হাততালি

মলয় রায়চৌধুরী
কবিতা
Bengali
হাততালি

তারপর পলিতকেশ কাশফুলে
পইপই বারণের পুশতুভাষী দুর্যোধন বেরিয়ে পড়েছে
দগদগে রোদে
চন্দনরক্তের পাথরপোশাক রক্ষীদের সরিয়ে
অন্ধকারকে খুঁচিয়ে বের করে এনেছেন সকালের বিকল্প
কাঁচা নরকের উদাত্ত অনুভব
হাহ
রোগা পৃথিবীর শিয়রে রাতজাগা নেশুড়ে
হরতালের দরুন ক্রুশকাঠ থেকে নামতে পারেননি হাততালি
চোখে জলসুদ্ধ হেসেছে শিশুরা

একথোকা অন্ধকারে জোর-করে দেখানো স্বপ্নে
যাত্রীডুবির খবরে ডুকরে উঠেছেন লালশালু-নৌকাের হাততালি
না-খেতে পাওয়া হলুদ শীতে
গরম আলকাৎরায় ফোটা ফরসা রজনীগন্ধা
যখন নরুন-খোদাই বাতাসে
নিকেল-চকচকে বিচিবীজ
কাঁধে চাঁদ নিয়ে ভররাত শাসিয়েছে শ্যাওলাধরা করোটি
ঘাসফুলে না-ফোঁপানো ফড়িং পুরুষ
বারবাডোজ পেশির ব্রোঞ্জ পুরুষরা
জ্বরগরম কপাল ছুঁইয়েছে তার পশুপশম নাভিতে

চিরুনিধার বৃষ্টিতে
ভুরু-কোঁচকানো ঢেউয়ে শুয়ে
জলকে চাপড়েছে ডিজেলচাদর ছায়া
সমস্ত ডানা সরিয়ে ফেলা হয়েছে আকাশ থেকে
হরিবোল দিতে-দিতে দল-বেঁধে সাংবাদিকদের সদ্যছাপা সকাল
চাবির ঘোলাটে ফুটোয় যাবজ্জীবন কয়েদির চোখ
বাইরে
হেমন্তের ঢেঁকিতে গোলাপ-গোড়ালি
লালুং রমণি
ঘামসুগন্ধে বিহ্বল প্রতিধ্বনি ফেরত চেঁচাতে ভুলে যায়

তারপর
অপারেশান বুলশিট
মুখে ঘা
শহিদ চবুতরায় অর্থনমিত লিঙ্গে যুবাবিপ্লবীর শীৎকার
পেঁয়াজবাটায় ভেজা আমিষ হৃদয়
চোখে-কালি হাসনুহানা
জলে ভিজে পদ্মফুলের নিউমোনিয়া
হুঁকোটানা বুড়ো রেলগাড়িতে মেঘের চেষ্টাকৃত গর্জন
আর সোনার মাকড়সার জালে ঢাকা বিদ্যুৎ
হোঁতকা মরদকে সবুজ পিঠ থেকে নামিয়ে দিয়েছে ব্যাঙযুবতী
ব্যাবিলেনর শাদা নরকহুরি
উত্তরমুখাে নকিশমেঘের ওষুধবড়ি গিলিয়েছে
রেড়িপ্রদীপে ঝুঁকে ঘুরঘুরে শুঁটিপােকা
এলােচুলে ঢাকা উল্কামুখ রাজকন্যার মুকুট থেকে গানের টুকেরা
পায়ে রক্তমাখা রাজহাঁস
যখন-তখন চেয়েছে বাড়ি-ফেরত সৈন্যের বসন্তকাল
সাজিয়েছে খেলাচ্ছলে-মারা চরমযুবার মা-বাপের সবুজ কাঁথা ধানক্ষেত
তুঁতেরঙা কুয়াশা এগিয়েছে সিংহচামড়া শিকারির গােপন ঘাসপথে
বিবাহযােগ্য ঘুড়সােয়ার হাততালি
হেই হাে

কিছুটা অপিরিচত থাকার কষ্টে
যে-বাগান সুপুরিগাছকে কড়ে আঙুলে দাঁড় করিয়ে আজীবন
দূরপাল্লার ঝড়ে
ল্যামপোস্টের নিচে
বৃষ্টি মুড়ি দিয়ে
সেই ভাঙচুর চেহারাই তাঁর আঙ্গিক
যে-আদল খুঁজেছে শরীর এলিয়ে-দেয়া ঢেউ
কথকনাচে বাঁধা ব্রহ্মান্ড
মন্দিরের চােরাকুঠুরিতে মুখবাঁধা
হাততালি

আগুন যখন ধােঁয়া থেকে আলাদা হচ্ছে
যেটুকু সময়ে
আলজিভ
দুই হৃৎস্পন্দনের মাঝে তেতাে হয়ে ওঠে
জলপথে এসে আক্রমণ করেছে জ্বরবিদ্রোহী
গাছে-গাছে ঝড়কালীন পলাশের লাল-সখ্যতা
ঠিক যেন চিড়িয়াখানার ভবিষ্যৎহীন
শেষ হাওয়ায়
পটকা ফাটিয়েছে রাংতাপাড় মেঘ
যেন এক্ষুনি এসে পড়ল বলে হাততালি

রাতভর ছড়নাে হাততালি সকালে এককােণে ঝেঁটিয়েছে ঝাড়ুদার
আঘাতহীন ভালােবাসায়
থলেতে পুরেছে অসুস্থ গঙ্গানদীকে
এক বা তিনরঙা পতপতে রামধনু
কবরে পাওয়া গেছে ভাত খাবার কাঁসি
অত্যাচারিতের কাতরানিতে পড়েছে হাড়ের খিলান
কেউ সুখী নয়
কেমন আছাে জানতে চাইলে বলেছে
ভালাে
পাকের পর পাক কাঁটাতার কােমর থেকে খুলে দিয়েছে

নষ্টের শপথ আওড়ানাে শেষে
শহরগ্রামে রােদে বেরিয়েছে মড়াসংগ্রহকারী
কষ্ট হলে কাঁদতে পারার আশীর্বাদ চেয়েছে নগরবাসী
ওদিকে হাততালিবাদক
ভগ্নস্বাস্থ্য আকাশে
পাখিদের গান ধরে দিতে চেয়েছে
তারা-দপদপে অন্ধকারে
বালিশ-জড়ানাে বর্ষায়
পালােমৗ জেহানাবাদ রােহতাসে কাদাপেছল মাগুরের আঁশটে হাঁপানি
শামুক-থুতনি বুড়ির চােখের পাতায় ধূসর সােরাগন্ধক

আধপচা হুগলি নদীর ডাগরেচাখ পারশের গান শুনতে
কেউটে যুবতীর শরীর থেকে খসে পড়েছিল শীতের মিহিন আদল
আচমকা সজারু
বিয়ের লাল বেনারসিতে শিমুল
এদিকপানে মুখ করে দাড়িয়েছে ছােকরা সূর্যমখুী
গরম তেলে লাল দুহাত উড়িয়ে স্বাস্থ্যবতী কাঁকড়া
ভাতের হাঁড়িতে নেচেছে সফেদ-মসলিন নরম অপ্সরা
তখন অন্ধকারে কেঁদে নিয়ে আলােয় হেসেছে হাততালি
হাসপাতালের বিছানায় লােহার শেকলে বাঁধা শুনেছে
টেবিল ঘড়িতে সারারাত গ্রেপ্তারের ঠকঠক ঠকঠক ঠকঠক।

মলয় রায়চৌধুরী। বাঙালি কবি, ঔপন্যাসিক, গল্পকার, প্রাবন্ধিক, অনুবাদক ও সাংবাদিক। মলয় রায়চৌধুরী জন্মগ্রহণ করেন ১৯৩৯ সালের ২৯ অক্টোবর । ১৯৬০ দশকে হাংরি আন্দোলন –Hungryalism–এর মাধ্যমে শিল্প-সাহিত্যে প্রতিষ্ঠানবিরোধী আন্দোলন শুরু করেন। এবং এ কারণে ১৯৬০-এর দশক থেকেই ব্যাপক পাঠকগোষ্ঠীর দৃষ্টি আর্কষণ করতে সক্ষম হয়েছিলেন।সর্বোপরি ...

এই বিভাগের অন্যান্য লেখাসমূহ