পাঠ প্রতিক্রিয়া ‘আমার সপ্তাহান্তেরা’- ইসরাত জাহান
উপায়ন “রাত জেগে বই পড়ার একটা আলাদা ভালোলাগা আছে। চারিদিকে চুপচাপ আর নৈঃশব্দ্যের ভিড়ে বইয়ের…..
রুমী, খৈয়াম, হাফিজের কয়েক শতাব্দী পর এলেন গালিব। মির্জা গালিব। এত দিতে সুরাপাত্র ও প্রেমের মজলিশের চেহারা পাল্টে গেছে। সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় কানুন কখনোই তাঁর সহায় হয়নি। জীবনের ওপর দারুণ বিতৃষ্ণা তাঁর। এই বিতৃষ্ণা ধরা দিল কবির এক একটি কাপলেট বা শের-এ। মনে হতে লাগল এসবই যেন তার আত্মকেন্দ্রীক জিজ্ঞাসা, নিজেকে বুঝ দেওয়া যুক্তির চরণ। ইকবাল সে অর্থে আত্মকেন্দ্রীক ছিলেন না, চিন্তার রূপ দিয়েছেন বৃহত্তর মানবজীবনে। তবে আসলেই কী গালিবের এই শের আত্মকেন্দ্রিক থেকেছে শেষমেশ? তা কি পরাজিত মানুষের আর্তনাদের প্রতিধ্বনি হয়ে ওঠেনি? উঠেছে। এই অর্থে গালিব পৌঁছে গেল মানুষের হৃদয়ে। দেখেছি, গালিব পরাজিত ভাগ্য নিয়ে বারবার ঈশ্বরের মুখোমুখি হয়েছেন জিজ্ঞাসু মন নিয়ে। বলেছেন—
‘ আমি কী এমন জ্ঞানী ছিলাম, কোন গুণেই বা সেরা ছিলাম, / অকারণে, আসাদ, আসমান আমার শত্রু হলো। ‘
আসমান তথা ঈশ্বরের কুনজর কি আজীবনই গুণীজ্ঞানীদের ওপর? হয়তো। না হলে স্পিনোজা, কীটস্, ফ্রয়েড বা জীবনানন্দের জীবন এমন কেন? বহু প্রশ্ন এসে জমা হয় সামনে। ভাগ্যের এই পরাজয়কে ভুলে জীবন অতিবাহিত করার পন্থা কবিরা আবিষ্কার করেন বিভিন্ন কৌশল প্রয়োগ করে। গালিবও এক কৌশল আবিষ্কার করেছিলেন। তা হলো জাগতিক অত্যাচারকে নীরবে সহ্য করার ক্ষমতা। আর এই কৌশলই গালিবকে ধ্যানী মানুষে রূপান্তর করে, হয়ে ওঠেন বিশুদ্ধ কবি। এজন্য গালিবের গজল তখন আর গজল থাকে না, হয়ে ওঠে বাণী। এ সকল রচনায় আমরা তখন দেখি, কবিতার দুই চরণই পূর্ণাঙ্গ কবিতার অর্থ বহন করতে সমর্থ হয়। এগুলোকে কাপলেট বলা যায়, যা জাপানি হাইকুর কাছাকাছি। এ ধরণের কাব্যকণিকাগুলো অতিসীমিত বলে শব্দ চয়ন ও বিন্যাসে কবিকে অতিশয় দক্ষ হতে হয়।
এই দক্ষতার সুর যেন ভীষণভাবে পেলাম কবি কাকন রেজার কবিতায় আর তিনিও হয়ে উঠলেন বিশুদ্ধ কবি। গালিবের মতো কী যেন এক বিষাদে তিনি লিখলেন কাব্যের ভেতর কাব্যকণিকা। কী এমন বিষাদে তিনি প্রজ্ঞাপথে হাঁটলেন, ধ্যানস্থ হলেন, তাঁর পুরো কবিতার দুচরণই শের-এর মতো অর্থবহন করছে? তাঁর কবিতাগ্রন্থ ‘ স্থির করে দাও কম্পমান জল ‘-এর উৎসর্গ পত্রে কার নাম লেখা?
‘ ফাগুন ‘।
ফাগুন তাঁর টগবগে সন্তান। ‘ফাগুন হত্যা’র বেদনা তিনি কী বহন করছেন না আজও, গহীনে গোপনে? পুত্র হারানোর ব্যথা কি কবিকে ধ্যানমগ্ন করলো? কবিকে আমাদের অন্তরালে নিয়ে গেল? এজন্যই কি দীর্ঘ দিন নিজ নামে কবিতায় লিখলেন না তিনি? লিখলেন ছদ্মনামে! এসব প্রশ্নের উত্তর কবি দেননি আমাদের। তবু কাব্যের শুরুতেই লিখেছেন—
‘ স্থির করে দাও, কম্পমান জল, হে ঈশ্বর
বীক্ষণে উঠে আসে যে মুখ, সে অবিনশ্বর ‘
স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে কালির অক্ষরে লেখা তাঁর কবিতা যেন এসব পরাজয় ও ব্যথারই নিরাময়। গালিবের মতো স্বল্প কথায় বৃহৎকে আবিষ্কার করা তাঁর কবিতার মূল প্রবণতা। বেশ কিছু কবিতায় তিনি নিজেই দুচরণগুলোকে ক্রমিক সংখ্যা দিয়ে আলাদা করে দিয়েছেন। যেমন —
‘ কতটা সময় গেছে, কতকাল আর বাকি
সমূহ হিসেব থাক, চলো শিলালিপি হয়ে থাকি। ‘
এই চরণ পড়তে যেয়ে আমার শুধু মনে হয়েছে—কবি কাকন রেজা কি গালিবের সেই প্রশ্নের উত্তর দিয়ে যাচ্ছেন আমাদের?
জিন্দগী অপনী জব্ ইস শকল্-সে গুজরী, গালিব,
হম-ভী কেয়া য়াদ করেঙ্গে কেহ্ খুদা রখতে থে।।
অর্থাৎ-
‘এমনভাবে, গালিব, জীবন কেটেছে,
আমি কি আর মনে রাখতে পারি যে আমার মনেও ঈশ্বরের স্থান ছিল।’
কাকন রেজা কি এই মনে রাখার জন্যই শিলালিপি হয়ে থাকতে চাইছেন? কবি গালিবের প্রশ্নের উত্তর পেতে আমাদের তাহলে কি পৌঁছাতে হচ্ছে কবি কাকন রেজার কাছে!
এ সময় এসেও কবি কাকন রেজা শরাবের কথা বলছেন! কিন্তু ওই যে আমি প্রথমেই বলেছিলাম, সুরাপাত্র পাল্টে গেছে। শুধু সুরাপাত্র নয়, তার ভেতরের শরাবও পাল্টে গেছে। এই শবার গালিবের নয়, গালিবও নয়; এ শরাব কাকন রেজা নিজে।
‘ গ্লাসটা খালি হলে উঠবো ঠিক দেখো
খালি গ্লাস এখানে শরাব ছিল মনে রেখ।’
কবির শূন্যতা দেখেও যেন মনে হয়, এখানে কবি ছিলেন। এ যেন গালিবের সেই আত্মমগ্নতা। যে আত্মমগ্নতার প্রাজ্ঞতা গালিবকে ধ্যানী করল, সেই আত্মমগ্নতার প্রাজ্ঞতাই কি কবি কাকন রেজারে ঋষি করে তুলেছে? কবিতার ভাবকে তিনি তাঁর প্রতিটি শেরেই তা ধরতে চেয়েছেন? ‘কবিতাগুচ্ছ’ নামে তাঁর কবিতাটির প্রতি দুচরণকে তিনি ভিন্ন ভিন্ন নাম দিয়েছেন। গ্রন্থের যে সব কবিতার এভাবে আলাদা নাম দেননি, সেখান থেকেও চরণগুলোকে যদি আলাদা করে তুলে আনা হয়, তবুও তা অর্থ বহন করে; যেভাবে গালিবের গজল থেকে
তাঁর শেরগুলোকে তুলে আনা যায়। যেমন কবি কাকন রেজার ‘ গন্তব্য ‘ কবিতা থেকে যদি শুধু শেষ দুই চরণ তুলে আনা হয়, তাহলেও আমরা প্রজ্ঞাময় মেসেজ পাবো—
‘ রাস্তা বসে আছে, সাথে আমি
গন্তব্য কোথায় জানে অন্তর্যামী। ‘
‘জালের প্রণয়’ কবিতা থেকে যেকোনো দুই চরণ যদি তুলে আনি, তাও গুরুতর অর্থবহ —
‘ মাছেরাও ফেরে সাথে, চতুর ইলিশ, ফেরা দল
জালের প্রণয় জানে, পালানোটা যে নিষ্ফল ‘
কবিতায় গালিব, হাফিজ, এমনকী রবীন্দ্রনাথের একটি প্রবণতা আছে, ঈশ্বরকে প্রিয়া বা প্রেয়সী হিসেবে সামনে আনা; অথবা বলা যায় কাব্যে শব্দালঙ্কার ব্যবহারের দক্ষতায় শব্দে ঈশ্বর বা প্রেয়সী তথা দ্বি-অর্থরূপ প্রকাশ। মূলত, হাফিজ, রবীন্দ্রনাথ ও গালিবের নারীপ্রেম ও ঈশ্বরপ্রেমের মধ্যে খুব বেশি দূরত্ব নেই, পথ প্রায় সুগম। এ রূপ পাচ্ছি, কবি কাকন রেজার কবিতাতেও।
‘ শীত ও আলো বিষয়ক ‘ কবিতাটিতে যাই—
‘উৎসবে দারুণ তুমি, উষ্ণতায় মাতো
শিস দেয়া শীতে আমি দারুণ আহত’
কে এই তুমি? প্রেয়সী নাকি ঈশ্বর?
‘শীতার্ত রাতেরা জানে, উষ্ণতা দরকার
কিছুই মানো না তুমি, ফ্যাসিস্ট সরকার ‘
কে ফ্যাসিস্ট? দেশপ্রধান নাকি স্বেচ্ছাচারী ঈশ্বর?
এভাবেই কাকন রেজা আমাদেরকে দ্বৈতভাবনার স্পেস দিয়ে রেখেছেন তাঁর কবিতায়।
প্রেয়সীর আড়ালে তিনি যেন ঈশ্বরকেই ডাকছেন—
‘ কীভাবে যে ডাকি, গলায় অসুখ, বন্ধ
শুনবে কী টেলিপ্যাথি, সনির্বন্ধ’
নিজের অক্ষমতার জন্য ঈশ্বরকে ডাকতে না পারলেও অসীম ক্ষমতাধর ঈশ্বরের তো এই টেলিপ্যাথি ভাষা বোঝার সক্ষমতা থাকা উচিত, এ পর্যন্ত বলেই তিনি থামেননি? ঈশ্বর ঈর্ষাকাতর কিনা সে প্রশ্নও তুলেছেন—
‘ স্রষ্টা তবে কী ঈর্ষাকাতর! প্রেমে ব্যর্থ কবি
খুঁজে ফিরি প্রশ্নের উত্তর বেতাল আজনবী। ‘
গালিব অভিযোগ তুলছেন, ঈশ্বর এমন শত্রুতা করছেন যে তার নিষ্ঠুরতা থেকেও বঞ্চিত হতে হচ্ছে —
‘ অব জফা-সে ভী হৈঁ মহরুম, আল্লাহ আল্লাহ
ইস্ কদর্ দুশ্ মন্-এ অর্বার-এ বফা হো জানা।।’
অর্থাৎ—
‘এখন নিষ্ঠুরতা থেকেও বঞ্চিত আমি- হায় ঈশ্বর
একনিষ্ঠ প্রেমিকের সঙ্গে এতোখানি শত্রুতা! ‘
ঈশ্বরের প্রতি এই যে অনুযোগ, একে বলা হয় ‘ শিকওয়াহ্ ‘।
না পাওয়ার ব্যর্থতা, অতৃপ্ততা থেকেই কি জন্ম হয় প্রাজ্ঞতার? গালিবের সাথে পরিচিত হয়ে তাই দেখেছিলাম —
‘আ-হী জাতা বোহ্ রাহ্-পর, গালিব
কোঈ দিন অওর-ভী জীয়ে হোতে।।’
অর্থাৎ—
‘ মন তার পেয়েই যেতে, গালিব
আরো কিছু দিন বেঁচে থাকলে পারতে।।’
কাকন রেজাও লিখেছেন —
‘পাখি শিকার নিষিদ্ধ
আহা, মানুষের যদি ডানা থাকতো!’
( জোড়া পঙক্তি)
কবি কাকন রেজার কবিতায় শরাব এসেছে, জুয়া এসেছে, পানশালা এসেছে, এমন কী গালিব নিজে এসেও ধরা দিয়েছেন কয়েকবার। ‘ঘরহারাদের আফসানা’ কবিতায় চমৎকারভাবে গালিবের গুরুত্ব তুলে ধরলেন কবি, তবে তখন গালিব আর ব্যক্তি গালিব থাকলেন না, কবি বা স্রষ্টার প্রতিনিধি হিসেবে এলেন—
‘ সন্ধান করি আশ্রয়ের, নিরাপদ হৃদয়ের চাতাল
গালিব পায়নি বলে পানশালা হয়েছিল মাতাল।’
কাকন রেজা বলছেন, গালিবের যেমন পানশালা প্রয়োজন, পানশালারও গালিবের প্রয়োজন। এখন আমরা যদি, পানশালাকে পৃথিবী ধরি, আর গালিবকে যদি কবির সমার্থক ধরি, তাহলে কি এ পৃথিবীর একজন কাকন রেজা প্রয়োজন? এ উত্তর এত ক্ষণে আমাদের জানা হয়ে গেছে আমি নিশ্চিত, কারণ —
প্রজ্ঞার সুরাপাত্রটি শুধু হাত বদল হচ্ছে; এক ধ্যানী থেকে আরেক ধ্যানীর হাতে।
উপায়ন “রাত জেগে বই পড়ার একটা আলাদা ভালোলাগা আছে। চারিদিকে চুপচাপ আর নৈঃশব্দ্যের ভিড়ে বইয়ের…..
টমাস মান (Tomas Mann) – এর বুদেনব্রুক (Buddenbrooks) বইটি মূল জার্মান ভাষায় পড়ার পর কিছুটা…..
ইংরেজি ভার্সান এখানে >>> Welcome to the Pataquerical Night Show (Last Episode) পূর্ববর্তী পর্ব এখানে>>>…..
ইংরেজি ভার্সান এখানে >>> Welcome to the Pataquerical Night Show (Episode-5) পূর্ববর্তী পর্ব এখানে>>> শেষ…..