স্বপন রায়ের কবিতাগুচ্ছ

স্বপন রায়
কবিতা
Bengali
স্বপন রায়ের কবিতাগুচ্ছ

শুভেচ্ছা

শুধু তোমার জন্য।
শ্রাবনের বারি ধারা সিক্ত করেছে মাটি
ঢেকি শাকের জঙ্গলে পড়েছে প্রথম ভোরের ভেজা আলো;
মেটো রাস্তা মেখেছে কাদা ,
কচু ফুলে পাক ধরেছে ছড়িয়ে দিয়েছে লতা

যদি তুমি আসো।
তোমার জন্য তুলে রাখবো গুচ্ছ গুচ্ছ কদম ফুলের সমস্ত সাদা রঙ;

অথচ তুমি না এসেই চলে যাবার ভান করো।

কচি কচি আমন ধানের বীজতলায় নেমে আসা নরম সন্ধ্যা
কৃষকের কর্মঠো হাত ধরে
আমায় বলেছে; –
গ্রীষ্মের ক্ষীণকায়া তোর্ষা, আজ যৌবন গোপন বুকে রেখেছে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ ভালোবাসা

শুধু তোমার অপেক্ষায়!
তুমি এসো,বুক ধরে ডুব দেবে,

শুনবে তুমি,
ভাওয়াইয়ার উজান ভাটির সুর খেলা করে কৃষকের গলে
দেখবে তুমি,
চঞ্চলা কৃষক রমণী নরম দুহাতে কচি কচি বীজ তলা আলতো করে তোলে,

ততক্ষণে বর্ষার খাল বিল পুকুর গর্ভবতী।

সাপের মত এঁকেবেঁকে চলা বৃষ্টিস্নাত আলপথ
গোধূলির আলো পড়ে সবুজ ঘাস চিকচিক জ্বলে ,
যেন গ্রীক দেবী হেরা আগ্রার্সের চোখগুলি তুলে নিয়ে ময়ূর পুচ্ছ বসিয়ে দিয়েছে সবুজ ঘাসে।

একবার এসো,
ন্যাংটো ছেলে দলের কাদায় লুটোপুটি খেলা
তোমার বয়স দেবে কমিয়ে,
ছিপ হাতে স্কুল পালানো ছেলেটি ব্যাঙ ধরার দৃশ্যে তুমি হবে পুলকিত,
খুঁজে পাবে, তোমার ফেলে আসা শৈশব।

পাট পচা জলে সরপুটি লুকোচুরি খেলে
উৎপেতে থাকে সারি সারি বক
আর অনিমেষ চোখ।
ভালোবাসার প্রতিচ্ছবি!

আল্লাহ মেঘ দে পানি দে
তোমারি প্রতীক্ষা।
বাসি উঠোনের নরম মাটি বৃষ্টির ফোটায় ফোটায় নিংড়ে নেয় ভালবাসার স্বাদ,
আমি একগুচ্ছ তুচ্ছ কাতর সবুজ লতার মতো
আমার কাঙ্খিত ভালোবাসায় পসরা সাজিয়ে অপেক্ষা করব।

যদি তুমি আসো।

সন্ধিক্ষণ

আমি এমন এক যুগ সন্ধিক্ষণে দাঁড়িয়ে আছি,
হত্যা,অত্মহত্যা বলে চালিয়ে দেওয়া হচ্ছে
এখানে মৃতু্য প্রতিযোগিতা চলে
কার কয়টা মৃতু্য…!
অযথা বাকবিতন্ডায় জড়িয়ে পড়ি
কথা বলা বন্ধ করো,
তার চেয়ে চলো
গতরাতে নিখোঁজ ভাইকে খুঁজে বের করি।

ঐ তো সেদিন গণতন্ত্রের অধিকার স্বাধীনতার দিনে
গণতন্ত্রের ক্ষতবিক্ষত দেহ পাওয়া গেল,
রেললাইনের ধারে…
সবুজ ঘাসের উপরে লাল লাল চোখ
রক্ত শুষে নেয় দ্রুততায় সবুজ রঙ!
ভয়ে থরথর,অনবরত বেড়ে চলে নাড়ীর স্পন্দন।

সবুজ ঘাস লিকলিকিয়ে বাড়ে ,ফুল ফোটার শব্দে
পুকুরের জল সজোড়ে ঢেউ তোলে
গর্জে উঠে ভাড়া নেওয়া শিক্ষিত অশিক্ষিত বেকার।
প্রতিশ্রুতি বদ্ধ বিবেকের বিশ্বাসঘাতকতা
কোনদিনও বুঝতে চায়নি মায়ের জঠর যন্ত্রণা,
আবারও একটি মৃতু!
স্থল থেকে জলে জল থেকে স্থলে মৃত দেহ টেনে চলে
নিশ্চুপ সন্ধ্যা তারা ভয়ে ভয়ে মিটমিট জ্বলে
ছোপ ছোপ তরতাজা গরম রক্ত
একটু পরেই শুকিয়ে হবে বিবর্ণ!
মুছে যাবে স্ত্রীর সিঁদুর
অবুজ শিশু মৃত শরীর বেয়ে বেয়ে একটু চুম্বন খুঁজে ,
মায়ের চোখে রাতজাগা ভোরের শিশির অধঃক্ষেপণ।

ঐ দেখ প্রভুর চোখে মুখে সাদা অপরাজিতার মতোই হাসি খুশি।
সমস্ত শরীরে গন্ধবিহীন ফুলের সুভাষ
মৃত আত্মা ডেকে বলল…
অধমৃত আত্মাকে আমরা তো ভাই
বললঃ আমরা উভয়ই শিক্ষিত বেকার!
এদিকে এসো…
আমরা বনের বাইরের জানোয়ারের মৃতু চাই।

 

চিঠি

জানি তোর খুব কষ্ট হচ্ছে!

আজকাল ভালোবাসার কথা গুলো কেউ আর তোকে জানায় না,
গত কয়েকদিন ধরে জবলাটার জ্বর কমছে না
সামনের মাসে মেয়েটার স্কুল টেস্ট,
ওভার টেলিফোনে গতরাতে বিকানে জানিয়েছে জবলার মা,
জবলার বাপ ওখানে রাজমিস্ত্রীর যোগান দেয়,
অথচ, তুই কিচ্ছু জানতেই পারলি না;

জানি তোর খুব কষ্ট হচ্ছে!

পিয়ন কাকু’ প্রায় প্রতি সপ্তাহে তোর কুশল সংবাদ দিয়ে যেত
কাকুটা আর এখন আসে না, সাইকেলের বেল বাজানো শব্দটি আর শুনতে পাইনা-রে!
তুই বোধহয় রোগাটে হয়ে গেছিস?
ধুলো -ময়লা মেখে সবার অগোচরে একা কোণে আছিস
তোর থাকার বাইরের লাল ঘরটায় আজকাল কেউ
আর যায় না

জানি তোর খুব কষ্ট হচ্ছে!

তুই একটা সময় সবার আপন ছিলিস … তুই আসলেই জমিদার বাড়ির বড় ছেলের কাছে নিয়ে যেত,
তোর কথা নাকি বিলেত ফেরত জমিদার বাবুর বড় ছেলে ভালো বলতে পারতো
মা, ঠাম্মা, বড়দি, মেজদি, সেজদি তোর চারদিকে বসে, চুপ করে তোর কথা শুনতো,
তখন কোনদিন -কোনদিন -মা তোর কথায় কেন জানি চোখের জল ফেলতো,
মা -অবশ্য আমাদের বলতো না!

জানি তোর খুব কষ্ট হচ্ছে!

সেইদিন বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়া অমলবাবুর সুন্দরী মেয়েটা,
একমাত্র তোর জন্য পড়া শেষ না করেই বিয়ের পিড়িতে বসতে হলো,
তোর, অসাবধানতার কারণেই বাবা সব কথা জেনে ফেলেছিল,
তুই না-ছোড় বান্ধার মতোই কলেজ থেকে বিশ্ববিদ্যালয় দাপিয়ে বেড়িয়েছিস,
তারপর, পিয়ন কাকুকে কম জ্বালিয়েছিস?
আজ আর তোর খবর কেউ নেয় না!

জানি তোর খুব কষ্ট হচ্ছে।

আমি একটা তোকে কলম উপহার দিবো,
বৃদ্ধা আশ্রমে খাম বন্ধী জীবন কাহিনীর মতোই
তুই জাদু ঘরে গিয়ে নতুন করে লিখিস – কেমন!

 

শব্দ!

আপনি’ই তো সরকার
লাশ বহন করার শক্তি দিন!
কথাটি সহস্র বুলেট থেকেও কয়েক গুণ শক্তিশালী।
এতটা আবেগ এবং স্মৃতি জড়ানো -প্রতিবাদ!

মিছিল হাতে মোমবাতি পুড়ে আগুনের ছেঁকা
জ্বলে উঠুক আগুন পুড়ে যাক পিপিলিকা ,
লাভা, ভস্ম, সমতল থেকে পাহাড় ছড়িয়ে যাক… কৃত্রিম লালিত মানবিকতা।

শুকিয়ে যাওয়া জমাট বাঁধা রক্ত, আত্মার গভীরে শব্দ খুঁজে পায় ভাষা।

 

সেও বলে গেল

মাঝে মাঝে অদৃশ্য হয়ে ঢুকে পড়ি
তোমাদের ষড়যন্ত্রে;
পলাশির বিশ্বাসঘাতক কঙ্কালগুলি তখন লজ্জায়
ফিসফিস করে,
যাবার সময় আমার বিস্ফোরিত মানব আত্মা
রেখেছিলাম, গোপন অন্ধকার কুঠুরিতে

যেন,কখন জানি লখীন্দরের মৃত্যুর আগে
মনসা আমার আত্মা গিলে ফেলে;
ফিরে এসে ছুঁয়ে দেখি গোপন কুঠুরি অভিশাপে ভর্তি;
আমাকে তাড়া করে নিয়ে বেড়ায়
হূল ফোটান অজস্র স্বাধীন বোলতা,

দেশ বিক্রির দালাল আমি …
আমাকে আর সইতে পারে না আমারি দেশের মাটি,

আমার বৃত্তের বেষ্টনি স্বাধীন সংঘবদ্ধ প্রতিবাদি হাত
আমি নদীকে একটু দাঁড়াতে বলি,
সে তখন আরও ভয়ার্ত মূর্তি
আমি সূর্যের আলোগুলো ধরতে চাই,
সে তখন আমাকে পোড়াতে চায়
আমি বাতাসে ভয়ে ভয়ে কান পাতি,
সে তখন আমার উপর গরম নিঃশ্বাস ফেলে !

আমি ভোরের অপেক্ষা করি,
ভোরের সুমিষ্ট পাখিটিও কর্কশ সুরে আমাকে শাসিয়ে গেল,
দ্বাদশীর ম্লান জোছনা আমার শিয়রে মৃত্যু
… সে কথাই বলল!

স্বপন রায়। কবি। জন্ম ১৯৫৬। ভারতের দুটো ইস্পাতনগরী জামশেদপুর এবং রাউরকেলা স্বপন রায়ের অস্তিত্বের সঙ্গে জড়িয়ে আছে। প্রথমটি জন্মসূত্রে। দ্বিতীয়টি বড় হয়ে ওঠার সূত্রে। নব্বই দশকের শুরুতে 'নতুন কবিতা'র ভাবনায় সক্রিয় হয়ে ওঠেন। পুরনো, প্রতিষ্ঠিত ধারাকবিতা ত্যাগ করে কবিতাকে নানাভাবে...

এই বিভাগের অন্যান্য লেখাসমূহ

ঝরা পাতা

ঝরা পাতা

  চারিদিকে কোলাহল শূণ্যতা করেছে গ্রাস, বেদনা বিধুর অতৃপ্ত বাসনায় হাহাকার, অজান্তে নীরবতা তোমার স্পর্শে…..