স্বরভঙ্গির কাব্যতত্ত্ব ও মুরাত নেমেত-নেযাত

রুণা বন্দ্যোপাধ্যায়
অনুবাদ
Bengali
স্বরভঙ্গির কাব্যতত্ত্ব ও মুরাত নেমেত-নেযাত

স্বরভঙ্গির কাব্যতত্ত্ব ও মুরাত নেমেত-নেযাত

ইহুদি মার্কিন কবি লেখক ও অনুবাদক মুরাত নেমেত-নেযাত। আমা্দের এই অনুবাদ পর্বের প্রথম কবি যিনি পশ্চিমি মূলধারা কবিতার পরম্পরা ভেঙে অধুনান্তিক কবিতার এক অন্যতম প্রধান মুখ। ইস্তাম্বুলে জন্মগ্রহণ করলেও মুরাত একজন পারসিক ইহুদি। বড় হয়েছেন আমেরিকায়, সাহিত্য নিয়ে পড়াশোনা করেছেন আমেরিকার আমহার্সট কলেজ ও কলম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে এবং ১৯৫৯ থেকে আমেরিকার বাসিন্দা। এই বিবিধ অবস্থানের বিভিন্ন সংস্কৃতির মিশ্রণে ঘটেছে তাঁর মানসিক অভিযোজন। মার্কিন কবি হয়েও তিনি মার্কিন ভাষায় সরাসরি কবিতা লেখেননি। প্রথমে স্বরভঙ্গিহীন তুর্কিভাষার আত্মা দিয়ে গর্ভবতী করেছেন স্বরভঙ্গিযুক্ত মার্কিন ভাষাকে। মসৃণ মার্কিন ভাষার অন্তরে সৃষ্টি করেছেন ফাটল যাকে বিচ্যুতি বলা যায়। এই বিচ্যুতিগুলোই হয়ে উঠেছে তাঁর স্বরভঙ্গি। আর সেই ত্রুটিপূর্ণ মার্কিন ভাষাটিকে হাতিয়ার করেছেন আপন কাব্যসৃষ্টিতে। কীভাবে? তারই বিশদ ব্যাখ্যা দিয়েছেন তাঁর বহুল বিতর্কিত প্রবন্ধে Questions of Accent. ১৯৯৩ সালে প্রথম প্রকাশিত হয় The Exquisite Corpse পত্রিকায় এবং দ্বিতীয়বার প্রকাশিত হয় Thus Spake The Corpse (An Exquisite Corpse Reader, 1988-1999). যা শুধু স্বদেশী বা বিদেশীয়ানার সনাতন আইডিয়াকে লক্ষ্য করে নয়, বরং ভাষা ও ব্যক্তির আইডেনটিটির খোঁজ। ১৯৭৭ সালে লন্ডনের মার্টিন ব্রায়ান এবং ওকিফি প্রকাশনী থেকে প্রকাশিত হয় তাঁর প্রথম কাব্যগ্রন্থ The Bridge. আমেরিকায় যখন আখ্যানধর্মী কবিতার মৃত্যু ঘোষিত হয়েছে তখন তিনি চ্যালেঞ্জ জানালেন এবং কবিতার আখ্যানধর্মীতাকে পরিবর্তন করলেন বর্তমান সময়ের নিরিখে। গড়ে উঠল তুর্কি ও মার্কিন দুই অসম সংস্কৃতি, অসম ভাষা ও প্রতীকের যোগাযোগ সেতু, এক দীর্ঘ কবিতা, যার কেন্দ্রে টলটল করছে একজন অভিবাসীর সাংস্কৃতিক সংঘর্ষের যন্ত্রণা। নিউইয়র্কের ব্রুকলিন ব্রিজ নিয়ে লেখা আমেরিকার মর্ডান কবি হার্ট ক্রেন–এর বিখ্যাত দীর্ঘ কবিতা ইতিপূর্বেই মার্কিন সাহিত্যে গৌরবের আসনে বসে আছে একই নামে। তবু কবি চ্যালেঞ্জ জানাবার স্পর্ধা করেন আপন বিশ্বাসে। এই কবিতা রচনাকালে সত্যজিৎ রায়ের অপু তাঁর চোখে মায়াঞ্জন লাগিয়েছিল বলে জানিয়েছেন মুরাত। তারপর দীর্ঘ তিরিশ বছর পর আমেরিকার তালিশম্যান হাউস প্রকাশনী থেকে প্রকাশিত হয় তাঁর দ্বিতীয় কাব্যগ্রন্থ The Spiritual Life of Replicants. রিড্‌লে স্কটের কল্পবিজ্ঞানধর্মী সিনেমা ব্লেড রানার-এর ওপর ভিত্তি করে লেখা হয়েছিল এই কবিতাগুলো। যেখানে আছে এক অফুরন্ত স্পেস, যেখানে অনন্ত এসে বসে তার অন্তরঙ্গতা নিয়ে। যেখানে বর্তমানের পিঁড়িতে বসে জীবন ও মৃত্যুর প্রেক্ষাপটে অতীত ও আগামীর উত্তর খুঁজছেন এক সচেতন কবি। ২০১৬ সালে তাঁর তৃতীয় কাব্যগ্রন্থ Animals of Dawn. কেন্দ্রিয় চরিত্র সেক্সপিয়ারের হ্যামলেট হলেও এ কোনো হ্যামলেটের তুলনা নয়, বরং এক মেটাফর। কবি চলেছেন সেই মেটাফরের খোঁজে শূন্য ও অশূন্যের ভেতর, বাস্তব ও অবাস্তবের ভেতর, জীবন ও মৃত্যুর ভেতর, স্যা্নিটি ও ইনস্যানিটির ভেতর। সময়কাল ও চেতনা সেক্সপিয়ারের হ্যামলেট নাটকের মূখ্য নিয়ন্ত্রক। এই কালখণ্ডের চেতনাকে রোপণ করেছেন তাঁর সমান্তরাল সময়ের আইডিয়াতে। মুরাত বলেন,“Time is not defined by memory (therefore vertical-memory is deceptive); but by attention, therefore horizontal”. ২০০৩ সালে প্রকাশিত হয় তাঁর প্রবন্ধের বই The Peripheral Space of Photography. ফোটোগ্র্যাফিও শিল্পের একটি মাধ্যম। আর সেই মাধ্যমের ভাষার খোঁজ করেছেন মুরাত। ফোটোগ্র্যাফির কেন্দ্রিয় চরিত্রে থাকে তার পরিধির অস্পষ্টতা, অ্যাপার্চারে আলোর খেলা, তার বেলাঅবেলা। ফোটোগ্র্যাফির ফোকাল পয়েন্টে ঝুলে থাকা এই বিচ্যুতিগুলোই তার রূপারূপের গল্প বলে। আর এইখানেই মুরাত খুঁজে পেতে চেয়েছেন শব্দ ও ছবির মধ্যে, তার ছায়া ও আঁধারে ঝুলে থাকা অন্তর্বর্তী বারান্দা, যেখান থেকে শুরু হয় কবিতাভাষা ও ফোটোগ্র্যাফিভাষার মেলবন্ধন। তিনি শুধু কবিই নন, বিখ্যাত তুর্কি অনুবাদক। তুর্কিভাষা থেকে মার্কিন ইংরেজিতে তাঁর অনূদিত বইগুলো ১৯৯৭ সালে ইসিই অ্যাইহানের A Blind Cat Black and Orthodoxies,  ১৯৮৯ সালে অরহ্যান ভেলির I, Orhan Veli. ২০১০ সালে সেয়হান এরোসিলিকের Rosestrikes and Coffee Grinds. ২০০৪ সালে তিনি সম্পাদনা ও অনুবাদ করেন  EDA: An Anthology of Contemporary Turkish Poetry. এ শুধু কবিতা ও প্রবন্ধের অনুবাদই নয়, মুরাত একে আখ্যা দিয়েছেন একটি ভাষার অনুবাদ বলে। ওয়ালটার বেঞ্জামিন যেমন বলেন, একটি ভাষার অনুবাদযোগ্যতা নির্ভর করে উৎসভাষা থেকে তার দূরত্বের ওপর। মুরাত এই দূরত্বকেই নিহিত করেছেন এই গ্রন্থে যার মূল কেন্দ্রে আছে তুর্কি থিম, ভাষাতত্ত্ব ও মেটাফিজিক্সের নির্যাস। অনুবাদ সম্পর্কে মুরাত বলেন, “The afterlife of a poem exists in translations where all the potentialities and the buried meanings of a poem (its dark-matter force) that the original language suppresses and cannot permit to be expressed can reveal themselves and flower.”

 

It is the task of the translator to liberate the language imprisoned in a work – Walter Benjamin[i]

তো সেই অনুবাদকের ভূমিকা থেকেই প্রথমে দেখে নেওয়া যাক আমাদের অনুবাদ সাহিত্যকে। প্রতিটি ভাষার গায়ে জড়িয়ে থাকে সে দেশের সংস্কৃতি। তার অতীত বর্তমান আর ভবিষ্যৎ সমস্ত আলোড়ন নিয়ে ইউনিফায়েড হয়ে থাকে সময়ের নাভিতে, যাকে ধারণ করে সে দেশের ইতিহাস। সেই নাভি থেকে উৎসারিত তৃতীয় পদচিহ্নে নতজানু কবি সময়ের মিথ ভেঙে গুঁড়ো গুঁড়ো করে মিশিয়ে দেয় আপন কবিতাধুলোয়। ভাষার পরম্পরা ও শিকড়ের আবিষ্কার, তার চারপাশের পরিবেশ ও শিক্ষা থেকে গড়ে ওঠা চেতনার উছলে পড়া আলোয় কবির বোধ। এই বোধ কোনো সীমানা মানে না। এই বোধ প্রতিটি কবির ক্ষেত্রে আলাদা হলেও ভূগোলভাঙা রহস্যে কেবলই মনে হয় আমার প্রাণের পরে চলে গেল কে, আঁখির কোণে ডেকে গেল সে। দেশান্তরের বেড়া ভেঙে, সংস্কৃতির সীমানা টপকে, ভাষামিথের খোলস ছাড়িয়ে কবির এই পাগলপণ পা রাখে বিরহী বাহুর নিরঙ্কুশ অসমতায়। যেখান থেকে শুরু আমাদের অনুবাদ সাহিত্য।

 

অনুবাদের আলোয় দেশান্তরের কবিতাটির এক মৌলিক অস্তিত্ব সৃষ্টি হলেও অনুবাদকের আঙুলে সতত দোল খায় আনুগত্য ও স্বাধীনতার বিতর্কটি। এই আনুগত্য মানে কি উৎস ভাষার অর্থটিকে আক্ষরিক অনুকরণ? এখন এই ভাষার ধারক ও বাহক হল শব্দ, অথচ শব্দ তো ধ্বনিরই প্রতীক মাত্র, শব্দের কোনো অর্থ হয় না। চিহ্ন ও চিহ্নিতের মধ্যে সম্পর্ক স্থাপনের চিহ্নক মাত্র। শব্দ বস্তুর প্রতীক, বস্তু কারো প্রতীক নয়। এই শব্দই তৈরি করে ভাষা। আদিতে যে শব্দের মূলে ছিল নিঃস্বন। ক্রমে পৃথিবীর বিভিন্ন ভাষা ও তার ডায়ালেক্ট, তার বিভিন্ন ধর্ম ও সংস্কৃতির আলোয় জারিত হয়ে একই বস্তু একই ভাবনা একই ঘটনা বিভিন্ন নিঃস্বনে প্রকাশিত। ফলত আমাদের নিঃস্বন প্রতীকে বদলে গেলেও দেশকালের সীমানা ভেঙে আমাদের হাতে এসে পড়ল একই বস্তুর বিকল্প নিঃস্বন বিকল্প শব্দ। বস্তু ও ক্রিয়াশব্দগুলো প্রতীক শব্দ, যাকে রেফার করতে পারি, তবু সে অর্থহীন। আর ভাববাচক শব্দ প্রতীক নয়, যাকে রেফার করতে পারিনা, তবু সে অর্থময়। এইখানে আঙুল তোলে  অনুবাদকের স্বাধীনতার প্রশ্নটি। নিজের মৌলিক অস্তিত্বের খোঁজে সে ঝুঁকে পড়ে সেই শব্দটির দিকে যা ইমোটিভ, সেই ভাষা যা ইন্দ্রিয় স্পর্শে ট্রিগার করে তার আবেগকে, অর্থময় হয়ে ওঠে আপন চেতনার আলোয় অথচ ভাষাবিজ্ঞানের নিরিখে তা অবৈজ্ঞানিক ব্যবহার! আজকের বিজ্ঞানকে পিছনে ফেলে আসে আগামীর জ্ঞান। তাই অবৈজ্ঞানিক আখ্যায় টাল খায় না নতুন পথের পথিক।

 

এখন প্রশ্ন হল এই আনুগত্য ও স্বাধীনতার ব্যালান্স। অনুবাদক প্রথমে একজন লেখক, তারপর সে অনুবাদক। তার লেখক সত্তা তাকে প্ররোচিত করে মৌলিক রচনায়। প্রথমে উৎসভাষার কবির মূর্ত অভিজ্ঞতার বিমূর্ত রূপটি অনুবাদকের পাঠক সত্তায় মূর্ত হয়ে ওঠে, অর্থাৎ দুজনের মধ্যে একটা রেসোন্যান্স, একই বিন্দুতে অনুরণন। উৎসভাষার সাহিত্যটির অন্তর্নিহিত আবেগ যা তাকে ট্রিগার করেছিল তাকে সে পুনঃস্থাপন করতে চায় অনূদিত ভাষায়, নান্দনিক করতে চায় আপন বোধে চেতনার আলোখোঁজ চৌকাঠে। তার এই বোধ তাকে আনুগত্য দেয়, আর ভাষা দেয় স্বাধীনতা। এই দুয়ের ব্যালান্স সতত চলতে থাকে দড়ির ওপর চলমান সার্কাসের মেয়েটির মতো; পাদুটির নিখুঁত চলন তাকে দেয় আনুগত্য আর দুপাশে ছড়ানো হাতদুটিতে আকাশে ওড়ার স্বাধীন ডাক। উড়ে আসে অক্ষরের ইশারাপাখি। অথচ পাখিডাকের প্রতিশব্দের মতোই ধ্বনিপ্রকল্পনায় নিঃশব্দ সে। বিকল্প নিঃস্বনে সম্ভাবনারা কাজলিত হলে ভাষাপ্রণালীও বৃষ্টির ডাক পায়।

 

তো সেই অনুবাদ সাহিত্যের আস্বাদ নিতে এবারে আসুন, শুরু করি মুরাত নেমেত-নেযাতের স্বরভঙ্গির প্রশ্ন গদ্যটির অনুবাদপাঠ।

 

Questions of Accent by Murat Nemet-Nejat

স্বরভঙ্গির প্রশ্ন

প্রথম পর্ব

প্রথম। ব্যক্তিগত স্বরভঙ্গি

আমি কোনো অধিবাসীর মতো ভাষায় কথা বলি না। যদিও ১৯৫৯ সাল থেকে আমি যুক্তরাষ্ট্রের বাসিন্দা, আমার স্বরভঙ্গি এখনও বিদেশীর মতো শোনায়। আমি তুরস্কে জন্মগ্রহণ করেছি, কিন্তু তুর্কি নই। আমি ইহুদি। পঞ্চাশের দশকে তুরস্কের বেশিরভাগ ইহুদি ছিল সেফার্ডিম এবং লাদিনো স্প্যানিশ ভাষায় কথা বলতো। কিন্তু আমি সেফার্ডি নই; আমি পারস্যদেশীয় ইহুদি। আমার বাবা মা ব্যবসার জন্য ইস্তাম্বুলে এসেছিলেন এবং আমি সেখানে ইহুদি প্রতিবেশীদের মধ্যে জন্মগ্রহণ করি। কিন্তু আমি লাদিনো শিখিনি, এটা কোনোরকমে বুঝতে পারতাম। প্রতিবেশী ইহুদি বাচ্চারা মনে করত আমি মুসলমান, একজন বহিরাগত। বাড়িতে আমার বাবা মা পরস্পরের সঙ্গে ফার্সিতে কথা বলতেন। সেটাও আমি কোনোরকমে বুঝতে পারতাম। আমরা ভাইয়েরা নিজেদের মধ্যে তুর্কিতে কথা বলতাম। আমার মা একজন প্রবাসীর মতো ভাঙা ভাঙা তুর্কি ভাষায় কথা বলতেন (আমার বাবা পারতপক্ষে আমার সঙ্গে কথা বলতেন না)। তুর্কি আমার মাতৃভাষা হয়ে উঠল। আমি রাস্তায় তুর্কি ভাষায় কথা বলতাম। আমি ভাষাগতভাবে সবচেয়ে বেশি স্বচ্ছন্দ বোধ করতাম অন্যান্য তুর্কিদের সঙ্গেই যারা বেশিরভাগই ইহুদিদের অবজ্ঞা করত। আমার কথাবার্তা প্রায় তুর্কি হয়ে উঠল। যে ভাষা পুরোপুরিভাবে আমার নিজের নয় তার প্রতি ভালোবাসা ইহুদি হিসেবে নিজেকে প্রকাশ করার প্রথম পদক্ষেপ হয়ে উঠল। প্রায় স্বরভঙ্গিহীন কথাবার্তা সত্ত্বেও, আমার বিদ্রোহের প্রথম পদক্ষেপ ছিল আমার তুর্কি বন্ধুদের জানানো যে আমি তাদের একজন নই, আমি ইহুদি।

 

দ্বিতীয়। লেখক অবরোধের ভেতর খোঁজ

১৯৫৯ সালে আমি তুরস্কের হৈচৈ ছেড়ে এলাম, পিছনে পড়ে রইল তাদের রক্তে মিশে থাকা গোঁড়ামি ও আবেগের অনুরণন। যদিও তখন আমি ততটা ভাবিনি যে আমি ছেড়ে এলাম আমার মাতৃভাষা, যা তুর্কি, যা আমি নই। ১৯৬১ সালে আমি একজন লেখক হওয়ার সিদ্ধান্ত নিলাম। একজন মার্কিন লেখক হিসেবে আমার প্রথম কাজ হল আত্মাহুতি দেওয়া। একদিন ইংরেজিতে স্বপ্ন দেখব এই আশায় আমার মধ্যে থাকা তুর্কিয়ানা ধ্বংস করতে হয়েছিল। যখনই কোনো ভাবনা তুর্কিভাষায় ভাবতাম আমি তাকে বাতিল করতাম, ছেঁটে ফেলতাম। আমি ঠিক করেছিলাম সেই ভাবনাকে প্রশ্রয় দেবো না যতক্ষণ না আমি ভাবতে পারছি ইংরেজিতে, যে ভাষা আমাকে অভিভূত করেছিল কারণ আমি মাত্র ছ বছর আগে এই ভাষায় আমার প্রথম শব্দ উচ্চারণ করি। ফলত আমার একটি লেখক অবরোধ তৈরি হল যা প্রায় দশ বছর ধরে চলেছিল। তখন আমি বছরে তিনচারটে কবিতা লিখতাম, সবই দশ লাইনের মধ্যে। আমার প্রথম সাফল্য এল The Bridge কবিতায়, যা একটি আখ্যানধর্মী দীর্ঘকবিতা, লিখেছিলাম দীর্ঘ পাঁচ বছর ধরে (১৯৭০-১৯৭৫)।

 

তৃতীয়। ভাবনা, কথাবার্তা ও কাজ

এখন, একজন চিন্তাবিদ যুবক হিসেবে, আমি একটা স্বরভঙ্গিতে ইংরেজি বলি। আমি তুর্কিও বলি একটা স্বরভঙ্গিতে। অথচ তুর্কি ভাষা স্বরভঙ্গিহীন সমতলীয় ভাষা, যাতে সমস্ত স্বরবর্ণ সমদৈর্ঘ্যের। ইংরেজির প্রাস্বরিক ছন্দ বিরোধ বাধায় আমার তুর্কিভাষায়। যখন আমি কথা বলি, তুর্কিরা মনে করে আমি সাইপ্রাসের বা আর্মেনিয়ার লোক, একজন বহিরাগত। আমি যদি ইংরেজি না বলে এক সপ্তাহ তুর্কিতে থাকি তবে আমার তুর্কিভাষার স্বরভঙ্গি প্রায় অদৃশ্য হয়ে যায়। প্রাচ্যের বিখ্যাত কার্পেটের ব্যবসা আমার, যা বেশিরভাগ ফার্সি ইহুদিদের অধিনে। আমার ফার্সি অবিশ্বাস্যভাবে উন্নত হয়েছে। আমি দৈনিক ব্যবসায়ীক ভাষা, তার দরাদরি, হালচাল, নাটকীয়তা, কৌতুক (যা আমি খুব ভালো পারি) অনায়াসেই বলতে পারি; কিন্তু আমি ফার্সিভাষায় অশিক্ষিত। যখন কোনো ব্যবসায়ী, আমিও একজন কবি জানতে পেরে সাদী বা হাফিজের কবিতা আবৃত্তি করেন, আমার কাছে সম্পূর্ণ অবোধ্য মনে হয় (এবং সামান্য বিরক্তিকরও বটে)।

 

 

চতুর্থ। AM-erica

“America” -র প্রথম দুটি অক্ষর অসীম রোমাঞ্চকর বলে আমার মনে হয়। এর অর্থ তুর্কিতে  “যোনি” এবং ইংরেজিতে “আমি”। এটি মাতৃত্ব/যৌনতা (“AM” বিপরীতমুখে “MA”) এবং ব্যক্তিপরিচয়ের টানাপোড়েনে অনুরণিত হয়। আমি যখন এই ভাবনাটা লিখছি, হঠাৎ লক্ষ্য করি  “AM” শব্দটি স্বাভাবিক শব্দমাত্রার ভাঙনকে বিকৃত করছে। এটি “আ-মেরিকা” স্বরভঙ্গি পাচ্ছে।  আমি শুধু ইংরেজি বলিই না, মানসলোকেও শুনতে পাই এর স্বরভঙ্গি। আমার জন্য মার্কিন ইংরেজির আসল শক্তি, এমনকি এর প্রকৃতিও এই স্বরভঙ্গির মধ্যে, এই স্বরভঙ্গিতেই নিহিত : “শোনা গানের সুর কি মিষ্টি, কিন্তু যারা অশ্রুত….”

আমার কাছে একটি ভাষার সত্যিকারের শক্তি বা অনুপ্রেরণা তার সচেতন বা অচেতন বিচ্যুতি, ফাটল বা অসম্পূর্ণতাগুলো। আমি একজন কবি, মার্কিন কবি, কারণ আমার একটি ত্রুটিপূর্ণ কান আছে। এই ত্রুটিই আমার সম্ভাব্য প্রতিভা এবং তাদের সীমাবদ্ধতার উৎস। কিন্তু ইংরেজির আগে যে সমস্ত ভাষা আমি জানতাম সেইসব ফরাসি, তুর্কি বা ফার্সি ভাষার কবিরা কেন নয়?

 

পঞম। ইহুদিয়ানা ও স্বরভঙ্গি

গত বছর আমি জোয়েল লুইশ পরিচালিত ইহুদি লেখকদের ওপর একটি ওয়ার্কশপে অংশগ্রহণ করি। জোয়েল নিখুঁতভাবে উপস্থাপনা করেছিলেন অংশগ্রহণকারীদের বিকল্প পরিসর সম্পর্কে, চিকেন স্যুপ ও ব্রেডের টুকরো ভাসানো (আনন্দদায়ক) কবিতা, আইজ্যাক বাশেভিস সিঙ্গারের ‘The Black Wedding’ গল্পের সেই দর্জি, Fiddler On The Roof গানে ইহুদি গ্রাম বানিয়ে দেওয়ার প্রতিশ্রুতি, Bronx এ Lower East Side থেকে Grand Concourse পর্যন্ত আন্দোলন সম্পর্কে লুইশ ওয়ার্সের চমৎকার কবিতা, ইদ্দিস ও গোইশ সংস্কৃতির মধ্যে সংঘর্ষ সংক্রান্ত প্রাকযুদ্ধ ইউরোপের কবিতাগুলির অনুবাদ এবং প্রিমো লেভির অনুবাদ করা হলোকাস্টের হানা দেওয়া স্মৃতি নিয়ে কবিতা। আমি অ্যাশকেনাযি ইহুদি নই। যদিও আমি প্রত্যেক ইহুদির একজন বহিরাগতের অন্তর্নিহিত মানসিক অবস্থানের অংশীদার, তবু আমি মনে করি তুর্কি নাৎসিদের দ্বারা কখনই আক্রান্ত হয়নি। আমি বাড়িতে কখনও matzo ball[ii] খাইনি। নির্দিষ্ট ইউরোপীয় বা আমেরিকার মূলধারার অর্থে, যা ওই ওয়ার্কশপে সংজ্ঞায়িত হয়েছিল, আমার লেখায় সেভাবে খুব সামান্যই ইহুদিয়ানা আছে। তাহলে কি আমি ইহুদি নই? এ এক অর্থহীন প্রশ্ন, কারণ আমি ইহুদি। ইস্তাম্বুলে ইহুদি বাচ্চাদের মধ্যে যেমন মনে হত, ঠিক সেরকমই ওই ওয়ার্কশপে আবার একবার নিজেকে বহিরাগত বলে অনুভব করলাম যারা একই ভাষায় কথা বলে না।

তাহলে কেমন করে  আমি একজন ইহুদি লেখক, কীভাবে আমি মার্কিন ইংরেজিতে কবিতা লিখছি যা আমার ইহুদি লেখার সংস্করণ?

 

ক্রমশ…

 

 [i]  The Task of the Translator by Walter Benjamin, P-261

[ii] Matzo Ball – These are balls (like meatballs, “koftas”) made of crumbs of unleavened bread, that Jews solely eat during Passover.

রুণা বন্দ্যোপাধ্যায়। কবি, লেখক ও অনুবাদক।

এই বিভাগের অন্যান্য লেখাসমূহ

তিনটি আমেরিকান কবিতায় কোভিড-১৯ এর অনুভব

তিনটি আমেরিকান কবিতায় কোভিড-১৯ এর অনুভব

ভূমিকাঃ কোভিড-১৯ বিশ্ববাসীকে নানান অভিজ্ঞতায় প্লাবিত করেছে। কেউ নিজে আক্রান্ত হয়েছেন। কেউ স্বজন, বন্ধু, প্রতিবেশীহারিয়েছেন।…..