স্পর্শসুখ

শ্বেতা সরকার
ছোটগল্প
Bengali
স্পর্শসুখ

সাদা সুতির টেপফ্রকের ওপর খদ্দরের ফ্রকটা পরিয়ে মিমির চুলটা ভালো করে বেঁধে দিলো মা। তারপর ফ্রকটা তুলে মা বললো,

“এই প্যান্টটা ছেঁড়া না, ভালো প্যান্টটা পড়ে যা, আর কাপড়টা ঠিক করে বেঁধেছিস তো, খুলে না যায়। ”

সাড়ে দশ বছরের মিমি মাথা নাড়ে। সময়টা উনিশশো অষ্টআশি। তখন সাধারণ মধ্যবিত্ত বাড়িতে মেয়েরা খদ্দরের মোটা জামা সাদা সুতির টেপফ্রক আর দড়িবাঁধা ইজের ব্যবহার করতো।

“তুমি যাবেনা মা? ”

” না, তুই বাবার সাথে যা, জেঠু দেখবে তোকে। ”

মিমি অবাক হয়ে বলে,

“আমার তো জ্বর হয়নি, সর্দিও নেই, তাহলে জেঠু কি দেখবে? ”

” ওই যে তোর শরীর খারাপ বন্ধ হচ্ছে না, জেঠু ওষুধ দিয়ে দেবে। ”

শরীর খারাপ শব্দটার সাথে মাস দুয়েক আগে মিমির পরিচয় হয়েছে। টয়লেট করতে গিয়ে অল্প রক্ত দেখে সে ভয় পেয়ে গিয়েছিলো খুব। বিকেলে মাঠে খেলতে গিয়ে হামেশাই হাত পা কেটে ছড়ে নিয়ে আসে সে। কয়েকদিন আগে কবাডি খেলতে গিয়ে খুব জোরে উল্টে পড়েছিলো। পেটেও লেগেছিলো। মিমি ভেবেছিলো ব্যথা লেগে পেটে কোথাও কেটে গেছে তাই রক্ত পড়ছে। মা খুব বকবে সেই ভয়ে দুদিন কিছু বলেনি। বারবার বাথরুমে গিয়ে জল দিয়ে ধুয়ে নিত। কিন্তু দুদিন পরে রক্ত বন্ধ তো হলোনা উল্টে বেড়ে যাচ্ছে দেখে অগত্যা মিমি বুঝলো মায়ের বকুনি খাওয়া ছাড়া আর কোন উপায় নেই।বাবার কাছে পড়তে বসে ভয়ে ভয়ে বললো,

” বাবা দেখো, আমি পায়ের এখানটা মুছলাম কত রক্ত।”

বাবা খানিক গম্ভীর হয়ে বললো,

“মায়ের কাছে যা এখুনি।”

ভয়ে ভয়ে মিমি রান্নাঘরের দরজায় গিয়ে দাঁড়ায়। মাকে সব বলতেই মা তাড়াতাড়ি তাকে বাথরুমে আনে।

” কখন থেকে হচ্ছে, বলিসনি কেন, বাবাকে কেউ বলে এসব, দাঁড়া এখানে। ”

বাথরুমে চুপ করে দাঁড়িয়ে  সাড়ে দশ বছরের মিমি ভাবতে থাকে এতোখানি কেটে গেলো তাও মা বকলোনা! আজব কান্ড!

একটা বড় কাপড় ছেঁড়া নিয়ে মা বাথরুমে আসে। কাপড়ের একদিকটা ছিঁড়ে দড়ি তৈরি করে মিমির কোমরে বেঁধে দিয়ে বলে,

” এইভাবে কাপড় নিবি, স্নান করার সময় এগুলো সাবান দিয়ে ভালো করে ধুয়ে দিবি, এখন ওই রাজেশ সুমন ওদের সাথে বেশী খেলবিনা, বড়ো হয়ে গেছিস বুঝলি। ”

মিমি কিছুই বুঝলোনা। শুধু এটুকু বুঝলো তার বড় রকমের কিছু হয়নি। কিন্তু রাজেশ সুমনদের সাথে খেলবেনা কেন কিছু বুঝলোনা। মাকে প্রশ্ন করলে বকুনি জুটবে। মিমি মাকে খুব কম প্রশ্ন করে। নিজে নিজে সব কিছু বোঝার চেষ্টা করে। প্রশ্ন করলে একটাই কথা শুনতে হয়,

“ছোট ছোটর মত থাকবি, বেশী পাকা পাকা কথা বলবিনা একদম।”

এরপর দিন দশেক বাড়ি থেকে বেরোতে দেয়নি মা। মিঠু সুমন রাজেশ প্রতিদিন বিকেলে ডাকতে আসতো। তিনতলা কোয়াটারের বারান্দায় দাঁড়িয়ে মায়ের শেখানো বুলি মিমি বলতো,

” পড়া আছে রে, পরে যাবো। ”

দশদিন পরে মিমি বুঝলো ওই শরীর খারাপটা আর নেই। কিন্তু বিকেলে খেলতে যেতেই মায়ের গজগজানি শুরু হলো

“এসব খেলা টেলা এবার বন্ধ করো, যথেষ্ট খেলেছো। ”

মিমি অবশ্য শোনেনি। মাঠে দৌড়েছে। দ…শ দি… ন! উফ সে খেলেনি! পরের মাসে মিমি দেখলো তার শরীর খারাপ হয়নি বলে মা চিন্তা করছে। মিমির অবশ্য আনন্দই হয়েছিল। শরীর খারাপ হলেই তো খেলা বন্ধ।

কিন্তু এই মাসের এক তারিখ থেকে সেই যে শুরু হয়েছে কুড়ি তারিখ হয়ে গেল বন্ধই হয়না। এই মাসে শুরু হতেই মিমির ভীষণ কান্না পেয়েছিলো। স্নানের সময় বাথরুমের দরজা বন্ধ করে ফুপিয়ে ফুপিয়ে খানিক কেঁদেছে। আবার খেলা বন্ধ। ইতিমধ্যে নিজের শারীরিক পরিবর্তনটাও তার নজরে পড়েছে। ভাগ্যিস স্কুল বন্ধ নয়। মা অবশ্য বারবার বলেছে স্কুলে বেশী দৌড়াদৌড়ি না করতে। কিন্তু মিমির বয়ে গেছে চুপ করে বসে থাকতে। স্কুলের মাঠটাই তো সম্বল। ঘরে গেলেই তো বন্দী।

বাবার সাথে মিমি খুদু জেঠুর কোয়াটারের সামনে এসে দাঁড়ালো। খুদু জেঠুর আসল নামটা যে কি তা মিমি জানেনা। জেঠু রেলে বাবাদের ডিপার্টমেন্টে কাজ করে। বাবা আর অফিসের অন্য কাকুরা তাকে খুদুদা বলে। তাই মিমিরা বলে খুদু জেঠু। জেঠুর কিছু হোমিওপ্যাথি জানা আছে। কোয়াটারের অনেককেই জেঠু জ্বর সর্দি কাশি পেটব্যাথা ইত্যাদির ভালোই ওষুধ দেন। সব ওষুধের একদাম।দু টাকা। মিমিও অনেকবার ওষুধ খেয়েছে। ওই মিষ্টি মিষ্টি সাদা গুলি গুলো দেখলে মনে হয় একসাথে সব ওষুধ খেয়ে ফেলি।

জেঠিমা দরজা খুলে বললো,

” কি রে, তোর আবার কি হয়েছে?”

মিমি জানে জেম্মা বাচ্চাদের খুব ভালোবাসে। তার কোন ছেলেপুলে নেই তো তাই। বাবা বললো,

” দাদা ঘরে আছে বৌদি? ”

” হ্যাঁ হ্যাঁ আছে তো, এসো এসো, চা খাবে তো? ”

” একটু হলে ভালোই হয়, করেই ফেলুন। ”

ঘরে ঢুকে মিমি দেখলো জেঠু টিভি দেখছে। নতুন সাদাকালো টিভি। কোয়াটারে খুব কম লোকের বাড়ী আছে।আর একটা আছে ক্লাব রুমে। ক্রিকেট খেলা হলে বাবা অবশ্য জেঠুর বাড়িই দেখতে আসে। তখন মিমিও আসে। ক্লাবে খুব ভীড় হয়তো। বাবা বললো,

” দাদা ওই যে বলেছিলামনা, মিমিকে এনেছি, দেখবে বলেছিলে। ”

জেঠু যেন একটু হকচকিয়ে গেল।

” ওহ্ হো, এনেছো বুঝি, হ্যাঁ হ্যাঁ, ওই ঘরে যেতে হবে যে। ”

” হ্যাঁ হ্যাঁ, এ্যাই মিমি জেঠুর সাথে যা। ”

এর আগে কখনো এমন হয়নি। জেঠু তো এ ঘরেই নাড়ী দেখে জিভ দেখে পেট টিপে দেখে স্টেথোস্কোপ দিয়েও দেখে। অবশ্য মিমি যখন আসে ওই ঘরেও খেলে বেড়ায়। জেঠিমার সাথে গল্প করে। ওই ঘরে ঢুকে জেঠু আলো জ্বালালো না। যদিও বারান্দার আলোতেই ঘরটা অনেকটাই আলো হয়ে আছে। জেঠু ঘরে ঢুকে বললো,

” শুয়ে পড় ”

মিমি তাই করলো। জেঠু জামার তলা দিয়ে হাত ঢুকিয়ে গায়ে হাত বোলাতে লাগলো। খানিকটা অন্যমনষ্ক ভাবে বললো,

” মাসিক কবে হয়েছে? ”

মিমি আন্দাজে বুঝলো জেঠু ওই শরীর খারাপের কথা বলছে।

” এক তারিখে ।”

জেঠু যেন শুনতে পেলোনা।

” পেটটা দেখি ”

মিমিকে প্যান্টের দড়ি খুলতে হলো। এরকম অবস্থায় কখনো পড়েনি সে। জেঠু বুক থেকে তলপেটে হাত বুলিয়ে যাচ্ছে। মাঝে মাঝে ছাড়া ছাড়া কথা বলে যাচ্ছে,

” আগে কবে হয়েছে, কবে হয়নি, কতদিন ধরে ছিলো। ”

কিন্তু মিমির উত্তরের দিকে যেন কোন নজর নেই। মিমি ভাবছে জেঠু তেল মাখানোর মত হাত বোলাচ্ছে কেন। বাবা আগে তাকে এভাবে তেল মাখিয়ে স্নান করাতো। কিন্তু জেঠু কি দেখছে। পেট ব্যাথা আছে কিনা দেখার জন্য জেঠু যেমন পেট টিপে দেখে সেরকম পেট টিপেও দেখছে না। স্টেথোস্কোপ ও দিলোনা জিভও দেখলোনা। বেশ কিছুক্ষণ পরে জেঠিমা চা নিয়ে এসে ডাক দিলো,

” চা হয়ে গেছে গো।”

জেঠু যেন চমকে উঠলো। তারপর তাড়াতাড়ি দাঁড়িয়ে বললো,

” ঠিক আছে, আমি ওষুধ দিয়ে দেবো। ”

মিমি উঠে জামা প্যান্ট ঠিক করতে করতেও ভাবতে লাগলো জেঠু কি দেখলো।

বাসের দুলুনিতে পিছনে শক্ত মাংসল চাপটা আবার টের পেতেই মেজাজ সপ্তমে উঠলো মিমির। ঘুরে গিয়ে ঠাস করে চড় কষালো কাকু মার্কা লোকটাকে। মেয়ে অনুকে নিয়ে বান্ধবীর জন্মদিনের নেমতন্ন খেতে গিয়েছিলো মিমি। ফেরার পথে ভিড় বাসে যা হয়। সুযোগের সদব্যবহার করা মালটাকে দুবার সাবধান করেছে। কিন্তু সবসময়ের মতোই লোকটা তাকে পাত্তা না দিয়ে ভিড়ের অজুহাত দেখিয়ে টেরাবাঁকা তাচ্ছিল্য করেছে। আর বাস সুদ্ধ প্যাসেন্জারও নীরব দর্শকের ভূমিকা পালন করেছে। মিমি জানে এখুনি একটা পকেটমার পড়ুক। তখন বীরত্ব দেখাতে কেউ বাকি থাকবেনা। তবে সে মোটেই হজম করার মেয়ে নয়। কথা শুনলে ভালো নইলে ঘা কতক বসিয়ে দেয়। যত বড় হয়েছে তত বুঝেছে তাদের খুদু জেঠু বাবা মায়ের সরল বিশ্বাসের সুযোগ নিয়ে সেদিন ঠিক কি দেখেছিলো। ততই রাগে গা রি রি করে উঠেছে। লোকটাকে সপাটে দুটো কষিয়ে মিমি দাঁত চিপে বললো,

” অত পুলক তো যা না ভাড়ার জায়গায় যা, এখানে জ্বালাচ্ছিস কেন, সরে যা এখুনি? ”

লোকটা বুঝেছে রং নম্বর ডায়াল হয়ে গেছে। স্টপেজে বাস দাঁড়াতেই লোকটা নেমে গেল। মিমি আরও তিনটে স্টপেজ পরে নামবে। বছর নয়ের অনু মা কে এরকম করতে দেখে আগে অবাক হতো এখন আর হয়না। সে বোঝে লোকটা মা কে ব্যাড টাচ করেছে।

” কি রে মা, অমন যুদ্ধাং দেহি হয়ে মা বেটিতে কোথা থেকে এলিরে ?”

কাঁধে আলতো চাপ পড়লো মিমির। বাস থেকে নেমে  মেয়েকে নিয়ে বাড়ির পথে হাঁটছিলো। ঘাড় ঘুরিয়ে একগাল হাসলো মিমি।পাড়ার তুষার জেঠু। সত্তরোর্ধ মানুষ। সারাক্ষণ এমাথা থেকে ওমাথা ঘুরে বেড়ান আর সবার খোঁজ নেন। বাচ্চাদের গল্পদাদু। প্রতিদিন কারোর না কারোর ছাদে সবাই মিলে দাদুর কাছে গল্প শোনার আসর বসে।

” কিছু না জেঠু, যা গরম পড়েছে, তার ওপর অফিস ফেরতা ভিড়। তাই ঘেমে গেছি গো। ”

” যা বলেছিস, কি গরম কি গরম রে মা, বুড়ো হয়েছিতো, সব কিছুই যেন বেশী লাগেরে, তারপর দিদুভাই, মায়ের সাথে কোথায় গিয়েছিলে? ”

” মাসির জন্মদিনের পার্টিতে। ”

জেঠু অনুর মাথায় হাত রাখে।

” বা বা, খুব মজা, বাড়িতে দুষ্টুমি করছো তো, খুব দুষ্টুমি করবে, আর মা বকলে আমাকে বলবে ,আমি মাকে বকে দেবো বুঝলে। ”

অনু হাসিমুখে মাথা নাড়ে। অনু জানে এটা গুড টাচ।

” হ্যাঁ হ্যাঁ তোমাদের আদরে দিন দিন বাঁদর হচ্ছে। ”

মিমি হেসে ফেলে। মিমির পিঠে কপট শাসনে চাপড় পড়ে।

” এ্যাই খবরদার বলছি, আমার দিদুভাইকে বাঁদর বলবিনা একদম, ও দুষ্টু, বাঁদর নয়, যা ঘরে গিয়ে ফ্রেস হ, উফ কি গরম রে মা।”

তুষার জেঠু রাস্তার মোড়ের দিকে এগিয়ে যান। মিমি অনুর হাত ধরে বাড়ির পথে হাঁটা শুরু করে। মনে মনে বলে,

“ওকে খুব বেশী বকিনা গো, আমি ওর বন্ধু হতে চেষ্টা করি, সবার শরীর ঘড়ি এক সময় দেয়না, অনুর ঘড়ি যদি আমার মতো আগে ছোটে তাহলে তো আর একবছর পরেই অনুর পিরিয়ড শুরু হবে, মায়ের মতো ভুল আমি করিনি, অনুকে বুঝিয়ে দিয়েছি কোনটা গুড টাচ আর কোনটা ব্যাড টাচ। “

শ্বেতা সরকার। জন্ম ১৯৭৮ সালের ফেব্রুয়ারি। স্থান, বাবার কর্মস্থল টিকিয়াপাড়া রেল কোয়াটার, হাওড়া,বাংলা, ভারত। পাড়ার প্রাথমিক বিদ্যালয়ের পাঠ শেষ করে হাওড়া নরসিংহ কলেজ থেকে বায়ো-সায়েন্সে স্নাতক। ছোট বেলা থেকেই নাচ,গান, আবৃত্তি, ছবি আঁকা, ফটোগ্রাফিতে ছিল শখ। বিবাহসূত্রে খড়্গপুরের বাসিন্দা। আঞ্চলিক...

এই বিভাগের অন্যান্য লেখাসমূহ