গৌর (মালদা) – বাংলার চিত্তাকর্ষক ইতিহাস
বাংলার চিত্তাকর্ষক ইতিহাস সম্পর্কে জানার সময়, গৌরের মতো আর কিছু গন্তব্য হতে পারে না।…..
৭১ এর মুক্তিযোদ্ধের গল্প বাঙালি প্রত্যেক পরিবারের মধ্যে কিছুনাকিছু জানার ইতিহাস রয়েছে।তখনকার বাংলাদেশের সাড়ে সাত কুটি বাঙালির সাড়ে সাত কোটি গল্পের জন্ম হওয়ার কথা থাকলেও তখন হয়তো সবাই মুক্তিযুদ্ধ প্রত্যক্ষ করেন নি। আবার কিছুসংখ্যক লোক হয়তো মুক্তিযুদ্ধের বিপক্ষে চলে গেছেন। নিঃসন্দেহে মুক্তিযুদ্ধ বাঙালি আপামর জনতার সবচেয়ে প্রত্যাশিত আত্মত্যাগী অর্জন। সার্বভৌম স্বাধীন রাষ্ট্রের নাগরিক হবার প্রত্যয়ের চূড়ান্ত পটভূমি। ৭১ এর নয়মাসব্যাপী অগ্নিঝরা সংগ্রাম পাক হানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ বিশ্বের মানচিত্রে রক্তের অক্ষরে লিপিবদ্ধ হয়ে আছে। দেশপ্রেমের এক উদার মনোভাবনারই ফসল। মুক্তিযুদ্ধের নির্মম বাস্তবতা ধ্বংসযজ্ঞের ভয়াবহতা আর স্বজন হারানোর হাহাকার প্রত্যক্ষদর্শীর বর্ণনায় কিংবা স্মৃতিচারণে অভিন্ন ভূমিকা থেকে পাঠকের মনে অনুরণন সৃষ্টি করে। এ লেখায় একজন মুক্তিযোদ্ধা আপন সহোদর মুক্তিযোদ্ধাকে হারানোর যে মর্মস্পর্শী বর্ণনা ফুটে উঠেছে তাই তুলে ধরার ক্ষুদ্র প্রয়াস।
কাজি ইসলাম,পুরো নাম কাজি সফিকুল ইসলাম। বর্তমানে পেশায় একজন দন্ত চিকিৎসক। এবং একজন সুলেখকও বটে। বড়ভাই শহীদ কাজি নুরুন্নবী।
৭১’এ রাজশাহী মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের শেষবর্ষের ছাত্র। কাজি ইসলামের মুখে শোনা ৭১-এর মুক্তিযুদ্ধের গল্প।
২২ এপ্রিল পাক বাহিনী হানা দেয় নওগাঁয়। পাকিস্তানিদের নৃশংসতার কথা ছড়িয়ে পড়ে লোকমুখে। মানুষের স্রোত তখন সীমান্তমুখী। এক বিকেলে পুকুরের ধারে ভাই আমাকে ডাকলেন। সাথে দু’জন পরিচিত লোক। ভাই ধীর শান্তস্বরে বলল, খান সেনারা গ্রামেও আসবে। আমরা কী করব, অহেতুক মরে কী লাভ। আমি ভাবছি ভারতে যাব। মুক্তিবাহিনীতে যোগ দেব। তোমরা যাবে? আমি বললাম, কিন্তু আম্মা যেতে দেবেন? উত্তরে বলল, কারো মাই যেতে দিতে চাইবেনা। যারা যাচ্ছে তারাও কোন না কোন মায়ের সন্তান। ভাইয়ের কথায় আমি রাজি হলাম, সাথের দু’জনও।
আব্বা রাজি হলেন। আমি আম্মাকে বুঝালাম। একসময় কেঁদে বললেন, যা ওখানে তো তোরা বেঁচে থাকবি অন্তত। আমরা চারজন বিভিন্ন চরাই উতরাই পেরিয়ে উত্তরাঞ্চলের বর্ডার পার হয়ে ভারতে প্রবেশ করি। জলপাইগুড়ির বাঙালিপুর রিক্রুটিং ক্যাম্পে আমাদের স্থান হয়।
একদিন ওই ক্যাম্পে বিএসএফ-এর ব্রিগেডিয়ার আসলেন ট্রেনিং-এর জন্য ছেলেদের নির্বাচন করতে। আমাকে জিজ্ঞেস করলেন, আমি কী পড়ি। আমি বললাম ডেন্টালের ছাত্র। ভাইকে জিজ্ঞেস করল কী পড়, ভাই বলল madical final year, শুনে বললেন তোমাদের যুদ্ধে যাওয়া হবেনা, তোমাকে ক্যাম্পে ডাক্তারের দায়িত্ব নিতে হবে। ভাইকে সহকারী করবে। এতদূর এসে যুদ্ধে যাওয়া হবেনা ভেবে আমরা মুষড়ে পড়েছিলাম।
কিন্তু ভাই বেঁকে বসল, বলল আমরা যুদ্ধ করতে এসেছি ডাক্তারি করতে নয়। বিএসএফ অফিসার বললেন, ঠিক আছে তবে পরবর্তী ব্যাচ-এ তোমাকে ট্রেনিং-এ পাঠানো হবে।
ইতোমধ্যে শুনলাম যুবলীগের নেতারা ছাত্রলীগের কর্মীদের সমন্বয়ে মুজিববাহিনী গঠনের লক্ষ্যে বিভিন্ন ক্যাম্পে ঘুরে ছাত্রলীগের ছেলেদের সঙ্গে মিলিত হচ্ছেন। এরমধ্যে তখনকার যুবলীগের নেতা আব্দুর রাজ্জাক আমাদের বাঙালিপুর ক্যাম্পে এসে হাজির। ভাইয়ের সাথে কি নিয়ে জানি অনেকক্ষণ আলাপ হলো। পরদিন ভাই চলে গেল কলকাতায়।
আমি রয়ে গেলাম বাঙালিপুর ক্যাম্পে। পরে লোক মারফত আমাকে চিঠি পাঠিয়ে জানালো আমরা কোথায় মিলিত হবো।
পরদিন সকালে একটা ট্রাকে করে যাত্রা শুরু হলো বাঙালিপুর থেকে একটা ট্রেনিং ক্যাম্পের উদ্দেশে।
পাহাড়ের ওপর দিয়ে ট্রাক ছুটে চলছে। একপাশে পাহাড়ের অনেক নিচে একটা স্রোতস্বিনী ঝরণা বয়ে চলেছে। রঙিন অনেক পাথর। দূরে ছোট ছোট গ্রাম। ক্যাম্পে আসার পর আমরা একটা রুটিনের মধ্যে থিতু হলাম।
ট্রেনিংয়ের জন্য বিভিন্ন স্কোয়াডে ভাগ করা হলো। আমাদের স্কোয়াড লিডার হলো আমার ভাই নুরুন্নবী। শৃঙ্খলাবদ্ধ জীবন আমাকে অনেকটা পরিশ্রমী করে তুলেছিল।
১২ জুলাই ১৯৭১, আমাদের দেশে ফিরে অপারেশনে নামার কথা। সকাল থেকে শুরু হলো বিদায় নেবার পালা। সবার চোখের জল উপচে পড়ছে। বিস্মিত হয়েছিলাম ভারতীয় ইনস্ট্রাক্টর কঠোর কঠিন মেজর মালহোত্রা অশ্রু গোপনের চেষ্টায় সিগারেটের ধোঁয়ায় আড়াল করতে চেয়েছিলেন। মেজর রেড্ডি শুনলাম ভাই কে বলছে, ‘ Take care of your brother’।
সন্ধ্যার পর ট্রাকে করে রওনা হলাম। পাহাড়ী রাস্তা। এঁকেবেঁকে নিচে নামার সময় প্রচুর বমি হওয়ার সম্ভাবনা। ওরা বমি না হওয়ার ট্যাবলেট দিল। আমি আগেই খেয়ে ফেললাম। তারপরও আটকালোনা। ট্রাক উঁচুনিচু পাহাড় তারপর শহর পেরিয়ে এয়ারপোর্ট এসে থামলো। ভাই অন্য ট্রাক থেকে নেমে এসে আমাকে জিজ্ঞেস করে, কিরে বমি করেছিস? আমি বললাম হ্যাঁ। কেন ওষুধ খাসনি? খেয়েছি। কীভাবে খেলি? কেন পানি দিয়ে। ভাই হেসে বলল, দুর বোকা, ওটা চুষে খেতে হয়।
তিন ঘণ্টা বিমান ভ্রমণের পর জলপাইগুড়ি হয়ে আবার বর্ডার ক্যাম্পে। পাশে শীর্ণ নদী কানায় কানায় ভরা। বাংলাদেশে এখন বর্ষা। সারি সারি ক্যাম্প। এখানে কোনো প্যারেড পিটি নেই। অনেকটা অলস সময় কাটে। আমার এলো জ্বর। আচ্ছন্ন হয়ে পড়ে থাকি। ভাই খানিক পরপর এসে দেখে যায়। সঙ্গে থাকা টুকটাক ওষুধ খেয়ে কাজ হয়না। একদিন জ্বর খুব বেশী হয়। ভাই অসীম মমতায় নদী থেকে বালতিতে করে পানি নিয়ে এসে মাথা ধুইয়ে দেয়। স্বাধীনতা মাথার ওপর থেকে সেই মমতার হাত আমার কাছ থেকে মূল্য হিসেবে নিয়ে গেছে।
কয়েকদিন পর ভাইয়ের পেটে ব্যথা হল। প্রচণ্ড ব্যথা। তাকে শহরের হাসপাতালে পাঠানো হল। আমিও চলে গেলাম ভাইয়ের সঙ্গে। রাতে আমি ভাইয়ের পাশে নিচে মেঝেতে চাদর পেতে ঘুমাতাম। তিন চার দিন পর ব্যথা নিরাময় হলো, হাসপাতাল থেকে ছেড়ে দিল। বলে দিল কিছু দিন পর এপেন্ডিসাইটিস অপারেশন করাতে হবে।
৭১ এর ৩১ জুলাই ভাইয়ের জন্মদিন ছিল, এবার কাকে দিয়ে যেন জলপাইগুড়ি থেকে একটা কবিতার বই আনিয়ে নিলাম। সুভাস মুখাপাধ্যায়ের বই। শুভ জন্মদিন বলে বইটা দিলাম। ভাই কি যে খুশী হলো। সেই খুশির প্রকাশ তার ডায়েরিতে আছে, পরে দেখেছি। আশ্চর্য, ওই দিনই ও শেষ ডায়েরি লিখেছিল। আমাদেরকে দেশে Induct করবে। আমি ওর জন্য উৎকণ্ঠিত ছিলাম। কারন অসুস্থতার জন্য ভাই নুরুন্নবীর তখন দেশের ভেতরে যাওয়ার মত অবস্থা ছিল না। আমি দেশে যাওয়ার আগে নুরুন্নবীর সাথে বিদায় আলিঙ্গন করলাম। ও বলল, Take care of your self. দেশে গিয়েই আব্বা আম্মার খোঁজ করবে। আমার দুচোখ ভারি হয়ে গেল। শুধু বললাম, এপেন্ডিসাইটিস অপারেশনটা করিয়ে নিও।
ভোররাতে পৌছলাম বুনিয়াদপুর। ওখানে ট্রানজিট ক্যাম্প। দেশের অভ্যন্তরে ওখান থেকে মুক্তিযোদ্ধাদের পাঠানো হত। আমার মনটা তখনও ভারি ছিল। যেখানে নুরুন্নবীর পরিচালনায় সবকিছু চলার কথা, সেখানে অন্য লোককে দায়িত্ব দেওয়া হলো। যাইহোক আমার দলের ১১জন নিয়ে সীমান্তরেখা পেরোলাম। বাংলাদেশে ঢুকলাম আগস্টের ৫ তারিখ। বেশ কিছুদিন পর দেশের মাটিতে পা রাখতেই অন্যরকম একটা অনুভূতিবোধ মনের মধ্যে কাজ করছিল। যেন আপন ঘরে পরবাসী।
আমাদের অঞ্চল গৌড়, ভারত, পাকিস্তান কত নামে ছিল। এখন হবে বাংলাদেশ। ভাবতেই মেজাজটা ফুরফুরে হয়ে যায়।
দুবলাহাটি এসেই আব্বাকে খবর পাঠিয়েছিলাম। বাংলাদেশের শহরগুলো তখন পাকিস্তানিদের পূর্ণ নিয়ন্ত্রণে। খবর পেলাম বাবা মা নিরাপদে আছেন। জেনে স্বস্তি পেলাম। কয়েকদিন পর শেল্টারে ফিরে দেখি কি আশ্চর্য ভাই বসে আছে। ও ছিল রাজশাহীর ডিস্টিক্ট লিডার। সংগঠনের তদারকী আর আব্বা আম্মার খোঁজ করাই ওর আসার উদ্দেশ্য। ঠিক হলো আমাদের একটা লোক ভাইকে আমাদের বাসার সামনে পৌছে দেবে। রাতে আমিও গেলাম। সাত ফুট উঁচু দেয়াল টপকে ভেতরে নামলাম। ওই রাতটি আমাদের জন্য স্বর্গীয় একটা রাত ছিল। আব্বা আম্মাসহ আমাদের চারজনের শেষবারের মতো একসঙ্গে হওয়া।
ভাই যাবে রাজশাহী চাঁপাইনবাবগঞ্জ তার কর্মক্ষেত্রে। তার নিরাপত্তার জন্য আমিও সঙ্গী হলাম। কিন্তু রাজশাহীতে গিয়ে আমি বিস্মিত হলাম। ওখানকার স্বাভাবিক জীবনযাত্রা দেখে। ভাই খুবই বিস্মিত হলো ওর সতীর্থদের অনেকেই ক্লাস নিচ্ছে দেখে। ও কখনো দিনে বের হতনা। একদিন এসে দেখি ও খুবই নার্ভাস। জিজ্ঞেস করায় বলে, করিম খোক্কার নামে এক পাঞ্জাবি ডাক্তার ওকে খুব কাছে থেকে দেখে ফেলেছে। করিম খোক্কার প্রবল বাঙালি বিদ্বেষী। বাঙালিদের Bustard বলতো। পাকসেনাদের ঘনিষ্ঠ বন্ধু ছিল সে।
আমি তীব্র বিরক্তি প্রকাশ করি ওর অসাবধানতার জন্য। পরে বুঝলাম রাজশাহীর স্বাভাবিক জীবনযাত্রা আপ্লুত তাকে করেছে। কিন্তু বড় ক্ষতি হয়ে গেল সেদিন। আমাদের এবং দেশের। পাক সেনাদের হাতে নুরুন্নবী ধরা খেল। বটগাছের ছায়া সরে গিয়ে মরুময় নিষ্করুণ জগতে দাঁড়ালাম। খুব দ্রুতই বিজয় যেন মুখ থুবড়ে পড়ল।
তখনও যোগাযোগ ব্যবস্থা ঠিকমতো চালু হয়নি। কষ্ট করে রাজশাহী গেলাম। যদি ভাইয়ের কোনো খবর পাওয়া যায়। মেডিকেল হলের রুমে রুমে তখনও নির্যাতনের চিহ্ন। মেঝুতে ভাঙ্গা কাচের চুড়ি। বধ্যভূমিতে খুঁজে পাওয়া করোটিগুলো হাতে নিয়ে দেখছিলাম।
নুরুন্নবীর নিচের পাটির একটা দাঁত ভাঙ্গা ছিল। নিবিষ্ট মনে খুঁজছিলাম, একটা একটা করে করোটি হাতে নিয়ে। কিন্তু পেলাম না। নিচের পাটির ডান দিকের একটা ভাংগা দাঁত। তবে প্রত্যেকটা করোটি মনে হয়েছিল আমার ভাইয়ের, আমার স্বজনের।
হাত ধুয়ে নিতে মন চায়নি। তখনকার সময়ে এই মানসিকতা ছিল স্বাভাবিক। এখন হয়তো সাবান দিয়ে হাত ধুয়ে নিতাম। যেমন করে সমগ্র বাংলাদেশ ধুয়ে ফেলেছে মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস, শহীদদের স্মৃতি ও আত্মত্যাগ। সব ধুয়ে ফেলেছে বিস্তৃতির সফেদ সাবান দিয়ে। কিন্তু স্বাধীনতা কি মুছতে পেরেছে ভাই হারানোর ব্যথা?
বাংলার চিত্তাকর্ষক ইতিহাস সম্পর্কে জানার সময়, গৌরের মতো আর কিছু গন্তব্য হতে পারে না।…..
স্মৃতি খুব বিশ্বস্ত সঙ্গী। দূরে সরে গেলেও চলে যায় না পুরোপুরি। কোনো মানুষই তাই কখনো…..
আগের পর্ব পড়ুন এখানে >>> রনির ফোনটা বেজে বেজে থেমে গেল কিন্তু কেউ উত্তর করল…..
আগের পর্ব পড়ুন এখানে >>>> ১০৯ স্ট্রিট ধরে গাড়ি চালিয়ে ওয়াল্টার ডেল হিল এর ঢালু…..