স্মৃতিগদ্য : গালিভার ফিভার

মাসকাওয়াথ আহসান
প্রলাপ, রম্য রচনা
Bengali
স্মৃতিগদ্য : গালিভার ফিভার

নবম শ্রেণীতে জোনাথন সুইফটের গালিভারস ট্রাভেলস চিন্তাজগতটাকে পালটে দিয়েছিলো। ছোটবেলায় রঙ্গিন ছবি-অলা গালিভারস ট্রাভেলস-এর শিশুতোষ সংস্করণ পড়ে তেমন কিছু বুঝিনি। এখনো যে খুব বুঝি সেটা মনে হয় না।
রাজশাহী কলেজিয়েট স্কুলের প্রধান শিক্ষক রমজান আলী স্যার একদিন ঢাউস বারান্দার গোল খিলানের পাশে দাঁড়িয়ে সিগেরেট খাচ্ছিলেন। আমি তাকে দেখিনি। হঠাত খপ করে চেপে ধরে বললেন, জোনাথন সুইফট পড়ে কী বুঝলে!
যেখানে সেখানে পড়া ধরে বসলে তো মুশকিল। টিফিন আওয়ারে মাজদা রেস্তোরায় চাটনি চেটে সিঙ্গাড়া খেতে যাবার পথে এমন বিপত্তি প্রত্যাশিত ছিলো না।
ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে বললাম, ভাবছি স্যার; এখন গালিভারের সফরনামা সম্পর্কে ভাবছি।
শুধু সিলেবাসের লিলিপুটিয়ান ল্যান্ডে ভ্রমণ নিয়ে ব্যস্ত থেকো না; গালিভারের ব্রবডিংনাগ ভ্রমণ নিয়েও ভাবতে হবে।
সিঙ্গাড়া খেতে খেতে অন্যমনস্কভাবে ভাবছিলাম, গালিভার লিলিপুট আর ব্লেফুসকুডিয়ানদের “ডিমের কোন দিক থেকে ভাঙ্গা সঠিক” তা নিয়ে বছরের পর বছর যুদ্ধ করছে এটা নিয়ে বিস্মিত হচ্ছে, উপহাস করছে। এটা ভারত-পাকিস্তান, হিন্দু-মুসলমান কিংবা আওয়ামী লীগ বিএনপি যুদ্ধের মতো।
এই লিলিপুটেরা গালিভারের চেয়ে লম্বায় অনেক ছোট। গালিভারকে দড়ি দিয়ে বাঁধতে লিলিপুটদের পুরা এলিট ফোর্স ব্যস্ত হয়ে পড়েছিলো। লিলিপুট ক্ষুদ্র; কিন্তু ব্রবডিংনাগের মানুষেরা বিশাল। এর সিগনিফিকেন্স কী এই সফরে!
সেই থেকে ভাবতে ভাবতে মাসের ক্যালেন্ডারকে লিলিপুট আর ব্রবডিংনাগ দুইভাগে ভাগ করে ফেললাম। মাসে পনেরো দিন খুব আমোদে থাকতাম; যখন চিন্তাজগতে লিলিপুট; পনেরোদিন বিষণ্ণ থাকতাম যখন চিন্তাজগতে ব্রবডিংনাগ।
গালিভারের চিন্তাভ্রমণে একইসঙ্গে লিলিপুট আর ব্রবডিংনাগ ছিলো। মনের ডাক্তারের কাছে গেলে সে গালিভারের চিন্তাকে বাই-পোলার ডিজ-অর্ডার বলে; হয়তো দুটো এন্টিডিপ্রেসেন্ট আর দুটো ঘুমের ওষুধ লিখে দেবে। গালিভারকে জিজ্ঞেস করবে, আপনি কী ব্যবসায় লস খেয়েছেন; নাকি প্রেমে ব্যর্থ; আপনি কী নিজে নিজেই গুম হয়ে সরকারের ওপর দায় চাপাতে চান।
আমি যখন ক্ষুদ্র চিন্তার কলহ দেখি তখন হাসি পায়; পেটি হলো লাফটার প্রভোকিং লিলিপুট যখন তার দুই ইঞ্চি চিন্তার গজফিতা দিয়ে কারো সাফল্য, দেশপ্রেম, ধর্মপ্রেম কিংবা চরিত্র মাপে; ফেসবুকে গালাগালিভারস ট্রাভেলস করে; তখন আমি ভীষণ আমোদে থাকি। তখন খুলে বসি, ভণ্ড শাসক শোষক পরিতোষক স্থূল সৌন্দর্য্য ধারকদের নিয়ে “খাজাঞ্চির খাতা।”
কিন্তু যখন জালালুদ্দিন রুমি বলেন, কোথায় খুঁজছো স্বর্গ; সে তো তোমার মস্তিষ্কে, রবীন্দ্রনাথ যখন ফিস ফিস করে বলেন, ওরে চারিদিকে মোর একি কারাগার ঘোর, সাদাত হাসান মান্টো যখন শরীর হিম করা ঠান্ডা গোশত গল্পে হ্যাঁচকা টানে দক্ষিণ এশিয়ার দোজখ উন্মোচন করেন, মারকুস আরলিয়াস যখন বলেন, তোমার চিন্তা তোমার জীবন নির্মাণ করে; নজরুল যখন বলেন, ভৃগু ভগবান বুকে এঁকে দিই পদচিহ্ন, টিএস এলিয়ট যখন প্লাস্টিক শহরে মিসফিট প্রুফকের ব্যর্থ লাভ সং গাইতে থাকেন; তখন নিজেকে ক্ষুদ্র মনে হয়। মনে হয় আমি ব্রবডিংনাগ ভ্রমণ করছি। ঠিক ওরকম মানসিক অবস্থায় লিখে ফেলি “প্যাসেজ টু হেভেন।” যে গল্পে পৃথিবীতে দাগ রেখে যাওয়া বড় মানুষেরা আনন্দযজ্ঞ করেন।
চিন্তাভ্রমণ যখন লিলিপুটদের দ্বীপে; তখন দিনে দশটা সরস ফেসবুক স্টেটাস লিখি; দিনে তিন তিনটা পর্যন্ত ক্লাস নিই বিশ্ববিদ্যালয়ে, চারিদিকের বাতিগুলো নিভে যাবার গল্প বলতে যখন ডাকে মিডিয়ার বন্ধুরা; তখন চুল আঁচড়ে লাফ দিয়ে পৌঁছে যাই যুমের বারান্দায়। কিংবা একঘন্টায় লিখে ফেলি রাজনৈতিক পর্যবেক্ষণ। সপ্তাহান্তে পার্টিতে যাই; সমুদ্রে নৌকা ভাসাই, ক্যারিওকি করি; প্রেসক্লাবে খুশিজলে স্নাত হয়ে কবি বন্ধুর লেখা নতুন কবিতা শুনি।
অথচ শেষবার কী হলো; তুরস্কের আনাতোলিয়ায় মারকুস আরলিয়াসের যুগে নির্মিত বিশাল এম্পথিয়েটারের সিঁড়িতে বসে মনে হলো; আমি ব্রবডিংনাগে বসে থাকা এক লিলিপুট। আরলিয়াসের জীবন দর্শন অনেকবার পড়েছি। তার সুকৃতি ছোয়ার পর ক্ষুদ্রত্বে মিইয়ে গেলাম। এই আমার ক্যালেন্ডারের ভাটার সময়; এসময় বাবল ছাড়াই ক্লাস নিই। হয়তো না পড়ে আসার দায়ে এক-দুজন ছাত্রকে উপদেশ দিই, পলিটিক্যাল ক্যাডার হতে কিংবা শেয়ার বাজার কারবারি হতে। তাদেরকে সফল সুখনের গল্প বলি। সিক্স ডিজিটটাই আসল বলি। অনেকদিন ধরে চেনে বলে ছাত্ররা এগুলোকে স্যাটায়ার ভাবে; তবু রক্ষে। এসময় ফেসবুকে আসিনা; ইনবক্স খুলিনা, মিডিয়ার ফোন ধরিনা এবং আমি নিজেই জানি এটা আনপ্রফেশনাল আচরণ। নতুন কী বই এলো তা দেখতে যাই; মুভি দেখি। আবুল হাসানের মতো করে মনে মনে জপ করি, আমি বুঝে গেছি; তোমাদের বৃক্ষের শাখায় ফুল ফোটাতে পারবো না ; আমি লাস্ট বেঞ্চি।

মাসকাওয়াথ আহসান। লেখক, শিক্ষক ও সাংবাদিক। 'শিল্পের জন্য শিল্প নয়, সমাজ-রাজনৈতিক উত্তরণের জন্য শিল্প' এই ভাবনাটিই মাসকাওয়াথ আহসানের লেখালেখির প্রণোদনা। নাগরিক বিচ্ছিন্নতার বিচূর্ণীভাবনার গদ্য ‘বিষণ্ণতার শহর’-এর মাঝ দিয়েই লেখকের প্রকাশনার অভিষেক ঘটে। একটি পাঠক সমাজ তৈরি হয় যারা নাগরিক জীবনের...

এই বিভাগের অন্যান্য লেখাসমূহ