প্রক্সি
তারপর ইলেকট্রিক বিল জমা দিতে যাবো। আমার দেরি হবে আসতে। স্বামী অমর বলে, ঠিক আছে।…..
গল্পের অডিওপাঠ শুনুন এখানে:
অজানা দেশের অজানা গ্রাম। গ্রামের সবাই সব সময় কিছু না কিছু কাজে ব্যস্ত। তবে তার মধ্যেও সবার হাতে অনেক সময়। কারুর বাড়ির চকোলেট গাছে গোড়ায় যদি পোকা ধরে, তাহলে সঙ্গে সঙ্গে আর একজন সেখানে কোলগেট লাগিয়ে দিয়ে আসে। বা কারুর বাড়িতে যদি কোন বাচ্চা কেঁদে ওঠে, তাহলে পাশের বাড়ির কাকিমা, সাদা ইমোজি মেঘ ঝুলিয়ে দিয়ে আসে, তার দোলনার মাথায়। বাচ্চাও হাসে, মেঘ-ও হাহা করে হেসে… তার তালে তাল মেলায়।
এই গ্রামেই থাকে একটি বাচ্চা ছেলে, তার বাবা মা-র সাথে। ছেলেটির মা, রেশম সুতো দিয়ে খুব সুন্দর করে স্বপ্ন বোনেন। আর ছেলেটির বাবা এই স্বপ্নগুলো শহরে বিক্রি করে, ছেলের জন্য ভবিষ্যৎ কিনে আনেন। ছেলেটি যখন জানতে চায় “কী ভবিষ্যৎ কিনে আনলে বাবা !!!” বাবা বলেন “ ওরে, ভবিষ্যৎ কি আর এখনই দেখা যায় রে পাগল?? তবে তোর জন্য, এক মুঠো সুগন্ধ এনেছি। ব্যাগটা খোল…গন্ধ পাবি।“ বাবার ব্যাগটা খুলে, বুক ভরে শ্বাস নেয় সে। সত্যি গন্ধটা ভারি মিষ্টি। বাবা বললেন “এই গন্ধটার নাম প্রফুল্ল গন্ধ।” সারারাত স্বপ্ন বিক্রি করে, সকালে বাড়ি ফিরে দুপুর পর্যন্ত ঘুমিয়ে দেন। তারপর খেয়ে দেয়ে ছেলের সঙ্গে খানিকক্ষণ খেলা করে, আবার সন্ধে সন্ধে নাগাদ শহরে চলে যান স্বপ্ন বিক্রি করতে। তবে শুক্রবার তিনি বাড়িতেই থাকেন। ছেলেকে তার বাবা বলেছেন যে শহরে নাকি শুক্রবার কেউ ঘুমোয় না, তাই স্বপ্ন-ও সেদিন ভালভাবে বিক্রি হয় না।
বাচ্চাটির শুধু একটাই দুঃখ। তার মা কোনদিন তাকে স্বপ্ন বুনে দেয় নি। অনেকবার বায়না করেছে ছেলে। কিন্তু মায়ের এক কথা “যে নিজে স্বপ্ন বোনে তাকে স্বপ্ন দেখাবার প্রয়োজন হয় না।“
শিল্পী: রিয়া দাস
পদক্ষেপ-১
সদ্য ভূমিষ্ঠ হওয়া বাচ্চার হাতের নরম তালুর মতো, কচি ভেজা ঘাসের স্পর্শে, পায়ের পাতাটা একটু কেঁপে গেল নন্দিনীর। এই রকম একটা জায়গার স্বপ্ন সে অনেক দিন ধরেই দেখছে। পুরনো বাড়ি কিন্তু নতুন করে সাজাতে হবে। প্রতি মুহূর্তে যেন এক অজানা কারিগরের হাতের ছোঁয়ায়, প্রকৃতি বার বার নতুন নতুন রঙে নিজেকে মিশিয়ে নিচ্ছে। বাইরে রাখা একটা বেতের চেয়ারে খানিকক্ষণ চুপচাপ বসে রইলো নন্দিনী। অজানা পাখিটা অনর্গল কথা বলেই চলেছে। এখানে আসার পথেই বৃষ্টি পেয়েছে, এখন ঝকঝকে রোদ্দুর। নন্দিনীর মনে পড়ে গেল ওর দিদিমার কথা। দিদিমা স্নান করে উঠে ঠিক এই গাছগুলোর মতো, নিজের চুল শুকানোর জন্য রোদ্দুরে দাঁড়িয়ে আবার নিজেকে ধুয়ে নিতেন। তখন দিদিমার ভেজা শরীর থেকে খুব সুন্দর একটা গন্ধ পেতো নন্দিনী। সেই গন্ধটা সে আজ পাচ্ছে। আকাশে আবার ফ্যাকাসে রঙ ধরেছে। নন্দিনী আস্তে আস্তে বাড়ির দিকে এগিয়ে গেল। স্বপ্ন ছুঁতে আর বেশি দেরী নেই।
সমুদ্রের বুকে একটা ছোট্ট দ্বীপ। বাঁশ দিয়ে বানানো ছোট্ট কুঁড়ে ঘরটা থেকে বেরিয়ে, মেয়েটা পা ছড়িয়ে বসে পড়লো একটা নারকোল গাছের তলায়। পাশে রাখা বইটা তুলে নিয়েও আবার রেখে দিল স্বর্ণময় বালির ওপরে। সামনে অসীম শূন্যতা। নিজেকেই নিজে নির্বাসন দিয়েছে সে, এই অজানা ভূখন্ডে। বেশ খানিকক্ষণ চুপচাপ বসে থাকার পরে, দিগন্তে দেখা গেলো একটা কালো রেখা। ব্যস্ত হয়ে উঠলো মেয়েটা। চোখে ধাঁধা লাগার তীব্র বাসনা ফুটে উঠল মেয়েটার চোখে। সে চায় না কেউ আসুক, সে চায় না কেউ তাকে ফিরিয়ে নিয়ে যাক, কোলাহলের রাজত্বে। সেই দিকে তাকিয়ে আরও খানিকক্ষণ বসে রইলো সে। নাহ, আর দেখা যাচ্ছে না।
এক ঝাঁক পাখি উড়ে যাচ্ছে মাথার ওপর দিয়ে। সব সাদা। মেয়েটা এবার একটু মুষড়ে পড়লো যেন। সেকি সত্যি চায় না যে কেউ তাকে খুঁজে পাক, সেকি সত্যিই সারা জীবন এই ভাবে একাকীত্বের সাথে সমঝোতা করে চলবে? কেউ কি কোনদিন তার কাছে এসে বসবে না? কিন্তু সে তো কথা দিয়েছিল যে ‘লা ন্যুই’ তারা পাশাপাশি বসে পড়বে।
বইটা হাতে নিয়েও আবার রেখে দিল স্বর্ণময় বালির ওপরে। বইয়ের ছাপ ঢাকা পড়ে গেল আরেকবার।
নন্দিনী বাড়ির ভেতরে পা রাখল, মুহূর্তের জন্য নিজেকে তার অন্ধ মনে হল তার। খানিকক্ষণ দাঁড়িয়ে চোখটা সইয়ে নেওয়ার পরে বুঝতে পারলো যে ঘরটা বহুদিন যাবৎ অসূর্যম্পশ্যা হয়ে পড়ে আছে। কালকে থেকে একজন আসবে, তার অকাজ গুলো গুছিয়ে দেওয়ার জন্য। কিন্তু আজকে সে একা। অভ্যাসবশত ডানদিকে হাত বাড়াতেই সুইচবোর্ডের নাগাল পেয়ে গেল। একে একে সব কটা আলো জ্বালিয়ে জানলাগুলো খোলার চেষ্টা করলো। কিন্তু একটা জানলা খুলতে না খুলতেই তীরের ফলার মতো বিঁধে গেল বৃষ্টির ফোটা। হাওয়ার সঙ্গে রীতিমত যুদ্ধ করে, কপাটগুলো বন্ধ করে দিল নন্দিনী।
সে একা। সাদা কাপড়ে মোড়া আসাবাবপত্রগুলো উন্মোচনের অপেক্ষায় দিন গুনছে। নববধূ পিঁড়িতে বসার আগে যে ভাবে নিজেকে মেলে দেয় তার রূপবিশারদের কাছে ঠিক সেই ভাবেই গোটা মহল শুধু সেজে ওঠার অপেক্ষায়। তারা বহুকাল ধরে অপেক্ষা করে আছে, নন্দিনীর জন্য।
নন্দিনী সাজাবে। খুব যত্ন করে নিজের মতো করে সাজাবে তার প্রথম নির্বাক বন্ধুটিকে।
একটা ঘর তার জন্যই গুছিয়ে রাখা ছিল। ঘরটা খুঁজে পেতে একটু সময় লাগলো। চারপাশের নিস্তব্ধতার শব্দতরঙ্গ, গ্রাস করে ফেলছে প্রতিটা রক্তকণিকা।
মাটিতে বসানো কাঠের প্যাকিং বাক্স আর তার সামনে একটা রীডিং ল্যাম্প। রীডিং ল্যাম্পের আলোটা কৌণিক ভাবে বাক্সের যেদিকটায় পড়েছে, সেই দিকটা উন্মুক্ত। একজন ছায়ামানুষ পা মুড়ে বসে আছে সেই বাক্সের মধ্যে। আলোকে তার ভয় তাই উল্টোদিকে বসে আঁকিবুঁকি কাটছে প্যাকিং বাক্সের গায়ে। কুসুমরঙা ভোর সমানুপাতিক হারে মিশে যায় গোধূলির ঘনচ্ছায়ায়। মানুষটি দোটানার মধ্যে সাঁতার কাটছে। শুধু কারুর ছুঁয়ে ফেলার অপেক্ষা। যেখানে যত আলো সেখানে অন্ধকারের গভীরতা ঠিক ততোটাই। অন্য দিকে তুলির চলাচলে ফুটে উঠেছে খোলা জানলা। সেখানে আলো থাকলেও তার ঘনত্ব অনেক কম।
আজ প্রায় কুড়ি বছর পরে, নন্দিনী আবার সেই নববধূর সামনে দাঁড়িয়ে। এই বাড়ি তাকে উন্নতির উচ্চশিখরে পৌছে দিয়েছে। সে ঠিক করেছে, দেশ ছেড়ে যাওয়ার আগে তার স্বপ্নের প্রথম বাস্তবরূপের সাথে মুখোমুখি হবে। বাড়ির সদস্যরা তাকে উষ্ণ অভ্যর্থনা জানালেন। আজ নন্দিনীর চুলে পাক ধরেছে কিন্তু ভেতরে ভেতরে পুনর্মিলনের শীৎকার। যে ঘরে তার থাকার ব্যবস্থা করা হয়েছিল প্রাক্কালে, সেই ঘরের চৌকাঠে মুহূর্তের জন্য দাঁড়িয়ে গেলো নন্দিনী। ভেতরে একটা ছেলের গলা। সে আস্তে আস্তে এগিয়ে গেল ঘরের ভেতরে। পশ্চিম দিকের বিশাল দেওয়ালে, তিনটে ছবি। এই ছবির টানেই ফিরে এসেছে সে। দেওয়ালের সামনে একটা হুইল চেয়ারে বসে আছে পনেরো বছরের একজন যুবক। আনমনে চেয়ে আছে ছবিগুলোর দিকে।
নন্দিনী গিয়ে দাঁড়াল ছেলেটির পাশে। পা দুটো অসম্ভব সরু। পেরিফেরাল আর্টারিয়ালে আক্রান্ত। কিন্তু এতো আবেগপ্রবন যুবক খুব কম-ই দেখা যায়। পায়ের বেড়ী, তার মনকে আটকাতে পারে নি।
কলকাকলির নন্দনবন থেকে একঝলক রোদ মেখে, কলকাতার পথে পা বাড়াল নন্দিনী। বহু যত্ন করে বিভিন্ন ছবি সাজিয়ে ছিল, প্রতিটা ঘরের দেওয়ালে, কিন্তু তার মধ্যে প্রায় এক বছর সময় নিয়ে খুঁজে বের করেছিল, এই তিনটে ছবি।
পনেরো বছরের যুবক তার সরু পায়ের ভারকেন্দ্র উপেক্ষা করে উড়ে চলছে স্বপ্ন রাজ্যে। যেখানে প্রতি রাত্রে রেশম সুতোয় বুনে স্বপ্ন বিক্রি হয়… যেখানে ছেলেটি সাগরে নৌকা ভাসায়, তার স্বপ্ন মানবীর সঙ্গে ‘লা ন্যুই’ ভাগ করে নেওয়ার জন্য। এতো কিছুর পরেও নিঃশব্দে, একা, সে তার বন্ধ মনের কোনায় যে জানলা আঁকে তার ঔজ্বল্য কম হলেও নন্দিনীর ছোঁয়ায়, সে মুখ ফেরানোর চেষ্টা করছে রীডিং ল্যাম্পটার দিকে। নন্দিনীর স্বপ্ন তাকেও নতুন স্বপ্ন দিয়েছে।
নন্দিনীও কি তার একাকীযাপনের সঙ্গী, ‘ন হন্যতে’-র প্রেমিককে বাস্তবে ছুঁতে পারবে? ‘লা ন্যুই’-র উত্তর কি ছেলেটি কোনদিন পাবে?
স্বপ্নঘোরের দোলাচলে সেই জাহাজটি আজও তার কিনারা খুঁজে পায় নি।
তারপর ইলেকট্রিক বিল জমা দিতে যাবো। আমার দেরি হবে আসতে। স্বামী অমর বলে, ঠিক আছে।…..
নভেম্বর চলছে। অনির সাথে আজ দেখা হবে তা জানাই ছিল। এই তো ক’দিন আগেই দেখা…..
বুড়িমাসি বলেন,জীবনটা বালির ঘর গো।ঢেউ এলে ধুয়ে যায় জীবনের মায়া।তবু বড় ভালবাসা ওদের দাম্পত্যে।রোদের চাদরের…..
এক ড্রইং রুমে বসে রয়েছে সদ্য কিশোর উত্তীর্ণ তরুণ গোয়েন্দা সজীব। সামনের টেবিলে ছড়িয়ে…..