বৈচিত্র্য ও অ‍্যাডভেঞ্চার প্রিয় আমেরিকানরা ঘরে তালা দিয়ে বেরিয়ে পড়ে, পাহাড়ে বন জঙ্গলে ক‍্যাম্পিং করে। আমেরিকায় ক‍্যাম্পিং খুব জনপ্রিয়। আর ক‍্যাম্পিংয়ের জন‍্য নিদৃষ্ট জায়গা ও আছে। সামার এলেই লোকজন বাক্স পেটরা নিয়ে তাবুতে থাকতে বনে জঙ্গলে ছুটে।

তখন ২০০৯ সাল, আমেরিকায় নতুন এসেছি। কর্মহীন অখণ্ড অবসর। আত্মীয় পরিচিতদের বাড়ি বাড়ি উইকেন্ডে দাওয়াত খাচ্ছি, তাদের কেউ কেউ এখানে –   ওখানে দর্শনীয় জায়গা দেখাতে ও নিয়ে যাচ্ছেন। মুগ্ধতা নিয়ে আমেরিকার সৌন্দর্য দেখছি, বৈচিত্র্যরকমের মানুষও দেখছি। একদিন শিরীন আপা ক‍্যাম্পিংয়ে নিয়ে  যাওয়ার কথা বললেন। আনন্দে একপায়ে খাড়া। বুঝতে দেরী হলোনা প্রথম ক‍্যাম্পিংয়ের অভিজ্ঞতা অনুভবের জন‍্য আমার ভিতরে কতটা তৃষ্ণা, কতটা ব‍্যাকুলতা।

দেশে থাকতে ‘হুমায়ুন  আহমেদ’ এর লেখায় আমেরিকার  বনে ক‍্যাম্পিং এর রোমান্সকর অভিজ্ঞতার কথা পড়েছি গভীর রাতে ক‍্যাম্পের তাবুতে শীলার অহেতুক  কান্নার কথা পড়েছি, আর মনে মনে কত স্বপ্ন গড়েছি আর ভেঙেছি। পর্যাপ্ত নিরাপত্তার অভাবে বাংলাদেশে ইচ্ছা করলেই রাতবিরাতে আমরা ঘরের বাইরে থাকতে  পারি না।

শিরীন আপা ও তার স্বামীর  পায়ে চাকা লাগানো জীবন। কোথায় আরামে বসবাস করবেন তা না করে তল্পিবাহী ইস্তেমার লোকদের মত উনারা গাড়ি বোঝাই লটবহর নিয়ে সারাবছরছুটতে থাকেন। সেই বোঝায় তাবু, বিছানা, হাড়ি পাতিল, খাবার সামগ্রী ছুরি রশি ক‍্যামেরা (তখন সেলফোনে ক‍্যামেরা ছিল না) ইত্যাদি নানা জিনিস।

পেনসেলভেনিয়ার Nockamixon state Park ক্যাম্পিং এরিয়া। নিউইয়র্ক থেকে  অনেকদূর তাই সকাল ১১টায় দুটো গাড়ি করে মহাউৎসাহে আমরা রওয়ানা দিলাম। রাস্তায় রেস্ট এরিয়াতে কিছুটা সময় আমরা থামলাম, গাড়িতে গ‍্যাস নিতে হবে, কিছুটা বিশ্রাম ও কফি পানের পর আবার যাত্রা শুরু। যথাসময়ে স্পটে পৌছার পর  পার্কের গার্ড আমাদের হাতে হসপিট‍্যালের মত নম্বর দেওয়া বেল্ট পরিয়ে দিল ও প্রবেশ পাস, পার্কের ম‍্যাপ, ক‍্যাম্পের নিয়মকানুন সম্পর্কে তথ‍্যের কাগজ দিয়ে  শুভকামনা জানালো।

গাড়ি পার্কিংয়ের নিদৃষ্ট জায়গায় গাড়ি রেখে ভারী – পাতলা ব‍্যাগ – বাক্স বহন করে  আমরা ক‍্যাম্পিং এরিয়ায় চলে এলাম। জায়গাটার সৌন্দর্যে আমরা সকলেই উল্লসিত  হয়ে উঠলাম। এরিয়ার ভিতরেই পাথরের পাহাড়, স্বচ্ছ পানির লেক, লেকের পাড়ে  বসার ব‍্যবস্থা, বাইকিং, বোটিং, ফিশিং ও সুইমিং। টয়লেট একটু দূরে হলেও কাছে বড় পিকনিক টেবিল, গার্বেজ ক‍্যান। খাবার পানি ও বারবাকিউয়ের ব‍্যবস্থা, সবুজের সমারোহ ও পাখির কুজন। আমাদের উৎসাহ ও কলকাকলিতে জায়গা হেসে উঠলো। দুজন তাবু টানাতে লেগে গেল, কেউ কেউ পরিষ্কার ও গোছগাছে। আমি, চারু ও  পৌষী কাঠ কুড়াতে গেলাম। এক অভূতপূর্ব আনন্দে যার যার কাজ শেষে সকলে ক্ষুধার্ত। গিয়েই রান্নার ঝামেলায় না পড়ার জন‍্য যাওয়ার সময় রেষ্টুরেন্ট থেকে খাবার  নিয়ে যাওয়া হয়েছিল। পিকনিক টেবিলে কাভার বিছিয়ে তারউপর খাবার রাখা, সকলের দৃষ্টি ক্ষুধার্ত কাকের মত, সেদিকে। চিকেন বিরিয়ানি, কাবাব আর সালাদ। শিরীন আপা প্রত‍্যেকের হাতে খাবারের বক্স ও সোডার ক‍্যান দিয়ে দিলেন।

খাওয়ার পর সবাই লেকের তীরে হাটতে গেলাম। ভাসিয়ে নেওয়া প্রকৃতির স্বভাব। জ‍্যোৎস্না দিয়ে, বৃষ্টি দিয়ে, বরফ দিয়ে, রোদ দিয়ে, আবার প্রবল প্রেম, বেদনা  দিয়ে ও ভাসিয়ে দেয়। ওইদিন আমাদের প্রবল প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে ভাসিয়েছিল।

জহির ভাই হ‍্যামক টানিয়ে শুয়ে শুয়ে বই পড়া শুরু করে দিলেন। পাহাড়ে উঠতে কষ্ট  হবে বলে আমি পাহাড় দেখা বাদ দিলাম। আমাদের লেকের পানিতে নামার পারমিশান নেওয়া হয়নি বলে নৌকা চালানো ও সাঁতারে নামতে না পারার দুঃখে সকলে আফসোস করলো।

বিকেলের সূর্য তার লাল আভাসহ লেকের পানিতে ডুব দেওয়ার পর আমরা ক‍্যাম্প এলাকায় ফিরে এলাম। কাছেপিঠে কোন মানুষের দেখা না মিললেও শেষ বিকেলে  বেশ দূরে দুজন নরনারীকে তাবু টানাতে দেখা গেল। আমাদের বৈচিত্র সন্ধানী দলে তখন আরো দুজন যুক্ত হয়ে গেছেন।

পাশাপাশি তাবুগুলি ও বিছানাপত্র, কে কোন তাবুতে, দিনের বেলা ঠিকঠাক করে রাখা হয়েছিল।

রাত নামার সাথে সাথে জনমানবহীন বন এলাকায় চারিদিকে নিস্তব্ধতা, ঝিঁঝি পোকার ডাক আর কুহ কুহ করে হয়তো কোন রাতজাগা পাখির ডাক আসছিল। ক‍্যাম্পফায়ার  ছিল আমার আকর্ষণের কেন্দ্র, আমরা ক‍্যাম্পফায়ার ঘিরে গোল হয়ে বসলাম। আমি ভীতু তাছাড়া প্রথম রাতের বনবিহার বারবার পাশে বসা চারুকে স্পর্শ করছিলাম।  শিরীন আপা, জহির ভাই রান্না করতে ব‍্যস্ত।

উপরে আকাশে পেঁজা তুলোর আড়াল থেকে চাঁদ বারবারে উঁকি দিয়ে আমাদের দেখে আবার লুকিয়ে পড়ছিল। বাতাসে সড়সড় শব্দে এক আধাভৈতিক পরিবেশ।

তান্দুরী চিকেন ও বিফ বার্গার দিয়ে রাতের খাওয়া শেষ হলো।

“এমন নিশুতি রাতে বন‍্য পশুদের আক্রমণ কোথাও, কোন ক‍্যাম্পে হয়েছি কি না?”  ভয়ের কিচ্ছু নেই, তবু টয়লেটে যেতে টর্চলাইট সাথে নিও ও দুইজন একসাথে যেও”   বললেন শিরীন আপা।

আমাদের দলে চারজন উচ্চমানের কন্ঠশিল্পী। সংগীত গুরু ওস্তাদ আমির এলাহি, কনিকা ভাবী ও নাহিয়ান দম্পতি। শিরীন আপা ও ভালই গান।

সে রাতে কি জানি কেন – রাত যত বাড়তে লাগলো আকাশের মুখটা গোমড়া হতে লাগলো -চাঁদ অন্য কোথাও বেড়াতে চলে গিয়েছিল।

আমরা খাওয়া দাওয়া শেষ করে খোলা আকাশের তলায় চাদর বিছিয়ে গোল হয়ে বসলাম।

চারু ও পৌষী মাটির বাটিতে কটি মোমের প্রদীপ জ্বালিয়ে আলো নিভিয়ে দিল। গান শুরু হলো। ওস্তাদজি রজনীকান্ত দিয়েই যাত্রা আরম্ভ করলেন, ডিএল রায়, সতীনাথ, আমরা তন্ময় -মুগ্ধাবেশ এতটাই ছড়িয়ে পড়ল আমি হাততালি দিতেও ভুলে গেলাম। হঠাৎ গান থামিয়ে ওস্তাদ বললেন-

“= আপনারা যদি এসে থাকেন তাহলে কোন শব্দ করে সংকেত দিন =”

কাসার বাটিতে চামচ দিয়ে আঘাতে যেমন ঝংকার উঠে তেমনি দুবার ঝংকারের শব্দ শুনলাম। গান চলতে থাকলো।

ভয় শিহরণসহ আমি অনুভব করলাম প্রতিটি গানের শেষে আমাদের হাততালির সাথে

যুক্ত হচ্ছে অন্যরকম সুরেলা অনেক গুলো হাতের তালি। তবে কি সে রাতে আরন্যিক পরিবেশে আমাদের সাথে গানের শ্রোতা ছিল অন্যকোন অশরীরী সুর পিয়াসী প্রানী, নাকি মনের কপাটখুলে আমার অজান্তে ঢুকে পড়েছিল না দেখতে পাওয়া কয়েকটি অশরীরি আত্না!

প্রণয়ীর প্রথম পরশ ছুঁয়ে দ্বিধাগ্রস্ত
চুপিচুপি চোখের উপকূলে জোয়ারের মত
স্বপ্নালু হেঁটে আসা রাত যে রাত আচ্ছন্ন আকাশের নীচে
সে রাত শুধু আমার নয় , সে রাত অন‍্য কারোও

– (রুদ্র মুহাম্মদ শহীদুল্লাহ)

সোনিয়া কাদির। লেখক। জন্ম -১৯৫৬ সালের ১লা জানুয়ারি সিলেটের বিয়ানী বাজারে, বর্তমান নিবাস আমেরিকার নিউইয়র্কে। মিসেস কাদির নিউইয়র্কের সাহিত‍্য সংগঠন 'সাহিত্য একাডেমির' সাথে যুক্ত এবং তিনি সাহিত্য একাডেমি ব্রক্সস্ শাখার পরিচালক। প্রকাশিত বই: ১টি।

এই বিভাগের অন্যান্য লেখাসমূহ