হলুদ রঙের প্রজাপতি

বদরুদ্দোজা শেখু
কবিতা
Bengali
হলুদ রঙের প্রজাপতি

হলুদ রঙের প্রজাপতি

যাচ্ছিলাম ইচ্ছামতো আনমনে হেঁটে
পাথর ছড়ানো দীঘল রেললাইন ধ’রে ধ’রে
ক্লান্ত পায়ে। মনে মনে ক’রে নিচ্ছিলাম
একরাশ গৃহপালিত স্বপ্নের তল্পি-বওয়া তদারক আর
দৈনিক ক্রিয়াকর্মের খুচখাচ হিসাব-নিকাশ
ঠিক দিনের বাণিজ্য শেষে ঘর-ফিরতি ফেরিঅলার মতো
অবসন্ন,আত্মমগ্ন, ক্রমশঃই বেজায় ব্যাজার
বিরক্তিতে ভরপুর সমস্যা-সঙ্কুল জীবনের ঘানি
টেনে টেনে ।
হঠাৎ চোখে পড়লো —
কুচি পাথরের কোলে ঝাঁপড়া ঘাস-ফুলের উপর একটা
হলুদ রঙের প্রজাপতি । স্বতঃস্ফূর্ত
ডানা দুটো নেড়ে নেড়ে অদ্ভুত ভঙ্গীতে
ইতস্ততঃ উড়ছে বসছে বারবার,নীল
জলের উপর পাল-তোলা ময়ূরপঙ্ক্ষী নৌকার মতো
অনায়াসে ঢেউ ভাঙে যেন দাঁড়-বাওয়া ছিপছিপে ঢেউয়ে ।
চৌদিকের ঝোপঝাড় ঘাসের সবুজ তার সেই
উদ্দীপক বর্ণাঢ্য আভায় উদ্ভাসিত
উদীয়মান সূর্যের সৌম্যকান্তি দিগন্তের মতো অপরূপ ।
মুহূর্ত্তেই আবিষ্ট দু’চোখ
সৃষ্টির বিস্ময় দ্যাখে নিসর্গের নিরুদ্দিষ্ট শিল্পের নিভৃত
ক্ষুদ্রতম অভিব্যক্তি থেকে । অকস্মাৎ
ইচ্ছে হয় , কেউ দেখুক বা নাই-বা দেখুক,
জীবিকার যাঁতাকলে বিচূর্ণ হয়েও
সমস্ত উপেক্ষা দুঃখ ব্যর্থতা সয়েও
কবিতার ডানা মেলে আমি ওই হলুদ রঙের
প্রজাপতির মতোই মোহন ভুবনচারী হ’য়ে যেতে চাই ।।

 

পত্রিকার খোঁজে

রাস্তায় যেতে যেতে লোকটা
একটা পত্রিকা খোঁজে রোজ ,
আজকাল অভ্যাসটা তার মূদ্রাদোষে দাঁড়িয়েছে ।

শহরের রাস্তার দু’ধারে
ভিড়ভাট্টা হট্টগোল গাড়িঘোড়া ট্রাফিক সিগন্যাল ,
ডবকা আপেল আঙুর কলা কমলা লেবুর লোভনীয় ঝুড়ি ,
আধুনিক নানাবিধ খেলনা পুতুল, ম্যাজিক কিউব , মর্চেহীন
আসবাবপত্র , মনোহারী জিনিস-পত্তর,স্যুটকেস সোফা
বাহারী রুমাল,নরম তোয়ালে, চেক লুঙ্গীর লোবান ,
বুক-ফোলা ব্রেসিয়ার ,জুতোর জমক,দোকানের
দাঁত-বের-করা সাইনবোর্ডের বিবরণমালা ,দেয়ালের
রঙচটা পোষ্টারের পেঁচানো বক্তব্য , চকচকে
কাচের দীঘল দেয়ালে নিজের রঙীন প্রতিবিম্ব,স্তূপানো
ইটপাথর ,পুরাতন বই-পত্র-পত্রিকার স্টল,অথবা
শিল্প-বই-মেলা প্রদর্শনী পার্ক ,শোকের বা দাবীর মিছিল
সবকিছুর উপর দিয়ে তার ক্ষিপ্র দৃষ্টি চ’লে গিয়ে শুধু
একটা পত্রিকা খোঁজে সদা-সর্বদাই ।

এমন কি যখন সে গাঁয়ের বাড়িতে যায়—
ঝরা পাতা,খাঁ খাঁ মাঠ,শুকনো খড়ের গাদা ,অগাধ ধূলোর লিক , খিটকেল
গরু-ছাগলের দোঘা ,
অথবা শিশির-স্নাত সবুজ ধানের আলে
সফেদ বকের সাথে কৃশকায় শালিকের শান্তিপূর্ণ ভোজ ,
চৈতালির গমের সোনালি শিষ,
গরুর গাড়ির মন্থর মিড়িক ,
সকরুণ কাক-ডাকা কোজাগরী পূর্ণিমার রাত
সবকিছু ভেদ ক’রে চোখ দু’টো তার
দিনরাত একটা পত্রিকা খুঁজে যায় ।

লোকটা আপন মনে বিড়বিড় করে যেতে যেতে ।
পাশাপাশি লোকজন ভাবে ‘লোকটা পাগল’
অথচ সে আদৌ তা নয়। শুধু তার
আঁখির তারায় ভাসে ঝকঝকে পাতার ঝিলিক ,
ঠোঁট নেচে ওঠে ।
অবসন্ন দেহে , কিছু খেয়ে না খেয়েই
যখন ঘুমোতে যায়
ঘুমোতে ঘুমোতে
সরীসৃপ আস্তানার অন্ধকার খোপ ,
অর্থাভাব-ক্লিষ্ট অস্তিত্ত্বের উপেক্ষিত বিপর্যয়,
বুদ্ধিজীবি-কবি-শিল্পী-সংগ্রামীর নৃশংস নিধন
আন্তর্জাতিক মঞ্চের জটিল তুখোড় খুচরো খবরাবর্ত
ক্রমশঃ থিতিয়ে যেতে যেতে যেতে
সবুজ স্বপ্নের ঘোরে আবারো সে
একটা পত্রিকা খুঁজে যায়
আজন্ম ভালবাসার স্বপ্নময় মানসীর সন্ধানের মতো ।
কিসের পত্রিকা খোঁজে ?–আদর্শ পত্রিকা :
একগুচ্ছ কবিতার কারুময়তায় সুশোভিত বিবর্ণ বর্ণমালার দুঃখিনী মাতৃকা ।।

 

কোনো কোনো কবিতার জন্ম

ঘরে ফিরি । কর্মক্লান্ত অবসন্ন দেহ , ভগ্ন-মনোরথ—
দিনের কর্মের ফর্দ অসম্পূর্ণ থেকে যায় প্রতিদিন
আর অবিন্যস্ত ঘুরপাক খায় প্রতীক্ষার আবিষ্ট মগজে ।
পৃথিবীর প্রতিটি মানুষ হয়তো নিদেনপক্ষে খুঁজে’ পেতে চায়
মাথা গুঁজবার মতো একখণ্ড নিজস্ব আস্তানা
দৈনন্দিন রুজি-রোজগারের নাস্তানাবুদ-করা উপদ্রব শেষে ;
তার চেয়েও অধম ইচ্ছায় আর অবুঝ নিষ্ঠায়
আমি তো কোনোরকম দাঁড়াবার মতো
পায়ের তলায় মাটি খুঁজি
হৃদয়-বৃত্তির শব্দের সভায় ,নগর-কেন্দ্রিক
বহুল-প্রচার প্রেসের ভাগাড়ে ; গণ্ডগ্রাম উৎসারিত
সবুজের পরিচিত প্রাসঙ্গিক রূপকল্প আর বালিরঙ
মাঠের ধূলোর মতো বৈচিত্রহীন সরল অনাড়ম্বর জীবন
শহরতলির নগর-পালিশ-প্রাপ্ত ঝঞ্ঝাট-মুখর
বস্তির অস্থি-র সাথে অনুষঙ্গ গ’ড়ে তোলে
জনারণ্যে উপেক্ষার মর্চে-পড়া অস্তিত্বের কোনোরকম অক্ষম প্রয়াসে
সময়ের সাথে নিজেকে টিকিয়ে রাখার আশায় ।
নিজের ভবিষ্যৎ সাহিত্যিক প্রতিমা
এখন কেবল কোজাগরী পূর্ণিমার রাতে
বয়োবৃদ্ধ কোনো বটের তলার মায়াময় ছায়ার মতোই মনে হয়
বাস্তবের বাণিজ্যিক চোখে , তবু
হৃদয়ের অনিবার্য টানে
কোনোক্রমে দিনান্তের কর্মকাণ্ড গোগ্রাস চুকিয়ে
লন্ঠনের স্তিমিত আলোয়
শুয়ে শুয়ে পেন্সিলের আঁকিবুকি টানি দুর্মূল্য কাগজে ,
ফুটো পাত্র হাতে শহরের ফুটপাতে ব’সে
ভিক্ষে করতে করতে অসাড়ে ঘুমিয়ে-পড়া
ভিখারীর মতো কখন্ ঘুমিয়ে পড়ি
ভোরের আযান শুনে ধড়ফড় ঝেড়েঝুড়ে উঠি
ব্যর্থ মনোরথ । জাগতেই
হয়তো-বা কোনো কোনোদিন রৌদ্রোজ্জ্বল পৌষালির
কিশোরীর গায়ে কস্তাপেড়ে উৎফুল্ল শাড়ির মতো
নেচে নেচে ওঠে রাজেন্দ্র শব্দের মূদ্রা
কাব্যের অনাথ এই ভিখারীর তরে ।।

 

অসহায় একজন 

লোকটি পিছনে হাঁটে , আনমনে বিড়বিড় করে ,
পাখিদের ওড়া দেখে’ থমকে’ দাঁড়ায় ,খড়কুটো
গাছপালা ঘাসমাটি মানুষ মন্দির খুঁটে খুঁটে
দ্যাখে,দ্যাখে নদী নৌকা চাঁদ দিগন্ত গোধুলি; কোনো-
রকম দুশ্চিন্তাহীন ছাগলের চ’রে বেড়ানোর
নির্ভার জীবন দ্যাখে ছিটে-ফোঁটা ঘাসের কল্যাণে,
দ্যাখে পথ-পার্শ্বে ঝোপঝাড়ে ফুটে-থাকা কতো কী-যে
রূপের রহস্য-ভরা আনকোরা ফুল ,কান পেতে
শোনে যেন সকরুণ বৃন্তচ্যুত ফুলের বিলাপ,
আর সবুজ পাতার আন্দোলনে শোনে সে কী-এক
অলৌকিক গান ;কাঙাল চাষীর মতো আজীবন
মাঠকে সোনালি দ্যাখে হাভাতে দু’চোখে,অথচ যে
কুক্ষিগত করতে জানে না তার শ্রমের সম্পদ ;
আদর্শের ধূসরিত ঋজুপথে প্রগাঢ় বিশ্বাসে
নিঃসঙ্গ শেরপা যায় প্রকৃতির সম্রাটের মতো
মগ্ন মনে নান্দনিক মাধুকরী খোঁজে সবখানে,
প্রত্নতাত্ত্বিক প্রয়াসে ঘাঁটে শব্দের শৈবাল, তার
চলন-বলনে নাই কোনোরূপ নগর-পালিশ ।
মনেপ্রাণে লোকটি গণতান্ত্রিক ,কিন্তু নাগরিক
দলবৃত্ত রাজনীতি সংগঠন সভা সমাবেশ
মিছিল এড়াতে চায় আরক্ত দ্বিধায়, অথচ সে
অন্যায়ের প্রতিবাদে শূণ্যে মুঠি তোলে, গর্জে উঠে’
বিপন্ন আঁধারে দ্যায় সুনির্দ্দিষ্ট পথের বিধান,
আত্মার সন্ন্যাসী তার বিশ্বাসের বাগান সাজায় ।
কেউ বলে ‘লোকটা লাজুক’ ,কেউ বলে ‘অমিশুক’ ,
কেউ-বা ‘অসামাজিক’ , কেউ কেউ বলে ‘বর্ণচোরা ,
কাপুরুষ,স্বার্থপর,অপদার্থ ‘ ,’আত্মভোলা’ কেউ।
একটা কিছু বুঝলো ,কিন্তু হায় ,ওরা বুঝলো না–
পৃথিবীতে কবিরাই সবচেয়ে বড়ো অসহায়।।

বদরুদ্দোজা শেখু। কবি। জন্ম ১৯৫৫ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে, ভারতের পশ্চিমবঙ্গরাজ্যের মুর্শিদাবাদ জেলার সাগরদিঘিতে। অভাব অনটনের মধ্যে তাঁর বেড়ে উঠা। প্রথাগত শিক্ষায় স্নাতকোত্তর। পেশায় অবসরপ্রাপ্ত রাজ্য সরকারি কর্মচারী, নেশায় কবিতা লেখালিখি। প্রকাশিত কাব্যগ্রন্থ: অলৌকিক আত্মঘাত, দুঃস্বপ্নের নগরে নিভৃত নগ্ন, শব্দ ভেঙে...

এই বিভাগের অন্যান্য লেখাসমূহ

ঝরা পাতা

ঝরা পাতা

  চারিদিকে কোলাহল শূণ্যতা করেছে গ্রাস, বেদনা বিধুর অতৃপ্ত বাসনায় হাহাকার, অজান্তে নীরবতা তোমার স্পর্শে…..