ইমন কল্যাণ
পরিচ্ছেদ ৬ অনেক রাতে ফিরেছিল কল্যাণ ওরফে শহীদুল।গাড়িটা শেডে রাখার পর দু’বার হালকা করে মা…..
\ পাঁচ \
শেল্টেক্ নির্মিত ছয়তলা ফ্ল্যাট বাড়িটার তিনতলার দক্ষিণ পাশের বামের ফ্ল্যাটটা আমাদের। মূলরাস্তা থেকে গলিতে প্রবেশ করার বিশ-পঁচিশ গজ পর হাতের ডানে দাঁড়িয়ে আছে নীল রঙের এই বাড়ি। বছর তিনেক হয় এটি নির্মিত হয়েছে। আকাশী-নীল রঙের গেটের পাশে চকচকে সোনালি ফলকে একটা গাঢ় নীল অপরাজিতা ফুল খোদাই করা। আর তার নিচে ইংরেজি অক্ষরে লিখা ‘অপরাজিতা’।
বাইরে থেকে এসে মেইন গেট দিয়ে ঢুকার আগে বাড়িটাকে প্রায়ই আপাদমস্তক দেখি। এর বহ্যিক দৃষ্টিনন্দন স্থাপত্যশৈলীর প্রশংসা না করে পারা যায় না।
ডান পাশেরটা তমাদের ফ্ল্যাট। তমার বাবা রায়হান চৌধুরী বাবার ঘনিষ্ঠ বন্ধু। দুইজনে প্রতিবেশী হতেই এখানে পাশাপাশি ফ্ল্যাট কিনেছে। কলেজ থেকে ফিরে গেটের কাছে এসে তমার রুমের খোলা জানালায় চোখ পড়ে। গম্ভীর মুখে শ্যেনদৃষ্টিতে সে এদিকেই তাকিয়ে আছে। চোখে চোখ পড়তেই পর্দা টেনে সে ভেতরে চলে গেল।
গ্রাউন্ড ফ্লোরে লিফট ধরার সময় পার্কিংয়ে আমাদের গাড়িটা দেখতে পেলাম। এসময়ে বাবার বাসায় থাকার কথা নয়—তাহলে কি বাবার শরীর খারাপ! আশেপাশে ড্রাইভারকে দেখতে না পেয়ে চট করে উপরে উঠে এসে কলিংবেল চাপি।
এর আওয়াজ খুব কম হয়, বাইরে থেকে শোনা যায় না। বাবা হৃদরোগী—তাই একেবারে কম আওয়াজের একটা ডোরবেল লাগানো হয়েছে। হানিফের মা এসে দরজা খুলে দেয়।
বাবা বাসায়?
উৎকণ্ঠা ভরা গলায় জবাব দেয়, হ। স্যারে ত আজকে তাড়াতাড়ি বাসায় আইস্যা পড়ছে। শরীর নাকি খারাপ।
ড্রাইভারকে দেখছি না যে? সে কোথায়?
স্যার উনারে বাসায় চইল্যা যাইতে কইছে। আজকে নাকি আর বাইর অইব না।
অর্ধেক চাপানো দরজার ফাঁকা দিয়ে বাবাকে বিছানায় দেখতে পেলাম। মায়ের কোন সাড়াশব্দ পেলাম না।
মা কোথায়?
তন্ময়ের সাথে হের টিচারের বাসায় গেছে।
কখন গেছে?
গেছে ম্যালাক্ষণ অইছে। এতক্ষণে বোধহয় আইস্যা পড়তাছে।
দরজা ঠেলে ভেতরে ঢুকে দেখি বাবা ঘুমাচ্ছে। মৃদু আওয়াজে রোমান্টিক ইংরেজি গান বাজছে। রিচার্ড মার্ক্স এর আই উইল বি রাইট হিয়ার ওয়েটিং ফর ইয়্যু।
গত দশকের জনপ্রিয় এই গানটা বাবার খুব পছন্দের। বাবাকে আমার খুব অধুনিক মনে হয়—যাকে বলে কসমোপলিটান। হালের যেসব রুচি এবং ফ্যাশন বিষয়ক পরিবর্তন আমরা ভালো চোখে দেখি—বাবাও বেশিরভাগ ক্ষেত্রে সহমত পোষণ করে। অথচ এসব ক্ষেত্রে প্রায়ই দেখা যায় মায়ের অবস্থান বিপরীতমুখী। এমনকি বাবার বয়সীদের বেশিরভাগই এসব ব্যাপারে মন্তব্য করে বলে ‘সমাজটা নষ্ট হয়ে যাচ্ছে’। যেই প্রজন্মে বাবার বয়সীরা আলোচনায় বসে জাতীয় ক্রিকেট দলের অধিনায়ক ‘হাবিবুল বাশার সুমন’ প্রসঙ্গে তাকে চিনতে না পেরে বলে ‘হাবিবুল বাশার যেন কোন পার্টির? দলের না লীগের?’, সেই প্রজন্মের লোক হওয়া সত্তে¡ও বাবা গলা ছেড়ে হিমেশের হিন্দি গান গায়। তাই বলে রাজনৈতিক আলোচনাতে মোটেও পিছিয়ে নেই। মাঝে মধ্যেই সে টেলিভিশনে টকশোতে ডাক পায় মুখর আড্ডা বসানোর জন্য।
ঘুমের ব্যাঘাত ঘটানো ঠিক হবে না ভেবে বেরিয়ে আসার সময় বাবা পেছন থেকে শান্ত গলায় ডাকল, রাইম।
কাছে গিয়ে বললাম, তোমার শরীর এখন কেমন?
বাবা প্রথমেই আমার প্রশ্নের জবাব দেয় না। বসতে ইশারা করে বলে, সিডি প্লেয়ারটা অফ করে এসো।
সিডি প্লেয়ার বন্ধ করে কলেজ ব্যাগটা কাঁধে রেখেই বাবার পাশে গিয়ে বসলাম। বাবার দিকে জিজ্ঞাসু চোখে তাকালে বলে, বুকে একটু ব্যথা করছিল। চারপাশটা কেমন যেন ঘুরছিল। এখন কমেছে।
তোমাকে এই অবস্থায় রেখে মায়ের বাইরে যাওয়া কি ঠিক হয়েছে?
তোমার মাকে তো চেনই। সে কি আর যেতে চেয়েছে! তন্ময়ের পরীক্ষা। আমিই সেধে পাঠালাম। তাছাড়া টিচারের বাসা কাছেই। একটা কল করলেই চলে আসতে পারবে।
তবুও তো, অসুখটা হার্টের। কখন কী হয়ে যায় তার নেই ঠিক। যদি কিছু হয়ে যায়!
তোমরা আসলে অসুখটাকে যত বড় করে দেখছ সমস্যাটা এখনো ততটা প্রকট হয়নি। তাছাড়া বাসায় হানিফ আছে, হানিফের মা আছে। তারা কি আমাদের নিজেদের লোক না?
এবার শাসনের গলায় বললাম, বাবা—ওরা আর মা এক হল? বিপদের সময় ওরা চিৎকার চেঁচামেচি ছাড়া কিছু করতে পারবে? আসলে তুমি নিজের ব্যাপারে খুবই কেয়ারলেস।
আমাকে শান্ত করার চেষ্টায় বাবা একটু হাসে। জিজ্ঞেস করলাম, ব্যথাটা এখন পুরোপুরি সেরেছে?
বাবা একটু নড়ে চড়ে জবাব দিল, হ্যাঁ, এইতো—এখন অনেকটা কমে এসেছে।
বাবার হার্টের প্রবলেমটা ইদানিং প্রায়ই দেখা দেয়। আমাদের দুই ভাইকে নিয়ে তার অনেক স্বপ্ন। রাতদিন খাটে। কর্ণফুিল গার্ডেন সিটিতে একটা জুয়েলারি দোকান—স্টেডিয়াম মার্কেট আর এলিফ্যান্ট রোডে আরও দুইটা ইলেক্ট্রনিক্সের দোকান বাবা নিজেই তদারকি করে। বসুন্ধরায় দুইটা ফ্ল্যাট নিয়েছে। আমাদের সুন্দর ভবিষ্যতের ভাবনায় তার খাটনির শেষ নেই। তার নানাবিধ সমস্যা আমাদেরকে বুঝতে দেয় না। এমনকি মাকেও না। আমাদের সাথে সবসময় হাসি ঠাট্টার সাথে সময় কাটায়। বাবাকে দেখে বোঝার উপায় নেই যে সে কত ব্যস্ত মানুষ। কেমন যেন ভয় হয়—বাবার অসুখটা বোধহয় এতদিনে বেশ নাজুক হয়ে গেছে। কেন যে বুঝে না! এই সহায়সম্পদের চেয়ে সে আমাদের কাছে অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ।
বললাম, বাবা—আর দেরি করা ঠিক হবে না। তোমার ভালো ট্রিটমেন্ট দরকার।
ডাক্তার তো দেখানো হচ্ছে। রেগুলারলি ঔষধও খাচ্ছি।
রেগুলারলি ঔষধ খেলেই কি সব হয়ে গেল? ডাক্তার তোমাকে বাইরে গিয়ে ভালো করে চেক-আপ করার জন্য রেফার করেছে—করিয়েছ? গতমাসেও ব্যবসার কাজে সিঙ্গাপুর গেলে! নিজের প্রতি কেন এত অবহেলা কর বাবা? বলে বাবাকে জড়িয়ে ধরি।
পাগল ছেলে! কাজের এত প্রেসার ছিল যে সময়ই করে উঠতে পারিনি। সামনের মাসে চায়না আর সিঙ্গাপুর যেতে হতে পারে। এবার গেলে অবশ্যই ডাক্তার দেখাব।
নিজেকে নিয়ে বাবার এই উদাসীনতা আমাকে বড় পীড়া দেয়। এই মানুষটা আমাদের মাথার উপর বিস্তৃত আকাশ হয়ে আছে অথচ নিজের প্রতি এত উদাসীন! এই মানুষটাকে বাদ দিয়ে পৃথিবীতে একটা নিশ্চিন্ত দিনের কথাও ভাবতে পারি না।
বাবাকে জড়িয়ে ধরে বললাম, বাবা তুমি নিজের প্রতি এত কেয়ারলেস কেন? তোমার যদি কিছু একটা হয়ে যায় তবে আমাদের কী হবে?
পাগল ছেলের কথা শোন। কী এমন হয়েছে শুনি? বাবাকে জলদি তাড়াতে চাস!
ছি বাবা!
তাহলে এসব অলক্ষুণে কথাবার্তা কেন? শুধু শুধু দুশ্চিন্তা বাড়াস!
আসলে—তুমি না খুব খারাপ। আমাদের চিন্তায় নিজের প্রতি কেয়ারলেস থাক। অথচ জানো—তোমার জন্য আমরা কত টেনশনে থাকি!
বাবা হাসে। পরিবেশটা পাল্টানোর জন্য নতুন প্রসঙ্গ টেনে বলে, তুমি নাকি আবার ড্রাইভার ছাড়া গাড়ি নিয়ে বের হয়েছিলে?
কে বলেছে?
বেরিয়েছিলে কিনা তাই বল।
বাবা—আমি যথেষ্ট ভালো ড্রাইভিং পারি—শুধু লাইসেন্স নেই এই যা।
লাইসেন্স ছাড়া বের হবেই বা কেন? কাগজপত্র ছাড়া গাড়ি নিয়ে বের হয়েছ এমন যেন আর কখনো না শুনি। কিছুটা রাগান্বিত স্বর। পাশ ফিরে সাইড-ড্রয়ার হতে একটা খাম নিয়ে হাত বাড়িয়ে আমাকে দেয়, নাও—ধরো।
খামটা হাতে নিয়ে জানতে চাইলাম, কী এটা?
বাবা এবার গলার স্বর নামিয়ে বলে, হাতে যখন আছে নিজেই দেখ।
আমার নামে একটা ড্রাইভিং লাইসেন্স! আজকাল ড্রাইভারের চেহারা পর্যন্ত না দেখিয়েই ড্রাইভিং লাইসেন্স মিলে! বাবার দিকে তাকালাম। মুচকি মুচকি হাসছে। খুশিতে বাবাকে জড়িয়ে ধরে বলি, থ্যাংক য়্যু বাবা।
ওয়েলকাম।
কিছুটা বিরতি নিয়ে বলে, যা কিছু করি সবই তোমাদের ভবিষ্যত সুনিশ্চিত করতে। তোমাদের যেন কোন অনিশ্চিত সময়ের মুখোমুখি না হতে হয়। জীবনকে উপভোগ কর, তবে অনিয়ন্ত্রিত বা উচ্চবিলাসী জীবনযাপনের দিকে ঝুঁকে নয়। যেকোন কাজের আগে সাতপাঁচ ভেবে নিও। লিভ সিম্পল, থিংক হাই। তোমার উপর আস্থা রাখি। তাই বলে সেদিন এভাবে বাইরে রাত কাটিয়েছ—ঠিক করনি। এমন যেন আর কখনো না হয়। এখন যাও, কাপড় চেঞ্জ করে ফ্রেশ হয়ে নাও।
কথার ভেতরেই কলিংবেলটা বেজে ওঠে। মা এসেছে ভেবে দরজা খুলে দেখি রায়হান আংকেল।
তোমার আব্বু বাসায়?
জী আংকেল।
শুনলাম—অসুস্থ!
জী—এখন একটু ভালো।
ঘুমাচ্ছে নাকি?
উনাকে পথ ছেড়ে দিয়ে বললাম, না আংকেল। ভেতরে আসেন।
আংকেল বাবার দরজার সামনে গিয়ে বাবাকে নাম ধরে ডাকেন। উনার উপস্থিতি টের পেয়ে বাবা উনাকে ভেতর থেকে ডাকে।
রুমে এসেই ক্লান্ত শরীরটাকে বিছানায় এলিয়ে দিলাম। চোখ মুদলেই মনে পড়ল তমার সুতীক্ষè চাহনি। সেদিন ছাদে বৃষ্টিতে ভেজার পর আর দেখা হয়নি। সে কি আমাকে কিছু বলতে চায়? কী বলতে চায়?
কলিং বেলের আওয়াজে আমার তন্দ্রা কাটলো। মা এসেছে বোধহয়। তড়িঘড়ি বাথরুমে ঢুকলাম। বাইরে থেকে এসে ফ্রেশ না হয়ে শুয়ে আছি দেখলে মা ভীষণ রেগে যাবে। ক্লান্তি দূর করতে একটা লম্বা গোসল দিলাম। দারুণ ফ্রেশ লাগছে এখন।
বাথরুম থেকে বেরিয়ে দেখি পড়ার টেবিলের সামনের চেয়ারটায় তমা বসে আছে। একটা আলগা কাগজে কি যেন আঁকিবুঁকি করছে। আমাকে দেখতে পেয়েই বলে, পড়ার টেবিলটাকে এরকম হ য ব র ল করে রাখতে হয়? একটু গুছিয়ে রাখতে পার না?
চেয়ে দেখি টেবিলটা মাত্রই গুছানো হয়েছে। বললাম, এক-আধদিন গুছিয়েই বেশ শাসন শুরু হয়েছে—না?
বাহ! আমি কি কারো দাসী-বাঁদী নাকি যে রোজ রোজ টেবিল গুছিয়ে দেবো?
দাসী-বাঁদী না তো আজ করলি কেন?
ইচ্ছে হয়েছে—তাই। আজ করেছি বলে কি প্রতিদিনই করে দিতে হবে?
দিবি! রোজ রোজ যে এতসব প্রবলেম সলভ করিয়ে নিস—বিনিময়ে কী দিস আমাকে? একটু কাজকর্মই না হয় করে দিবি।
ইশ! সময়মতো সার্ভিস নাই—আবার পারিশ্রমিক চায়। কয়দিন ধরে ঘুরে তার দেখা পাওয়া যায় না। খুব ব্যস্ত মনে হচ্ছে?
ব্যস্ত না তো কি? তোর মতো নিষ্কর্মা?
ইশ! কেমন আমড়া কাঠের ঢেঁকি তা আমার ভালোই জানা আছে। সেদিন পিচ্চিগুলার সামনে সে কেমন জাপটে ধরে আছে! ছাড়ে না তো ছাড়েই না। বুদ্ধু কোথাকার! সলাজে টিপ্পনী কেটে সে মুখটা ঘুরিয়ে নেয়। আমার থেকে তার দৃষ্টি আড়াল করে।
ওর কথা শুনে আমার চোখ তো ছানাবড়া! অবলীলায় সে এসব কথা এভাবে বলে ফেলবে ভাবিনি। বললাম, এখন আমড়া কাঠের ঢেঁকি—না? না ধরলেই টের পেতিস। ঠিক আছে আবার এমন সিচ্যুয়েশন হলে সবার সামনে আর তোকে ধরতে যাব না। মাথা ফাটলে ফাটুক।
সবার সামনে ধরবে না তো কি আড়ালে ধরবে?
রসিকতা করে কথাটা বললেও লজ্জায় সে হাত দিয়ে মুখ ঢাকে। ঠিক যেমন লাজে নববধূরা আবিরমাখা মুখের সামনে ঘোমটাটাকে লম্বা করে বাড়িয়ে দেয়।
বৃষ্টিভেজা সেই সন্ধ্যার পর আজ প্রথম দেখাতেই সে ওই প্রসঙ্গ তুলেছে। সন্ধ্যাটা ওর হৃদয়ে কতটা গেঁথেছে তা বুঝতে অসুবিধা হল না। ওর উৎসাহে ভাটা দিতে বললাম, বেশি বকবক না করে কী জন্যে এসেছিস বল। আমি টায়ার্ড—রেস্ট করব।
মা বলেছে জিজ্ঞাসা করতে—সময় করে আমাকে পড়াতে পারবে কিনা।
কীহ! আমি কেন তোকে পড়াতে যাব? আমি কি প্রাইভেট টিউটর?
হলে ক্ষতি কী? ভেবে দেখ, বসায় বসে ছাত্রী পড়াবে। তার উপর মাস শেষে আড়াই হাজার টাকা মাইনে। তুমি চাইলে আমি তিন হাজার পর্যন্ত করে দিতে পারি।
পাগল! আমি পড়াব! তাও তোর মতো একটা পাগলিকে?
তমার প্রাইভেট টিউটর হয়ে পড়াব কিনা—এরকম চিন্তাভাবনা আন্টির মাথায় আসতে পারে না। নিশ্চয় এটা তমার কাজ। তাহলে ওর মাঝে আমাকে ঘিরে অনেক কল্পনাই ইতিমধ্যে বসতি গেড়েছে। তমা ছোট মানুষ। বয়স কতই বা হবে! সেদিনের ঘটনাটা তার হৃদয়ে যে দাগ কেটেছে তা যেন শিকড় গজিয়ে আরও গভীরে না পৌঁছায়, সেজন্য ওর ভাবনার রথ এখানেই থামিয়ে দিতে হবে। বললাম, কীসব ওলটপালট ভাবছিস! দ্যাখ—সেদিনের ছাদের ঘটনাটার জন্য আমি খুবই দুঃখিত।
হঠাৎ একথা বলার পর ওকে দেখে মনে হলো যেন জ্বলন্ত শিখা দপ করে নিভে গেল। আমার দিকে এমন কঠিন দৃষ্টিতে তাকালো যেন সে শিকারির শিকারে পরিণত হওয়া আহত পাখি—আর আমি সেই নিষ্ঠুর শিকারি যে ওই পাখির মুক্তভাবে উড়ার স্বাধীনতা খর্ব করেছি। মুখে শুধু অতটুকুই বলল, কী এমন করে ফেললে যার জন্য আমায় সরি বলছ? ও—আমার মাথা ফাটতে না দিয়ে তো অন্যায়ই করেছ—তাই না? তোমাকে বোঝা বড় দায়! কেন যে সেদিন তোমাকে ছাদে ঢুকতে দিলাম!
কথাটা শেষ করে তমা মুখ টিপে হাসে। আজব সব আচরণ করছে মেয়েটা। এই গম্ভীর—এই হাসিখুশি। তমার এরকম বহুমাত্রিক প্রকাশ আগে কখনো খেয়াল করিনি। বরাবরই তাকে দেখেছি সে বেশ লাজুক স্বভাবের। সেদিন মাকে সামলানোর পর মনে হয়েছিল বৃষ্টিভেজা সন্ধ্যার রেশ ওখানেই শেষ। এখন দেখি সেই সন্ধ্যার দৌরাত্ম শেষ হয়নি—আরও অনেক বাকি!
বেশিক্ষণ সে থাকেনি। চলে গেছে। যাবার সময় বলে গেল, পড়ানোর ব্যাপারে ভেবে দেখো। ডিসিশন আগামী দুই-তিন দিনের মধ্যে জানালেও চলবে।
\ ছয় \
মঙ্গলবার দুপুরে টিফিন পিরিয়ডের আগের ক্লাসটা খুবই বিরক্তিকর! প্রিয়নাথ স্যারের মার্কামারা অপ্রিয় ক্লাস। রসায়নটা এমনিতেই রসকষহীন একটা সাবজেক্ট—তার উপর স্যারের পড়ানোর ঢংয়ে রস যা ছিল তাও বুঝি নিঃশেষ হবার যোগাড়!
ক্লাসটা করব কি করব না বুঝতে পারছি না। শুভ্র এসে ধরেছে ওর সাথে এয়ারপোর্ট যাওয়ার জন্য। জাহাঙ্গীর আলমকে বিদায় জানাতে সে এয়ারপোর্ট যাবে। মিস্টার আলমের আরও কয়েকদিন থাকার কথা ছিলো—কিন্তু কর্মস্থল হতে ডাক পড়ায় তড়িঘড়ি করে চলে যেতে হচ্ছে। এয়ারপোর্ট গেলে কোনমতে এসে হয়তো টিফিনের পরের ক্লাসটা ধরা যাবে। কিন্তু কেমেস্ট্রির সাথে যেখানে এমনিতেই তাল মিলাতে পারছি না—সেখানে ক্লাস না করলে তো আরও বেকায়দায় পড়বো!
শুভ্র আবার তাগিদ দেয়, আরে এত চিন্তাভাবনার কী আছে? চল।
না মামা। তুই আর কাউকে নিয়ে যা।
ধুর শালা, তুই এই ফালতু ক্লাস নিয়ে ভাবছিস? ওই প্রিয়নাথবাবু যা পড়াবে আমিই তোকে বুঝিয়ে দিতে পারব। চল তো।
টিফিনের পর প্র্যাকটিক্যাল ক্লাসটা যদি ধরতে না পারি?
ধ্যাৎ, প্র্যাকটিক্যাল ক্লাস ধরার টেনশন কি তোর একারই? আমার নেই? ক্লাস শুরুর আগেই এসে যাব। রাস্তায় যদি খুব বেশি যানজট থাকে তো বড়জোর একটু লেট হতে পারে। ওটা স্যারকে বলে ম্যানেজ করা যাবে।
তুই কামাল স্যারের কাছে প্রাইভেট পড়িস বলে হয়তো পার পেয়ে যাবি। আমার কী হবে? আমার তো উল্টা আবার লেট প্রেজেন্ট আছে। আরেকবার লেট হলে টোটালি একটা অ্যাবসেন্ট পাব।
কথার ফাঁকে ফাঁকে শুভ্র করিডোরের দিকে নজর রাখছিল। স্যার যেদিক দিয়ে আসে। আমাকে বাগাতে না পেরে স্যারকে দেখতে পেয়ে ‘কর তোর ক্লাস, আমি গেলাম।’ বলে সে তার ব্যাগটা নিয়ে মুহূর্তের মধ্যে হাওয়া হয়ে যায়।
হাতে একটা হাজিরার খাতা ডাস্টার বেত আর চকের বক্স নিয়ে প্রিয়নাথ স্যার ক্লাসে ঢুকলেন। বেত দিয়ে টেবিলের উপর ঠাশ ঠাশ শব্দ করে ক্লাসের কোলাহল থামান—কখনো মারামারির কাজে ব্যবহার করেন না। এই কাজটা মাঝে মাঝে তিনি ডাস্টার দিয়েই করেন। ডাস্টার দিয়ে মারার সময় শিক্ষার্থীরা ব্যথার চেয়ে বেশি ভয় করে চকের গুঁড়াকে।
রোলকল করার পর নিত্যনৈমিত্তিকভাবে স্যার ব্ল্যাকবোর্ডে লিখা শুরু করেছেন। একটার পর একটা বিক্রিয়া টানা লিখে যাচ্ছেন। আর সেদিকে চোখ রেখেই পেছনের ছাত্রছাত্রীদের উদ্দেশ্যে বলে যাচ্ছেন বিক্রিয়া কোন দিক থেকে কোন দিকে কোন পথ ধরে এগোচ্ছে। ব্ল্যাকবোর্ডের দিকে মুখ রেখে বলার কারণে স্যারের কথাগুলো ঠিকমতো বোঝা যাচ্ছে না।
কথা বুঝতে না পারার প্রসঙ্গ নিয়ে একটা গুঞ্জন শুরু হল। অবশেষে ক্লাসের ফার্স্টবয় হিল্লোল এদিক-ওদিক তাকিয়ে ইশারা-ইঙ্গিতে সবার সমর্থন পাবার পর বুকে সাহস সঞ্চয় করে বলে, স্যার—শোনা যাচ্ছে না।
স্যার এবার পেছনে ঘুরে জিজ্ঞেস করলেন, কে বললো?
শঙ্কিত-বিনম্র কণ্ঠে হিল্লোল বলে, স্যার আমি।
সবাই ভেবেছে ফার্স্টবয় হিসাবে স্যার তাকে যৎকিঞ্চিত হলেও সমীহ করবে। কিন্তু সবাইকে নিরাশ করে দিয়ে স্যার হুঙ্কার ছেড়ে বললেন, স্যারদের সাথে দাঁড়িয়ে কথা বলতে হয়—তাও শিখসনি!
মুহূর্তের মধ্যে হিল্লোল লাফিয়ে উঠে দাঁড়ায়।
বেশি করে গোলমাল কর আর মেয়েদের সাথে ফিসফাস কর—তাহলে শোনা যাবে। বস!
তীব্র ধমক শেষে স্যার আগের মতোই ব্ল্যাকবোর্ডের দিকে মুখ করে তার নিজস্ব গতিতে কাজ করে যাচ্ছেন। হিল্লোল একবার ডানে একবার বামে তাকিয়ে হাস্যোজ্জল মুখে সিটে বসলো। তবুও বাঁচা গেল! একটা হুংকার মেরেই এই যাত্রায় স্যার সন্তুষ্ট রইলেন।
মাঝে মধ্যে স্যার ক্লাসের গোলমাল থামানোর জন্য গলা ফাটিয়ে গর্জন করেন। কী যে বিশ্রী লাগে—কানের উপর দিয়ে খুব চাপ যায়! গর্জন শুনে আমরা ভয়ের চোটে না হলেও কর্কশতার তোড়ে থামি। স্যারের মেজাজ বেশি ভালো থাকলে মাঝে মাঝে নিজের জীবনের স্মরণীয় ঘটনা—বিশেষ করে শ্বশুরবাড়ির গল্প করে পুরো ক্লাস জুড়ে হাসির রোল তুলে দেন। আমরা অবশ্য রসালো গল্প শুনে হাসি না বরং ঘটনার উপস্থাপনায় স্যারের চোখ মুখ হাত ও কণ্ঠঘটিত বিরস অঙ্গভঙ্গি দেখে হাসি। কেউ কেউ বিকৃত হাসি হাসে। হাসির তোড়ে স্যার প্রায়ই রেগে যান এবং শাস্তিস^রূপ আগেরচে দ্বিগুণ বেগে বোর্ডে বিক্রিয়া লিখা শুরু করেন।
দুষ্টু স্যারদের শায়েস্তা করতে আমাদের স্টকে প্রচলিত অনেক ধরনের ফাজলামি আছে। প্রিয়নাথ স্যারের বেলায় সেগুলো প্রয়োগ করা যায় না। একবার যদি কাউকে ধরেন তবে সে নির্দোষ হলেও তার খাতা চেক করবেন, সব ওঠানো হল কিনা। গলদ কিছু না পেলে কোন বিক্রিয়া লিখার সময় তিনি কী বলেছেন তা জানতে চাইবেন। তাও আটকাতে না পারলে খাতায় আগের দিনের লিখা চেক করবেন—ইত্যাদি বিভিন্নরকম হয়রানি। যদি একান্তই কোন দোষ বের করতে না পারেন তবুও কোন না কোন ইস্যুতে তাকে তিরস্কার করবেনই। আর বাঁটে পেয়ে গেলে তো তাকে ডাস্টার দিয়ে মেরে সাদা ভূত বানাবেন।
শুভ্র নিলয় আর আমি—তিনজন বরাবরই এক টেবিলে বসি। শুভ্র চলে যাওয়ার পর চন্দন এসে নিলয়ের পাশে বসেছে। স্যারদের চোখ এড়িয়ে সে প্রায়ই ফাজলামি করে। টানা পুরাটা ঘন্টা যাবত বিভিন্নভাবে সে আমাদের দুজনকে হাসিয়ে যাচ্ছে। আমি স্যারকে ফলো করছি আবার চন্দনের সাথেও তাল মিলিয়ে যাচ্ছি। মাঝখানে বসে নিলয় বারবার সাবধান করে যাচ্ছে।
ক্লাসের নির্ধারিত সময় পেরিয়ে যাবার পরও আরেকটু আরেকটু বলে প্রিয়নাথ স্যার বোর্ডে লিখে যাচ্ছেন। সবার আপত্তিকে অগ্রাহ্য করে স্যার লিখছেন তো লিখছেনই। সবই বইয়ে আছে, তারপরও লিখে দেবার এই তাগিদ কিসের তা আমাদের মাথায় ধরে না। চরম বিরক্তির একপর্যায়ে চন্দন জোরসে এক শিস মেরে বসল।
নিলয় তড়িঘড়ি করে ‘দিসনে দিসনে’ বলে ওর হাত টেনে ধরেও আটকাতে পারেনি। শব্দ শুনে স্যার যখন ঘাড় ঘোরাল ততক্ষণে ক্লাসে পিনপতন নীরবতা—আর স্যারের চাহনিতে দশনম্বর বিপৎসংকেত! কাউকে কিছু না বলে তিনি আমাদের দিকে তেড়ে আসলেন। ভাবলাম না জানি এবার কার কপালে কী শনি আছে!
খুব কাছ থেকে স্যারের অগ্নিশর্মা চেহারাটা কিম্ভূতকিমাকার লাগছে। হাতের ডাস্টার মেঝেতে ছুঁড়ে আমার সামনে দিয়ে উবু হয়ে হাইবেঞ্চের উপর থেকে চন্দনের পানির বোতলটা ছোঁ মেরে তুলে নিয়ে দ্রুত ক্যাপ খুলতে লাগলেন। ঠিক বোঝা গেল না তিনি এখন কী করতে যাচ্ছেন। পানি কি নিজেই খাবেন—নাকি কাউকে ধরে খাওয়াবেন! ক্যাপটা খুলে কাউকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে আচমকা নিলয়কে চুল ধরে টেনে দাঁড় করিয়ে ওর মাথায় সমস্ত পানি ঢেলে খালি বোতলটা ছুড়ে ফেলে ক্লাস থেকে বেড়িয়ে গেলেন।
ঘটনা দেখে ক্লাসের ছেলেমেয়েরা থ হয়ে গেল। ভাগ্যিস বোতলে বেশি পানি ছিল না। থাকলে নিলয়কে পুরোপুরি গোসলই করিয়ে দিতো!
স্যার বেরিয়ে যেতে না যেতেই ক্লাসজুড়ে হাসির রোল পড়ে গেল। নিলয় আচমকা বিব্রত হলেও পরে হাস্যোজ্জল মুখে সুন্দর মানিয়ে নেয়। তারপর চন্দনকে ধরে বারকয়েক পেটায়। কিছু উৎসাহী ছেলেমেয়েরা এসে ওকে ঘিরে ভিড় জমায়। কেউ স্যারের নিন্দা করে—কেউ স্যার পাল্টানোর প্রস্তাব দেয়। মোনালিসা পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় উৎসুক চোখে নিলয়ের দিকে তাকায়। তারপর হাতে মুখ চেপে হাসতে হাসতে চলে যায়। ওর হাসির ধরন দেখে আমার হাসি পেল।
ক্যান্টিনে এই সময়টাতে এমনিতেই ভিড় লেগে থাকে। তার উপর আজকে প্রিয়নাথ স্যার কিছু সময় নষ্ট করে লম্বা লাইনের মধ্যে ফেলে দিয়েছে। এই লাইন মাড়িয়ে খাবার পেতে অনেক দেরি হয়ে গেল—তাও আবার কোল্ডড্রিংস পেলাম না। কী যে বিশ্রী একটা অবস্থা!
খাবার নিয়ে নিলয়ের কাছে যেতেই বলে, কীরে—কোল্ডড্রিংস কই?
যা পেয়েছিস তাতেই শুকরিয়া কর। নে—ধর।
দুজনে মিলে একটা ফাঁকা জায়গা দেখে খেতে বসলাম। খেতে খেতে বললাম, দেখেছিস? মোনালিসা তোর দিকে তাকিয়ে কী হাসিটাই না দিলো!
নিলয়ের মাঝে কোন ভাবান্তর দেখলাম না। নতশিরে যে ভঙ্গিতে খাচ্ছিল সে ভঙ্গিমায় থেকেই বলে, তাই নাকি?
আবার জিগায়? ওর হাসির ধরনটা যদি তুই দেখতি না—বুঝতে পারতি কাটা ঘায়ে নুনের ছিটা কাকে বলে! তোর গা জ্বলে যেতো।
ভাগ্যিস তাকাইনি! ওর হাসি দেখে কি তোর গা জ্বলেছে নাকি?
কিছু বলার আগেই নিলয় বাম হাত তুলে ডাকে, এই কুনাল! এদিকে আয়।
কুনাল একটা স্প্রাইট খেতে খেতে ক্যান্টিনের ক্যাশ থেকে যাচ্ছিল। নিলয়ের ডাকে সে কাছে এসেই বলে, শারজা কাপের আপডেট জানিস?
ওইতো, ইন্ডিয়া পাকিস্তানকে চার উইকেটে হারালো। দে মামা, এক ঢোক খাই—বলে কুনালের হাত থেকে সে স্প্রাইটা টেনে নেয়। বুঝতে বাকি রইল না কেন সে কুনালকে ডেকেছে।
ওয়াও! পাকিস্তান কি আর ভারতের সাথে টক্কর দিতে পারে? চিরপ্রতিদ্বন্দ্বী বলে চালিয়ে দিলেই চলে! শচীনের খেলা দেখেছিস? ওহ—যা খেলেছে মামা! আগেই জানতাম ভারত জিতবে।
ক্রিকেটপোকা কুনালের কথা শেষ হয় না। ওকে থামিয়ে দিয়ে বললাম, আরে দোস্ত, এরচে আরও ইন্টারেস্টিং খবর আছে আমার কাছে।
শোনা দেখি তোর ইন্টারেস্টিং খবর।
নিলয় বলে, মামা, শোনা তোর ইন্টারেস্টিং খবর—আমি গেলাম। নামাজের টাইম চলে যাচ্ছে।
নিলয় চলে যাবার পর কুনালকে প্রিয়নাথ স্যারের কাণ্ডকীর্তি শোনালাম। শুনে সেও প্রচণ্ড হাসে। কাহিনী বলতে বলতে যখন মূলফটকের দিকে যাচ্ছিলাম তখন পিছন থেকে প্রভা কাতরস্বরে ডাকল, এই রাইম, একটু এদিকে আয় না!
কি হয়েছে?
হাত বাড়িয়ে ওর ক্যামেরা দেখিয়ে বলে, কয়েকটা ছবি তুলে দে না দোস্ত।
কুনাল বললো, যা তুই। আমি একটু বাইরে যাব।
প্রভার আন্তরিক অনুরোধ উপেক্ষা করতে না পেরে বাধ্য হয়ে গেলাম। কাছাকাছি যেতেই ‘থ্যাংক ইয়্যু দোস্ত’ বলে হাতের ডিজিটাল ক্যামেরাটা বাড়িয়ে দিলো।
ইদানিং প্রায়ই সে রাজনের সাথে কলেজ ক্যাম্পাসে আড্ডা দেয়। শুনেছি ওদের অ্যাফেয়ার চলছে। ছেলেটা এই কলেজের না। উত্তরার দিকে কী একটা কলেজে পড়ে। ফালতু সব বেশভূষায় অভ্যস্ত—একদম ভালো লাগে না! ছেলেটার কানে দুল, হাতে ব্রেসলেট, গলায় কয়েক পরতের চেইন, উফ—কী জঘন্য!
ক্যামেরায় এক চোখ রেখে ওদেরকে পোজ দিতে বললাম। তারপর চোখের সামনে থেকে ওটাকে সরিয়ে এক হাতে রাজনের কানেরদুল টেনে দিয়ে বললাম, এই দুল আর মেগা সাইজের লকেটের কারণে স্ন্যাপ ভালো আসছে না। খুলে নিলে ভালো মানাবে!
স্যুর—স্যুর, বলে রাজন সহাস্যে সেগুলো খুলে পোজ দেয়।
অবস্থা বুঝে কিছুটা আত্মবিশ্বাস নিয়ে নিয়ন্ত্রণ করতে পারলে এধরনের অনেক ছেলেকেই দেখেছি, ওরা বেশ লক্ষ্ণী হওয়ার ভান করে। গোপনে সীমালঙ্ঘনের সময় মানুষের ভেতরটা দুর্বল থাকে। ওর মতো ছেলে গভীর প্রেম কিংবা নিবেদিত বন্ধুত্বে জড়াতে পারে—তা মোটেও বিশ্বাস হয় না। চোখ বন্ধ করে বলে দেওয়া যায় সে ধান্দায় আছে। কাজ শেষ হলে মানে মানে কেটে পড়বে। তাই তার সাথে একটু-আধটু ইয়ার্কি করলে সে যে আমার সাথে দ্বন্দ্বে জড়াবে না—সে বিষয়ে কোন সন্দেহ ছিল না। তার উপর ক্যাম্পাসটা আমার। সব মিলিয়ে সুযোগটা নিলাম।
কয়েকটা ছবি তুলে দেবার পর প্রভা আমার হাত থেকে ক্যামেরাটা নিয়ে রাজনের হাতে দিয়ে ‘আমাদের ছবি তুলে দাও না প্লিজ!’ বলে আমাকে প্রায় জড়িয়ে ধরেই পোজ দিলো। জড়তা বলতে যে একটা শব্দ আছে তা বোধহয় এই মেয়েটার মধ্যে নেই!
প্রভাদের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে একা হয়ে গেলাম। সাবধানে লুকিয়ে একটা সিগারেট ধরিয়ে কলেজের প্লে-গ্রাউন্ডের একপাশ ধরে আনমনে হাঁটছিলাম। বেশ বড় মাঠ। কিছুদূর হাঁটার পর একটা কৃষ্ণচূড়া গাছের ছায়ায় মোনালিসার সাথে দেখা। বসে বসে মনোযোগ দিয়ে কী যেন করছে। দূর থেকে দেখে তাকে একদমই চেনা যায়নি। ঘন ঘন কয়টা টান দিয়ে সিগারেটটা ফেলে ওর কাছে গিয়ে বসতে বসতে বললাম, একা একা এত মনোযোগ দিয়ে কী কর? প্রকৃতির কোন অজানা রহস্য উদঘাটন করছ মনে হয়?
ইয়ার্কিটা সে খেয়াল করেছে কি করেনি তা বোঝা গেল না। পাল্টা প্রশ্ন করল, এত জায়গা থাকতে জ্বলন্ত সিগেরেটটা এভাবে ঘাসের উপর ফেললে যে?
সিগারেটের অবশেষের দিকে তাকিয়ে ভাবলাম, এটা আবার কেমন প্রশ্ন? মোনালিসার দিকে তাকালাম। ওকে যথেষ্ট সিরিয়াস মনে হচ্ছে। বললাম, সিগেরেট ঘাসের উপর ফেলেছি, তাতে হয়েছে কী?
সিগেরেটের আগুনের টেম্পারেচার কত জানো? প্রায় হাজার ডিগ্রী সেলসিয়াস।
হলোই বা—তাতে প্রবলেমটা কী? এক হাজার ডিগ্রী সেন্টিগ্রেড টেম্পারেচারে তো কারো গায়ে ছ্যাঁকা দিইনি—তাই না?
দাওনি মানে? দিয়েছই তো।
মানে?
কেন তুমি জান না—বাঙালি বিজ্ঞানী জগদীশ চন্দ্র বসু প্রমাণ করে গেছেন উদ্ভিদেরও অনুভূতি আছে!
এতক্ষণে বিষয়টা ধরতে পারলাম। বললাম, বাব্বাহ—বেশ প্রকৃতিপ্রেমী মনে হচ্ছে!
আরে প্রেম-টেম আবার কী। কমনসেন্স। একটু ভেবে দেখ, যেহেতু প্রাণ আছে কাজেই সিগেরেটের আগুনের মতো হাইয়ার টেম্পেরাচারে জ্বলা ওদের জন্য নিশ্চয় অনেক কষ্টকর হবে—তাই না?
অবাক না হয়ে পারলাম না। সামান্য উদ্ভিদের অনুভূতি নিয়ে যার এত ভাবনা—এত সমবেদনা! অথচ মানুষের তো শুধু প্রাণ না—মনও আছে। নিলয়ের জন্য ওর অতটুকু অনুভূতি নেই! তবে এমনও হতে পারে কোন ভুল ধারণা থেকে নিলয়ের প্রতি তার এই অবজ্ঞার সূত্রপাত। আজ এই একান্তে নিজেদের মধ্যে প্রসঙ্গটা তুললে কেমন হয়!
চুপচাপ কিছুক্ষণ ভেবে কথাগুলো যথাসম্ভব গুছিয়ে নিয়ে বললাম, মোনালিসা—জানি না তুমি কীভাবে নেবে। অতটুকু বুঝতে পারি তোমার ভেতর একটা সুন্দর মনের বসবাস। কিন্তু বুঝতে পারি না নিলয়ের প্রসঙ্গ আসলে কেন এড়িয়ে যাও। আবার নিলয়কে এই ব্যাপারে জিজ্ঞাসা করলে তোমার কাছ থেকে জেনে নিতে বলে। যতটুকু জানি—নিলয় তোমাকে তার জীবনে চেয়েও পায়নি। ওর ভেতরে না পাবার একটা হাহাকার স্পষ্ট দেখা যায়। কেনই-বা তুমি নিলয়কে তোমার জীবনে গ্রহণ করতে পারনি, বন্ধু হিসেবে অন্তত কারণটা জানার রাইট তো আমাদের আছে?
সে নীরব। কিছু বলে না। আমি বলতে থাকি, দেখ—তুমি যেমন আমাদের বন্ধু তেমনি নিলয়ও। তাই বিষয়টা নিয়ে আমাদের আগ্রহ থাকা কি অনুচিত? আই মীন, তুমি কি এই ব্যাপারটা আমাদের শেয়ার করতে পার না?
মাঠের একটা বিশেষ ঘাসের উপর দৃষ্টি নিবদ্ধ রেখে কথাগুলো বললাম। সে মোটেও স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করছে না। যা বলছিলাম চুপচাপ শুনে গেল। আরও কয়েক সেকেন্ড চুপ থাকার পর সে মুখ খুলে, রাইম—আই এম নট ইন্টারেস্টেড ইন নিলয়। প্লিজ, টক টু মি উইথ এনাদার টপিক।
এক নিঃশ্বাসে কথাগুলো বলার পর ক্ষণিকের নীরবতা নেমে আসে। সে আবার প্রসঙ্গ টেনে বলে, তোমদের যত জিজ্ঞাসা তার সব জবাব নিলয়ের কাছেই আছে। জানতে খুব আগ্রহী হলে তার কাছ থেকেই জেনে নিও।
কোন কথা বললাম না। শুধু ভাবলাম, কেমন কঠিন মানুষরে বাবা!
অদূরে দুইটা শালিকপাখির দিকে চুপচাপ চেয়ে আছি। খাবারের খোঁজে ওরা মাঠের উপর লাফিয়ে বেড়াচ্ছে। একসাথেই উড়ে এসেছিল, তারপর খাবার খুঁজতে দুইদিকে ছুটে গেল। কোত্থেকে আরেকটা শালিক উড়ে এসে যেই ওদের একটার পাশে গিয়ে বসল—অমনিই দূর থেকে অন্য শালিকটা ছুটে এসে নবাগত শলিকটার সাথে ভীষণ লড়াই বাঁধালো। হারালো তো হারালোই—পেছন পেছন ধাওয়া করে ওই নবাগত শালিককে এই তল্লাটছাড়া করে তবেই তার সঙ্গীর কাছে ফিরে এলো। দ্বন্দ্ব তাহলে কেবল মানুষে মানুষে নয়—নান্দনিক রমনীয় সৃষ্টি পাখিদের মধ্যেও সম্পর্কের দাবিতে এরকম সংঘাত চলে!
ভাবতে ভাবতে কোথায় যেন হারিয়ে গিয়েছিলাম, মোনালিসার ডাকে আবার নিজের মধ্যে ফিরে এলাম। সে শান্ত গলায় বলে, রাইম—যদি কখনো তোমার খুব কষ্ট লাগে, তবে খোলা আকাশের দিকে তাকিও। দেখো—আকাশের বিশালতা সব কষ্টকে ম্লান করে দেবে।
এই শহরের অলিতে গলিতে ঘুরতে ঘুরতে সত্যিই ভুলে যাই যে মাথার উপর সুবিস্তৃত একটা আকাশ আছে। রোদ ঝলমলে সাদা ধবধবে মেঘের আড়ালে নীল আকাশের দিকে তাকিয়ে দেখি কতগুলো পাখি দলবেঁধে উড়ে যাচ্ছে। সীমাহীন আকাশটা যে কত কিছুর আশ্রয়! ভালোবাসার জন্য কি ওরকম একটা বিশাল মন থাকতে হয়—যা নিলয়ের নেই? আচ্ছা, নিলয় কি কোন কারণে মোনালিসাকে অনেক কষ্ট দিয়েছে! মোনালিসা কি সেই কষ্টকে দমিয়ে রাখতে প্রকৃতির মাঝে আশ্রয় খুঁজে ফিরে? বড় রহস্যাবৃত লাগে এই মেয়েটাকে। বললাম, আচ্ছা—অবসরে কি তুমি এমন প্রকৃতির সাথেই থাকতে পছন্দ কর?
হ্যাঁ করি। তবে অবসর আর পাই কোথায়? পড়াশোনার বাইরে যতটুকু সময় পাই তাতে একটা পার্টটাইম জব করি।
বিস্মিত হয়ে জিজ্ঞেস করি, তুমি পার্টটাইম জব কর? কোথায়?
একটা শোরুমে। সেলসগার্ল।
কিন্তু সময় কীভাবে দাও?
সপ্তাহে দুইদিন তো ক্লাস থাকে না, তার একদিন পুরাটা। আর যেদিন যেদিন বিকালে ক্লাস থাকে না সেই সময়গুলোও দেই। ওরা পড়াশোনার জন্য ভালোই ছাড় দেয়।
কিন্তু এত প্রেসার নিয়ে তুমি পড়াশোনা করবে কীভাবে?
মোনালিসা কাঁধ ঝাঁকিয়ে বলে, চালিয়ে যাচ্ছি তো। খুব কি খারাপ করছি? আসলে চাইলেই পারা যায়। আমার অবস্থানে থাকলে তুমিও পারতে। তুমি হয়তো জানো না যে আমার বাবা প্যারালাইজড। পরিবারে আমিই একমাত্র সন্তান। সংসারের আয়-রোজগার বলতে তেমন একটা নেই। এখানে খালার বাসায় থাকি। ঢাকায় এসেছি ভালো কোন কলেজে পড়াশোনার উদ্দেশ্যে নয়—সহজে কিছু ইনকাম করে নিজের খরচটা চালানোর জন্য। মফস্বলে থাকলে এটা একটু কঠিন হয়ে যেতো।
এই বয়সে মোনালিসা রোজগার করে। সে একটা মেয়ে হয়েও স্বনির্ভর। অথচ আমি! বাবার টাকা দেদারসে খরচ করি। কারো উপর এভাবে নির্ভরশীল হয়ে আছি—সেই ভাবনার সামনে এর আগে কখনো নিজেকে দাঁড় করাইনি। ইদানিং বাবাকে বেশ অসুস্থ লাগে। মোনালিসার মতো আমাকেও স্বনির্ভরতার পাঠ নিতে হবে। কিছু তো একটা করা যায়। তমার টিউশনির প্রস্তাবটা গ্রহণ করা কি ঠিক হবে!
তোমার বাবা প্যারালাইজড হলো কীভাবে?
আমার দিকে সে একদৃষ্টিতে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে মুখটা অন্যদিকে ফিরিয়ে নেয়। ক্ষীণকণ্ঠে সংক্ষিপ্ত জবাব দিল, তিন বছর আগে স্ট্রোক করেছিল।
কীভাবে হলো—জানতে পারি?
দূর থেকে ঢং ঢং করে টিফিন পিরিয়ড শেষ হবার ঘণ্টা ভেসে আসে। সে ব্যাগ গুছিয়ে উঠে দাঁড়ায়। ব্যবহারিক ক্লাস শুরু হবে। কাঁধে কলেজব্যাগটা রাখতে রাখতে চোখে চোখ রেখে সে জবাব দিল, সে অনেক কথা। আজ থাক, আরেকদিন।
মোনালিসাকে ছাড়তে মন চায় না—তবুও ছাড়তে হবে। ইচ্ছে হয় সারাক্ষণ সারাবেলা তার সাথে এমন সব গল্পে মেতে থাকি—যার কোন শেষ নেই।
চলবে…
পরিচ্ছেদ ৬ অনেক রাতে ফিরেছিল কল্যাণ ওরফে শহীদুল।গাড়িটা শেডে রাখার পর দু’বার হালকা করে মা…..
পরিচ্ছেদ ৫ আকাশে এখন আর মেঘ নেই। হাওয়া হচ্ছে।কদিন পরেই বর্ষা নামবে।একদিন হাসপাতাল থেকে ফিরতে…..
পরিচ্ছেদ ৪ ভোর হয়ে আসছে।রাতে ভালো ঘুম হয়নি।ঘুমের ঘোরে মনে হচ্ছিল দম বন্ধ হয়ে আসছে।এরকম…..
পরিচ্ছেদ ৩ শীত শেষ হয়ে আসছে।রাঙ্গালীবাজনা ঢোকার মুখের রাস্তাগুলো পলাশ ফুলে ভরে গেছে।অথচ ঠান্ডাই।…..