স্বরভঙ্গির কাব্যতত্ত্ব ও মুরাত নেমেত-নেযাত (২য় পর্ব)

রুণা বন্দ্যোপাধ্যায়
অনুবাদ, প্রবন্ধ
Bengali
স্বরভঙ্গির কাব্যতত্ত্ব ও মুরাত নেমেত-নেযাত (২য় পর্ব)

পূর্ব প্রকাশের পর…

ষষ্ঠ। স্বরভঙ্গিহীন এক ইহুদি

এই উত্তরের বীজবপন হয়েছিল জেব্‌সের মুখোমুখি হয়ে, যাঁকে মার্কিন দৃষ্টিভঙ্গিতে এই ওয়ার্কশপটি উপস্থাপিত করে ইহুদি সাহিত্যশিল্পীদের একজন রাজা হিসাবে, যিনি “Book in Exile” গ্রন্থের লেখক। আমি জেব্‌স সম্পর্কে কৃত্রিমতাগুলো কী, তারই বিশ্লেষণ করে বুঝতে শুরু করলাম আমার মধ্যে কোনটা ইহুদিয়ানা, কীভাবে জেব্‌সকে একজন আদর্শ ইউরোপীয় ইহুদি হিসাবে দেখা  আমার ও আমার মতো অন্যান্য অপশ্চিমী ইউরোপীয়দের ইহুদি লেখক হিসেবে অস্বীকার করা বোঝায়। আমাদের ইহুদিয়ানার পচ্ছন্দগুলোর মৌলিক বৈসাদৃশ্য সত্ত্বেও জেব্‌স ও আমার প্রেক্ষাপট সমান। সুতরাং জেব্‌সের একটা সংক্ষিপ্ত সমালোচনা নিয়ে আমার এগোনো আবশ্যক।

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে জেব্‌সের অস্তিত্বের মূল কারণ দেরিদা তাঁকে “আবিষ্কার” করেছিলেন; দেরিদার আবিষ্কৃত ও “অনুমোদিত” বলেই জেব্‌স বিদ্যমান। জেব্‌সের কোনো স্বাধীন পূর্বস্বীকৃতি ছিল না। এটা দেখা খুবই জরুরী যে দেরিদার অনুমোদন ছাড়া আমেরিকায় জেব্‌সের কোনো অস্তিত্ব থাকত না। সুতরাং জেব্‌সের সমালোচক আসলে দেরিদার সমালোচক, ফলত তা মূলধারার মার্কিন বুদ্ধিজীবীর ইউরোপের ওপর মনোনিবেশের সমালোচনা। কেন দেরিদা জেব্‌সকে আবিষ্কার করলেন? এ কি কোনো সৌভাগ্যজনক ঘটনা যা প্রতিটা শিল্পীরই চিলেকোঠা স্বপ্ন? মোটেই তা নয়। তাঁকে “আবিষ্কার” করে দেরিদা নিজেকে বিধিসম্মত করেছিলেন। তাঁদের দুজনেরই পশ্চাৎপটে ছিল উত্তর আফ্রিকা, তাঁরা দুজনেই উত্তর আফ্রিকা্র ইহুদি, এক অবশ্যম্ভাবী ভাষাগত শ্রেণীবিন্যাস। দেরিদা আরবদের মধ্যে ফরাসি ভাষায় কথা বলতেন, যাকে বলা যায় উপনিবেশবাদী ভাষা। যখন তিনি ফ্রান্সের মূল ভূখন্ডে চলে আসেন, তখন কর্মজীবনে উন্নতির লক্ষ্যে ভাষাগতভাবে ক্ষমতার দিকটাই বেছে নেন। তিনি ফরাসি গদ্যে “বিকশিতদের” একজন হয়ে উঠলেন।

মিশরে বড় হয়ে ওঠা জেবস্ ফারসি বলতে পারতেন। একজন মিশরীয় ইহুদি হিসাবে জেব্সের ফারসি মিশরের সুবিধাপ্রাপ্ত শ্রেণীর ভাষা, আরবী “বালি” দিয়ে ঘেরা ক্ষমতার অধিকারী দ্বীপ। জেবসের ফারসি টলস্টয়ের ওয়ার অ্যান্ড পিইস এবং অ্যানা ক্যারেনিনার মতো, যেখানে প্রধান চরিত্ররা অভিজাত পরিবারের এবং যাঁরা নিজেদের মধ্যে রুশি না বলে ফারসি বলতো। এ কারণেই রুশি ভাষায় লেখা এইসব উপন্যাসগুলি পড়লে নীরব অনুবাদের মতো মনে হয়।

জেবস্ও দেরিদার মতো ফ্রান্সে চলে আসেন। তাঁর “ভাষাগত নির্বাসন”-এর থিম মূলত ইহুদি বা রহস্যময় ডায়াসপোরা বা ঈশ্বর (হাশেম) থেকে দূরত্বের থিম নয়; তাঁর দূরত্ব তাঁকে ঘিরে থাকা ও পিছনে ফেলে আসা সেই সব অবহেলিত মানুষ ও তাদের আরবি ভাষা থেকে নির্বাসন। অন্তত মানসিকভাবে তাঁর সত্যিকারের বাড়ি (যদি তিনি প্রতিবেশী বাচ্চাদের সাথে কখনো খেলে থাকেন) আরবি হলেও জেব্‌সের ফারসিভাষার ওপর আরবির কোনো প্রভাব নেই। তাঁর ফারসিতে কো্নো স্বরভঙ্গি নেই। যদি তা থাকত তবে তা গ্রহণযোগ্য হত না, কারণ বিশুদ্ধতা একটি ফরাসি আদর্শ যা তার কেন্দ্রীয় ঐতিহ্যের সাথে ঘনিষ্ঠভাবে সম্পর্কযুক্ত এবং তা স্বরভঙ্গিকে প্রতিহত করে। মিশর শুধুমাত্র একটি আলংকারিক রূপক (বুদ্ধিমান চমকের ছোঁয়া দেওয়া: বালি, মরুভূমি, মরুদ্যান ইত্যাদি “আরবিয়ানা,” যা উত্তরনেপোলিয়ান ফরাসি রুচির কাছে গ্রহণযোগ্য) হিসেবে এসেছে তাঁর কাজে। আমি এটা যেভাবে দেখি, স্মৃতিহীন তাৎক্ষনিক অভিজ্ঞতার বিচ্ছিন্ন সিরিজ হিসাবে জেব্‌সকে তাঁর নিজের লেখা নিতে হত, স্মৃতি এক নেতিবাচক স্থান (এ এক নান্দনিকতার চাবিকাঠি তাঁর জন্য, দেরিদার জন্য এবং তাঁদের দ্বারা প্রভাবিত মার্কিন কবিদের জন্য) কারণ একটা বিশৃঙ্খল রাজনৈতিক বাছাই এখানে অন্তর্নিহিত : এক ইহুদি অবহেলিতের পরিবর্তে সুবিধাপ্রাপ্ত শ্রেণী ও তার ভাষা নির্বাচন। জেব্‌সের ইহুদিবাদ ভ্রান্ত (অঙ্গীভূত) কারণ তার প্রকৃত স্থান “হাশেম” হল আরবি, যাকে তিনি চমকপ্রদ করতে গিয়ে দুর্বল করে তুলেছেন। ইহুদিয়ানা তাঁর অতীত, রাজনৈতিক পছন্দের স্মৃতি, শৈশবের অভিজ্ঞতা থেকে তাঁর বিচ্ছেদ গোপন করার এক কেতামাফিক কৌশল। যখন দেরিদা জেব্‌সকে “আবিষ্কার” করলেন, তখন তিনি তাঁদের এই অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভাষাগত (সুতরাং ক্ষমতা) বাছাই উপেক্ষা করেন। ১৯৯২ এর পোয়েট্রি প্রজেক্টে ডেভিড শ্যাপিরো তাঁর অনুভবী বক্তৃতায় বলেছিলেন যে তাঁর এই “বিপ্লবী” আচরণের অধীনে দেরিদা মূলত একজন শিক্ষানবিশ, যিনি সূ‌ক্ষ্ম ও তীব্র ফরাসি ভাষার এক নতুন বিকাশ অর্জন করছেন।

আমার এক ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা আছে, প্রায় এক বছর আগে আমি 42 স্ট্রিট গ্র্যাজুয়েট সেন্টারে দেরিদার লেকচারে যোগ দিয়েছিলাম। তাঁর নব্বই মিনিটের অসাধারণ মনোরম ও স্বতঃস্ফূর্ত বক্তৃতা “উপহারটি উপহার নয়” যদি স্বীকার করা যায় তবে এই চেতনাটি কেবলমাত্র “উপাদানগত উচ্চারণ” বলেই অযোগ্য হয়ে ওঠে। আমি জানতে পেরেছিলাম যে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে এক সপ্তাহের সফরের জন্য দেরিদা ২০০০০ ডলার নেন। দেরিদা জেব্‌সকে “আবিষ্কার” করেন কারণ জেব্‌স তাঁর আকাশচারী, কারুকার্যময় গদ্যে সম্ভাব্য একই ধরনের তারকা, যাঁর অবশ্যম্ভাবী বাছাই একই রকমের ছিল। দেরিদার “আবিষ্কার” আসলে আত্মপক্ষ সমর্থনের জন্য।

মার্কিনিরা মূলত জেব্‌সের দেরিদা সংস্করণটিকে গ্রহণ করেছে, যা বিকৃত এবং সমালোচনামূলক নয়, এমন এক সংস্করণ যা অবচেতনে দেরিদার মতামতগুলোকে শক্তিশালী করে, যা লেখক হিসাবে তাঁর ত্রুটি এবং সীমাবদ্ধতাগুলোকে “স্বাভাবিক” ও “সার্বজনীন” সত্য হিসেবে অন্তর্ভুক্ত করে। অন্য সবকিছুর ওপরে জেবসের ইহুদিয়ানাকে (যা আমার কাছে, আরবি মুদ্রণ ছাড়া এক ফ্যাশনেবল “স্বাদ”) জোর দেওয়াটা খুবই বিভ্রান্তিমূলক (এবং মার্কিন লেখকদের এটা প্রতিরোধ করা উচিত) কারণ এটি খুব সহজেই (দেরিদা যেমন চেয়েছিলেন) লেখক হিসাবে তাঁর বাছাইকে এক রাজনৈতিক মাত্রা দেয়। জেব্‌সের ইহুদিয়ানা এক রহস্যময় থিম, আমি বিশ্বাস করি মিশর ও আরবির তৃতীয় বিশ্ব ছেড়ে যাওয়ার জন্য রাজনৈতিক বিষয়টিকে আচ্ছাদনের এ এক মুখোশ। এই দৃষ্টিকোণ থেকে দেখলে জেব্‌সের “ইহুদিয়ানায়” দৃঢ় “পশ্চিমি” ঔপনিবেশিক মাত্রা রয়েছে, যেমন পল দে ম্যান্সের বিশুদ্ধ, “অরাজনৈতিক” বিনির্মাণ, যেমন আমেরিকান বুদ্ধিজীবী হ্যারল্ড ব্লুমের নিজের নাৎসি শিকড় আবিষ্কার করে ভীত হওয়া।

একই দৃষ্টিকোণ থেকে দেখলে, অ্যালবার্ট কামুর দ্য স্ট্রেঞ্জার, আদি উত্তর আফ্রিকান ফরাসি কাজ, একটি জাতিগত খুন, সমুদ্র সৈকতে আরবে আসা অপরিচিত একটি সাদা লোকের দ্বারা আরবি হত্যা; নায়কের বিভ্রান্তিকর আচরণ মুছে ফেলা, বাধা হিসেবে ব্যবহার ও তার দায়িত্ব লোপ করা, অস্তিত্ববাদের কুয়াশাচ্ছন্ন রহস্যময়তার ভেতর মননশীল সমর্থন, এ সবই কি দ্য স্ট্রেঞ্জার-এর অমর “শৈলী” নয়? আরবে নতুন সেই নায়ক অপরিচিতের মধ্যে নিজেকে “যুক্তিসঙ্গত” করে তোলে। কামুর এই লোবোটোমাইজড স্টাইল এবং জেব্‌সের সফিস্টিকেটেড আরবিয়ানা: রাজনৈতিক ও নৈতিক বিভ্রান্তির এই সমান্তরাল কাজগুলো একটা প্রজন্মকে পৃথক করে। শুধুমাত্র ফ্রান্সের গৌরবময় সভায় গৃহীত হওয়ার জন্য একজন উত্তর আফ্রিকান ইহুদিকে কি কেবলই সাদা মানুষের নোংরা কাজ করতে হবে?

সপ্তম। স্বরভঙ্গিযুক্ত এক ইহুদি: ক্ষমতার প্রতি দ্ব্যর্থকতা অসম্পৃক্ত ইহুদিদের ভাগ্য

ক্ষমতার প্রতি দ্ব্যর্থকতা আমার মতে সমসাময়িক ইহুদি থিম, প্রতিটি ইহুদি লেখককে সচেতন বা অচেতনভাবে, স্বেচ্ছায় বা অনিচ্ছায় যার মুখোমুখি হতে হয়। এই দ্ব্যর্থকতা আছে ইহুদি ইতিহাসে, ইহুদি ব্যক্তিত্বে, তার পুরাণ ও ইতিহাসের বিরোধের ভেতর। তার প্রতিবাদ সত্ত্বেও, Torah এক ইতিহাস যা লেখা হয়েছিল ঈশ্বর চিহ্নিত শক্তিশালী এক জাতির দ্বারা, যারা অন্যের জমি নিজের বলে কেড়ে নেয়। অন্যদিকে ডায়াস্পোরার ইতিহাস এক প্রতারিতের ইতিহা্স,‌ অধিকারচ্যুত, বহিষ্কৃত, সংগঠিত সাম্প্রদায়িক হত্যাকাণ্ড ও হোলোকাস্টের শিকার। কোথায় থাকবে ইহুদির আনুগত্য? সমসাময়িক ইহুদি তাহলে শক্তিশালী নাকি অবহেলিতের সহযোগী হবে? যদিও এই দ্বন্দ্ব ইসরাইলের জন্মের পরে স্পষ্ট হয়ে উঠেছে, তবুও তা অন্তর্নিহিত ছিল, যেহেতু ইহুদি গোষ্ঠী আত্তিকরণ গ্রহণ করেছিল এবং শারীরিকভাবে মহল্লা থেকে বেরিয়ে গেছিল। প্রায়শই অর্থনৈতিকভাবে ইহুদিরা বিশেষাধিকারী শ্রেণীভুক্ত ছিল; কিন্তু সাংস্কৃতিক ও ভাষাগতভাবে তারা ছিল বাইরের এবং অবহেলিতের দলে। ইহুদি হিসেবে দেরিদা ও জেবস্‌ এই দ্ব্যর্থকতা মুছে ফেলেছিলেন, উপেক্ষা করেছিলেন, রেহাই পেয়েছিলেন। তাঁদের বাছাই ছিল চরম, কারণ তা ক্ষমতার প্রতি। জেব্‌স ও দেরিদার লেখা স্বরভঙ্গিহীন, দ্ব্যর্থকতাহীন ফরাসি। তাঁরা ইহুদি আত্তীকরণ শৈলী ও ক্ষমতার সঙ্গে সনাক্তকরণের প্রতিনিধিত্ব করেন। তাঁদের লেখার রাজনৈতিক মাত্রা তাঁরা গোপন করেন এবং তাঁদের মার্কিন ভক্তরা উপেক্ষা করেন।

অষ্টম। স্বরভঙ্গিযুক্ত লেখা তাহলে কী?

তাহলে কেমন সেই লেখা যাতে স্বরভঙ্গি আছে? এ এমন এক লেখা যা ব্যবহৃত ভাষার কতৃত্ব বা ক্ষমতাকে সম্পূর্ণরূপে শনাক্ত করে না বরং মুখোমুখি হয় ভাষা ও তার ব্যবহারকারীর মধ্যে ফাঁকটাকে ঝকমকে না করেই। এই ধরনের লেখা ক্ষমতার প্রতি দ্ব্যর্থকতা প্রকাশ করে: লেখক বেছে নেন সেই ভাষাকে (তার বিস্তৃত কেন্দ্রীয়তার জন্য), যা তিনি জানেন যে এটা সম্পূর্ণরূপে তাঁর নিজের নয়, তাঁর আভ্যন্তরীণ উদ্দেশ্যের জন্য অপর্যাপ্ত। লেখার স্বরভঙ্গির সঙ্গে কোনো সুস্পষ্ট প্রসঙ্গ বা শব্দার্থগত অনুষঙ্গের তেমন কিছু সম্বন্ধ নেই; বরং তার বয়ন, গঠন, আঁচড়ের দাগগুলো, বিকৃতি এবং লেখক ও তাঁর গৃহীত ভাষার মধ্যে বহিরাগত সম্পর্কহেতু তৈরি হওয়া কষ্টকর ফাঁকগুলোর সঙ্গে তার সম্বন্ধ। স্বরভঙ্গি হল স্বচ্ছ পৃষ্ঠের ওপর বিচ্যুতিগুলো (অচেতনতায়, একজন বক্তা যখন কথা বলেন তিনি যেভাবে তাঁর স্বরভঙ্গি সম্পর্কে উদাসিন থাকেন, তাঁকে এটা তৈরি করতে হয় না)।

স্বরভঙ্গিযুক্ত ইহুদি লেখা ক্ষমতার প্রতি দ্ব্যর্থকতা মুছে ফেলার পরিবর্তে তাকে অঙ্গীভূত করে। এটা করার জন্যই তার স্বরভঙ্গি সৃষ্টি হয়। আমার কাছে কাফ্‌কাই প্রথম আধুনিক ইউরোপীয় লেখক, যিনি তাঁর ভাষার বয়নে ক্ষমতার প্রতি ইহুদি দ্ব্যর্থকতা প্রকাশ করেছেন। লেখক হিসাবে তাঁর বেছে নেওয়া ভাষা ইদ্দিশ বা চেক না হলেও তা বৈধ জার্মান (এক জটিল আইনি নথি হিসেবে), ক্ষমতার দ্বিগুণ অন্তর্ভুক্তি: প্রথমত সাংস্কৃতিক মূলধারা, দ্বিতীয়ত তার সেই অংশটি যা তার ক্ষমতার সংকেত দেয়। কিন্তু কাফকার স্বরভঙ্গি আইনি সংকেত উৎখাত করে, তার অর্থ থেকে তাকে মুক্ত করে, ক্ষমতাশালীর ভাষাকে পরিবর্তন করে তাঁদের ভাষায় যাঁরা বিচ্ছিন্নতাবোধের শিকার। মজার ব্যপার হল কাফ্‌কার গল্পগুলোতে (যা তাঁর ডায়েরির বিপরীতে) ইহুদিদের সরাসরি উল্লেখ খুব কম, শব্দার্থগতভাবে প্রায় নেই বললেই চলে, আছে কেবল শৈলীগত ইহুদি বিষয়।

নবম। মার্কিন শব্দের নির্যাস, এটা কি ডায়াস্পোরার সংগীত হতে পারে?

কাফকা কেন Amerika লিখলেন, কেন তিনি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বিষয় নিয়ে আকৃষ্ট হলেন? জার্মানও Am-erika উচ্চারণ করে। তিনি কী শুনলেন ওক্‌লাহোমা শব্দে? এক বন্য, অপরিচিত, দূরবর্তী জার্মান শব্দ ওক্‌লাহোমা! একই সময়ে, এক অন্তরঙ্গ শব্দ, ইংরেজিতে বিরল শব্দগুলোর একটা, যাতে আছে স্বরবর্ণের ঐক্যতান, চেকভাষাতেও এমন বলেই আমার মনে হয়। কাফকা ওকলাহোমার অপরিচিত মাটিতেই শুনতে পেয়েছিলেন তাঁর ব্যক্তিগত আত্মার বাসা বাঁধার ইচ্ছে, শক্তিশালী ও অবহেলিতের মধ্যে সংশ্লেষণ। তাই তিনি ওকলাহোমার থিয়েটারে (Noah’s Ark) সংযুক্ত করেছিলেন মুক্তির সীমাহীন অন্তহীন নির্বাণ। ওকলাহোমা শব্দটা আসলে কী, এ হল আদি মার্কিনিদের ছাপ, সেই সব অবহেলিত মানুষ যাঁদের ভাষা আক্রান্ত হয়েছিল প্রভুর ভাষা দিয়ে।  মার্কিন ইংরেজী হল সেই ভাষা যা অন্তর্ভুক্ত করে এক অদ্ভুত সংমিশ্রণ, ভাগ্যক্রমে একত্র হওয়া  শিকার ও শিকারীর ধারণ করা ভাষাটি।

একজন কবি হিসেবে মার্কিন ইংরেজীর ব্যবহার হল বহিরাগতের, অবহেলিতের, ক্রমাগত ক্ষমতার দ্ব্যর্থকতায় আক্রান্ত হয়েও যাঁরা প্রভুর ভাষাকে আকঁড়ে ধরেন ও ছাপিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করেন।

দশম। মার্কিন কবিতা, স্বরভঙ্গির কাব্যতত্ত্ব

এই কবিতা কীভাবে ফরাসি, ইংরেজি বা অন্যের থেকে ভিন্ন? এখানেই বিরাজ করে তার মৌলিক দ্ব্যর্থকতা: সাধারণভাবে কাব্যিক ভাষা হিসেবে মার্কিন ইংরেজি তার মাতৃভাষা নয়, বরং এক ছদ্ম-মাতৃভাষা বা সৎ-মাতৃভাষা বলা যায়। এর কোনো ঐতিহ্য থাকতে পারে না, তার শব্দভাণ্ডার কখনও সর্বসাধারণের বা পৌরাণিক হতে পারে না, বরং তা ব্যক্তিগত, একান্ত অনুরণন। এটি কর্তৃপক্ষের সার্বভৌম ক্ষমতার ভাষা যা অনুরণনহীন এবং যার মধ্যে ভাষার বলি সেই অভিবাসীকে কথা বলতে হয়। মার্কিন ইংরেজিতে কবিতা লেখা অন্তরের মৌলিক বা তাকে অতিক্রম করে এক ধারাবাহিক অনুবাদের কাজ। তার অনুপ্রেরণার গর্ভ সবসময়ই বাইরের দিকে, তা কখনই খননের জন্য বা ঐতিহ্যের কারুকার্য নির্মাণ নয়। মার্কিন কবিতা পড়া বা লেখা সবিরাম হতে হয়। এই কেন্দ্রীয় কর্তৃত্বপূর্ণ ঐতিহ্যের গ্রহণ ক্ষমতা ও বলিপ্রদত্তের ভারসাম্যকে নষ্ট করে দেয়।

এমনকী শক্তিশালীর কাছেও মার্কিন ইংরেজি অস্থিরতাময়, তার ক্ষমতা দ্বিধান্বিত। উদাহরণস্বরূপ, যখন গোঁড়া লোকও ইংরেজিতে কথা বলেন তখন তিনিও নিজেকে এক ভৌগোলিক ও নৈতিক বন্যতার হুমকির মুখোমুখি দেখেন, এমনকী তাঁর আভ্যন্তরীণ নিশ্চয়তাকেও অস্থিতিতে নিয়ে যায়। তার ভাষাটি আত্মরক্ষামূলক, আঁকড়ে ধরার ক্ষমতা সম্পর্কে সন্দেহ জাগায়, আলো ও যুক্তিবৃত্তের বাইরে এক অন্ধকারের সঙ্গে মানিয়ে নিতে হয়।

লেখক ও তার ভাষার মধ্যে এই বিচ্ছিন্নতা ও অস্থিরতা, তার আভ্যন্তরীণ সত্য প্রকাশের ক্ষমতা সম্পর্কে মৌলিক সংশয়বাদ গঠন করে তার অপরিহার্য প্রকৃতি। ভাষার সাথে কবির সম্পর্ক অনিবার্যভাবে দ্বন্দ্বজনক। মার্কিন ইংরেজি সেই অবাস্তব, অপর্যাপ্ত, দুর্বল ভাষার প্রকৃত উদাহরণ, যা লেখককে দুমড়ে মুচড়ে বিকৃত করে অনুবাদ করতে হয় নিজের দৃষ্টিভঙ্গিতে লেখার জন্য। আমার কাছে, ঊনবিংশ শতাব্দীর তিনজন লেখক, যাঁরা কেউই ইহুদি নন, প্রতিবাদকারী সাদা চামড়ার মানুষ, যাঁদের লেখা এই স্বরভঙ্গিকে অন্তর্ভুক্ত করেছিল, তাঁরা হলেন হাউথর্নে, মেলভিলে এবং ডিকিনসন। হাউথর্নের গোঁড়া ইংরেজি গদ্যকে দুমড়ে মুচড়ে তৈরি করতে হয়েছিল আভ্যন্তরীণ ও  মহাদেশ অতিক্রান্ত বন্যতা আত্তিকরণের জন্য। (House Of The Seven Gables-এর প্রথম পৃষ্ঠাগুলি পড়ুন; এটাতে হেনরি জেমসের বিশুদ্ধতম ও আরো অনেক কিছুই রয়েছে।) মেলভিলের বাধ্যতামূলক তিমিশিকারের পাণ্ডিত্যের তথ্যপূর্ণ তালিকাটি ভেঙে পড়ে, মর্মস্থলে ধ্বংসবাদ ধারণ করতে পারে না এবং উপচে পড়ে তাঁর অন্তরদৃষ্টির টুকরো টুকরো হয়ে ছড়িয়ে পড়ার মুহূর্তের ওপর, যা আখ্যানের ছদ্মবেশে হাজির হয়। ডিকিনসন এমন একটি ভাষা আবিষ্কার করেন যা শুধুমাত্র ইংরেজির বেশে উপস্থাপিত এবং বারবার পড়লে তাঁর বার্তায় এক উগ্র মর্ষকামের সংকেত পাওয়া যায়। শব্দেরা ব্যক্তিগত প্রতীক, তার বিন্যাস অস্থিরতাময়, ক্রমাগত স্থানান্তরিত হয়, যা পুরোপুরি “ইংরেজি” শব্দবিন্যাস নয়, মসৃণ “মন্ত্রের মতো” উজ্জ্বল পৃষ্ঠতল গোপন করে মর্ষকামজাত হিংস্রতা। এই সব রচনার লেখকরা সাদা চামড়ার খ্রিস্টান, যাঁদের কাছে প্রদত্ত ভাষা আদতে তাঁদের নিজস্ব ছিল না, প্রকৃতপক্ষে তাঁদের মাতৃভাষার মতো “সহজাত” ছিল না।

সমসাময়িক ইহুদি লেখা অন্তর্ভুক্ত করছে ক্ষমতার প্রতি দ্ব্যর্থকতাময় সম্পর্ককে, সুতরাং তা মার্কিন লেখার এক নির্দিষ্ট উদাহরণ। প্রতিবাদকারী, চিরকুমারী, আর্মহাস্টের বাড়িতে স্বেচ্ছানির্বাসনে থাকা অথচ একেবারেই তার চৌহদ্দির বাইরে থাকা এমিলি ডিকিনসন আমার কাছে একজন মার্কিন কবি, এক ইহুদি, নির্বাসনে থাকা এক বোন/প্রতিবেশী, যাঁর হেঁয়ালিপূর্ণ, অতিরিক্ত, অধিকারবাদী, দূরবর্তী, অবাধ্য কয়েকটি কবিতাই আমি একসঙ্গে গ্রহণ করতে পারি।

ক্রমশ…

 

The original English text is available on the following link:

Questions of Accent (Ch. 2)

 

এই বিভাগের অন্যান্য লেখাসমূহ