ইমন কল্যাণ
পরিচ্ছেদ ৬ অনেক রাতে ফিরেছিল কল্যাণ ওরফে শহীদুল।গাড়িটা শেডে রাখার পর দু’বার হালকা করে মা…..
যা হবার তাই হল। নিলয় আর আমার প্রাণবন্ত পার্টনারশিপ আর শুভ্রর মীরজাফরিতে বাজিটা আমরাই জিতলাম। মিস্টার আলম আমাদের চালাকির কতটা ধরতে পেরেছে কিংবা আদৌ কিছু বুঝতে পারল কিনা—বোঝা গেল না। তবে হেরে যাবার আগ পর্যন্ত সে মনোবল ধরে রাখার আপ্রাণ চেষ্টা করেছে। তার ভাষায়—মনোবলই তাস খেলার মূলমন্ত্র। মনোবল চাঙ্গা থাকলে হাতে কার্ডও আসে ভালো, ফর্মও থাকে চাঙ্গা। তবে হেরে যাবার আগমুহূর্তে এসে এটা সেটা নিয়ে তার বাগবিতণ্ডার ধরন থেকে বোঝা যাচ্ছিলো যে মনোবল আর চাঙ্গা রাখতে পারছে না।
খেলা শেষ হতে হতে বিকাল গড়িয়ে সন্ধ্যা হয়ে আসে।
কী একটা কাজ নিয়ে দুলাভাই বেরিয়ে গেছে। বাইরে গিয়ে একটু ঠান্ডা মাথায় ভাবলে আমাদের চালাকিটা ধরা পড়ে যেতে পারে। অবশ্য ওটা নিয়ে আমাদের তেমন কোন মাথাব্যথা নেই।
বাজিজেতা টাকাটা ভাগবাটোয়ারা করতে গিয়ে একটু সমস্যা তৈরি হয়। জনপ্রতি ছয়শ করে নিলে বাকি থাকে আরও দুইশ টাকা—সেটা নিয়ে মুসিবত।
শুভ্র বলে, দ্যাখ—এই বাজি জেতার জন্য আমি দুলাভাইয়ের সাথে গাদ্দারি করলাম। কাজেই তোরা এই দুইশ টাকার দাবি না রেখে আমাকে দিয়ে দে।
নিলয় জবাব দেয়, এমন ভাব নিচ্ছিস যেন সে তোর মায়ের পেটের বোনের জামাই!
মাম্মা, তাতে কী হয়েছে? বোন-জামাই তো!
আমি বললাম, রাখ তোর বোন-জামাই। আমরা যে রিস্ক নিয়ে খেললাম। বাজি হেরে গেলে জনপ্রতি এক হাজার করে গচ্চা যেত! তোর তো এক পয়সারও রিস্ক ছিল না। তাই অসম বন্টন যদি হয় তবে একশ-একশ করে দুইশ আমাদের পাওনা।
কিছুক্ষণের বাদানুবাদে স্পষ্ট হল—ওই দুইশ টাকার ভাগে কেউ ছাড় দেবে না। শেষতক নিলয়ের প্রস্তাবে সবাই একমত হলাম। সিদ্ধান্ত হল রেস্টুরেন্টে খাওয়া-দাওয়া হবে। যদি দুইশ টাকা বাজেটে না কুলায় তবে তিন জনের পকেট থেকে সমহারে আরও কিছু যোগ করা হবে।
যেকোন উপলক্ষে আমাদের খাওয়ার আড্ডা মানেই রসনা বিলাস। কোন উপলক্ষ না থাকলেও অন্তত মাসের শেষ বৃহস্পতিবার রাতের খাবারটা সরব আড্ডার মাধ্যমে বেশিরভাগ ওখানেই খাই। পালাক্রমে একেকজনকে বিল দিতে হয়। আজকের বিল হবে বাজির টাকা হতে।
শেষ বিকেলে এসে বৃষ্টিটা থামল। আকাশ পরিষ্কার। চারপাশটা আলো-ঝলমলে। কোথাও হয়তো রংধনু উঠেছে। আকাশ দেখতে গিয়ে নীলা আপুর গলা শুনতে পেলাম। দোতলার বারান্দা থেকে হাত নেড়ে নেড়ে ডাকছে, এই—রাইম! কখন আসলে?
অনেকক্ষণ। সেই দুপুর বেলায়।
অনেকদিন দেখি না যে?
আসা হয় না। একটু ব্যস্ততা আর কুড়েমির মধ্যে দিন যাচ্ছে।
কুড়েমি কেন? বারিশ? বলে সে হাতটা গ্রিলের ফাঁক দিয়ে বের করে উঁচিয়ে ধরে।
কথা বলতে গিয়ে ঘাড়টাকে উপরের দিকে বাঁকিয়ে রাখতে হচ্ছে। অভ্যাসবশত বাম হাতের আঙ্গুলগুলো ঘাড়ের উপরে চুলের ভেতর আর ডান হাত জিন্স পকেটে। নীলা আপু মিষ্টি করে হাসছে। খাটো করে চিকন এই আপুটাকে মনে হয় যেন সজীবতায় ভরে থাকা এক প্রাণোচ্ছল তরুলতা। আমিও একটু মিষ্টি হাসি বিনিময় করে জবাব দিলাম, হ্যাঁ।
কী নীলা আপু—মনে হয় রাইমকে ছাড়া আর কাউকে দেখতে পাচ্ছেন না? এই যে, আমরাও আছি এখানে! বলে শুভ্র হাত নাড়ায়।
যা সর—তোদের দেখতে দেখতে বোর হয়ে গেলাম!
ছি আপু! এভাবে বোল্ড করে দিলেন? বলে সে কোমর বাঁকিয়ে—হাতে মুখ ঢেকে—পিছন ঘুরে চেহারা লুকানোর ভান করে।
শুভ্রর কাণ্ড দেখে নীলা আপু আবার হাসে। এবার সবাইকে লক্ষ্য করে ডাকে, এই—উপরে আসো না! বৃষ্টির দিনে সবাই মিলে জমিয়ে আড্ডা দেওয়া যাবে।
নিলয় বলে, না আপু। আমরা একটু বাইরে বেরুচ্ছি। আপনিও আসতে পারেন। একটু খানা-দানা হবে।
তাই?
হ্যাঁ। সাথে রাইমের গাড়িও আছে। মজা করে ঘোরা যাবে।
কোথায় যাবি?
এ-ই-ই ঘরোয়ায় খিচুরি কিংবা রসনায় নান-কাবাব চাখতে।
ইশ। তাহলে তো সত্যিই কিছু মিস করছি!
শুভ্র বলে, মিস করবেন কেন? চলেন আমাদের সাথে।
না ভাই। একটু পরে হাসি আসবে, তাই তোদের সাথে যেতে পারছি না।
হাসি আপু নীলা আপুর বান্ধবী। দিন নাই রাত নাই টিএন্ডটি ফোনে দুইজন সারাক্ষণ গল্প করে। তাও আবার হিন্দিতে। যদিও নীলা আপু ইংরেজিতে অনার্স করছে—হিন্দির প্রতি তার ঝোঁক বেশি। অনার্সটা যদি হিন্দিতে করা যেতো তবে বোধহয় সে আর ইংরেজিতে করতে যেতো না।
শুভ্র-নিলয়দের সাথে আপু আড্ডায় বা ঘোরাঘুরি করে সময় কাটাতে খুব উপভোগ করে। বিভিন্ন অনুষ্ঠানে ঘোরাঘুরি মুভি এমপিথ্রি গান আদান-প্রদান দাবা-লুডু-তাসখেলা সবকিছুতেই নীলা আপুর সরব উপস্থিতি। মাঝে মধ্যে আমিও যোগ দিই। আপুর সাথে চুটিয়ে আড্ডা দিতে দারুণ লাগে! হাসি আপুর আসার কথা না থাকলে যে নীলা আপু আমাদের সাথে যেতো তা মোটামুটি নিশ্চিত করেই বলা যায়।
গাড়ি চালু করতেই শুভ্র ব্যস্ত হয়ে বলে, এ-ই-ই রাখ রাখ। সিগেরেট ফেলে এসেছি।
আমি বললাম, পকেটে এক প্যাকেট বাংলাফাইভ আছে। চলবে না?
খুব চলবে। ছাড় তাহলে।
গাড়ি চলতেই নিলয় বলে, আগে নিউমার্কেট যা।
জানতে চাইলাম, নিউমার্কেটে কী?
কিছু সিডি কিনব।
গাড়ির গতি বাড়াতেই শুভ্র চেঁচিয়ে বলে, আরে মামা একটু আস্তে চালা। খোদা চোখ দিয়েছেন দেখার জন্য। আশে পাশে কত রঙবাহারি সিন! ওগুলো একটু দেখার চানস দে।
গতি আরও বাড়িয়ে দিয়ে বললাম, দিনে তোর কত মেয়ে দেখা লাগে রে শালা? কলেজে সারাদিন মেয়েদের পেছনে ঘুরঘুর করিস, নীলা আপুর সাথেও ফিল্ডিং কম মারিস না। তারপরও একটু শান্ত থাকতে পারিস না?
পেছনের সিট থেকে নিলয় ইয়ার্কি করে বলে, তাতে কি আর শান্ত হওয়া যায়! বরং মনের জ্বালা আরও বাড়ে।
শুভ্র বলে, আমার বেলায় এমন হিংসুটেমি করিস কেন রে? তোরা কি কম যাস নাকি?
কিছুদুর যাওয়ার পর সে আবারও চেঁচায়। তর্জনী উঁচিয়ে দেখায়, ঐ শালার পাপিষ্ঠ ম্যানহোল। তারপর অভিযোগের গলায় বলে, একে তো বৃষ্টির পানিতে ডুবে ছিল—তার উপর নেই ঢাকনা। বোঝার কী উপায় আছে বল?
নিলয় ব্যঙ্গ করে বলে, না মামা। খোদা তোকে চোখ দিয়েছে শুধু মেয়েমানুষ দেখার জন্য, বাসার পাশে খোলা ম্যানহোলটা দেখতে না।
সিগারেট ধরানোর জন্য সাথে লাইটার-দিয়াশলাই কিছু আনা হয়নি। ফুটপাতের একটা চা দোকানের সামনে গাড়ি থামিয়ে দিয়াশলাই কেনা হল। পল্টন মোড় হয়ে হাইকোর্টের বামের রাস্তা দিয়ে ঢাকা ভার্সিটি জোনে ঢুকে টিএসসিতে এসে ব্রেক কষলাম। সাঁঝের পর এখানটায় প্রতিদিন আড্ডা জমে। আজো তরুণ-তরুণীদের জমজমাট ভিড়। এই জটলায় শরিক হয়ে একটু কফি খাওয়া যাক।
কফি মুখে দিয়েই শুভ্র মুখ বিকৃত করে, উমম.. রাবিশ!
একদমই যাচ্ছেতাই কফি। টাকাটাই জলে গেল। মুখটা তেতো হয়ে গেছে। এর চেয়ে কফিক্যান্ডি কিনে খেলেও ভালো টেস্ট পাওয়া যেত। শুভ্র বলে, সেলসম্যানকে দুই কথা শুনিয়ে আসব নাকি মামা?
নিলয় ওকে থামায়, যাহ! অযথা গ্যাঞ্জাম বাঁধিয়ে লাভ নেই। তার চেয়ে বরং দুই টাকার বাদাম চিবা—তেতো ভাব কেটে যাবে।
চত্বরের গাছগুলোর নিচে ঘাসের উপর বসার জন্য বাঁধানো ইটের দেয়ালের উপর উঁচু ফুটপাতের কিনারা ঘেঁষে জাতির ভবিষ্যতেরা যে যার মতো আড্ডায় মেতে আছে। তবে এই মুহূর্তে এখানকার কেউ জাতিকে উদ্ধারের চিন্তায় ব্যস্ত নয়—বরং নিজেদেরকে কর্মব্যস্ততার ছকেবাঁধা জীবন থেকে উদ্ধার করতেই বিভোর। কারো আড্ডা সরব মুখরিত—আবার কারোরটা নীরব অনুভূতিসর্বস্ব। কেউ কেউ আবার গলা ছেড়ে গান ধরেছে। সাদামাটা একগুঁয়ে জীবনের মধ্যে ক্ষণিকের জন্য উপভোগ্য এই রসদই যেন লম্বা রেসের জীবন চলার জন্য উপজীব্য হয়ে থাকে।
এই মহামিলনমেলায় নিজেদের শামিল করতে পেরে দারুণ লাগছে। যেন ব্যস্ত ঢাকার বুকে এক অন্য অনুভূতির আসর। দীপ্তিমান আকাশ থেকে ধীরে ধীরে আঁধারের চাদর নেমে এসে পরিবেশটাকে আরও মাতিয়ে তুলে। অল্পকিছুক্ষণের মধ্যেই আঁধার ঠেলে ধনুকের মতো বাঁকা চাঁদ উঠেছে আকাশে। তবে সেদিকে তাকিয়ে খেয়াল না করলে কারো দৃষ্টিগোচর হবার সম্ভাবনা কম। রঙবেরঙের নিয়ন বাতিতে আলোকিত চারপাশটায় আলো আঁধারের এক মুগ্ধ খেলা চলছে। কোথাও এক চিলতে আলো—কোথাও এক ফালি অন্ধকার। মাঝে মধ্যে গাড়ির জাজ্বল্যমান হেডলাইটগুলো এসে আলো আঁধারের এই খেলাকে আলোড়িত করে যাচ্ছে।
ধীরে ধীরে জায়গাটা আরও জনাকীর্ণ হতে থাকে। লোকের সাথে সাথে ফকিরের সংখ্যাও বাড়তে থাকে। ফকির বলতে আট-দশ বছরের মেয়ের সংখ্যাই বেশি। এই পরিবেশে মশা বাদে ওরাই পীড়াদায়ক কোন উপকরণ যাদের যন্ত্রণায় অতিষ্ঠ হয়ে উঠতে হল।
নীলক্ষেতের সামনের রাস্তাটা পার হয়ে মিরপুর রোডে মোড় নিয়ে ঢুকতেই শুভ্র ইশারা করে বলে, লুক।
ওকে অনুসরণ করে দেখি দুই নম্বর গেটের কাছে মোনালিসা তার খালার সাথে দাঁড়িয়ে আছে। পেছনের সিট থেকে নিলয় ইয়ার্কি মারে, শালার দেখি শকুনের চোখ—এই ভিড়ের মাঝেও ঠিকই খুঁজে বের করে ফেলেছে!
আজ মার্কেটে অতটা ভিড় নেই। অন্য যেকোন স্বাভাবিক দিনের কথা ধরলে রাস্তার পাশে একগাদা সারিবদ্ধ গাড়ি দাঁড়িয়ে থাকত, বৃষ্টির কারণে আজ তাও নেই। না দেখার ভান করে মোনালিসার সামনে দিয়ে ধীর গতিতে যাওয়ার সময় সে হাত নেড়ে চেঁচিয়ে ডাকে, এই—এই রাইম!
দরজার কালো গ্লাস ওঠানো থাকায় ভেবেছিলাম হয়তো দেখতে পাবে না। ঠিকই দেখল। গাড়ি থামালে কাছে এসে জিজ্ঞেস করে, তোমরা কোথায় যাচ্ছ?
প্রশ্নটা করে সে পেছনের সিটে বসা নিলয়ের দিকে অর্ধেক-নজর তাকিয়ে দৃষ্টি ঘুরিয়ে আবার আমাদের দিকে নিবদ্ধ করল। উৎসাহদীপ্ত মোনালিসার চাঞ্চল্যতা যেন মুহূর্তেই উবে গেছে। কিছুটা বিব্রতও হলো।
স্পষ্টতই প্রশ্নটা কেবল শুভ্র আর আমার উদ্দেশ্যে করা। ভাবতে অবাক লাগে—পেছনের সিটে বসা ছেলেটা তার কাছে এতোই অবজ্ঞার পাত্র! ভালো না লাগলে কাউকে প্রত্যাখ্যান করাই যায়। নিলয় কি এতটাই অযোগ্য ছেলে যে সে মোনালিসার কাছে ভালোবাসা দাবি করে মহা অন্যায় করে ফেলেছে? না হয় হলোই সে বিশেষ কেউ—তবু নিলয়ই বা তারচে কম কীসে? এটা তার কেমন অহংকার!
সামনের সিট থেকে শুভ্র মোনালিসার প্রশ্নের জবাবে বলে, এমনিতেই ঘুরতে বের হলাম। আর এদিকটাতে এলাম তোমার সাথে দেখা করতে।
কী করে জানলে যে এখানে আসলেই আমাকে পাওয়া যাবে? ফাও বুলির আর জায়গা পাও না—না!
তোমার খবর আমরা জানব না—তো কে জানবে?
আহা রে!
আমি বললাম, কেন এসেছিলে? খুব মার্কেটিং করেছ মনে হয়?
মোনালিসা ঠোঁট উল্টিয়ে বৃদ্ধাঙ্গুলি ঘুরিয়ে বলে, কচু করেছি। মানুষের ভিড়ে এখানে হাঁটাচলা করা যায়?
ইয়ার্কি করে বলি, সাথে করে গার্ড নিয়ে বেরুলেই পার।
এমনিতেই ভাই ছা-পোষা মানুষ। আবার গার্ড পাব কোথায়?
এমন নওজোয়ান বন্ধুরা থাকতে গার্ডের অভাব হয়?
পাশ থেকে খালা মুচকি হেসে বলে, কেমন বন্ধু তোমরা? এত করে বললাম—একদিনও বাসায় আসলে না।
এমনি এমনিই এসে যাব? একদিন দাওয়াত করেই দেখেন না আসি কি না আসি।
নিলয় আর শুভ্র ইতিমধ্যে গাড়ি থেকে নেমে দাঁড়ায়। নিলয় বলে, রাইম—তুই থাক। আমরা আসছি।
দুইজনে সিঁড়ি বেয়ে ফুট-ওভারব্রিজে উঠে যায়। গাড়ি থেকে নামতে নামতে চেঁচিয়ে বললাম, তাড়াতাড়ি আসবি। দেরি হলে কিন্তু টাকা-পয়সা নিয়ে কেটে পড়ব।
খালা না থাকলে এখানে মোনালিসা আর আমি কিছুক্ষণ একাকী থাকতাম। বেশ হতো! কলেজে বেশিরভাগই আমাদের দুজনের সঙ্গে উপস্থিত থাকে শুভ্র। কালেভদ্রে শুভ্র যদি নাও থাকে তখনো আশেপাশে অনেক চেনামুখ থাকে। খালা না থাকলে আজ এখানে একেবারে অপরিচিত জনসমুদ্্ের আমরা দুজন একাকী হয়ে যেতাম। দুজনের একাকীত্ব—ব্যাপারটা ভাবতেই দারুণ লাগে!
খালার উপস্থিতিতে আমাদের দুজনের কী কথা হতে পারে ভেবে পাচ্ছিলাম না। মোনালিসাকে জিজ্ঞেস করলাম, আচ্ছা—আমাদের দেখতে পেলে কী করে?
বাহ! বা—হ! তোমাদের এই কফি কালারের গাড়িটাকে কি এত সহজে ভুলতে পারি! কলেজের নবীনবরণের দিন গাড়িটা কীভাবে আমার জামা নোংরা করেছিল—ভুলে গেছ? বলে মোনালিসা অ্যাঁ—অ্যাঁ শব্দ করে একটু ন্যাকামি করে। আটপৌরে গাম্ভীর্যতা কাটিয়ে তাকে বেশ প্রাণোচ্ছল লাগছে। ন্যাকামিটাও মানিয়েছে। সে যা করে তাতেই ওকে মানায়—শুধু নিলয়কে এড়িয়ে চলার ব্যাপারটা ছাড়া।
ছোট করে একটু হাসলাম। আমাদের কলেজে নবীনবরণ হয় কিছুদিন ক্লাশ চলার পর। অর্থাৎ নবীনদেরকে আংশিক প্রবীণ বানিয়ে তারপর বরণ করা হয়—আজব নবীনবরণ! তখনো মোনালিসার সাথে বন্ধুত্ব হয়নি, কেবল মুখচেনাচেনি। কোন ছেলের সাথে সে কথা বলে না—চেহারায় অকারণ গাম্ভীর্যতা ধরে রাখে। গাড়িটা যখন তার জামায় কাদা ছিটালো, মনে হল রাগে সে ফেটেই পড়বে। মা গাড়ি থামিয়ে বিনীতভাবে ওর কাছে দুঃখ প্রকাশ করেছিল, ড্রাইভারকেও শাসিয়েছিল। সে একটা কথাও বলেনি। আমার দিকে একবার আড় চোখে তাকিয়ে চুপচাপ ওখান থেকে সরে গিয়েছিল। এর কিছুক্ষণ পর মায়ের সাথে ওর ভাব হয়ে গেল। সে-কী ভাব! ছেলেবুড়ো যে কারো সাথে বন্ধুত্ব জুড়তে মা বেজায় পটু। সেদিন মা অনেকক্ষণ যাবত ওর সাথে বকবক করেছিল। আমারও ওর সাথে প্রথম বারের মতো আলাপ হয়।
মোনালিসার প্রশ্নের জবাবে বললাম, আমি তো ভুলিনি। তুমিই ভুলে গেছ—মাকে সেদিন কথা দিয়েছিলে আমাদের বাসায় বেড়াতে যাবে।
ভুলিনি। সত্যিই একদিন যাব।
সেই একদিনটা কবে?
তা বলতে পারব না। তবে দেখে নিও—ঠিক যাব।
কথার মাঝে জাহাঙ্গীর আলমের ফোন আসে। সকালে নিলয় এই নম্বর থেকেই ফোন করেছিল। একপাশে সরে গিয়ে রিসিভ করলাম, হ্যালো—দুলাভাই!
হ্যাঁ—তোমরা কোথায়?
নিউমার্কেট।
আমি এখন মেসে। তাড়াতাড়ি আস।
সে-কী? আপনি না কী কাজে বের হলেন?
হুম, কাজ শেষ। তোমাদের সারপ্রাইজও রেডি। জলদি চলে এসো।
মোনালিসাদের চলে যাওয়ার পর শুভ্র ও নিলয়ের জন্য বেশ কিছুক্ষণ অপেক্ষা করতে হল। মার্কেটের ভেতর খুব আঁটসাঁট জামা পরিহিত মাথানষ্ট সুন্দরী এক মেয়েকে দেখেছে শুভ্র, এসেই উৎফুল্ল মনে তারই প্রলুব্ধ বর্ণনা দিলো কতক্ষণ।
শুভ্রর ধারাবিবরণী শেষে বললাম, দুলাভাই ফোন করেছিল। আমাদের জন্য সারপ্রাইজ নিয়ে অপেক্ষা করছে।
শুভ্র আরেকটু উত্তেজিত হয়ে বলে, ইয়েস, মালের আসরটা তাহলে আজকেই হচ্ছে? দারুণ জমবে!
মানে?
গুরু—খাসা মাল। স্পিন—অফ।
শুভ্রর উত্তেজনা আমার মাঝেও ভর করে। সত্যিই জমবে! দারুণ হবে! দুরন্ত আঠার ডিঙ্গিয়ে যাচ্ছি, সিক্তবসনা কোন ষোড়শীকে বুকে জড়াতে পারলেও এজীবনে এখনো মাতাল হওয়ার স্বাদ পাইনি। আজ তাও পেতে যচ্ছি! হঠাৎ করে জীবনটার কী যে হয়ে গেল! যত নিষিদ্ধ চাওয়াগুলো সব কেমন হুড়মুড়িয়ে পেতে বসেছি। এই বয়সটাই কি এমন বাঁধভাঙ্গা জোয়ারে নিষিদ্ধসব পাওয়ায় জীবনটা সাজিয়ে নেওয়ার—চাওয়া পাওয়া সব একসূত্রে গেঁথে জীবনকে রাঙিয়ে তোলার!
চোখ কপালে তুলে বললাম, সারপ্রাইজ তাহলে তোদের আগে থেকেই জানা!
আমার কথার জবাব না দিয়ে শুভ্র বলে, জাহাঙ্গীর আলম পুরা বোতল এনেছে?
বলেনি ত! পুরা এক বোতল খাবি!
একথারও কোন জবাব না দিয়ে বলে, কাঁটাবন থেকে দুয়েক পুরিয়া গাঁজা নিয়ে নেবো?
এবার নিলয় মুখ খুলল, না মামা—আজকে অন্তত আমার খাতিরে এটা নিস না। এই জিনিসটাতে আমার ভীষণ এলার্জি।
একটু থেমে বিনীতভাবে বলে, দ্যাখ—মাতালের আচরণকে আমি বড্ড ভয় পাই। দয়া করে মাতলামি করে কোন অঘটন না ঘটালেই খুশি থাকব।
হাবভাবে মনে হচ্ছে আসরের ব্যাপারটাকে সে ঠিকভাবে নিচ্ছে না।
স্প্রাইটসমেত শিককাবাব দিয়ে নানরুটি সাবাড় করে রসনা থেকে বের হতেই ইকবাল ভাইকে দেখতে পেলাম। আসতে বলেছিলাম—বেশ তাড়াতাড়িই এসেছে। গাড়ির চাবিটা দিয়ে বললাম, মাকে বলবেন বাসায় ফিরতে দশটা—সাড়েদশটা বাজবে।
ড্রাইভার যেতে না যেতেই নিলয় প্রশ্ন করে, ড্রিংক করে মায়ের নাকেরডগা দিয়ে বাসায় ফিরবি! পাগল নাকি?
মাতালামি করব সেটা ঠিক আছে—তাই বলে কি ভাববি পাগলামিও করব? গাড়ি পাঠিয়ে দিলাম কীসের জন্য—বুঝিসনি? রাতে বাসায় ফেরার কোন ইচ্ছাই নেই আমার।
রাত এগারটা বাজে। এখনো আসর শুরু হয়নি। মেসে আসার পর থেকে এতোক্ষণ যাবত তাসখেলা চলছে। সময় যেন ফুরায় না! এই ধরনের আসর নাকি গভীররাত ছাড়া জমে না—তাই কালক্ষেপণ করতে তাসখেলা চলছে। এর ভিতরেই মদের আড্ডায় নবাগত হিসাবে আমাকে তালিম দেওয়া হচ্ছে। তালিমের নমুনা দেখে মনে হচ্ছে সবকিছুতেই ওরা বাড়িয়ে বাড়িয়ে বলছে। অনেকদিন ধরে শুভ্র ও নিলয়কে জালাচ্ছি, কবে একটা হার্ডড্রিংকসের আসর হবে—আজ তবে সেই দিন এসে গেছে! কিছুক্ষণ পরেই নিজেকে দিয়ে এক্সপেরিমেন্ট করার সুযোগ পাব—কী করে একটা মানুষ নিজের মধ্যে থেকেও আত্মনিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যায়!
দরজা-জানালা সব বন্ধ করে দিয়ে একে একে সব আলো নিভানো হল। কেবল নীল রঙের একটা জিরো পাওয়ারের বাতি রুমের ভেতর আবছা আলো ছড়াচ্ছে। সকলের মাঝে চাপা রোমাঞ্চময় ঘোর আর এই আলোকিত আবহ মনে বিশ্বাস ধরিয়েছে—সত্যিই আজ অন্যরকম একটা কিছু ঘটতে যাচ্ছে। এই মুহূর্তে আমার মধ্যে প্রস্তুতি চলছে সেই অন্যরকম কিছুটাকে আমাতে বরণ করে নেওয়ার। শুভ্র বলল, বাহ! সিচ্যুয়েশনটা বেশ ভালোই জমেছে। যেন আমরা হোটেল গোল্ডেন ড্রাগনে!
মগবাজার দিয়ে ওদের মেসে আসতে গোল্ডেন ড্রাগন বারটা পথে পড়ে। শুভ্র দুয়েকবার গিয়েছে। আমি কখনো কোন বারে যাইনি। এখনকার এই আবহ থেকে বারের পরিবেশটা কল্পনা করে নিচ্ছি আর আসর সাজাতে শুভ্রর মনোনিবিষ্ট শিল্পকর্ম দেখছি। চানাচুর বাদাম চিকেনফ্রাই—একে একে সব সাজিয়েছে। আসরের মধ্যমণি লালচে রঙের পিনট নয়ার-এর বোতলটিকে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখা হচ্ছে। সাড়ে বারো শতাংশ ঘনমাত্রার ভিনটেজ। অস্ট্রেলিয়ার মাউন্ট লাঙ্গি ঘিরানের স্পিন-অফ ওয়াইন। ছিপি খুলতে গিয়ে বোতলটা হাতে নিয়ে সকাতরে জড়িয়ে ধরে শুভ্র ওটাকে চুমু খায়।
চারটা গ্লাসে প্রথমে দুই পেগ করে ওয়াইন ঢালা হল। অ্যালকোহলের তীব্র গন্ধ ভেসে এসে নাকে ধাক্কা দেয়। ল্যাবরেটরিতে অ্যালকোহল নিয়ে পরীক্ষানিরীক্ষা করতে গিয়ে গন্ধটার সাথে আগেই পরিচিত। এই মুহূর্তে আমার পৃথিবী অ্যালকোহলের গন্ধে মাতোয়ারা। দুলাভাই বলে, একদম র’ না দিয়ে একটু কোক মিক্সড করে দাও।
শুভ্র তাই করল। সমপরিমাণ কোক ঢেলে মিশ্রিত তরলের উচ্চতা গ্লাসের প্রায় অর্ধেক বানিয়ে ফেলে। কাক্সিক্ষত পানীয়ের জন্য সবাই সাগ্রহে প্রতীক্ষা করছে। দুলাভাই কোক ছাড়াই নিলো।
হাতে হাতে একটি করে স্বপ্নের গ্লাস। গ্লাসে গ্লাস ঠুকে সবাই সমস্বরে বলি, চিয়ার্স!
প্রথম চুমুকেই অ্যালকোহলের উৎকট গন্ধটা আরও তীব্র হয়ে নাকে ঠেকে। তরলটা গিলে পাকস্থলিতে চালান দিতে গিয়ে অস্বস্তিতে মুখটা বিকৃত হয়। জিহ্বায় কী বিশ্রী একটা তেতো স্বাদ লেগে আছে!
শুভ্র বলে, আজকে খাওয়ার পর রাইমের তাণ্ডবলীলা দেখব।
চেয়ে দেখলাম সবার উৎসুক দৃষ্টি আমার উপর। অভিষিক্ত হিসাবে প্রথম চুমুকের প্রতিক্রিয়া দেখছে। আমি বললাম, অই—তোরা এমন করে কী দেখছিস? আমাকে কি খালি গায়ের মাগি পেয়েছিস?
দুলাভাই বলে, ওহ নো। তুমি দেখি খাওয়ার আগেই খিস্তি শুরু করেছ। আচ্ছা যাক। কেমন লাগল বল।
তি-তা-হ! গলায় কেমন যেন একটু গরম গরম ঠেকলো।
দুলাভাই আপত্তি করে মাথা ঝাঁকাল, আরে না—না। আমি জানতে চাইলাম মদের গ্লাসে তোমার প্রথম চুমুকের অনুভুতি কী?
ঠিক বুঝতে পারলাম না মিস্টার আলম আসলে কোন অনুভূতি জানতে চাইছে। তবে এই মুহূর্তে নিজেকে নবাগত অপটুদের মতো কম সমঝদার বোঝাতে চাইছি না। তাই কোন প্রশ্ন না করে জবাব দিলাম, মাত্র তো এক ঢোক খেলাম। এখনই কী আবার অনুভূতি?
আমার বলার ভঙ্গিমায় উচ্ছ¡সিত হয়ে দুলাভাই পরিবেশকে আরও উস্কিয়ে দিয়ে বলে, শাবাশ শালা! তুমি দেখি আমার গুরু। ওয়েলকাম টু দ্য ড্রাংকার্স ওয়ার্ল্ড। এই নাও আমার তরফ থেকে তোমার জন্য। বলেই কয়েক ফোঁটা মহামূল্যবান ওয়াইন নিজের গ্লাস থেকে আমার গ্লাসে ঢেলে দেয়।
শুভ্র প্রতিবাদ করে, এটা কিন্তু ঠিক হল না গুরু। শুরুতেই ওকে পাস করে দিলেন। রুল ইজ রুল—সবাইকে সমান টানতে হবে।
খেয়াল করলাম, আসর শুরু হবার পর থেকে সম্বোধন করতে সবাই একটা শব্দ বারবার ব্যবহার করছে—গুরু। পরম তৃপ্তিতে একেকজনের ‘গুরু’ বলার ভঙ্গি দেখে মনে হচ্ছে—এই ডাকের মধ্যে জড়িয়ে রয়েছে কতো হৃদয়নিঃসৃত টান! ‘গুরু’ ছাড়া এতো গভীর আবেগ আর কোন সম্বোধনেও কি সম্ভব!
সতর্কতার সাথে সবার প্রতিটা হাসি প্রতিটা ঠাট্টা খেয়াল করছি। সবার মধ্যে আমিও একজন। খেয়াল রাখছি আমি কিংবা এই ঘরের কেউ ঠিক কোন মুহূর্তে মাতলামির শুরুটা করে। কেউ তার নিজস্ব নিয়ন্ত্রণ হতে কীভাবে বেরিয়ে আসে। একইসাথে সবার সঙ্গে তাল মিলিয়ে ফুর্তিবাজি চালিয়ে যাচ্ছি।
সময়ের সাথে পাল্লা দিয়ে আমোদ-প্রমোদ ও উদযাপনের মাত্রা কয়েকগুণ বেড়ে গেলো। এরই মধ্যে শুভ্র এবং নিলয় কী একটা বিষয় নিয়ে বেশ তর্কাতর্কি জুড়ে দিলো। ওদের কথাগুলো বেশ দুর্বোধ্য লাগছে। এমনকি তাদের তর্কের শুরুটা ঠিক কোত্থেকে হয়েছে—তাও ধরতে পারিনি। যেন পুরোনো কোন আসরের অসমাপ্ত তর্কের রেশ ধরে এই খোঁচাখুঁচি চলছে। তাদের হাসির ধরনে মনে হচ্ছে একজন আরেকজনকে খোঁচা মেরে সাংঘাতিক মজা পাচ্ছে। দুলাভাই ওদের দিকে ইশারা করে আমাকে বলে, গুরু—ধরেছে… ধরেছে..।
দুলাভাইয়ের কথায় ওরা তর্ক ফেলে একযোগে হাসতে থাকে। আমিও তাদের সঙ্গে যোগ দিলাম। এই হাসি আর থামতে চায় না। নিলয় কোনমতে হাসি সামলিয়ে আমাকে জিজ্ঞাসা করে, গুরু—তোরে ধরে নাই?
কই! তেমন কিছু তো মনে হচ্ছে না। আরও খেতে হবে।
সবাই আবার হাসে। নিলয় আমার চোখের দিকে ইঙ্গিত করে শুভ্রকে বলে, গুরু দ্যাখ—দ্যাখ। কেমন লাল হয়েছে! তাও ভাব মারে, কই—তেমন কিছু তো মনে হচ্ছে না! আরও খেতে হবে। বলে সে খাসা মাতালের মতো আমার কথাগুলো অভিনয় করে দেখায়।
ভাবলাম সবাই মিলে আমাকে নিয়ে ঠাট্টা করছে। মাতাল হইনি তারপরও ওরা সবাই মিলে আমাকে মাতাল বলে মজা কুড়াচ্ছে। এই আসরের নিয়মই এমন নাকি যে একজনকে বোকা বানিয়ে বাকিরা অন্যায়ভাবে মজা লুটবে! সরোষে প্রতিবাদ করে বললাম, আরে বাবা মানছিস না কেন যে আমার কিছু হয়নি! আমি বানিয়ে বলছি?
নিলয় বলে, আচ্ছা মানলাম তোর কথা-ই ঠিক। তোরে এখনো ধরে নাই। আমরা তো সবাই এখন মাতাল! যা তো—ফ্যানটা একটু বাড়িয়ে দিয়ে আয়। বেশ গরম লাগছে। বলেই গরমে সে হাঁসফাঁস করার ভান করে।
এই প্রস্তাবটা আমার মনে ধরে। একবার প্রমাণ করে দিলেই তো তর্কটা আর জমাতে পারবে না।
দাঁড়াতে গিয়ে পড়তে পড়তে নিজেকে সামলে নিলাম। ভাবলাম অনেক্ষণ বসে থাকার পর উঠতে নিলে ওরকম একটু হতেই পারে। দ্বিতীয় প্রচেষ্টায় উঠে দাঁড়ালাম। সতর্কতার সাথে পাখাটা কোনমতে বাড়িয়ে দিয়ে নিজের জায়গায় ফিরতে গিয়ে নিলয়ের উপর হুমড়ি খেয়ে পড়লাম। মুহূর্তেই হাসির একটা বোম ফাটে।
এবার আর অবিশ্বাস হয়নি যে আমি এখন মাতাল। যাহ বাবা! চোখের সামনে ঘরের প্রতিটা মানুষ কখন মাতাল হয়ে গেলাম টেরই পেলাম না! সবার হাসির সঙ্গে আমিও যোগ দিলাম। এই হাসি যেন বাঁধভাঙ্গা উচ্ছ¡াসে উপচে পড়া আনন্দ শতধা! এই হাসি অনন্ত—যেন কখনো ফুরাবার নয়। হাসিমাখা এই মুখগুলো আমার কত চেনা—অথচ এই সময়টাতে কতই না আজব লাগছে! না জানি আমার মুখটা কী রকম অদ্ভুদ দেখাচ্ছে!
দুলাভাই বলে, গুরু! হাত মেলে দেখ তো—উড়তে পারো কিনা!
উড়ার মতো করে দুই হাত প্রসারিত করলাম। সত্যিই যেন ওড়ছি! তবে এই আকাশ চিরচেনা পৃথিবীর কোন আকাশ নয়। এই আকাশ মনের ভেতরের লাল-নীল-বেগুনি আলোয় উজালা কোন এক স্বপ্নপুরীর আকাশ। যেন স্মরণাতীতকালে ঠিকানা হারিয়ে ফেলা এক নগরী, আজ হঠাৎ তার দেখা পেয়েছি। যেন স্বপ্নের খুব কাছাকাছি—হাত বাড়ালেই ছোঁয়া যাবে সবকিছু। চারদিকে কী আনন্দ! যেন এতকাল ধরে শক্তিশালী এক বাঁধে দমিয়ে রাখা হয়েছিল। বাঁধ ভেঙে গেছে। আনন্দ জোয়ারে ভাসছে এই হৃদয়নগরী। বললাম, আহ—ফিলিংস! আরও দুয়েক পেগ গিললে তো সত্যি সত্যিই উড়তে পারব গুরু!
দুলাভাই আমার পিঠ চাপড়ে দিয়ে বলে, আরে গুরু, শাব্বাশ!
পরবর্তী রাউন্ডে এসে নিলয়কে বেশ ক্লান্ত মনে হচ্ছে। ওর পক্ষে আর নেওয়া সম্ভব নয় বলে সে বেঁকে বসলো। শুভ্র বেশ বিরক্তি নিয়ে বলে, তোর সেই মুদ্রাদোষ। কয় পেগ টেনেই কাত হয়ে যাস।
নিলয় সত্যিই কাত হয়ে গেছে। বিছানায় উপুড় হয়ে বালিশে মাথাগুঁজে সটান হয়ে আছে। শুভ্র চটজলদি নতুন পেগ বানিয়ে ওকে খুঁচাতে থাকে, শালা—বাহানা ছাড়। এবার কম করে দিলাম। উঠ—গ্লাস নে হাতে।
নিলয় উঠে না। বাম হাত দিয়ে বড় ক্লান্তভাবে ইশারা করে আর কাতর গলায় বলে, প্লিজ দোস্ত, তুই ত জানিস—আমার সহ্য হয় না। আজকের মতো ছেড়ে দে।
কিছুটা অস্পষ্ট ভাষায় অনুরোধের সুরে আরও কী কী বলতে থাকে। শুভ্র তবুও নাছোড়বান্দা। প্রতিবার তুই এভাবে আসর পণ্ড করতে পারিস না। বলেই সে হেঁচকা টানে নিলয়কে তুলে বসায়।
আমারও মনে হল আসরটা পণ্ড হচ্ছে। তবে তার জন্য কে দায়ী—নিলয় নাকি শুভ্র—তা বুঝতে পারছি না। নিলয়ের একটা কথা মনে পড়লো—মাতালের আচরণকে সে ভয় পায়। কেন ভয় পায় জানি না, তবে কথাটা মনে আসার পর ওর প্রতি একটা সহানুভূতি কাজ করছে। ইচ্ছা থাকলেও মাতাল শুভ্রকে থামিয়ে দেবার সাহস পেলাম না। আবার সন্দেহ হচ্ছে এটাকি তাদের একটা পার্টিপ্ল্যান হতে পারে না? আজ আমার প্রথম দিন। তাই নানারকম চিন্তা-ভাবনা এসে মনে ভর করে চারপাশের চেনা পরিবেশটাকেও কেমন অচেনা করে তুলছে।
দুলাভাই শুভ্রকে বাধা দেয়, আহা—থাক না। শুধু আসরের কথা ভাববে! ওর দিকটা একটু কনসিডার করবে না?
শুভ্র সবার কাছ থেকেই সমর্থন আশা করছিল। তাই নিলয়ের প্রতি দুলাভাইয়ের অনাকাক্সিক্ষত পক্ষপাতিত্বের নিন্দা করে বলে, এমনিতেই সে বাহানা শুরু করেছে—তার উপর ওকে সাপোর্ট দিচ্ছেন?
দুলাভাই বলল, সত্যিই সে বেসামাল। ছেড়ে দাও ওকে।
শুভ্র তীব্র প্রতিবাদ করে বলে, সে কী দুলাভাই! তিনজনে কার্ড খেলা যাবে?
আমি বললাম, তা কেন হবে? এক কাজ কর না। নীলা আপুকে ডেকে নিয়ে আসলে কেমন হয়?
আমার বক্রোক্তি বুঝতে সে ভুল করেনি। আরও উচ্চস্বরে চেঁচিয়ে উঠে আমাকে শাসায়।
নিলয় শুভ্রকে কাতর স্বরে বলে, ওর কথা বাদ দে মামা। আমাকে কিছুক্ষণের জন্য ছেড়ে দে। তোরা কার্ড খেলার সময় ডাকিস—আমি খেলব।
নিলয়ের আশ্বাসে শুভ্র একদমই আস্থা পায় না। আর কোনদিক থেকে সমর্থন না পেয়ে তার প্রতিরোধও আর টিকিয়ে রাখতে পারলো না। ওকে ছেড়ে দিয়ে ক্ষোভের সঙ্গে বলে, হয়েছে তোর খেলা। মাতাল নিলয়ের কুম্ভকর্ণমার্কা ঘুম কে ভাঙ্গাবে তা আমার জানা আছে। তোর মতো একটা অপদার্থ কাওয়ার্ডকে পাত্তা না দিয়ে মোনালিসা ঠিকই করেছে।
নিলয়কে একটা অশ্রাব্য গালি দিয়ে সে আরেকটা সিগারেট হাতে নিলো।
ক্লান্ত কণ্ঠে নিলয় প্রতিবাদ করে, দ্যাখ, না জেনে কোন বাজে কথা বলবি না বলে দিলাম।
শুভ্র ক্ষেপে গিয়ে বলে, শালা মাতালের বাচ্চা, বললে কী করবি?
আমি বললাম, তুই তো বেশ বীরপুরুষ। যা না—ঝুলে যা মোনালিসার গলায়।
আরে ধুর। আমাকে বলছিস কেন? নিজেই ঝুলে যা। যতখুশি দোল খা গিয়ে। বিয়ে কর গিয়ে বাচ্চা-কাচ্চা পয়দা কর। এসবের মধ্যে আমাকে টানছিস কেন? ওর বলার ভঙ্গি দেখে মনে হল সে আমার প্রস্তাবটা তুড়ি মেরে উড়িয়ে দিচ্ছে।
তুই কি শালা মোনালিসার বাপ নাকি যে আমাকে কন্যাদান করে দিচ্ছিস?
না—তুই মোনালিসার সৎ মা। ওকে আমার গলায় ঝুলিয়ে দিলেই বেঁচে যাস। হা হা হা।
এখনো পর্যন্ত দুলাভাইয়ের সামনে যদিও বেশ কয়েকবার মোনালিসা প্রসঙ্গ উত্থাপিত হয়েছে, কখনো সে মুখ খুলেনি। এবার সে নিজেও প্রসঙ্গের স্রোতে গা ভাসিয়ে বলে, আরে শালাগুরু! ঝুলানো বলছ কেন? মেয়েটা দেখতে কেমন—যাচ্ছেতাই?
শুভ্র জবাব দেয়, আরে না। অপরূপা সুন্দরী না বললে ভুলই হবে। চলতে-ফিরতে রাস্তাঘাটে দেবী টাইপের কিছু মেয়ে দেখা যায় না—সেরকমই। ফিগারও সেরকম—দেখতে মাখনের মতো। বলতে গিয়ে ওর চোখ চকচক করে। না জানি কতজনের নজর পড়েছে। খাওয়া মাল হবে শালী। যেই বড় হিপ!
পাছা বড় হবার এই তত্ত¡ সে কোত্থেকে পেলো কে জানে! ওর মুখ থেকে মোনালিসাকে ঘিরে এরকম জঘন্য মন্তব্য শুনে ঘেন্নায় নিজের ভেতরে নিঃশব্দে উচ্চারিত হলো, ছি! ওরকম একটা ছেলের সাথে আমার বন্ধুত্ব! মুখে কিছু বলতে পারলাম না। ভেবেই অবাক লাগছে মোনালিসা আর এই ছেলেটাকে নিয়ে আমাদের মাঝে কী করে এমন একটা ত্রিভুজ-বন্ধুত্ব গড়ে উঠল! পরমুহূর্তে ভাবলাম নিজেকে বাহাদুর প্রমাণ করতে গিয়ে শুভ্র অনেক বেশি টেনেছে। সে এখন বেসামাল। আসরের শুরুতে তালিমের সময় বলা হয়েছিলো, মাতালের সব কথায় সিরিয়াস হতে নেই।
দুলাভাই শুভ্রকে পাল্টা প্রশ্ন করে, অ্যাঁ! খাওয়া মাল হলে পাছা বড় হয়—কীভাবে বুঝলে?
আরে গুরু জানতে হয়। বলে শুভ্র আয়েশ করে সিগারেটের ধোঁয়া গিলে প্রেমিকার ঠোঁটে চুমু খাওয়ার ভঙ্গিতে ওয়াইনের গ্লাসে চুমুক দেয়। ধোঁয়া ছাড়ে। বাতাসের সঙ্গে মিশে যায়। শুভ্রকে দেখে মনে হলো—মদের গ্লাস আর সিগারেটের ফিল্টারকে সে যতটা আপন করে নেয় অতটা ভালোবাসায় জড়িয়ে কোন মেয়েকে সে কোনদিনও কাছে টানতে পারবে না। দুচোখ ভরা কামুক-দৃষ্টিতে সে মেয়েদের শুধু ব্যবচ্ছেদই করে যায়—ওদের প্রতি গভীর থেকে কোন টান অনুভব করে না।
নিথর দেহে পড়ে থাকা নিলয়কে দেখে মায়া হচ্ছে। এই ছেলেটা সহজে কারো সাথে মিশতে চায় না। মেয়েদের সাথে তো একদমই না। ভাবতে ভাবতে বলেই ফেললাম, নীলা আপুকে পাওয়াতে নিলয়ের একটা মেয়েবন্ধু জুটেছে। নীলা আপুর দেখা না মিললে ওর লাইফটাই মেয়ে ছাড়া কাটত!
আরে—নীলা ওর মতো গবেটকে পাত্তা দেবে!
কথাটা কেমন খাপছাড়া লাগল। শুভ্র এমন জড়তাহীনভাবে নীলা আপুর নামটা আপু যোগ না করে বলেছে—কানে বাজল। ওদের মাঝে আবার চক্কর-বক্কর চলছে না তো? আপুকে দেখে কখনো তো সেরকম কিছু মনে হয়নি। তাছাড়া সে শুভ্রর চেয়ে কমসেকম দুই বছরের বড় হবে। বললাম, কীরে! নীলা আপু আবার নীলা হয়ে গেল কবে থেকে?
আরে ইয়ার, তুই কী বল তো? সব ব্যাপারেই প্যাঁচাচ্ছিস! লোকচক্ষুর আড়ালে শরাব খেতে বসেও কি আপু আপু করতে হবে নাকি? আপু প্যান্টটা খুলে দাও। আপু প্যান্টটা পড়িয়ে দাও। কথার শেষাংশটা সে বাচ্চাদের মতো গলা করে পড়নের প্যান্টটা টেনেটুনে অভিনয় করে দেখায়।
বলতে থাকে, তবে শালী মাঝে মধ্যে যা করে তাতে সিনিয়রিটি-জুনিয়রিটি যে কোথায় থাকে! সেদিন আমাকে ধরলো ওয়ান্ডারল্যান্ডে যাওয়ার জন্য।
আর তুইও গেলি? যাবি না—মেয়েমানুষ বলে কথা!
শুভ্রর বলার ভঙ্গিতেই বোঝা যাচ্ছে সে গেছে এবং সেখানে বলার মতো কিছু ঘটেছে। খুব আগ্রহী শ্রোতা হয়ে শুনছি, তাই সে আমার প্রশ্নগুলোকে তার কথার মাঝে বাধা মনে করেনি। সে বলতে থাকে, আরে ইয়ার—সমঝনা পড়েগা। আফটার অল কিসি লারকি কে সাথমে ঘুমনাকি বাত হ্যায়! মে কেসে—কেসে উসে মানা করো?
যাহ বাবা। মাতালটা দেখি এখন পুরাদস্তুর হিন্দি বলা শুরু করেছে। এটা অবশ্য নীলা আপু প্রীতিরই একটা প্রভাব!
নীলার পাশে বসে দারুণ রোম্যান্স ফিল করছিলাম। ওর বাহুটা যখন বাহুকে স্পর্শ করে, মনেই হচ্ছিল না কোন হাড্ডিমাংসওয়ালা কারো পাশে বসেছিলাম। যেন নিবেদিত একগুচ্ছ রেশম মোহনীয় কোমলতায় স্পর্শ বিলিয়ে যাচ্ছিলো। ওর নিঃশ্বাসের সাথে তাল মিলিয়ে সেই রেশমি ছোঁয়া প্রতি দুই সেকেন্ডে একবার করে প্রকট হচ্ছিলো আর শিথিল হচ্ছিলো। সমস্ত শিরা-উপশিরায় এই রক্তকণিকাগুলো যেন কামনা-বাসনায় জর্জরিত হচ্ছিলো।
শালা লুইচ্চা কোথাকার! সব ব্যাপারে এমন ঠোঁটকাটা হওয়া সাজে না—বুঝলি?
দুলাভাই বলে, দেখ দেখি? ওকে বলতে দাও গুরু! সে এখন ভাবে আছে। দেখি না—আমার শালাবাবু কতটা পেকেছে!
নেশায় বুঁদ শুভ্র জড়তায় আচ্ছন্ন ঠোঁটটা নেড়ে বলতে থাকে, এক পর্যায়ে সে আমার হাতটা প্যাঁচিয়ে ধরে। ওহ—তখন যেন জীবনের সবচে উপভোগ্য মুহূর্তটায় ছিলাম! বলে সে কোথায় যেন হারিয়ে যায়। সম্ভবত কল্পনায় সে ওই মুহূর্তটায় আবার ফিরে যায়।
হাতের গ্লাসটা একটু নেড়েচেড়ে ওটার ভেতরের তরলের উচ্চতার দিকে একবার তাকায়। তারপর এক ঢোক খেয়ে বলে, ট্র্যাজিক ব্যাপার কি জানেন দুলাভাই! সেই দিনই জীবনের সবচে বড় শিক্ষাটা পেয়েছিলাম। নীলা যখন ওর উচ্ছ¡সিত মুহূর্তগুলোর একপর্যায়ে হাতে হাতটা রেখে চোখের উপর সকরুণ দৃষ্টি রেখে বলেছিল—ছেলেদের মধ্যে আমি তার খুব ভালো বন্ধু—খু-উ-ব!
তাকে জিজ্ঞাসা করেছিলাম, কেন? তার ভার্সিটির বন্ধুরাও তো আছে! সে বলেছিল, ওদের মনমানসিকতা স্রেফ পশুদের মতো। জাস্ট লাইক দ্য বিস্ট। ওরা বন্ধুত্বের মাঝে ঠিক কী খুঁজে ফিরে—বোঝা মুশকিল। ছেলেগুলো মেয়েদের সাথে সম্পর্ক গড়ে। মামুলি গন্তব্য শরীর আর বিছানা। অতঃপর ঝগড়া-ঝাটি, ব্রেক-আপ। ঠিক এমনটাই ঘটেছে হাসির জীবনে।
আমি, আমার বন্ধুরা নাকি তার ভার্সিটির ছেলে বন্ধুদের চেয়ে আলাদা—অন্য ধাতের। সে নাকি সহজেই আমাদের বুঝতে পারে। আমাদের সম্পর্কে ওর অভিব্যক্তি জেনে নিজেকে বড় দীন মনে হয়েছিল। যেই নীলাকে ঘিরে নির্বিচারে আমরা নিজেদের মধ্যে অশালীন রসিকতা করি, সেই নীলা আমাদেরকে কত গ্রেট—সাধু মনে করে!
দুলাভাই নিজের মতো করে নীলা আপুকে ব্যাখ্যা করে। সাথে হাসি আপুর প্রসঙ্গটাও। শুভ্র আর আমিও ব্যাখ্যা করা থেকে পিছিয়ে থাকলাম না। তবে নীলা আপু যে শুভ্রর সাথে প্রণয়লীলায় জড়াতে পারে—আমার এই সন্দেহটাকে উপস্থাপন করতে পারলাম না। মনের মধ্যে একটু সংকোচবোধ হলো—পিছে না আবার ক্ষুদ্রমানসিকতার দায়ে কাঁধে অপবাদ জুটে।
এক হাতে কানের কাছে গুণগুণ সঙ্গীতচর্চারত একটা মশাকে সশব্দে চপেটাঘাত করে কানের প্রায় ভেতর থেকে টেনে বের করে এনে বললাম, নাহ—মশা বড্ড জালাচ্ছে তো! পায়ের দিকটায় কামড়িয়ে ফুলিয়ে ফেলেছে।
দুলাভাই শুভ্রকে জিজ্ঞেস করে, কয়েল আছে?
বেহেড অবস্থায় ঝিমাতে ঝিমাতে জড়িয়ে যাওয়া গলায় সে জবাব দেয়, ক-য়ে-ল? নেহি গুরু। মেনে সোচা থা। লেকেন বিলকুল ভুল গিয়া।
দুলাভাই বলে, আরে এমন একটা দরকারি জিনিসের কথা ভুলে গেলে হয়?
আ-রে ইয়ার, মেরা কোয়ি কসুর নেহি হ্যায়। মে ইয়াদ করকে করকে ভুল গিয়া।
মাতালটার হিন্দি কথাগুলো তার নীলা আপুভক্তির কথা আরও বেশি করে মনে করিয়ে দিচ্ছে। নীলা আপুকে ঘিরে আর মোনালিসাকে নিয়ে তার ভাবনার মধ্যে কত আকাশ-পাতাল তফাত! মোনালিসার প্রতি তার এমন ঘৃণ্য মানসিকতা থাকা সত্তে¡ও যখন সে আবার তার সামনে গিয়ে দাঁড়াবে—ঠিকই মনভোলানো হাসিতে মেয়েটার মন রাঙানোর চেষ্টা করবে। আমার ভেতরকার এই ছাইচাপা আগুনের তখন না জানি কী হাল হয়!
ওকে জিজ্ঞাস করলাম, মশারিটা কোথায়?
আরে ইয়ার, মুঝসে কিউ পুছা? ছোটাসা কামরা। জারা ঢুন্ড লে।
টলতে টলতে সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে শুভ্রর পাছায় কষে একটা লাথি দিয়ে বললাম, হারমির বাচ্চা, মশারিটা বের করে দে।
এই চমকপ্রদ দৃশ্য দেখে আর শুভ্রর চিৎকারের ভঙ্গিমা শুনে দুলাভাই হেসে খুন। আমিও তার সাথে যোগ দিলাম। মনে হলো, মোনালিসাকে জড়িয়ে বাজেকথা বলার উপযুক্ত শাস্তিই দিয়েছি শালাকে।
শালে, আজ মেনে থোরা জাদা পি চুকা হ্যায়। হুশ মে নেহি হো। মে তুঝে আগলে বার দেখলুঙ্গি, মে-মে তুঝে ইতনা মার মারুঙ্গি…। কুত্তেকি আওলাদ। গালিগালাজ করতে করতে হাতড়িয়ে মশারিটা আমার সামনে ছুঁড়ে ফেলে বলে, লে—খাটা।
হারামখোর! মে মে মাত কর। আর একটা হিন্দি ছাড়বি তো তোকে খুন করে ফেলব।
শুভ্র দমে যায়। গা এলিয়ে দিয়ে বসে ঝিমায়।
মশারি টানাতে টানাতে টের পেলাম বেশ খিদে পেয়েছে। যেসব খাবারের পসরা সাজানো হয়েছিল—সেগুলো অনেক আগেই ফুরিয়ে গেছে। শুভ্রকে জিজ্ঞেস করলাম, স্টকে খাবার কিছু আছে?
মুড়ি এনেছিলাম। চিবাতে পারো। বলে দুলাভাই মুড়ির টিনটা দেখিয়ে দেয়।
শুভ্র ঝিমাতে ঝিমাতে মদের সাথে সিগারেট টানছিল। হাতের গ্লাসটা নামিয়ে রেখে সে ঠাশ করে চপেটাঘাত করে হাত দুটো আমার সামনে মেলে ধরে উৎসাহের সঙ্গে বলে, দ্যাখ দ্যাখ, কত্ত বড় মশা মেরেছি। খানকি মাগি, রক্ত খেয়ে শরীরের কী অবস্থা করেছে!
ওর হাতের দিকে তাকিয়ে দেখি ওটা মশা নয়—একটা ছোট আকারের তেলাপোকাকে সে দুই হাত দিয়ে একেবারে থেঁতলে দিয়েছে। দুলাভাই সরেজমিনে তদন্ত করে ব্যাপারটা খতিয়ে দেখছে, আসলে ওটা মশা নাকি তেলাপোকা। এবার আমার পেটের ভেতরের সবকিছু প্রবলভাবে আন্দোলন করে বসল। কোনমতে ‘ককরোচ’ শব্দটা উচ্চারণ করে একদৌড়ে বাথরুমের বেসিনটায় উপুড় হয়ে সেকেন্ডেই পেট পুরা খালি করে দিলাম।
বমি করার সময় প্রচণ্ড কষ্ট হল। যেন অন্ননালির চেয়ে মোটা কোন জিনিস পেট থেকে বেরুবার প্রাণপণ চেষ্টা করছে। মাথা তুলে যখন আয়নাতে নিজের বিধ্বস্ত চেহারাটার দিকে তাকালাম তখন নিজের উপর কেমন ঘৃণা হয়। এসব আমি কী করছি! আমি কি নেশার ফাঁদে আটকা পড়ছি? অন্ধকারে নিমজ্জিত কালোরাত্রির গর্ভে আলো খুঁজে ফিরছি? নিজেকে নিয়ে এটা কোন ধরনের খেলায় মেতেছি! এটা কী রকম মাতামতি! জীবনে এই নিষিদ্ধ পাওয়াটা অনেক জরুরি ছিলো? নিজেকে শুধু প্রশ্ন করেই গেলাম—জবাব পেলাম না।
শাওয়ারের পানিতে আপাদমস্তক ধুয়ে যাচ্ছি। নিজের ভিতর কেমন একটা অস্থিরতা বিরাজ করছে! আমাকে পুড়াচ্ছে। এই দহন কি নিষিদ্ধ বাঁধভাঙ্গা আনন্দে মাতোয়ারা হবার? নাকি মোনালিসাকে জড়িয়ে এমন অশালীন মন্তব্য মুখবুজে হজম করার? যাই হোক, শাওয়ারের জলজ শুশ্রƒষায় অস্পৃশ্য অন্তর্দহন উপশমের প্রাণান্ত চেষ্টা চালিয়ে গেলাম।
সকাল আটটা। যেন পাখির ডানায় দিনের আলো ফুটল। রাতের ঘুমকে কখনো এত সংক্ষিপ্ত মনে হয়নি। দেড়টার দিকে শুয়েছিলাম—কাজেই ঘুমতো কম হয়নি। প্যাকেটটা কুড়িয়ে নিয়ে বারান্দায় গিয়ে একটা সিগারেট ধরালাম। কয়েক টান দিতেই নেশাটা মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে। শরীর ঝিম মেরে আসে। সিগারেটটা ছুঁড়ে ফেলে নিলয়ের পড়ার টেবিলের সামনে পাতা চেয়ারটায় এসে বসলাম।
বাথরুমের শাওয়ার থেকে পানি ঝরার আওয়াজ শোনা যাচ্ছে। নিলয় বিছানায় নেই। টেবিলের উপর ওর ডায়েরিটা খোলা পড়ে আছে। গোসলে যাওয়ার আগেই হয়তো লিখেছে। এলোমেলো হাতে লিখা, “…চতুর্থ পেগটা খাওয়ার পর মনে হল সেই মাতাল আততায়ীগুলো ধেয়ে আসছে। আমার দিকে হাত বাড়ালো—কলজেটা ছিনিয়ে নিতে। প্রাণপণ লড়লাম, শেষ রক্ষা করতে পারলাম না। যন্ত্রণায় ছটফট করতে করতে সইতে না পেরে শেষে মরতে চাইলাম—তাও পারলাম না। আমি চেয়ে চেয়ে দেখলাম নরপিশাচগুলো আমারই সামনে আমার কলজেটা ছিঁড়ে ছিঁড়ে খাচ্ছে আর হো হো করে…”
নিলয়ের এসব দুর্বোধ্য ভাষার বিন্দুবিসর্গ কিছু বুঝতে পারলাম না। হয়তো মাতাল অবস্থায় তার মনের ভেতর এক অদ্ভুত ভয় কাজ করছিল—আর সেই পরিস্থিতিটাই সে ডায়েরিতে টুকে রেখেছে। মাতাল অবস্থায় নাকি মস্তিষ্কের ভাবন ঘরের প্রচ্ছন্ন সব দরজা-জানালা খুলে যায়!
কারো অজান্তে তার ডায়েরি পড়ার অপরাধবোধ আমাকে থামিয়ে দেয়। খোলা কলমটা ভেতরে রেখে ডায়েরিটা চাপিয়ে রেখেদিলাম।
চলবে…
পরিচ্ছেদ ৬ অনেক রাতে ফিরেছিল কল্যাণ ওরফে শহীদুল।গাড়িটা শেডে রাখার পর দু’বার হালকা করে মা…..
পরিচ্ছেদ ৫ আকাশে এখন আর মেঘ নেই। হাওয়া হচ্ছে।কদিন পরেই বর্ষা নামবে।একদিন হাসপাতাল থেকে ফিরতে…..
পরিচ্ছেদ ৪ ভোর হয়ে আসছে।রাতে ভালো ঘুম হয়নি।ঘুমের ঘোরে মনে হচ্ছিল দম বন্ধ হয়ে আসছে।এরকম…..
পরিচ্ছেদ ৩ শীত শেষ হয়ে আসছে।রাঙ্গালীবাজনা ঢোকার মুখের রাস্তাগুলো পলাশ ফুলে ভরে গেছে।অথচ ঠান্ডাই।…..