হরপ্পা নগরীর এক গ্রাম

অনিরুদ্ধ চক্রবর্তী
গল্প
Bengali
হরপ্পা নগরীর এক গ্রাম

কিশোর হাওলাদার তার ঘরে আচমকা ঢুকে পরল। বলল, ‘কিরে তারা শুনলুম, তুই নাকি বড় মস্তান হয়ে গেছিস, দুমদাম হাত চালিয়ে দেচ্ছিস?’

‘বস দাদা বস। ’

চৌকির কোনায় বসল কিশোর। ঘরে চোখ বুলিয়ে বলল, ‘দেলে এত আঁকিবুকি কাটা কেন রে?’

‘ও কিছু না।’

‘বাড়িতে কোন বাচ্চা এসেছিল?’

‘না না কেউ আসেনি।’

‘তবে?’

‘ওই আর কি।’

‘হুম! আঁকা গুলো কিন্তু বেশ, বুঝলি। ইতিহাস বইয়ের পাতায় এমন ছবি থাকে না?’

‘হবে হয়ত। আমি কি আর ইস্কুলে পড়েছি!’

‘ছবি আঁকিস নাকি?’

‘ওই—’

‘বুঝেছি। মালটা বেশি টানছিস আজকাল।’

‘না না, তেমন আর না।’

‘তোর তো আবার গোপন রোগ নিয়ে কারবার। এ সব করতে কতই না নারীর কাছাকাছি আসিস তুই! তার ভেতর থেকে নতুন কোন মেয়ে মানুষ জোটাতে পারলিনি। একা একা এরকম করে কতকাল কাটাবি বল দিকি।’

‘সে সব আর চলে না দাদা, মাইরি। ’

‘কেন রে?’

‘ভালো লাগে না আর।’

‘তোর বয়স কত বলত? আমার চেয়ে ছোটই হবি, নারে।’

‘ছোট বলছ কেন, বড়ও হতে পারি।’

‘উঁহু, ছোটই হবি।’

‘তুমি যখন প্যান্ট জামা পরে ইস্কুল যেতে, আমি বাজারে বসে মাছ বেচতাম । তুমি মাঝে মাঝে মাছ নিতে আসতে।

মনে পড়েছে।’

‘দেলে আঁকিস কেন?’

‘গাঁজার টান।’

‘সারাদিন টানিস।’

‘না দাদা। দামি জিনিস। ’

‘হাত তোর ভালোই বুঝলি। ভালো আঁকিস তুই তুই। বিল্টুর সঙ্গে তোর লাগল কি নিয়ে।’

‘সে এক সামান্য ব্যাপার দাদা। জল হচ্ছিল, বেরুতে পাইনি। সারা রাত অভুক্ত কাটিয়েছি। তাই মাথাটা গরম হয়ে গেছিল। ’

‘তা উপোস দেবার দরকার কি? কমলে ত রয়েছে।’

‘তা আছে। জানোই ত, তার সনহে আমার কথা নাই।’

‘হুঁ। মেয়েটা কিন্তু ভাল ছিল। একটু আধুনিক ত, গ্রামের মেয়ে হয়েও শহুরে মেয়েদের মত। সিনেমায় দেখিস না? এখন রোজকার বাং লা সিরিয়াল গুলিতেও এসব বেশ দেখায়। একটি লোকের দুটি বউ। কেউ কেউ আবার তিনটেও দেখায়। তাই বলে কি কমলে খারাপ, তা নয়। তোর সঙ্গে বনল না—এই যা। যাক, সে আর কি করা যাবে বল। বিধির বিধান ত মানতেই হবে। যাক কি করছিস এখন?’

‘এই যে দাদা, শুয়ে বসেই কাটাই।’

‘যাক বিল্টুর কাছে মাপ চেয়ে নিস।’

‘দেখা হলেই নোব। ’

‘আর একটা কথা । বলি কি, তোর ঘরে কি কোন লোক থাকছে?’

‘না ত। কেন দাদা?’

‘শুনলুম। বাইরের লোক।’

‘কে বললে?’

‘অনেকে নাকি দেখেছে তুই এক ষাঁড়ের পিঠে চেপে উড়ে যাস।’

‘দূর!’

‘তুই ত নিজেও একথা বলেছিস তাপসের মুদি দোকানে বসে।’

‘সে মদের খেয়ালে বলা। উড়ন্ত ষাঁড় আমি পাব কোথা?’

‘তা বটে। ষাঁড় কোনদিন উড়েছে একথাও শুনিনি। পাখি ওড়ে জানি। আমরা সবাই দেখেছিও। মাছও নাকি ওড়ে। আমাদের দেশের জলা-জঙ্গলার মাছ নয়, বিদিশি মাছ। কিন্তু মুসকিল কি বলত, কথাটা তোর মুখ দিয়েই বেরিয়েছে।’

‘ওসব ধর কেন। আমার মুখ আবার একটা মুখ হল।’

‘পরে কি মনে হল জানিস, আমাদের অজান্তে দুনিয়ায় কত কিছু ঘটে যাচ্ছে তা কী আমরা জানি? কিন্তু গুজব হলেও তা সত্যি। তার উপর আকাশে উড়তে উড়তে তুই কত কিছু দেখিস—সব ফলাও করে বলেছিস। তাতেই লোকের চোখ কপালে উঠে গেছে। মাতালদের মহল্লায় তুই ত হিরো রে।’

‘ও সবে কান দেবে না দাদা।’

‘বেশ। তবে কমলে বলছিল—।’

‘কী?’

‘এক মুশকো লোককে সে তোর ঘরে ঢুকতে দেখেছে।’

‘ও সব ওর বানানো। লোক দরকার কমলির, আমার নয়। লোক নিয়ে আমি কি করব।’

‘ও তো খুব ভয় পেয়ে গেছে। ওর ধারনা হয়েছে তুই ওকে উতখাত করার জন্য লোক ভাড়া করে এনেছিস। আবার তুই বিল্টুকে কেলিয়েছিস শুনে ওর তো পাগল পাগল দশা।’

‘তাতে ওর কি হল?’

‘ওর ধারণা আসলে বিল্টু তোর লক্ষ্য ছিল না, ওটা হাত মকশো করা হল।’

‘কি যে বল দাদা। বিল্টুকে মেরে আমি হাত মক্সো করব, আমি কি পাগল?’

‘আরে সে কথা নয়। আসলে তুই নাকি এই কথাই প্রচার করতে চাস, তোর ঘরে এক শক্তিশালী লোক আছে, তুই কাউকে কেয়ার করিস না। বিল্টুকেও নয়!’

‘এটা কোন কথা হল দাদা? বিল্টুর দাপট এই এলাকায় কে না জানে। আসলে আমি সেদিন বিল্টুকে মারিনি।’

‘মানে!’

‘ওর সঙ্গে আমার কথা কাটাকাটি হয়েছিল এটা ঠিক। কিন্তু হাত আমি চালাইনি।’

‘কি বলিস।’

‘সত্যি দাদা।’

‘কিন্তু বিল্টু যে অন্য কথা বলে।’

‘ওর বুঝতে ভুল হচ্ছে।’

‘কেমন বল দিকি?’

‘আসলে এমন একটা অশরীরী ব্যাপার ঘটেছিল, তা আমিও বুঝিনি। আমার পিছনে লাগছিল ও। লাস্টে হল কি, গাছটা দুলছিল। তারই একটা ডালের একটা চাঁটি খেয়ে—’

‘হুম।’

‘তবে আমি ক্ষমা চেয়ে নোব। বিল্টু যদি মনে করে থাকে এই ঘটনার জন্য আমিই দায়ী—’

‘তোর কথা আমি কিছু বুঝতে পারছিনা জানিস। বিল্টু বললে তুই হাত চালিয়েছিস, এদিকে আমি শুনছু অন্য কথা।’

‘তুমি একটা কথা ভেবে দেখ দাদা, বিল্টুর চেহেরা আর আমার চেহেরার কথা। আমার গায়ে কি এতই শক্তি আছে যে এক চড়ে তাকে উলটে ফেলব?’

‘হুঁ।’

‘তাছাড়া বিল্টুর গায়ে হাত দেবে এমন বুকের পাটা কার আছে।’

‘তোর কথাটা ফ্যালনা নয়।’

‘তবে?’

‘তোর ঘরে যে লোক ঢোকে তার সঙ্গে তুই নাকি সবসময় গুজগুজ ফুসফুস করিস?’

‘কি যে বল!’

‘কমলে তা হলে ভুল দেখল বলতে চাস?’

‘সে আমি কি করে বলি বল দিকি। আমার সবেতেই তো ওর দেখি চক্ষুশূল, আমার খাবে আমার ঘরে থাকবে আবার আমারই দাড়ি ওপড়াবে, একি মেনে নেওয়া যায়?’

‘ও কি খায় না কি তোর?’

‘তা নয়। ওটা কথার কথা। মুখ ফসকে বেরিয়ে গেছে।’

‘যত তুই ভুল ভাল কথা বলিস।’

‘সে কথাই তো বলি দাদা। আমার আবার কথার দাম কি।’

‘আসলে কি জানিস, আকাশে যেমন তোকে কী কেউ উড়তে দেখে ছে, তেমনি কী কেউ কেউ আকাশের গায়ে তো হাসির শব্দ শুনেছে।’

‘দূর। ও মেঘের ডাক।’

‘হতে পারে। যাক। আমি উঠি। বিল্টুর সঙ্গে দেখা করে নিস।’ বলে থমকালো কিশোরদা। দেওয়ালের পেরেকে ঝোলানো তিরটা দেখিয়ে বললে, ‘এটা তুই কোত্থেকে পেলি।’

‘ঐ আর কি… ।’

‘আদিবাসী মেয়েটা দিয়েছে?’

‘হ্যাঁ হ্যাঁ।’

‘তুই মাইরি জীবনকে ভোগ করে নিলি। ওঃ! ঘরে মেয়েছেলে, বাইরে মেয়েছেলে। কিন্তু মুসকিল কি বলত, তোর টেঁটিঁয়া পনার জন্য কেউ তোর কাছে নেই। আদিবাসী মেয়েকে বিয়ে করলি, লোকে ভাবলে তুই সুখি হবি, কোথায় কি! তা এই তিরটা নিয়ে কি করবি?’

‘কি আর করব রেখে দেব।’

‘আমায় দিবি?’

‘তুমি নিয়ে কি করবে? আমার কাছেই থাক।’

‘বুঝেছি। সেই মেয়েছেলেটার স্মৃতি তুই ছাড়তে চাইছিস না। বেশ তোর কাছেই থেক। তবে একটা কথা কি জানিস, তিরটা কেমন যেন অন্য রকম।’

‘মানে?’

‘মানে এমন ধরণের তির সচরাচর দেখা যায় না। বেশ অন্য রমক। ঝকমক ঝকমক করছে। দেখে লোভ লাগে। মনে হয় এমনি একটা তির যদি সাজিয়ে রাখতে পারতুম নিজের ঘরে। এই তির নিয়ে কি তুই উড়ে যাস আকাশ পথে?’

‘কি যে বল দাদা।’

গদগদ হয়ে তারাপদ বলে।

কিশোর ঘর থেকে বেরুতে যাবে, তখনই হন্তদন্ত হয়ে ঘরে ঢুকে পড়ল কমলি। তারাপদর দিকে আঙ্গুল তুলে বলল, ‘এর বিরুদ্ধে আমার অনেক অভিযোগ আছে কিশোরদা।’

কিশোর বসে পড়ল বিছানায়। কমলি তারাপদর দিকে তাকালো না। এক মারমুখি ভাব নিয়ে সে ঘরে ঢুকেছে। হাঁ করে শ্বাস নিচ্ছে। নাকের পাটা ফুলে ফুলে উঠছে। ভারি বুক জোড়া ওঠানামা করছে। আঁচল যে অনেকতা সরে গেছে, বুকের খানিকটা দৃশ্যমান নিচু ব্লাউজ পরার জন্য, সেদিকে কি তার সত্যিই খেয়াল নেই নাকি এটা কিশোরকে এক সামান্য দৃশ্য সুখের উপহার, তারাপদ বুঝল না। তবে এখন যে কমলি মস্ত এক ঘোঁট পাকাবে সেটা পরিস্কার। সে চুপ করে দাঁড়িয়ে রইল।

তার বুক থেকে চোখ সরিয়ে কিশোর এবার মেঝের দিলে তাকাল। বলল, ‘বল, কি বলবি।’

কমলি তেড়িয়া বয়ে বলল, ‘আমি তোমার ভরসাতেই যে এখানে বাস করছি, তা কে না জানে, তাই তো কিশোরদা।’

‘কি হয়েছে সেটা বল না।

‘ও এক দঙ্গল বাদুড় পুষেছে সেটা কি জানো?

‘মানে?’

‘মানে ওটাই, বাদুড় বাদুড়! এক ঝাঁক বাদুড় সাদা রাত আমার আকাশে চক্কর কাটে আর কিচ কিচ করে।’

‘তো হল কি?’

‘মানে?’

‘তোর কি অসুবিধা হল সেটা বল।’

‘বাদুড়েরা আমাকে দেখে দাঁত খিঁচোয়।’

‘বাদুড় তো কিচকিচ করবেই।’

‘সে আমিও জানি। কিন্তু সেটা বড় কথা নয়। বাদুড়েরা আমাকে বাইরে দেখলেই তেড়ে আসে।

‘তেড়ে আসে?

‘তবে আর বলছি কি!’

 দুই.

সে চলে গেলে অন্ধকার কোণ থেকে বেরিয়ে এল লিম্বু মহারাজ। বলল, আমার জন্য তোমায় বিপদে পড়তে হল।‘’

‘এ আর এমন কি ।’

‘তুমি কি মাপ চাইবে?’

‘সে ত চাইতেই হবে। নইলে বাস করব কি করে।’

‘একবার না চেয়েই দেখ না। তুমি ত থাকছ না এখানে।’

‘তাহলে আর তোমার দেশে আর যাওয়া হবে না। তার আগেই আমায় মেরে রেখে যাবে। রাজার গোঁ কি আর বদলায় না ভাঙ্গে। রাজা রাজাই থাকে। আজ রাজা কাল রাজা।’

‘সে আর তুমি আমায় কি বলবে। আমাদের এখানেও সেই একই জিনিস। হয় রাজা যা বলছে তাই শোন, নয় মর। এই করেই সে ক্ষমতাচ্যুত হল। সে এক প্রবল প্রজা বিদ্রোহ উপস্থিত হয়েছিল। অনেক প্রাণের হত্যার পর রাজা সে সব সামাল দিয়েছে। আমিও সেই সব নিরীহ প্রজাদের হত্যা করেছি। কি কর। উপায় ছিল না যে। নইলে রাজা আমাকেও শেষ করে দিত। ’

‘তোমার কি মনে হয় সুদিন আসবে?’

‘বুঝতে পারি না। মৃত্যুর আগে সে আমাদের শাসক ছিল, এখনও সেই রাজত্ব করছে। এবার বদলে সময়। কিন্তু তা হবে কি কে জানে। বিরুদ্ধচারণ হলেই ত লুঠতরাজ, আগুন আর হল্লা।’

‘আমার কি মনে হয় জান। এই পৃথিবীতে নরনারীর সংখ্যা মাত্র এক জোড়া। তারাই অনন্তকাল ধরে ‘নিজেদের সেবা করে চলেছে।’

‘কে তোমাদের শাসক?’

‘আমাদের পুরোহিত। ঈশ্বরের সঙ্গে তার সোজাসুজি যোগাযোগ।’

‘সেই রাজার কাছেই ত তোমার কাজ।’

‘তাই বটে। কি করব, চাকুরি ছাড়া যায় না।’

‘তোমার জমি নেই?’

‘আছে। গ্রামে আছে।’

‘তা নিয়েই থাকলে পার।’

‘তুমি পারছ? তোমারও ত জমি আছে।’

‘আমার গায়ে বল নাই।’

‘আমার উপায় নাই। যতদিন মৃত্যুর প্রিথিবীতে থাকব, এভাবেই থেকে যেতে হবে। ’

‘তুমি ঈশ্বর কে দেখেছ?’

‘না। তুমি?’

‘আমিও দেখিনি। কেবল শুনিছি। দেখেছে আমাদের রাজা। যিনি আমাকে এই উড়ন্ত ষাঁড়টা দিয়েছেন।’

‘ওই ত। তাঁর কথা কেবল শোনা যায় অন্যের মুখ থেকে। তাঁর কাছ থেকে কিছু আসে না।’

‘তোমাদের দেশের কথা শুনি একটু।’

 ‘আমাদের দেশ তোমাদের থেকে ভালো।’

‘কিরকম?’

‘এই যে তোমাদের নগরের চারিদিকে নোংরা ছড়ান। আমাদের ওখানে কিন্তু এমনি না। জুল হলে এই যে জল দাঁড়িয়ে যাচ্ছে, তেমন ব্যাবস্থা আমাদের ওখানে নয়। আমাদের অখনাএ বৃষ্টি হলে জল জমে না। কারণ নর্দমা আমরা প্রতি বছর নাব্যতা ও জল ধারণের ক্ষমতা অনুযায়ী বানাই। সিন্ধু নদতে জল চলে যায়।’

‘আমাদের মুসকিল কি বলত? আমাদের কোন রাজা নেই।’

‘তবে কে আছে?’

‘মন্ত্রী।’

‘মানে? কেবল মন্ত্রী?’

‘হ্যাঁ। ’

‘রাজা তবে গেলেন কোথায়?’

‘জানি না। রাজার কথা তো শুনি না কোথায়। সবাই মন্ত্রীর নাম বলে।’

‘কি বলে তারা?’

‘অমুক মন্ত্রী তমুক মন্ত্রী—এই সব।’

‘আর?’

‘এই যে আকাশ মন্ত্রী বাতাস মন্ত্রী জল মন্ত্রী স্থল মন্ত্রী—কিন্তু কেউ রাজার কথা বলে না।’

 ‘মন্ত্রীরা দেশ চালায়! রাজা না থাকলে যে মন্ত্রীরা স্বেচ্ছাচারী হয়ে যায়। লোককে ধরে মারতে থাকে, লুঠপাঠ শুরু হয়।’

‘তা হয়। ’

‘ওই যে ছেলেটা, কি যেন না, তোমায় হুমকি দিচ্ছিল—’

‘বিল্টু?’

‘হ্যাঁ। ও কি মন্ত্রীর চর?’

‘না । অত লম্বা হাত ওর নেই। ’

‘তবে?’

‘মন্ত্রীর তিনধাপ নিচে যারা থাকে, তাদের লোক। কিন্তু তোয়াজ করতে হয়। নইলে হামলা করবে।’

‘ওকে কি আর মারার দরকার আছে?’

‘না না। ওই এক ঘায়েই অস্থির। এবার মারলে মরে যাবে।’

‘আমি এক রাজার কথা জানি।’

‘কি জান বলে ফেল।’

‘রাজার কাপড় ছিল না।’

‘মানে?’

‘রাজা ল্যাঙটা হয়ে বাইরে বেরুত।‘

‘বল কি। তারপর?’

‘সবাই বলে আআআ, রাজা মশাই কি পোশাক পরেছেন।’

‘কিন্তু রাজা তো পোশাক পড়ে নেই।’

‘নেই তো।‘

‘তবে তারা বলে কেন?’

‘ভয়ে ।‘

‘হুঁ। রাজাকে কে না ভয় পায়। পারপর?’

‘একটি বাচ্চা ছেলে তখন বললে, রাজা তোর কাপড় কোথায়।’

‘রাজা কি করলে?’

‘কি আবার, লজ্জা পেয়ে ঘরে ঢুকলে। আমার কি মনে হয় জানো, তোমাদের রাজার সঙ্গেও এমন কিছু ঘটেছিল। তাই সে সামনে আসছে না। মন্ত্রী দিয়ে দেশ চালাচ্ছে।’

 ‘তুমি ত ঠিক মত খেতে পাও না। আমদের ওখানে গেলে কিন্তু তোমার এই দশা থাকবে না। তুমি অনেক পরিচ্ছন্ন জীবন পাবে। লোকে তোমায় হ্যাটা করবে না। তোমায় আমরা একটি বাড়ি করে দোব। সাধারণ নাগরিকদের জন্য সর্বচ্চ তিনটি ঘর বরাদ্দ করেছে আমাদের দলনেতা, তুমি তাই পাবে। কিন্তু শর্ত অই একটাই, ওই রোগ ভাল করে দিতে হবে।’

‘সে আর এমন কি। এখন আমি যা অভিঞ্জতা সঞ্চয় করিছি, কোন অসুবিধা হবে না।’

‘আমরা তোমার মুখ থেকে এটাই শুনতে চাইছিলাম। আর পাবে নারী। সুন্দরী নারী। সুরা।’

তাচ্ছ্যিলের গলায় তারাপদ বলে, ‘আমি কবার জীবনে বিয়ে করিছি জান, দুবার। কেউ ভালো নয়। একজন, কমলা, আমায় ত্যাগ দিয়েছে বহুদিন। কিন্তু সে থাকে আমার ভিটেতেই।’

‘আর সেই গোষ্ঠীপতি?’

‘মানে?’

‘আরে যে নেতার কথা বলছিলে তার কথা জানতে চাইছি। সে কি বলে?’

‘কি বলবে? কিছুই বলে না। তার লোকেরাই ত আসে।’

‘বেশি আমাদের ওখানে শঙ্খিনী নারীর সংখ্যাই বেশি। অমন জিনিস তুমি দেখই নি।’

‘তাদের কোন ছবি আছে তোমার কাছে?’

‘ছবি নেই। তবে মূর্তি আছে । দেখবে?’

‘দেখাও।’

‘সে হল রাজনর্তকি। আমাদের যে গোষ্টীপতি, তার শয্যাসঙ্গিনী সে। রক্ষিতা বলতে পার। তার বয়স বেশি নয়। ষোলো মাত্র। সে এক বালুচকন্যা। একে তুমি পাবে না। তবে অন্য নারী আছে। তারাও এমনি সুন্দর। তারাও বালুচকন্যা।  তাদের তুমি পেতে পার। তারা প্রত্যেকেই অসাধারণ নারী। কামকলায় পারদর্শী। সেটা একদিকে যেমন সুখের, অন্যদিকে তেমনই বিপদ ডেকে আনে।’

‘বিপদ কেন?’

 ‘সেই যে দশরাজা আমাদের সম্মিলিতভাবে আক্রমণ করল, তার পিছলে কেবল লুঠতরাজ এর ‘উদ্দেশ্য  ছিল না, ছিল আমাদের ওই নারীদের প্রতি তাদের লোভ।

‘কিন্তু তোমাদের ওখানে যৌনরোগের মড়ক লাগল কি করে?’

‘সে এক দীর্ঘ ইতিহাস।’

‘তুমি বল, আমি শুনব।’

‘আমাদের জীবিকার প্রধান অবলম্বন হল সুমেরিয়দের সঙ্গে ব্যাবসা বানিজ্য। নদী পথে সেই ব্যাবসা চলত। ওরা এখানে কারবারে আসে, যেমন হয় আর কি, বিদেশের নারীর প্রতি অনেক বণিকের লোভ থাকে, ওদেরও ছিল। ওরাই কোথা থেকে এই রোগ নিয়ে এসে ভরে দেয় আমাদের নারীদের শরীরে। সেই সব নারীরা দেহের পসরা নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকে নদীর ধারে। বড় নৌকা এলে তারা সব খদ্দের ধরার কাজে ব্যস্ত হয়ে পড়ে। সেই সব সুমেরীয় বণিকদের ভেতর কবেকার সেই পুরানো যৌনরোগ বাসা বেঁধে ছিল। তারা আমাদের নদীর ধারের নারীদের শরীরে ঢেলে দিতে থাকে। পরে একটু একটু করে আমদের পুরুষদের মধ্যে সেই রোগ ছেয়ে ফেলে। যদিও আমরা সেই সব নারীদের আর নগরীর মধ্যে রাখিনি, সিন্ধু নদের অনেক পশ্চিমে তাদের ঠেলে দিয়েছি,  কিন্তু তবুও এই রোগ আমরা কমাতে পারছি না। এসময় আমাদের কাছে তোমার খবর আসে’

‘কি ধরণের যৌনরোগ মেলে তোমাদের ওখানে?’

‘সে বিচিত্র ব্যাপার।’

‘কিরকম?’

‘কয়েকজন পুরুষের শিন্ন খসে গেছ।’

‘বল কি!’

‘উন্মাদ হয়ে যাচ্ছে তারা।’

‘আর?’

‘তাতেও কি বাঁধ মানে তাদের কামনা? তারা ছুটছে সিন্ধুর পশ্চিমে সেই বারাঙ্গনাদের প্রতি।’

‘তারা এমন করে কেন?’

‘সেও এক কাহিনি আছে।’

‘কি কাহিনি?’

‘রাজা গিলগামেশের কাহিনি। সে মেসোপটেমিয়ার উরুক নগরের রাজা। তার খুব ইচ্ছে ছিল, মৃত্যুকে জয় করে। অমর হবে। তারজন্য সে নৌকা নিয়ে এক বিপদ সংকুল পথ পাড়ি দেয়।’

‘কি রকম তার বাকি কাহিনি?’

‘বলব তোমায়। পরে, এখন নয়।’

‘তোমার যৌনরোগ নেই?’

তিন.

 নিজের যৌনরোগের কথায় লিম্বু চুপ করে রইল। সে তখন তারাপদর জীবনের কথা জানতে চাইল। সেই প্রাচীন ভারতে বা যখন ভারত জমেউদ্বীপ নামে পরিচিত ছিল, তখন যে সব উন্নত ও সাধারণ সভ্যতা ছিল এদিক ওদিক, তাদের মধ্যে যারা মৃত্যু পরবর্তী জীবনে বেঁচে থাকার ক্ষমতার কথা জানত, লিম্বু সে সব বলে চলে। তাদের সেই অন্যতর পৃথিবীর কথা শুনতে শুনতে তারাপদ অবাক হতে থাকে। মৃত্যুর পরের জীবনের কাহিনি শুনে তারা ক্রমশ অবাক হতে থাকে।

তারাপদ বলে, ‘সত্যিই কখনো নারীগমণ করনি তুমি?’

‘সময় আর হল কই! ’

‘কি এত ব্যাস্ততা তোমার?’

‘আমি হলাম প্রধানযোদ্ধা। এর মানে জানো? আমাদের নগরীর বাইরে একটা প্রাচীর আছে। খুব বড় প্রাচীর। সেটা তৈরি হয়েছে সিন্ধুর বন্যার জল আটকাবার জন্য। সেখানেই আমরা থাকি। বুঝতেই পারছ, বর্ষার সময় ছাড়া আর অন্য সময় যে ভয় থাকে তা হল বাইরের লোকের আক্রমণ। আমরা সীমান্ত পাহারা দিই। সর্বক্ষণ সেখানেই বাস করতে হয় আমাকে। তাই নারীদের সঙ্গে কোন সম্পর্ক তৈরি হয়নি। তবে এক কিশোরের সঙ্গে আমার সম্পর্ক আছে। সে আমাদের দলেরই নীচু অংশের কর্মচারি। সেনাবাহিনীর এক পাচক। তার সঙ্গেই আমার মেলামেশা হয়েছে। বলা ভাল আমার অবসর তার সঙ্গেই কাটে।’

‘পলিক্লিনিক’ তার নিজের নয়। প্রথম যখন সে কুটকুট ভাব অনুভব করে, তখন কি মনে হতে, একবার ওদিক-ওদিক তাকিয়ে সে ঢুকেই পরে সবুজ পর্দা সরিয়ে। একটা সাইকেল গ্যারেজের লাগোয়া সেই কবিরাজি ক্লিনিক। একটা টেবিল ফ্যান সোঁ সোঁ আওয়াজ তুলে ঘুরছে। একটা লোক বছর চল্লিশেক, রোগা, হাফহাতা জামা পরা, তার কাছ থেকে তিনহাজার টাকা নিল, চারমাসে তাকে ভালো করে দেবে এই বলে।

এইভাবে আলাপ। তারপর সে তারাপদকে প্রস্তাব দেয়,  ‘তুমি আমার এজেন্ট হয়ে যাও।’

‘কি করতে হবে?’

‘এখন তুমি কি কাজ কর?’

‘করি না কিছুই। আসলে পারি না। খুব যন্তন্না হয়!’

আমার কাজ  কম খাটুনি। যারা মাঠে কাজ করে, লেবার, ইঁট ভাটার কর্মী, তাদের কাছে গিয়ে যৌনরোগের খুব গোপনে চিকিতসা করা হয় এই কথাটা পৌঁছে দেবে। ওরা যদি এখেনে না সতে পারে, তুমিই ওদের কাছে ওষুদ গিয়ে দিয়ে আসবে। এতে তোমার কমিশন বাড়বে।

সেই থেকে এই কাজ করে যাচ্ছে তারাপদ। হ্যাঁ এটা ঠিক তার ইনকাম খারাপ নয়। একবার একটা এলাকায় গিয়ে একজনকে পাকড়াও করতে পারলেই, সেই আবার দশজনকে নিয়ে আসে। তারাপদর ইনকাম বাড়ে। তারপর তাদের চিকিতসার ব্যবস্থা করা।  সবাই যে ‘পলিক্লিনিক’ এ আসতে চায় তা নয়। তখন তাদেরকে ঘরে ঘরে ওষুধ  পৌঁছে দেওয়াই তার কাছ। এছাড়া ‘পলি ক্লিনিক’ এর সাংগঠনিক দিকটিও তাকে দেখতে হয়। সেটি হল একেবারে গ্রামের ভেতর যে সব ওষুধের দোকান আছে, তাদের কে এজেন্সি দেওয়া। সেটা এক অভিনব পধতি। বহু মানুষ আছে যারা ডাক্তার দেখিয়ে ওষুধ খায় না। দোকানে গিয়ে রোগের কথা বলে চেয়ে নিয়ে ওষুধ খায়। তাদের মধ্যে যাদের যৌন সমস্যা থেকে থাকে, দোকানে গিয়ে চুপচাপ করে বলে, তারাই তার খদ্দের।

লিম্বু বলে, ‘জীবনে যে নারী আসেনি তা নয়। কিন্তু যতদূর গেলে সেটা যৌন সম্পর্কে এগোতে পারে, ততদূর যায়নি। আমাদের যখন ছুটি মিলত, আমরা নদীর ধারে চলে যেতাম। সেখানে যে সব বারাঙ্গণা থাকত, তাদের কামকলার বাহার দেখে অবাক হয়ে যেতে হয়। যোদ্ধাদের অনেকে যেত। আমরা কয়জন সেই সময় ঘুরে বেড়াতাম। দূরের বনে গিয়ে চেষ্টা করতাম পশু শিকারের।

আর পশুই বা কোথা! এত নির্বিচারে তখন বৃক্ষ ছেদন করেছি আমরা যে বলার কথা নয়। পশুরা আমাদের জীবন থেকে অনেক দূরে চলে গেহচে। পশু শিকারে এক আনন্দ ছিল। নিজের বিরত্ব দেখাবার একটা ব্যাপার ছিল। কিন্তু নগরের সম্প্রসারণ ও কৃষিকাযের জন্য জমির দরকার ছিল। বৃক্ষ ছেদনের ফলে হল কি, বৃষ্টিপাতের পরিমান কমে যেতে লাগল।  বাড়তে লাগল গরম। এত রোদের পাত যে গরমের সময় নগরবাসীরা মাথা ঘুরে পড়ে মারা যেতে থাকল। সমাজে এক চরম অশান্তি দেখা দিল। তবুও আমাদের সভ্যতা টিঁকে ছিল। কিন্তু আর্যদের আক্রমণের মুখে আমরা একেবারেই দাঁড়াতে পারলাম না।’

একটু চুপ করে থেকে তারাপদ বলল, ‘নারী মিলনের ইচ্ছে জাগে না তোমার?’

লিম্বু কোন কথা বলল না। তারাপদ বুঝল, লিম্বু অত সোজা লোক নয়। তার মন আর মুখ হয়ত এক নয়। কিন্তু সে কি করে, সেযে হরপ্পায় যেতে চায়। বসবাস করতে চায় সেখানে গিয়ে। সেই তির-ধনুকের যুদ্ধ, ঘোড়ার রথ—যা আর্যরা ব্যবহার করে, এবং সর্বোপরি সেই নিঃসৃম শূন্যতা। আর্যরা যে এই পৃথিবীতে ছড়িয়ে পরল, তার কারণ আর কিছুই নয়, এই নিঃসৃম শূণ্যতার প্রভাব। প্রথমে আর্যরা ওই শূন্যতারই পূজা করত। ব্যোম! আকাশ তাই হয়ে ওঠে তাদের দেবতা।

তারাপদ শূন্যতা ভালোবাসে। সে শূন্যতার কাছে নিজেকে নিবেদন করতে চায়।

চার.

একটু চুপ করে থেকে লিম্বু বলে, ‘নারী মিলনের ইচ্ছে আমার কোন কালেই ছিল না। কিন্তু এখন ‘জাগছে। তোমার কথা শুনে জাগছে। কিন্তু এখন কিছু করার নেই।’

‘কেন নেই?’

আর্য নারী এখানে কোথায় মিলবে?’

 ‘উপায় আছে।’

‘অবাক হয়ে লিম্বু বলল, সেটা কিভাবে সম্ভব?’

‘আমি জানি এখানে একজন আর্য নারী আছে।’

‘কোথায়?’

‘এদিকে কোথাও। আমার কাছে খবর আছে। সে নাকি অতিশয় সুন্দরী। তাকে একবার দেখলে চোখ ‘আর ফেরান যায় না।

কেবল তুমি রাজি কিনা বল।’

‘হুম… ।’

‘এত ভাবার কি আছে? যাবে, কিছুক্ষণ থাকবে, চলে আসবে। অতীব ফর্সা, গায়ের রঙ যেন ফেটে পড়ছে। আমায় একজন বলেছিল। তাদের সঙ্গে একবার যৌন সম্পর্ক করলে মানুষ অমর হয়ে যায়!’’

‘আমাদের তাই বিশ্বাস। তাই আমাদের দেবতাও আর্য নারীর খপ্পরে পরেন। আর্যনারী যেখানে পা রাখে, সেখানের মাটিতে ফুল ফোটে। আমাদের অনেক দেবতাও তাদের রূপে পাগল। দেবতারা বিবাহও করেছেন। যেমন গিলগামেশ। তার মাতা আর্যনারী, পিতা দেবতা। জন্মের পর তার মা তাকে সিন্ধু নদের জলে ভাসিয়ে দেয়। সে এসে ঠেকে আমাদের হরপ্পায়। এখানেই সে মানুষ হয়। দেবতা-মানুষে যৌন সম্পর্ক ছিল আমাদের সময় ছিল। যে জন্য অনেক মুনি ঋষি জন্মেছেন আর্য দের সময়ে।’

‘সেই নারীর কাছে যাবে?’

‘কোথায়?’

‘উঠোন পেরিয়ে ওদিকের ঘরে।’

‘হল কি তোমার! সে তোমার স্ত্রী।’

‘আগে ছিল। এখন ও একজন নারী মাত্র। লোকের কাছে দেখায়, হাতের কাজ করে সং সার চালায়। কিন্ত্য সত্যিটা কি সেতা আমি জানি। এই ত কদিন আগে এক চালের আদতদারের সঙ্গে দিঘা ঘুরে এল। আমায় এসে বললে, মাসি খুব অসুস্থ তাই দেখতে গেছিলাম। আমাকে কি গাড়ল ভাবে নাকি কে জানে! ’

‘ওর প্রতি এখনও কি কোন মায়া নেই তোমার?’

‘না।’

‘কোন অধিকার বোধ?’

‘ওর প্রতি অধিকার জগতের সকল পুরুষের। প্রতিটি কামার্ত পুরুষ ওর পায়ের প্রণাম করে যায়।’

‘এতটাই রাগ তোমার ওর প্রতি?’

‘আমি আরও কি চাই শুনবে? এই এলাকার প্রতিটি কিশোরের যৌনতার হাতে খড়ি হোক ওর দেহ দিয়ে। কমলির দেহ ঘেঁটে ওরা সব শিখুক, নারী কাকে বলে; নারীদেহ কেমন।

‘তুমি খুব কঠিন লোক হে, তারাপদ। তোমার মন অপরাধী।’

‘সময় আমাকে এমন করে দিয়েছে।’

‘সত্যিই কী সময় দোষী?’

‘কমলির পুরুষের প্রতি টান, ওর দেহের সুগন্ধে পুরুষের পাগলামি, সব সন আমি দেখি জানি। যখন বিবাহের কারণে ওকে দেখতে যাই, ওর এমন রূপ ছিলযে, আমি আর অন্য কিছু দেখতে পাইনি সেদিন। যেমন অর্জুন কেবল মাছের চোখ দেখেছিল, তেমনি আমি কেবল চোখ চেয়ে দেখে গেছি কমলিকে। আমার তখন একবারও মনে হয়নি কেন আমার মত এক কালো কুচ্ছিত চাষীর সঙ্গে ওর পরিবার বিয়ে দিতে চাইছে।  আমি কোনরূপ তলিয়ে দেখলুম না। দেখার কথা মনে হল না। কেবল যেন স্বপ্নের ভেতর থেকে গেছি তখন। পরে জানতে পারি আমার আগেই বহু পুরুষ ওকে ভোগ করেছে। সে দু’বার পেট খসিয়েছ। পরে তাই আর তার বাচ্চা এল না। ঈশ্বর তার জন্য দুটি নির্দিষ্ট করেছিলান। সেটা বিয়ের আগেই হয়ে গেছে। আমার চোখের সামনে যদি ও ঘরে লোক ঢোকাতে পারে, তবে আমি কেন তোমাকে ওর কাছে যেতে বলতে পারি।’

লিম্বু চুপ করে রইল। সে কিছু ভাবছে, তারাপদ বুঝতে পারল। তারপর সে গাছাড়া দিয়ে উঠে দাঁড়াল। সোজ়া ঘর ছেড়ে বেরিয়ে উঠোন পেরিয়ে লম্বা লম্বা পা ফেলে উঠল কদমের ঘরে। তারাপদ চুপ করে বিছানায় শুয়ে পরল। ভাবতে লাগল আকাশ-পাতাল। ক্রমে ঘুমিয়ে পরল তারাপদ। সন্ধে পেরিয়ে রাত নামল। রাত গভীর হতে লাগল।  আকাশ জুড়ে নামতে লাগল বাদুরের দল। অন্ধকার আকাশ কে ঘিরে ফেলতে লাগল তারা। বাইরের মানুষ দেখলে ভাবলে এটা বাদুড়েরই বাড়ি। একটা ছিন্ন ছিন্ন অন্ধকার, স্যাঁতস্যাঁতে ভাব। যেন মনে হল, তারা নয়,এ পৃথিবীর আসল বাসিন্দা ওই বাদুড়! সঙ্গে গাছপালা, মাঠঘাট, লতাপাতা ঘিরে এই যে এলাকা এমনিই ছিল সেদিনের হরপ্পার গ্রাম।

বাদুড়ের আচমকা চিতকারে সে বিছানায় উঠে বসল। দেখল ঘামে পুর ভিজে যাচ্ছে তার গা। কমলের সঙ্গে প্রথম যৌন মিলনের কালে এমনি হয়েছিল তার। সেই বহু পুরানো কথা কেন যে তার মনে এই, তা সে বুঝতে পারল না। এ সময় নিজের শিন্নে এক প্রবল ব্যাথা উপস্থিত হল। লুঙ্গি সরিয়ে তারাপদ অবাক বিস্ময়ে দেখল, তার গোপনাঙ্গে এক যন্ত্রনাদায়ক ঘা ফুটে উঠতে!

তারাপদ চিৎকার করে উঠল। আর তখনই আবার জেগে উঠল দেওয়ালে আঁকা সেই ষাঁড়। সে তারাপদকে পিঠে উঠিয়ে নিল। তারপর আকাশপথে সোজা উড়ে চলল হরপ্পা নগরীর সেই গ্রামের দিকে যেখানে লিম্বু মহারাজের বাড়ি।

অনিরুদ্ধ চক্রবর্তী। গল্পকার। লেখকের দেশ-ভারতবর্ষ। জন্ম ১৯৭৬ সালে, ভারতবর্ষের পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যের হুগলি জেলার ছোটচৌঘরা গ্রামে। পড়াশুনো- বাংলা সাহিত্যে এম এ। জীবিকা- চাকুরি। প্রকাশিত বই- একটি। 'মশাট ইস্টিশনের মার্টিন রেল' (১৫টি গল্পের একটি সংকলন)।  প্রকাশিত গল্পের সংখ্যা দুইশত। পশ্চিমবঙ্গের নানা পত্র পত্রিকায়...

এই বিভাগের অন্যান্য লেখাসমূহ

বালির বেহালা

বালির বেহালা

বুড়িমাসি বলেন,জীবনটা বালির ঘর গো।ঢেউ এলে ধুয়ে যায় জীবনের মায়া।তবু বড় ভালবাসা ওদের দাম্পত্যে।রোদের চাদরের…..

তদন্ত

তদন্ত

  এক ড্রইং রুমে বসে রয়েছে সদ্য কিশোর উত্তীর্ণ তরুণ গোয়েন্দা সজীব। সামনের টেবিলে ছড়িয়ে…..