স্কুল ছুটির পর একদিন (পর্ব ১)

ফরিদুর রেজা খান
নভেলেট
Bengali
স্কুল ছুটির পর একদিন (পর্ব ১)

–    এইগুলাইন রাস্তায় ফালায়েন না ভাইসাহেব। রাস্তা নোংরা হয়।

আলভি ঘুরে ছেলেটার দিকে তাকায়। ছেলেটার বয়সে আলভির সমান বা কিছুটা ছোট। তবে ওর থেকে বড় হবে না। বেশ নাদুসনুদুস চেহারা। গায়ের রঙ একটু কালোমতন। ওর ভুঁড়িটা দেখলে যে কারোর সর্বপ্রথম গোপাল ভাঁড়ের কথা মনে পড়বে। পরনে ময়লা জামা, ঢোলা প্যান্ট। প্যান্টটা হয়তো ওর নিজের না, একটু পর পর ঢিলে হয়ে কোমর থেকে নেমে যাচ্ছে। রেগে ওঠে ছেলেটার মুখে একটা ঘুষি বসাতে যাচ্ছিলো আলভি। কিন্তু শেষ পর্যন্ত পারে না। ওর হাতটা ধরে ফেলে মিশু।

–    ভাইয়া, ওকে মারবি না।

–    এই যা তো, দরদ দেখাতে আসবিনা।

মিশুর হাত থেকে এক ঝটকায় নিজেকে ছাড়িয়ে নেয় আলভি। ছেলেটার মুখের সামনে হাত নাচিয়ে ওকে শাসাতে থাকে। কিন্তু ছেলেটাকে এত বকেও ওর ওপর জমে থাকা রাগ একটুও কমে না আলভির। ছেলেটা ভয় তো পাচ্ছেই না বরং মুখে একটা ৩৬০ ডিগ্রি কোণের ফিচলে হাসি ঝুলিয়ে রেখেছে। আলভির এখন মনে হচ্ছে মিশুর কথা শুনে ছেলেটাকে না মারাটা ওর উচিত হয়নি। তার উচিত ছিলো ছেলেটার মাথায় টানা তিনটে ঠোয়া বসানো।

–    এই, হাসছিস কেনো রে?

–    আফনে ভাই খুবই সুন্দর কইরা কথা কন। একদম আমাগোর ওস্তাদ রবিন ভাইয়ের মতন। তয় উনি দেখতে আফনের মতন এতডা সোন্দর না। আফনে দেখতে অনেক সৌন্দর্য্য।

একজন মানুষ দেখতে ‘অনেক সৌন্দর্য্য’ কিভাবে হয় সেটা বুঝতে না পারলেও নিজের প্রশংসা শুনে কিছুটা শান্ত হয় আলভি। মুখে একটা হাসি ফুটিয়ে চুলগুলো নাড়াচাড়া করে ঠিক করতে চেষ্টা করে। তারপর দুই হাতে নেড়েচেড়ে স্কুলড্রেসের কলারটাকে সোজা করে নেয়। এক ফাঁকে মিশুর দিকে তাকিয়ে মেজাজ খারাপ হয়ে যায় আলভির। ফাজিলটা ওর দিকে তাকিয়ে তখনও মুচকি মুচকি হাসছে।

–    ফাজিল মেয়ে। অন্যের ভালো যেনো গায়ে সহ্য হয় না।

আলভি মিশুকে দাঁত কিড়মিড় করে একদফা বকে নেয় মনে মনে। চোখ কটমটে করে তাকিয়ে থাকে মিশুর দিকে। কিন্তু মিশুর দিক থেকে চোখ সরিয়ে নেয়ার আগেই ওর চোখে পড়ে যায় আলভি।

–    ভাইয়া, তুই কি কিছু বলছিস?

–    ইয়ে মানে, না তো! আমি তো কিছু বলিনি।

–    আমি মাত্র দেখলাম তোর মুখ নড়ছে। কি বলে ফেলছিস বল। মনে মনে গালি দিছিস আমাকে, তাই না? তুই এখনই বল আমাকে কি বিড়বিড় করছিলি তুই। নাহলে কিন্তু বাসায় গিয়ে বাবার কাছে নালিশ জানাবো। আর গতকালকে ডাইনিং টেবিলে রাখা সন্দেশগুলো কে খেয়েছে সেটাও আমি দেখেছি। মায়ের কাছে এই খবরটাও পৌঁছে দেবো।

থতমত খেয়ে যায় আলভি। গতকাল ওদের বড় মামা ওদের বাড়িতে বেড়াতে এসেছিলেন। মিশু আর আলভির মা বেচারি নিজের ভাইয়ের জন্য কিছু সন্দেশ বানিয়েছিলেন ভাইকে খাওয়াবেন বলে। কিন্তু ডজনখানেক সন্দেশের একটাও খাওয়াতে পারেননি ভাইকে। টেবিলের ওপর থেকে এতগুলো সন্দেশ কিভাবে একদম বাতাসে মিলিয়ে গেলো সেটা নিয়ে ঘন্টাখানেক বিলাপও করেছেন। এই কাজের মূল হোতা যে আলভি সেটা যদি তাদের মা জানতে পারেন তবে আর আলভির রক্ষা থাকবে না। মিশুর প্রশ্নের জুতসই একটা উত্তর মনে মনে গোছাতে শুরু করতেই কালো রোগামতন ছেলেটা বলতে শুরু করে।

–    ভাই বোনেরা থাকেন তাইলে। আমি যাইগিয়া। আমার বহুত কাম আছে।

কথাবার্তার শুরু থেকেই ছেলেটাকে বেশ রহস্যময় মনে হচ্ছিলো মিশুর। এবার ওর কথা শুনে কেমন যেনো একটু হাসি পায় তার। যদিও সাথে সাথেই মুখের হাসিটা গোপন করে ফেলে সে।

–    এইটুকুন ছেলে তুমি! তোমার আবার এত কাজ কিসের?

মিশুর কথা শুনে ছেলেটা একটু অবাক হয়। হয়তো একটু মজাও পায়। কৌতূকবোধে তার চেহারাটা কেমন যেনো বাঁকা হয়ে যায় মাঝখান থেকে।

–    আরে কি কন আপা বোকার মতো! কামের কি আবার কোনো বয়স বিচার আছে নাকি?

ছেলেটার এই প্রশ্নের কি উত্তর করবে বুঝে পায় না মিশু। বরং কিছুটা অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকে আলভির দিকে।

–    শিয়াল ধরন লাগবো, বুঝছেন? কিন্তুক এই শহরের মাঝে শিয়াল ধরা যে কতটুকু বড় বিটখিরি কাম সেইটা যদি রবিন ভাই বুঝতো! শিয়াল কি আমার দুলাভাই লাগে যে ‘ও শিয়াল দুলাভাই’ কয়া ডাক দিলেই সুড়সুড় কইরা আয়া পরবো?

মিশু আলভি দুজনেই হঠাৎ করে একটা ঝটকা খায়। এইটুকু ছেলে শেয়াল ধরতে যাবে একা একা? আলভিও যেখানে মাঝারি সাইজের একটা বিড়ালের ভয়ে একবার প্যাণ্ট নষ্ট করে ফেলেছিলো সেখানে এইটুকুন ছেলে কিনা জঙ্গল থেকে আস্ত শেয়াল ধরে নিয়ে আসে। তারচেয়েও বড় কথা হচ্ছে, ও রবিন নামের সে লোকের জন্য শেয়াল ধরতে যাবে কেনো? এই জঙ্গুলে প্রাণির মৃতদেহ দিয়ে সে কি করে? কয়েকদিন আগে একবার ওরা পত্রিকায় পড়েছিলো অস্ট্রেলিয়ার কোন একটা শহরে একবার রাস্তায় বন্য পশুরা সবাই একসাথে জড়ো হয়ে নাকি রাস্তায় এসে একদম ব্যারিকেড দিয়ে ফেলেছিলো। কিন্তু আমাদের এদিকটার শেয়ালগুলো তো মানুষ দেখলেই উল্টো দিকে দৌড়ে পালায়। তাহলে এখানে শেয়ালদের মেরে ফেলার কারণ যে মানুষদের আত্মরক্ষা এমনটাও তো হিসেবে মিলছে না।

–    শেয়াল ধরবে কেনো? শেয়াল দিয়ে কাজ কি?

চোখের চশমাটার ভেতর দিয়ে একটা জিজ্ঞাসু দৃষ্টি নিয়ে সেলিম নামের সেই ছেলেটিকে প্রশ্নগুলো করে মিশু। আলভি তখনও মুখ হাঁ করে দাঁড়িয়ে আছে। ওর মুখ দিয়ে কোনো কথাই যেনো বের হচ্ছে না। মাথা চুলকাতে চুলকাতে মিশুর দিকে সন্দেহের দৃষ্টিতে তাকায় সেলিম।

–    আফনেরা কেডা? এইসব গফ আপনাগোর সাথে করন উচিত হয় নাই। এইগুলাইন হইলো গিয়া গোপনীয় কথা। আপনাগোরে কওন যাইতো না। গোপনীয় কথার মা বাপ থাকন লাগে। এইভাবে ছড়ায় পড়লে চলে না।

বলেই মুখ ফিরিয়ে হাঁটতে শুরু করে সেলিম। মিশুও হাল ছাড়ার পাত্রী নয়। দৌড়ে গিয়ে পেছন থেকে সেলিমের হাতটা ধরে ফেলে সে। চোখ সরু করে সেলিমের দিকে তাকায়।

–    শোনো, ভালোভাবে জিজ্ঞাসা করছি। বলে ফেলো। নাহলে…

–    কি করবেন নাইলে?

উত্তরে বলার কিছুই পায় না মিশু। ও কিই বা করবে বা করতে পারে যদি সেলিম নাই বলে? জোর করে তো আর কারোর কাছ থেকে কিছু আদায় করা সম্ভব নয়।

–    মাইর দিবেন? আমি ডরাই না। অনেক মাইরা কইরা অভ্যাস আছে আমার। আমি কারাতি মাইর জানি।

বলেই সেলিম কাঁইকুঁই করে চিৎকার করতে শুরু করে। হাত পা নাড়তে শুরু করে বিশ্রীভাবে। ঘটনার আকস্মিকতায় কি হচ্ছে ঠিক বুঝে উঠতে পারে না মিশু। লাফিয়ে দুই পা সরে এসেও শেষ রক্ষা হয় না তার। সেলিমের কিলবিলে হাতের মাঝারি সাইজের একটা ঘুষিতে ওর নাকটা টনটন করে ওঠে। ‘বাবাগো’ বলে একটা চিৎকার দিয়ে নাক চেপে ধরে মাটিতে বসে পড়ে ও।

দুই

মিশুর ফুলে ওঠা নাকটার দিকে তাকিয়ে এখনও খিকখিক করে হেসেই যাচ্ছে আলভি। আলভির মুখের সেই কুৎসিত হাসি দেখে মিশুর গাটা যেনো জ্বলে যাচ্ছে। মিশু আর আলভি বসে আছে জয়নগর রোডের আশুতোষ কাকার সিঙারা সমুচার দোকানটাতে। সেলিমের সাথে অনেক দর কষাকষির পর তারা শেষ পর্যন্ত ওর সাথে একটা দফারফা করতে পেরেছে। সেলিমের শর্ত হলো তাকে প্রথম ভরপেট খাওয়াতে হবে। কেবল তখনই সে চিন্তা করে দেখবে সবকিছু খুলে বলা যায় কিনা তাদের সাথে। আর মিশুর সাথে ঘটে যাওয়া সেই ঘটনাটির জন্য সে নিজেও প্রস্তুত ছিলো না বলে দুঃখপ্রকাশ করার পর পরিস্থিতি মোটামুটি স্বাভাবিক হয়েছে। মিশু আর আলভির পকেটে খুব বেশি টাকা না থাকলেও পুরো ঘটনাটা জানার জন্য তাদের মনে সীমাহীন একটা আগ্রহ খেলা করছে। তাইতো সেলিমের ভাষায় তার জন্য এই ‘পেটচুক্তি’র আয়োজন করা হয়েছে।

–    ভাইয়া, হাসবি না একদম। এখানে হাসার কি আছে সেটাই বুঝলাম না।

–    তোকে দেখতে লাগছে পুরো ডলফিন মাছের মতো। কাল বাবা বাজার থেকে যে টমেটোগুলো এনেছিলো, ওগুলোর একেকটার থেকেও বড় দেখাচ্ছে তোর নাকটা।

আলভির কথার কি উত্তর দিবে বুঝে পায় না মিশু। একবার চোখ ঘুরিয়ে তাকায় সেলিমের দিকে। তাকে দেখে মনে হচ্ছে বর্তমানে পৃথিবীতে সবচেয়ে সুখি মানুষদের মধ্যে সে একজন। সুখি মানুষদের সেই তালিকায় তাকে দশের বাইরে ঠেলে দেয়া সম্ভব না কোনোভাবেই। কেউ যে খাওয়াদাওয়ার মতো ব্যাপারটাও এতো আগ্রহ নিয়ে করতে পারে সেটা সে সেলিমের সাথে পরিচিত না হলে হয়তোবা জানতে পারতো না। এই অল্প সময়ের ভেতর সেলিম চারটা সিঙ্গারা আর দুটো সমুচা পেটে চালান করে দিয়েছে। চার নাম্বার সিঙ্গারা আর তিন নাম্বার সমুচাটার অর্ধেক অংশও এই মূহুর্তে ওর মুখের ভেতর চলে গেছে। মিশুর এতদিন পর্যন্ত ধারণা ছিলো মানবসভ্যতার ইতিহাসে তার ভাই আলভিই সবচেয়ে বড় খাদক। কিন্তু এই মুহূর্তে তার মনে হচ্ছে তার ধারণাটা নিতান্তই ভুল। এই পৃথিবীর এখনও অনেক কিছুই দেখার বা জানার বাকি রয়ে গেছে তার।

–    শোনো সেলিম, তুমি এতক্ষণ যা বললে সেগুলো শুনে আমরা খুবই বিস্মিত। এই ধরণের একটা বিষয় চলতে দেওয়াটা কোনোভাবেই উচিত নয়। তাই আমরা চিন্তা করেছি আমরা আইনি পদক্ষেপ নেবো।

হাত দুটো পেছনে বেঁধে সেলিমের চারপাশে হাঁটতে হাঁটতে খুব গম্ভীর ভঙ্গিতে কথাগুলো বলে মিশু।

–    আইনি পদক্ষেপ? এইটা আবার কি জিনিস? এইটা দিয়ে কি করে আপা?

–    মানে আমরা পুলিশের কাছে যাবো। সাথে তোমাকেও নিয়ে যাবো। ভালোমতো যেতে চাইলে নিজের ইচ্ছাতেই যাবে। আর নাহলে ধরে বেঁধে নিয়ে যাবো। একটু সামনেই মুক্তা আপুদের বাসা। খবর দিলেই দৌড়ে এসে এমন মার মারবে যে মারের চোটে এমনিতেই রাজি হয়ে সুড়সুড় করে আমাদের আগেই থানায় পৌঁছে যাবে। ও কারাতে ব্ল্যাকবেল্ট। তোমার মতো না বানরের লাফঝাঁপ নয়, আসলেই ও অনেক ভালো কারাতে জানে।

ফুলে ওঠা নাকটার ওপর হাত বোলাতে বোলাতে কথাগুলো একদমে বলে শেষ করে মিশু। সেলিমের মুখে ভয়ের ছাপ স্পষ্ট হয়। ওর গোলগাল মুখটা যেনো হঠাত করেই কাঁদকাঁদ হয়ে যায়। চোখমুখ ছোট করে কাচুমাচু ভঙ্গিতে ও মিশু আর আলভিকে জানায় যে মুক্তা আপু নামের সেই মানুষটিকে ডাকার বা ওকে থানায় নিয়ে যাওয়ার কোনো দরকারই নেই। মিশু ওকে যাই করতে বলবে, সে সেটাই করবে।

অনেক কষ্ট করে মিশু আর আলভি সেলিমের কাছ থেকে শেয়াল ধরার কারণ বা এর পেছনের পুরো ব্যাপারটা জানতে পেরেছে। সেলিম খুব সোজা করে বলে দিলে তাদের এতটা কষ্ট করতে হতো না। কিন্তু সেলিম সেটা করেনি। অনেক আড়ালে আবডালে কথা ঘুরিয়ে পেঁচিয়ে নেয়ার চেষ্টা করেছে। তখন মিশু আর আলভিকে আবার একদম প্রথম থেকে শুরু করতে হয়েছে। শহরের মোক্তারপাড়া এলাকার একটা গলির মাথায় ‘বিসমিল্লাহ বিরিয়ানি হাউস’ বলে একটা বিরিয়ানির দোকান আছে। ছোটখাটো দোকান, একসাথে বিচ পঁচিশ জনও বসে খেতে পারে না। দোকানের একমাত্র আইটেম কাচ্চি বিরিয়ানি। বেশ ভালোই ব্যবসা হয়। প্রতিদিনই ক্যাশবাক্সের টাকা গুণে হোটেলের মালিক নাজমুল সরকার হাসিমুখে বাড়িতে ফেরত যান। শহরে এরকম আরও বিরিয়ানির দোকান আছে যেখানে কাচ্চি বিরিয়ানি বিক্রি হয়ে থাকে। সেলিমের কাজ প্রতি সপ্তাহে বেশ কিছু করে শেয়াল ধরা। শেয়াল মারার পর সে সেই শেয়াল রবিন নামের একজনের কাছে পৌঁছে দেয়। সেলিমদের এই দলে সেলিমের মতো আরও জনা দশেক ছেলেপুলে আছে। বলাই বাহুল্য, সবাই পথশিশু এবং ভাসমান। সবাই একসাথে গাদাগাদি করে রবিনের আরেক চ্যালা পার্থর বাড়ির একটা ঘরে থাকে। ওদের কাজ একেকসময় একেকরকম। আপাতত ওরা কয়েক মাস ধরে রবিনের জন্য শেয়াল ধরার কাজ করছে। সেলিমের কাছ থেকেই ওরা জানতে পারে যে এসব বিরিয়ানির দোকানের মালিকেরা শেয়ালের মাংস কেটেকুটে বিরিয়ানিতে দিয়ে সেগুলোকে খাসির মাংসের বিরিয়ানি বলে চালিয়ে দেয়। সবকিছু শুনে মিশু কাঁধ থেকে ব্যাগটা নামিয়ে রাখে। চিন্তিত মুখে বসে থাকে, ওর মুখ দিয়ে কোনো কথাই আসছে না। এর মাঝে সেলিম আরও দুটি সমুচা খেয়েছে। তার ভাষায় এই দোকানের সবকিছুই ‘অইত্যন্ত স্বোয়াদিস্ট’। আলভি বারকয়েক বমি করে এখন টেবিলে মাথা পেতে আধশোয়া হয়ে বসে আছে। গত সপ্তাহেও ও আর ওর বন্ধুরা নাজমুল সরকারের দোকানের বিরিয়ানি খেয়ে এসেছে। কোনো কারণ ছাড়াই আলভি এবং তার বন্ধুদের ধারণা ছিলো, এই শহরে নাজমুল সাহেবের দোকানের কাচ্চি বিরিয়ানিটা আসলেই বাকিদের থেকে অন্যরকম। এখন আলভির মনে হচ্ছে সেখানে এই বিষয়টা অনুঘটক হলেও হতে পারে।

–    তার মানে এটা অনেক বড় একটা চক্রান্ত।

বড়দের মতো মাথা নাড়তে নাড়তে কথাগুলো বলে মিশু। আলভি শুধু একবার মুখ তুলে ওর দিকে তাকায়। তারপর আবার মাথা নামিয়ে টেবিলে মুখ রেখে বিলাপের মতো একটা চাপা শব্দ করতে থাকে। হঠাৎ করেই উঠে দাঁড়ায় মিশু। ব্যাগটা কাঁধে ঝোলাতে ঝোলাতে আলভির মাথায় একটা চাটি বসিয়ে দেয়। বিরক্ত হয়ে টেবিল থেকে মাথাটা তোলে আলভি।

–    কি হলো? মারছিস কেনো? এমনিতেই আমি অসুস্থ, গা গোলাচ্ছে। তার ওপর আবার তুই মাথায় চাটি মারছিস।

কাতর কন্ঠে বলে আলভি।

–    চাটি মারবো না তো কি করবো? উলটাপালটা জায়গায় বসে যাচ্ছেতাই গিলবি, তারপর ভুঁড়ি দোলাতে দোলাতে বাড়ি ফিরবি। রাস্তার পাশের এসব দোকানে কি তোকে জামাই আদর করবে? এটা কি তোর মায়ের রান্নাঘর পেয়েছিস নাকি? ওদের যেভাবে লাভ হয়, সেভাবেই রান্না করবে। এটাই স্বাভাবিক। যেহেতু তুই খাচ্ছিস কাজেই তোর নিজেরই সচেতন থাকতে হবে যে তুই কি খাচ্ছিস আর কোথায় বসে খাচ্ছিস। আর শেয়ালের মাংস খাওয়া খারাপ এমনটা তো কোনোদিন শুনিওনি। শেয়ালের মাংস খেলে শ্বাসকষ্ট কমে শুনেছিলাম। এটা নাকি শ্বাসকষ্টের একটা অব্যর্থ চিকিৎসা। ভালোই তো হলো, তোর অসুখটার একটা চিকিৎসা পাওয়া গেলো। আজ বাড়িতে গিয়েই বাবাকে বলবো, এখন থেকে তোর জন্য প্রতি সপ্তাহে একটা শেয়াল কিনে আনবে বাজার থেকে। প্রতি শুক্রবার আমরা মাটন বা বিফ বিরিয়ানি খাবো, আর তুই খাবি ফক্স বিরিয়ানি।

মুখ বাঁকা করে ভেংচে ভেংচে একনাগাড়ে কথাগুলো বলে মিশু। একবার একটু দম নেয়। তারপর বলে-নে, এবার ওঠ। হাতে অনেক কাজ আছে।

উঠে দাঁড়াতে দাঁড়াতে ব্যাগ কাঁধে নেয় আলভি।

–    আজ আমার খুব খারাপ লাগছেরে। বাড়ি ফিরে আমার হোমওয়ার্কগুলো করে দিস? প্লিজ, বোন।

–    না। পারবো না।

কাঠখোট্টা একটা স্বরে উত্তর করে মিশু। আলভি আহত হওয়ার মতো একটু শব্দ করে।

–    তুই যদি আমাকে সত্যিই নিজের ভাই ভাবতিস, তাহলে এরকম করতে পারতি না। আমি তো তোর কেউই না। আমি মরে গেলেও তোর কিছু যায় আসে না।

–    বকবক করিস না। আমরা তো এখনই বাড়িতে যাচ্ছি না। বাড়ি গেলে তোর হোমওয়ার্ক করে দেয়ার কথা একবার হলেও ভেবে দেখতাম।

–    বাড়ি যাচ্ছি না মানে? তবে কোথায় যাচ্ছি আমরা?

–    সেলিমের সাথে রবিন সাহেবের বাসায় যাচ্ছি। পুরো বিষয়টাই একটু তদন্ত করে দেখতে হবে। রবিন সাহেবকে পেলেও ভালো হয়। তাকে আমরা বুঝিয়ে বলবো যে এমন কাজ মোটেও ভালো না। সে যদি শোনে, তাহলে তো ভালোই। নাহলে পুলিশকে খবর দেবো।

আরও একটা সমুচা পেটে চালান করার জন্য হাতে নিয়েছিলো সেলিম। মিশুর কথা শুনে সেটা হাত থেকে পড়ে যায় সেলিমের। মিশু দেখে সেলিমের চোখগুলো যেনো হল্যান্ডের আলুর মত গোল গোল হয়ে গেছে।

অনেক বোঝানোর পর সেলিমের সাথে একটা সমঝোতায় আসতে পারলো মিশু। আলভিও যে কিভাবে মিশুর সাথে যেতে রাজি হয়ে গেলো মিশু সেটা ধরতেই পারলো না। ও প্রথমে ভেবেছিলো আলভিও সেলিমের সাথেই না না করবে। যাই হোক, সেলিম শেষ পর্যন্ত ওদেরকে রবিনের বাড়িটা চিনিয়ে দেয়ার জন্য রাজি হয়েছে। কিন্তু সাথে একটা শর্তও জুড়ে দিয়েছে। রবিনকে কোনোভাবেই এটা বুঝতে দেয়া যাবে না যে সেলিম তাদেরকে এসব বলেছে বা রবিনের বাড়িটা চিনিয়ে দিয়েছে। আশুতোষ কাকার ভাজিভুজির দোকানের হিসাব চুকিয়ে দিয়ে ওরা বেড়িয়ে পড়ে। একটা ইজিবাইকে করে ওরা যখন রবিনের বাড়ির দিকে রওনা হয়েছে তখন প্রায় সন্ধ্যা নেমে এসেছে। একবার হাতঘড়িতে সময়টা দেখে নেয় মিশু। মনে মনে একটা হিসাব কষে নেয় সে। কিছুক্ষণ চলার পর তেরী বাজার এসে ইজিবাইকটার গতি কমে যায়। একটু সামনে রাস্তার মাঝখানে একটা পুলিশভ্যান আড়াআড়ি করে রাখা আছে। প্রতিটি ইজিবাইক আর রিকশায় পুলিশ তল্লাশি নিচ্ছে, হয়তো কাউকে খুঁজছে। ওদের ইজিবাইকটার কাছাকাছি আসার আগেই সেলিমের পাশে বসা লোকটা তার কাঁধের ব্যাগটা নিয়ে নেমে পড়ে। ইজিবাইকওয়ালাকে পাঁচ টাকা ভাড়ার জায়গায় দশ টাকা দিয়ে কিছু না বলেই উলটো দিকে হাঁটতে শুরু করে। বাকি পাঁচ টাকা দেয়ার জন্য ইজিবাইকওয়ালা কয়েকবার পেছন থেকে ডাকে লোকটাকে। কিন্তু জবাব দেয়া তো দূরে থাক, ঘাড় ঘুরিয়ে একবার তাকায়ও না সে পেছনে। লম্বা লম্বা পা ফেলে মোড়টা পার হতে হতে এক সময় অদৃশ্য হয়ে যায়। বিষয়টা সন্দেহের ঠেকে মিশুর কাছে। একবার ঘাড় ঘুরিয়ে তাকায় আলভির দিকে। আলভিও ওর দিকেই তাকিয়ে ছিলো। সেলিম মাথা নিচু করে গুণগুনিয়ে গান গাইছিলো। ওদের চোখের ভাষায় ছুড়ে দেয়া প্রশ্ন বুঝতে পারে না সেলিম।

প্রায় ঘন্টাখানেক পর বাড়িটার সামনে এসে পৌঁছায় ওরা। ওদের বাড়িটা ঠিক করে চিনিয়ে দিয়ে সেলিম চলে যায়। উত্তরপাড়ার জগন্নাথ মন্দিরের পেছন দিয়ে যে ছোট রাস্তাটা গিয়েছে সেই রাস্তাটা ধরে পার্থ নামের কারোর একজনের বাড়িতে থাকে সেলিম। পার্থও রবিনের হয়েই কাজ করে। এদিকটায় তেমন একটা ঘর বাড়ি নেই। কেমন যেনো অদ্ভুত একটা শান্ত পরিবেশ চারদিকে। একটা গুমোট নিঃস্তব্ধতা চারিদিকে ঘিরে রেখেছে। পা টিপে টিপে ওরা বাড়িটার দিকে এগোয়। টিনের দরজাটায় কয়েকটা টোকা দিয়ে একটা ধাক্কা দিতেই একটা গম্ভীর কন্ঠ শোনা যায়।

–    কে?

নিজেদের সামলে নিয়ে মিশু জবাব দেয়, আমরা, খুলুন।

–    আমরা কে?

–    নাম বললে আপনি চিনবেন না আমাদের। তবে আপনার সাথে একটু কথা ছিলো।

খট করে প্রথমে ছিটকিনি খোলার শব্দ হয়। তারপর দরজার ফাঁক দিয়ে একটা চোখ উঁকি দেয়। কাঁধে গামছা ঝোলানো একজন মধ্যবয়স্ক লোক ওদের দুজনকে পা থেকে মাথা পর্যন্ত কয়েকবার দেখে দরজা খুলে দিয়ে ওদের চোখের না তাকিয়ে ভেতরে আসতে ইশারা করে। ওরা ভেতর ঢুকতেই আবার দরজা লাগিয়ে দেয়। একটু অবাক হয় মিশু আর আলভি। লোকটা এবার ওদের দিকে ঘুরে তাকায়। ঘাড় চুলকাতে চুলকাতে বলে, কি বলবেন বইলা তাড়াতাড়ি বিদায় হন। কারে খুঁজতেছেন? কাঁপা কাঁপা কণ্ঠে আলভি বলে,

–    আমরা একটু রবিন সাহেবের সাথে কথা বলতে চাই।

–    মিয়াসাব বাড়িতে নাই। আফনেরা বিদায় হন। সইন্ধ্যা সইন্ধ্যা আপদ আইসা হাজির হইছে।

বিরক্ত হয়ে কথাগুলো বলেন লোকটা। উপায় না দেখে অনেকটা হাল ছেড়ে দিয়েই বাড়ি থেকে বের হয়ে আসার জন্য দরজার দিকে এগোয় আলভি আর মিশু। এমন সময়ে ভেতরবাড়ি থেকে কার যেনো একটা গলা শোনা যায়। হন্তদন্ত ভঙ্গিতে বাড়ির দিকে ছোটেন তিনি। খানিক পরেই আবার একইভাবে ছুটে বের হয়ে আসেন।

–    মিয়াসাবে আফনেগোরে ডাকে। যাইতেন।

–    কোন মিয়াসাব?

–    রবিন মামা, যার খোঁজ করতাছিলেন আফনেরা।

–    কিন্তু আপনি তো একটু আগেই বললেন উনি বাড়িতে নেই।

–    হ, কইছিলাম। কিন্তুক ভুল কইছিলাম। যান। কথা কইয়া দেখেন কেন আফনেগোরে তলব করছে।

বিভ্রান্ত ভঙ্গিতে পা ফেলতে ফেলতে বাড়িতে ঢোকে ওরা। বাড়ির বৈঠকখানায় নোংরা একটা সোফা, তেল চিটচিটে কুশন। কুশনগুলো কেমন যেনো চ্যাপ্টে গেছে। সোফাটায় বসতে রুচি হয় না ওদের। তাই না দাঁড়িয়ে থেকেই রবিনের জন্য অপেক্ষা করতে থাকে ওরা। খুকখুক করে কাশতে কাশতে ভেতরের একটা ঘর থেকে বের হয়ে আসেন একজন তরুণ। পড়নে লাল রঙের একটা স্যাণ্ডো গেঞ্জি আর বিবর্ণ সাদা একটা লুঙ্গি। হাতে সোনালি ধাতব ব্রেসলেট। লম্বা চুল। অমসৃণ মুখে খোঁচা খোঁচা দাঁড়ি। দাঁত বের করে হাসতে হাসতে তিনি ওদের দিকে এগিয়ে আসছেন। হলুদ দাঁত আর কালো মাড়ির কারণে তাকে দেখাচ্ছে দক্ষিণী ভৌতিক সিনেমার তান্ত্রিকদের মতো। মিশু একবার তাকায় লোকটার দিকে। মুখে পান গুঁজে দিয়ে ভদ্রলোক তখন গুণগুণ করে গান গাইছেন, ‘আমি যারে বাসি ভালো, কাজলের চেয়েও কালো; হয়না যে তার তুলনা…’।

–    কি বলবা তোমরা? এইযে খুকি, ওইরকম রাগ নিয়ে তাকায়া আছো কেনো আমার দিকে? কি বলবা বলে ফেলো।

কোটর থেকে যেনো চোখজোড়া বেরিয়ে আসতে চায় মিশুর। শহরের একটা স্কুলে অষ্টম শ্রেণিতে পড়ছে ও। দেখতে ওকে কোনোভাবেই বাচ্চা লাগে না। বরংচ ওকে বয়সের তুলনায় বড়ই লাগে। আর এই লোকটা কিনা তাকে খুকি বলে ডাকছে! মেজাজ তুঙ্গে চড়ে গেলেও মিশু বিষয়টাকে পাত্তা দেয় না। কেশে গলাটা একটু পরিষ্কার করতে থাকে।

–    দেখেন, এই যে আপনারা বাচ্চাদের দিয়ে জঙ্গল থেকে শেয়াল ধরিয়ে সেগুলো কেটেকুটে শহরের বিরিয়ানির দোকানগুলোতে পাঠিয়ে দিচ্ছেন সেটা কোনোভাবেই কোনো স্বাভাবিক কিছু নয়। এতে সাধারণ মানুষের ক্ষতি হচ্ছে, তাদের ঠকানো হচ্ছে যেটা চলতে দেয়াটা একদমই উচিত নয়।

এই পর্যায়ে আলভি মুখ খোলে।

–    হুম, একদমই উচিত নয়।

একটু দম নিয়ে আবার শুরু করে মিশু।

–    আপনাদের আমরা সাবধান করে দিচ্ছি। আমরা বিষয়টা জেনে গেছি। সুতরাং, নো ফস্টিনস্টি। আমাদের ব্ল্যাক ডেভিল টিমের কাছে একবার যে বিষয়য়া ধরা পড়ে গেছে সে বিষয়ে আর কেউ কোনোদিন ছাড় পায়নি। আপনি যদি কাজটা বন্ধ করে দেন তবে আপনারও ভালো, আমাদেরও। নাহলে পুলিশকে বিষয়টা জানাবো। এটা নিয়ে আমরা ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরের কাছেও যাবো।

লম্বা চুলের বেণি পাকিয়ে পাকিয়ে কথাগুলো বলে রবিনের দিকে তাকায় মিশু। রবিনের চোয়ালটা এমনভাবে ঝুলে পড়েছে যে মুখের ভেতির দিয়ে একেবারে পাকস্থলী পর্যন্ত দেখতে পারার কথা।

–    বেলেক ডেভিল? এইটা আবার কি বস্তু? নামই তো হুনি নাই জীবনে।

মধ্যবয়স্ক লোকটার দিকে বিরক্ত চোখে তাকায় মিশু। শব্দগুলোর ভুল উচ্চারণ সহ্য হয় না তার। ব্ল্যাক ডেভিল সিক্রেট সার্ভিস মিশু, আলভী আর ওর তিন ফুফাতো ভাই বোনের একটা গোয়েন্দা দল। বলাই বাহুল্য, তারা সবাই মোটামুটি সমবয়সী এবং একই শ্রেণিতে পড়ে। বছরের বেশিরভাগ সময়ই এটা নিষ্ক্রিয় থাকে। তবে হাতে ভালো কোনো কেস পেলে ওরা অভিযানে নামে। একটা সময় ওদের দুইজন মামাতো ভাইবোনও যখন এই শহরেই ছিলো তখন ওদের দলটা আরও অনেক বেশি শক্তিশালী ছিলো। গত বছরের শেষ দিকে ওরা ঢাকার কোনো একটা কলেজে ভর্তি হয়ে যাওয়ায় পর থেকে ওদের দলটা আগের থেকে একটু দুর্বল হয়ে পড়েছে।

কুৎসিত একটা হাসি হাসতে হাসতে মিশু আর আলভির দিকে তাকায় রবিন। খানিক পরে বাড়ির সেই লোকটাও রবিনের সাথে যোগ দেয়। হাসতে হাসতে বিষম খাওয়ার মতো অবস্থা হয়ে যায় রবিনের। ফাঁকে এক চুমুকে সামনের ছোট টেবিলে রাখা গ্লাসটার পুরোটুকু পানি শেষ করে আবার হাসতে শুরু করে।

তিন

–    আপুনি, এই আপুনি! শুনছিস?

অবাক হয়ে ঘাড় ঘুরিয়ে আশেপাশে তাকায় মিশু। আশেপাশে আলভি ছাড়া আর কাউকে দেখতে না পেয়ে আবার তার দিকেই তাকায় ও। মিশুকে আলভি সাধারণত যেসব নামে ডাকে সেগুলো হচ্ছে ‘মিশি’, ‘মশা’, ‘মিইশ্যা’, ‘মিচু’। ওর জন্মের এক মিনিট আগে জন্ম আলভির। কাজেই অলিখিত নিয়ম অনুসারে আলভিকে মিশুর বড় হিসেবে মানতে হয় এবং তার দ্বারা এইসব যন্ত্রণাও সহ্য করতে হয়। আজ প্রথমবারের মতো আলভির কাছ থেকে এরকম সম্বোধন শুনে অবাক না হয়ে পারে না মিশু।

–    কিরে, তুই কি কোনো কারণে আমাকে ডাকছিস?

–    তা না হলে আর কাকে ডাকবো? এই ঘরটাতে আর কে আছে? শুধু তুই আর আমিই তো!

–    হু! তাও তো ঠিক। খুবই চিন্তার বিষয়!

মাথা নাড়তে নাড়তে কথাটায় সায় দেয় মিশু। আবার ঘাড় ঘুরিয়ে তাকায় আলভির দিকে।

–    কি বলবি বল!

–    বলছি এখান থেকে বের হওয়ার কি কোনো রাস্তাই নেই? আমরা কি আসলেই আটকা পড়ে গেছি?

–    না, একেবারে আটকা হয়তো পড়িনি। বেরোবার একটা উপায় তো ঠিকই বের হবে। দেখি একটু চিন্তাভাবনা করি, ভাবার সময় দে। আশেপাশে ঘুরে দেখতে হবে বের হবার কোনো রাস্তা পাওয়া যায় কিনা।

রবিন নামের লোকটার সাথে কথা বলে কোনো লাভই হয়নি মিশুদের। বরং লোকটা ওদের রীতিমতো ভর্ৎসনা করেছে। যেনো শেয়াল মেরে সেটাকে বিরিয়ানির সাথে খাসির মাংস বলে চালিয়ে দেওয়াটা খুবই স্বাভাবিক একটা ব্যাপার। রবিনের সাথে কথাবার্তার এক পর্যায়ে যখন মিশু বুঝতে পারলো যে আদতে শুধু সময়ই নষ্ট হচ্ছে তখন ও আলভিকে সাথে নিয়ে বাড়িটা থেকে বের হয়ে আসতে চায়। কিন্তু যে বিষয়টার জন্য ওরা মোটেও প্রস্তুত ছিলো না সেটাই হয়েছে। কথা শেষ হওয়ার পর ওরা যখন চলে আসতে চায় তখন রবিনের ইশারায় মধ্যবয়স্ক লোকটি এসে মিশু আর আলভির হাত খপ করে ধরে টানতে টানতে ভেতরের একটি ঘরে নিয়ে আসে। বাজেভাবে অগোছালো একটা শোবার ঘর। ঘরের একদম এক কোণার দিকে থাকা ভারী আলমারিটা সরিয়ে মেঝের কাঠের পাটাতনটাতে টান দিতেই সেটি উঠে আসে। ভেতরে ছোট একটা অন্ধকার সিঁড়ি। কোথায় একটা সুইচে চাপ দিতেই ভেতরে আলো জ্বলে উঠেছিলো। মধ্যবয়স্ক লোকটা ওদের টেনেহিচড়ে সিঁড়ি দিয়ে নামিয়ে নিয়ে এসেছিলো। ভূ-গর্ভস্থ এই কক্ষটাতে ওদের তালাবদ্ধ করে দিয়ে ওরা আবার শব্দ করতে করতে সিঁড়ি দিয়ে উপরে উঠে যায়। একটু পর উপর থেকে ভারি পাটাতনটা টেনে দেয়ার শব্দ পাওয়া যায়।

ঘুরে ঘুরে মিশু আর আলভি পুরো ঘরটা দেখতে থাকে। পুরো ঘরটাই অন্ধকার। কোনো দিক থেকেই ঘরটাতে আলো আসছে না। সিঁড়িপথটার দিক থেকে কিছুটা আলো ঠিকরে ঠিকরে আসছে। মিশুর হাতে ছোট একটা লাইটার ম্যাচ। মধ্যবয়স্ক লোকটা যখন ওদের টেনেহিঁচড়ে নিচের এই ঘরটাতে নিয়ে এসেছিলো, তখন তার পকেট থেকে লাইটারটা পড়ে গিয়েছিলো। লোকটা চলে যাওয়ার পর মিশু আর আলভি সেটা কুড়িয়ে নেয়। তারপর বেশ খানিকটা সময় গেলে ঘরটা থেকে বের হবার রাস্তা খোঁজার কাজ শুরু করে। রুমটা খুব সম্ভবত এ বাড়ির স্টোররুম হিসেবে একটা সময়ে ব্যবহৃত হতো। ঘর জুড়েই এখানে ওখানে ছড়িয়ে ছিটিয়ে রাখা কিছু পুরাতন আসবাব। কিছু ময়লা কাগজ, কয়েকটা বস্তা, টাল দেয়া পুরাতন দৈনিক, একটা ভাঙ্গা সাইকেল, কিছু প্লাস্টিকের বোতল, কিছু উইকপোকায় কাটা বই আর বাচ্চাদের খেলনা ছাড়া তেমন কিছুই নেই। সেগুলো থেকে ছড়ানো কেমন যেনো একটা সোঁদা গন্ধে ঘরটা ম ম করছিলো। ঘরের ভেতরের গুমোট পরিবেশে আলভির দম বন্ধ হয়ে আসতে থাকে। মিশু ঘরের এক কোণে থাকা সেই ভাঙ্গা সাইকেলটা থেকে জোর খাটিয়ে দুটো মোটামুটি ভারি লোহার দণ্ড খুলে নেয়। বলা তো যায় না, যে কোনো সময়েই কাজে লাগতে পারে।

চার

–    জলিল চাচা, চা নিয়া আসো।

চায়ের পিরিচে চিনি দিয়ে সেটাতে চামচ দিয়ে ঘুটে রবিনের হাতে তুলে দেয় জলিল মিয়া। কাঁধ থেকে গামছাটা নামিয়ে মুখের ওপর জমে ওঠা ঘাম মোছে।

–    মিয়াসাব, আজকে পোলাপান জঙ্গলে যাইবো না?

–    না, আজকে যাইবো না।

–    কেন? শেয়াল না মারলে ধান্ধা হইবো কেমনে?

মুখটা সরু করে ইঁদুরের মতো করে এক ধরণের কিচকিচ শব্দ করে রবিন।

–    আমদানির লাগিনই তো ওগোরে বাইরে পাঠামু না আজকে। ওগোরে অনেক দূরে এক জায়গায় পাঠামু। ‘

–    কইনে মিয়াসাব? ওইনে কি শেয়াল আছে অনেক?

হাহা করে হাসতে থাকে রবিন। রবিনের হাসির কারণ কিছুই বুঝে ওঠে না জলিল মিয়া। বাইরের দরজায় কড়া নাড়ার শব্দে জলিল উঠতে চায়। তাকে হাত দিয়ে ইশারায় বসিয়ে রবিন নিজেই এগিয়ে যায় দরজা খুলতে। একটু পরেই টাকপড়া বেঁটেমতোন একজন লোককে নিয়ে আবার ঘরে ঢোকে। ভদ্রলোক খুব রেগে আছেন। এসেই হাত পা ছোড়াছুড়ি করে রাগান্বিত সুরে কি কি যেনো বলতে থাকে। রবিনের ইশারায় জলিল মিয়া আবার রান্নাঘরে ঢোকে আরও এক কাপ চা বানাতে। চুলায় গরম পানি বসাতে বসাতে ও ঘরের কথাবার্তায় কান পাতার চেষ্টা করে জলিল। শুনে লোকটা বাংলা আর ইংরেজিতে মিশিয়ে কি যেনো হাবিজাবি বলে যাচ্ছে।

–    What is this man? তুমি বললা শহর একদম শান্ত। কোনো ঝামেলা নাই। তাই আমি নিজেই আসলাম তোমার সাথে ডিল ফাইনাল করতে। আমাকে বলছো যাতায়াত ব্যবস্থা খুবই ভালো। ভালো মাই ফুট! ময়মনসিংহ পর্যন্ত আসতে যতটুকু কষ্ট হয়েছে তার হাজারগুণ বেশি কষ্ট হয়েছে সেখান থেকে এখানে আসতে। মুড়ির টিন মার্কা বাসের এক হাত সিটে বসে থেকে এসেছি। পায়ের উপর, ঘাড়ের উপর মানুষ গিজগিজ করছিলো। This is not fair at all young man!

উত্তরে রবিন ইনিয়ে বিনিয়ে অজুহাত দেখানোর চেষ্টা করে। কিন্তু কোনো অজুহাতই ভদ্রলোকের কাছে দাম পায় না। বরং সবগুলো অজুহাতই কেমন যেনো মার খেয়ে যায়।

–    শোনো, এসব ফালতু এক্সকিউজ রাখো। কাজের কথায় আসো। ছয়টা ছেলে, চারটা মেয়ে। ঠিক তো? সবাই তোমার হাতে?

–    উঁহু, ঠিক নেই।

–    কি ঠিক নেই?

–    সংখ্যাগুলো।

–    You bloody rascal! I will kill you. I want ten kids with me. Got it? I want ten.

রবিনের কলার ধরে টানতে টানতে কথাগুলো বলে ভদ্রলোক। চা নিয়ে এসে ঘটনা দেখে দৌড়ে এসে কোনোমতোন ভদ্রলোকের হাত থেকে রবিনকে ছোটায় জলিল মিয়া। রবিনের ঘাড়ে শার্টের কলার বসে গিয়ে জায়গাটা লাল হয়ে গেছে ততক্ষণে। সেখানে হাত বোলাতে বোলাতে লোকটার দিকে ভীত দৃষ্টিতে তাকায় রবিন।

–    স্যার, টেন তো আছেই। এখন টেন প্লাস টু ইকুয়েলস টু টুয়েলভ হয়ে গেছে আরকি।

রবিনের কথা শেষ হলে একটু শান্ত হন মোর্শেদ সাহেব।

–    আর দুইজন কোথায় পেলে?

–    নিজেই এসেছে।

–    ও আচ্ছা। আমার দশ জন চাই, বেশি হলে তোমার আমার দুজনেরই লাভ।

কথা শেষ করে ভদ্রলোক আবার তাকায় রবিনের দিকে।

–    আসার সময় দেখলাম একটা জায়গায় পুলিশ ভ্যান বসিয়ে সব গাড়িতে সার্চ করছে। বাই এনি ওয়ে, Did they get any information about me?

তুড়ি মেরে কথাটা উড়িয়ে দেয় রবিন।

–    স্যার, এই শহরে পুলিশের লোকেরা সারাদিন থানায় পড়ে পড়ে পেট উঁচিয়ে ঘুমায়। মাঝে মাঝে তখন টাকার দরকার পড়ে তখন মানুষের গাড়ি থামিয়ে লাইসেন্স, হেলমেট চেক করে সামান্য অনিয়ম পেলেই ঘুষ নেয়। ওদেরকে নিয়ে এতো ঘাবড়ানোর দরকার নেই।

–    Maybe, but something is very much fishy. I can feel that.

ট্রেতে দুই কাপ চা আর দুটো স্যান্ডউইচ সাজিয়ে নিয়ে ঘরে আসেন জলিল মিয়া। জলিল মিয়া লোকটার নাম জানতেন না। একটু আগেই শুনেছেন রবিন কার সাথে যেনো ফোনে বারবার বলছিলো যে চিন্তা করার কোনো কারণ নেই, মোর্শেদ সাহেব ভালোভাবেই এসে পৌঁছেছেন। সামনের টেবিলে ট্রেটা রেখে চলে যাওয়ার আগে জলিল মিয়া খেয়াল করে লোকটা তখনও তার দিকে অদ্ভূতভাবে তাকিয়ে আছে।

জলিল মিয়া ঘরটা থেকে চলে গেলে মোর্শেদ সাহেব রবিনের কাছ থেকে তার সম্পর্কে জানতে চান। মোর্শেদ সাহেবের কথাবার্তায় রবিন বুঝতে পারে জলিল মিয়াকে ভয় পাচ্ছেন তিনি। খুব বেশি শক্তিশালী মানুষরা সাধারণত খুব বেশি দূর্বলদেরই ভয় পান এবং সেটা বিনা কারণেই। অনেকভাবে বুঝিয়ে বলার পরে মোর্শেদ সাহেবকে রবিন বোঝাতে পারলো যে জলিল মিয়া নিতান্তই নিরীহ এবং বিশ্বস্ত একজন ভৃত্য। তার মাধ্যমে মোর্শেদ সাহেবের ক্ষতি হওয়ার কোনো সম্ভাবনাই নেই। ব্যাপারটা মিটে যাওয়ার পর টেবিলে রাখা চায়ের কাপ হাতে নিতে নিতে স্যান্ডউইচে একটা কামড় বসান মোর্শেদ সাহেব। রবিন অবাক হয়ে লক্ষ্য করে যে মোর্শেদ সাহেব স্যান্ডউইচ চায়ে ভিজিয়ে খাচ্ছেন। ঠিক যেমন বাচ্চারা চা খাওয়ার সময় চায়ে বিস্কুট ভিজিয়ে খায়। রবিনকে এভাবে চেয়ে থাকতে দেখে মোর্শেদ সাহেব যেনো একটু বিরক্ত হন। স্যান্ডউইচ চায়ে ভিজিয়ে খাওয়া যেনো খুবই স্বাভাবিক একটি ঘটনা। এতে তেমন কোনো অস্বাভাবাবিকতাই নেই। চা স্যান্ডউইচ খাওয়া শেষ হলে পায়ের মোজা আর জুতা খুলে সোফায় আধশোয়া অবস্থাতেই ঘুমিয়ে পড়েন মোর্শেদ সাহেব। একটু পর যখন জলিল মিয়া চায়ের কাপ আর পিরিচ ট্রেতে করে নিয়ে যাচ্ছিলেন মোর্শেদ সাহেব তখন বিকট শব্দে নাক ডাকতে শুরু করেছেন। তার নাক ডাকার শব্দের সাথে পুরনো ফিটনেসবিহীন মোটরগাড়ির শব্দের কোথায় যেনো একটা মিল আছে। রাতের খাবার খেতে বসে রবিন জলিল মিয়ার কাছ থেকে মিশু আর আলভির ব্যাপারে জানতে চায়।

–    জলিল চাচা, পোলাপানগুলোর কি খবর?

–    কোনগুলার?

–    ওইযে, পাখি ধরলাম যে দুইটা। ওইগুলার।

–    ও আচ্ছা।

কথা শেষ করেই হাহা করে হাসতে থাকেন জলিল মিয়া। তার মুখ দেখে মনে হয় যেনো সে কথাটাতে খুব মজার একটা বিষয় আবিষ্কার করে ফেলেছে। তরকারির বাটিটা রবিনের সামনে রেখে কাঁধে ঝোলানো গামছা দিয়ে মুখ মোছে সে।

–    ঐগুলাইন তো আপাতত মাটির নিচেই আছে। কি জানি বাইচা আছে নাকি অক্কা গেছে।

–    না না, অক্কা গেলে তো হইবো না। ওরা হইতাছে কচকইচ্চা টাকার নোট। রাতের খাবার দিছিলা ওগোরে?

–    না।

মাথা নাড়েন জলিল মিয়া।

–    তুমি খাইয়াই ওগোরে খাওন দিয়া আসবা। বুঝছো? আমি একটু ঘুমাইতাছি। এর আগে পার্থরে খবর দেও। ঐ বাড়ি থাইকা পোলাপাইনগুলারে নিয়া আসুক আস্তে ধীরে। ওরে বলবা ও, মান্না, রাকিব যেনো দুইজন তিনজন কইরা পোলাপানগুলারে সাথে নিয়া আসে। একবারে সবাইরে নিয়া যেনো বের না হয়।

হাত ধুয়ে উঠতে উঠতে কথাগুলো বলে রবিন।

–    আর হ, ওইগুলাইন আসলে ওগুলারে ভাত দিবা। খাওনের মধ্যে যেকোনো কিছু একটার লগে ওই ওষুধের গুঁড়াটাও মিশায়া দিয়ো। কড়া ডোজের ঘুমের ওষুধ। দুই চিমটি দিলেই ম্যানায়া যাইবো। আমিও একটু ঘুমাইতাছি। পোলাপানগুলা আসলে যেমনে কইলাম ওমনে খাওন দিয়া আমারে ডাক দিয়ো। আর রনিরে কও যেনো বড় গাড়িডা নিইয়া আসে। আজকে ভোরেই বাচ্চাগুলারে চালান দেওন লাগবো।

টেবিলের এঁটো থালাবাসন সরাচ্ছিলো জলিল মিয়া। এবার চোখ তুলে তাকায় রবিনের দিকে।

–    আপনিই লইয়া যাবেন নাকি ওগোরে?

–    না, আমি কেন যামু? আমি খালি শহর থাইকা বাইর করায়া দিমু। মোর্শেদ সাহেবের লগে পার্থ যাইবো দুর্গাপুর পর্যন্ত। ওইপাড় থাইকা পোলাপান নেওনের লাগিন আজকে রাইতেই লোক আইসা বর্ডার ক্রস করবো।

–    আচ্ছা।

ঘাড় নাড়েন জলিল মিয়া। যেনো তিনি সবই বুঝে ফেলেছেন।

খাবার টেবিল থেকে উঠে গিয়ে নিজের ড্রয়িং রুম হয়ে নিজের রুমে যায় রবিন। সোফায় ঘুমন্ত মোর্শেদ সাহেবের দিকে একবার চোখ যায়। কি বীভৎস এই লোকটার ঘুমন্ত চেহারা! ভাবতেই শরীর যেনো একেবারে শিউরে ওঠে। লাইট নিভিয়ে পাতলা একটা চাদর গায়ে দিয়ে কোলবালিশটা ধরে ঘাপটি মেরে বিছানায় পড়ে থাকে রবিন। সে আগে জানতো যে রাত বাড়ার সাথে সাথে আশেপাশে নিঃশব্দতা নেমে আসে। এতদিন তাই হয়ে আসছিলো। আজ যেনো সব বদলে গেছে। পাশেই ড্রয়িংরুম থেকে মোর্শেদ সাহেবের গগনবিদারী নাক ডাকার আওয়াজ ভেসে আসছে। কানে বালিশ চেপেও রক্ষা পাচ্ছে না রবিন। আওয়াজ ভেসেই আসছে।

 

চলবে…

ফরিদুর রেজা খান। কথাসাহিত্যিক ও শিক্ষার্থী। জন্ম ৬ এপ্রিল। জন্ম বাংলাদেশের নেত্রকোণা জেলায়। বর্তমানে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে ইংরেজি সাহিত্য নিয়ে পড়াশুনা করছেন। প্রকাশিত বই: 'তখন আঁধার ছিলো' (উপন্যাস)।

এই বিভাগের অন্যান্য লেখাসমূহ