হানিমুনে হারিকিরি (পর্ব – ৩)

মৈ মৈত্রেয়ী
ধারাবাহিক, নন ফিকশন
Bengali
হানিমুনে হারিকিরি (পর্ব – ৩)

পূর্ব প্রকাশের পর…

গ্যাংটকের ট্যাক্সি স্ট্যান্ডে এসে পৌছনোর সাথেই সাথেই প্রায় সন্ধে নেমে এলো। সেখান থেকে আরও খানিকটা উঠে তবে শহরের রাস্তার দেখা পাওয়া যায়। ট্যাক্সি স্ট্যান্ডের ডানদিকে অনেক ধরণের দোকান। আর বাঁদিকের খানিকটা দূরে তাকালে মনে হয় যেন হঠাৎ করেই কিছু একটা ‘নেই’ হয়ে গেছে। এগিয়ে গেলাম সেইদিকেই। রেলিং বলে কিছু নেই। গুলিয়ে ফেলা সিঁড়ির ধাপের মতো আরেক পা এগোলেই মৃত্যু। আজকের দিনের শেষ আলোটি দূরের পাহাড়ের গায়ে হেলান দিয়ে খানিক জিড়িয়ে নিচ্ছে মনে হোলো যেন। দুজনেই চুপ করে অপেক্ষা করছি, বিনা কারণের অজুহাতে। চারপাশের গোল হয়ে ঘিরে থাকা পাহাড়গুলোর গায়ে একটা একটা করে আলো ফুটে উঠছে। ঝুপ করে দিনের আলো ফুরিয়ে গেল। ফিরে এলাম পিছন দিকে।

হোটেল যদিও খুব দূরে নয় কিন্তু সাথে অগাধ মালপত্র থাকার সুবাদে আবার ট্যাক্সি নিতে হোলো। এখানে ট্যাক্সি মানে মারুতি ওমনি বা স্যান্ট্রো। মালপত্র গাড়িতে উঠিয়ে হোটেলের উদ্দেশ্যে যেতে যেতেই ঠিক করা হোলো যে আগামী দিনগুলিতে মানে শহরে ঘোরার সময় এই মিংমাই হবে আমাদের সারথি। সিকিমের সব থেকে বড় সুবিধা যে এখানকার মানুষজন ভীষণ সৎ। এই গ্যাংটক থেকেই বিভিন্ন দিকে ঘুরতে যাওয়া যায় আর সেই সব ট্যুরের জন্য আলাদা আলাদা সরকার অনুমোদিত মূল্য, ট্যাক্সি স্ট্যান্ডেই টানানো থাকে। তাই দরদাম করার প্রশ্নই নেই। আর সত্যি কথা বলতে ছোটোবেলা থেকে বাবা-মায়ের সাথে অনেক জায়গায় বেড়াতে গেছি এবং সবজায়গাতেই দেখেছি যে আমার বাবা খুব সুন্দর ভাবে সেখানকার স্থানীয় লোকজনের সাথে মিশে যেতেন। অনি-র বেলাতেও একই কথা খাটে। তাই দরদামের পথ মাড়ানোর কোন প্রশ্নই নেই। যেতে যেতেই বেশ অন্ধকার হয়ে এলো। রাস্তার আলো জ্বলে উঠেছে। পথচারীদের মধ্যে পর্যটকের সংখ্যা বড়ই কম। খুব তাড়াতাড়িই চলে এলাম হোটেলের সামনে।

হোটেলের একতলায় সারিসারি দোকান। সিঁড়ি দিয়ে উঠে দোতলায় রিসেপশান। আমি নিচে মালপত্র নিয়ে দাঁড়িয়ে রইলাম খানিকক্ষণ বাদে দুজন পাহাড়ি লোক নেমে এসে, সুনিপুণ দক্ষতায় প্রায় সবকটা ব্যাগ, নিজেদের ঘাড়ে চাপিয়ে দোতলায় রওনা দিল। আমিও তাদের পিছন পিছন উপরে উঠে অনির পাশে দাঁড়ালাম। এই হোটেলের রিসিপ্টই, ল্যাট্রিন দিয়ে ধাঁ হয়েছে। তবে সুখবর এটাই যে তাতে কোনো অসুবিধা হোলো না। এই হোটেলটি বাবি মানে শ্বশুরমশাই বুক করে দিয়েছিলেন। এটা পোর্টট্রাস্টের গেস্টহাউস হিসেবে ব্যবহার হয়। আমাদের রুমটি হোটেলের চারতলাতেও বলা চলে আবার তিনতলাতেও বলা চলে। রিসেপশানের দিক দিয়ে আরেকটা প্রবেশ পথ আছে। অর্থাৎ, হোটেলের পিছনদিকে যে রাস্তাটি আছে সেটার উচ্চতা সামনের রাস্তার থেকে এক ধাপ ওপরে। পাহাড়ে বেশীরভাগ হোটেলেই এই ব্যাপারটি বেশ মজার। যাই হোক, আমরা উঠে গেলাম চারতলায়। সিঁড়ি দিয়ে উঠে ডানদিকের করিডর দিয়ে সোজা হেঁটে গেলে একেবারে শেষপ্রান্তে আমাদের রুমের দরজা। ভেজানো দরজা খুলে ঢুকে একটু অবাক হয়ে গেলাম। বিশাল ঘর। সামনের দেওয়াল জোড়া কাচের জানালা। তাতে লাল রঙের পর্দা টানানো। বিছানার চাদরও লাল। ঘরে ঢুকে ডানদিকে বিশাল বিছানা আর বাঁদিকে বাথরুম। বাথরুমের দেওয়াল শেষ হতেই বাঁদিকে একটা বসার জায়গা। সেই দিকেও দেওয়াল জোড়া জানালা। তিনটে বেতের চেয়ার, একটা বেতের সোফা আর মাঝখানে একটা কাচের টেবিল। বলায় বাহুল্য যে ঘরটা বেশ পচ্ছন্দ হোলো আমাদের। সামনের জানালার পর্দাটা সড়াতেই মন্ত্রমুগ্ধের মত দাঁড়িয়ে রইলাম খানিক। রাস্তা থেকে আমাদের ঘরটি বেশ উঁচুতে হওয়ার জন্য রাস্তার ওপারে হোটেলটি, সামনের পাহাড় বা দিগন্তবিস্তৃত নীল আকাশকে আড়াল করতে পারে নি। অনিকে ডেকে দেখালাম। সেও আমার কাঁধে হাত দিয়ে খানিকক্ষণ চুপ করে দাঁড়িয়ে রইলো। আস্তে আস্তে আমাকে কাছে টেনে নিল আর আমি ওর বুকে মাথা রাখলাম। কতক্ষণ এইভাবে দাঁড়িয়ে ছিলাম জানি না। আকাশের তারাগুলোও বড্ড উজ্জ্বল।

দরজার আওয়াজ না হলে বোধহয় এইভাবেই দাঁড়িয়ে থাকতাম আরও খানিকক্ষণ। অনি গিয়ে দরজা খুললো। আমি ততক্ষণে চোখেমুখে জল দেওয়ার জন্য বাথরুমে ঢুকেছি। ফ্রেশ হয়ে বেরোনোর পরে অনি জানালো যে চা আসছে…তারপর আমরা বেরোবো। দুজনেই বেশ আরাম করে বাবু হয়ে বিছানায় বসলাম। এতক্ষণে খেয়াল হোলো যে সকাল থেকে পা ঝুলিয়ে বসে থাকার জন্য পায়ের পাতাটা বেশ ফুলে উঠেছে। এটা সেটা গল্প করতে করতেই চা চলে এলো আর তারসাথে পাকৌরা। আহা।

খেতে খেতেই অনিকে বললাম “কোথায় বেরোবি বললি?” অনি জানালো রাত্রের ব্যবস্থা করতে। আমি অবাক হয়ে বললাম “এখানে খেতে দেবে না? বাইরে থেকে খেয়ে আসতে হবে নাকি রে?” মৌজ করে পাকৌড়ায় আরেক কামড় দিয়ে বলল “ নাহ রে বাবা। পানীয় পানীয়।“ আমি তো এক গাল হেসে বললাম “ কী খাবি কী খাবি!” সে আরও এক গাল হেসে বলল “ এখানে অনেক ভ্যারাইটি পাওয়া যায়…গিয়ে দেখা যাবে।“

চা খেয়ে অনি ফ্রেশ হতে গেল। আমি তার মধ্যে ব্যাগ থেকে পরিষ্কার জামাকাপড় নামিয়ে পরে ফেললাম। প্রচন্ড ঠান্ডা। উলি কটন, তারপর হাফ হাতা গোলগলা শার্ট, কুর্তি, তার ওপর সোয়েটার এবং সবশেষে জ্যাকেট। আয়নার সামনে দাঁড়াতেই মনে হলো কুমড়ো পটাশও বোধহয় আমার থেকে রোগা ছিল। অনিও ততক্ষণে জামাকাপড় পরে নিয়ে তৈরি। অনিকে বললাম “ ওরে…পা তো ফুলে ঢোল। জুতো তো পরতে পারবো না।“ দেখলাম ব্যাগ ত্থেকে কিটো বেরিয়ে এলো। বলল “এটা দেখ, পায়ে ঢোকে কি না। নাহলে চটি বার করে দিচ্ছি। “ মনে মনে ভাবলাম – সত্যিই এখানে সংসার পাতা যাবে।
হোটেল থেকে বেরিয়ে যেটা সবচেয়ে আগে চোখে পড়লো সেটা হচ্ছে রাস্তা অত্যাধিক পরিষ্কার। কোথাও কোনো প্লাস্টিক বা আবর্জনা নেই। মানে পায়ে ব্যথা হলে, বিনা দ্বিধায় এই রাস্তাতেই দিব্যি বসে জিরিয়ে নেওয়া যাবে। আমরা চললাম বাঁদিকে। রাস্তা একবার নামছে তো আরেকবার উঠছে। রাস্তায় খুব বেশি ভিড় নেই। বেশ ফাঁকা ফাঁকা। বেশিদূর যেতে হোলো না। খানিকটা যাওয়ার পরেই বাঁদিকে লাইন দিয়ে সারি সারি সুরার দোকান। একটা দোকানে দাঁড়াতেই চক্ষু ছানাবড়া। কত রে বাবা!!! দোকানের সামনে স্থানীয় লোক এবং পর্যটকের ভিড়। গ্যাংটকে, সুরার কোনো ট্যাক্স নেই তাই অত্যাধিক কম দাম। অনিই বেছে নেছে তিনটে বোতল নিল। সবকটাই কাগজে পেঁচিয়ে দিল। কারণ এখানে প্লাস্টিক ব্যবহার করা দন্ডনীয় অপরাধ। কথায় বলে, নিজের শহর পরিষ্কার রাখার দায় শহরবাসীর। এই শহরে এটা তারা অক্ষরে অক্ষরে মেনে চলে। রাস্তার দাঁড়িয়ে সিগারেট খাওয়া, থুতু ফেলা, আবর্জনা যথা স্থানে না ফেললে জরিমানা হবেই হবে।

গ্যাংটকে আমি আগেও এসেছি। সালটা মনে হয় ১৯৯৫। স্মৃতির সাথে মিলিয়ে নিতে চাইছিলাম শহরটাকে। কিন্তু নাহ। কিছুই চিনতে পারছিলাম না। শুধু মনে আছে যে একটা স্টেডিয়াম ছিল আর সেখানে মেলা বসেছিল একটা। আর শহরটা এতো গোছানো ছিল না ঠিকই কিন্তু তাতে তার সৌন্দর্য বিন্দুমাত্র কম ছিল না। তবে আবছা স্মৃতির সাথে বাস্তবকে মেলানো বড় কঠিন। একটা ব্যাপারে এই শহরটা আজও একই রকম রয়ে গেছে। দার্জিলিং –ও আমার ভাল লেগেছিল ঠিকই। কিন্তু পর্যটকের ভিড়ের জন্য কি না জানি না দার্জিলিং কিন্তু বেশ অপরিচ্ছন্ন ছিল তখনও। কিন্তু গ্যাংটক আজও তার এই বৈশিষ্ট্যটি বজায় রেখেছে। নতুন করে আবার প্রেমে পড়লাম।

এপাশ ওপাশ ঘুরতে ঘুরতে হোটেলে চলে এলাম। সবে রাত ৮টা। হোটেলে বলল রাত ৯টার মধ্যে খেয়ে নিলে তাদের সুবিধা হবে। আমাদেরও কাল সকাল ৮টায় বেরনো। তাই বললাম ৯টাতেই রাতের খাবার দিয়ে দেওয়ার জন্য। আলু পারাঠা আর সব্জী। মাঝে অবশ্য আরেককাপ চা এসেছিল।

সব কিছু মিটলে আমরা বসলাম পান করতে। একথা সেকথা চলতে চলতেই জানালার দিকে তাকিয়ে অনি বলল “ ঐ দেখ” । তাকিয়ে দেখি মেঘ ছুঁয়ে যাচ্ছে জানালার কাচ। ছোটোবেলায় প্রথম যখন পাহড়ে আসি, ভেবেছিলাম এক মুঠো মেঘ নিয়ে আসবো কলকাতায়। কালিম্পং-এর ডেলো-তে যখন বেড়াতে যাই তখন মেঘ শরীর ছুঁয়ে পারাপার করছিল। সাদা মেঘ, ছোট হাতের মুঠিতে ধরার আপ্রাণ চেষ্টা বিফলে গেছিল ঠিকই কিন্তু সেই ঘটনাই ভবিষ্যতে অন্য রকম চেতনার জন্ম দিয়েছিল। অধরা উপলব্ধির রহস্যভেদ করা সম্ভব যদি প্রকৃতির কাছে আত্মসমর্পণ করে ফেলা যায়। ফিরে এলাম চেয়ারে। অনি তখন গ্লাস ভর্তি করে ফেলেছে।

পরেরদিন বেরিয়ে পড়লাম সাইটসিনের জন্য। আকাশ বেশ পরিষ্কার। দূরে দেখা যাচ্ছে কাঞ্চনজঙ্ঘা। তবে তারদিকের আকাশ একটু মেঘলা। মিংমাকে জিজ্ঞেস করলাম যে সে কোনদিকে আজকে আমাদের নিয়ে যাবে। মিংমার কথা মতো, শহরের আশপাশ ঘুরতে ২দিন সময় লাগবে। আমরা ঠিক করলাম যে মনেস্ট্রি আরেকদিন দেখবো আজকে বাকি জায়গাগুলো ঘুরে নেওয়া যাক। ঢেউ খেলানো পাহাড়ি রাস্তা বেশ মজার। আর গাড়িগুলো খাদের এতো ধার দিয়ে যায় যে মাঝে মাঝে ভিতর অব্ধি শিরশির করে ওঠে। চারপাশটা ভীষণ শান্ত। সামনে দিয়ে গাড়ি এলেও, হর্নের কোনো আওয়াজ নেই। খুব বেশিক্ষণ নয় মোটে ২ কিমি পেরিয়ে চলে এলাম প্রথম জায়গায়। হনুমান টক। যদিও প্রথমে এখানে আসতে চাই নি কারণ মন্দির প্রীতি আমাদের কারুরই খুব বেশি নেই। কিন্তু মিংমাই বেশ জোর করলো। আর এখন বুঝতে পারলাম যে না এলে কী ভুলটাই না করতাম। ৭২০০ফিট উচ্চতায় এই মন্দিরের চাতালে দাঁড়িয়েই, দেখা মিললো কাঞ্চনজঙ্ঘার। মানলাম যে প্রকৃতিই জন্ম দেয় প্রেমের।

প্রথম বলেই মিংমা ছক্কা মারল। তাই ওর হাতেই গোটা দিনটা ছেড়ে দিলাম। সারাদিন মন ভরে ঘুরলাম। দুপুরে, যে রেস্টুরেন্টটায় নিয়ে গেল সেটা বার কাম রেস্টুরেন্ট। অনি বলল “ভাল করে দাঁত মাজি নি মনে হয়। হ্যাঁ রে মুখ দিয়ে কি এখনও মদের গন্ধ বেরোচ্ছে নাকি রে? এইখানে নিয়ে এলো কেন?” আমি বললাম “ ভালো তো। এক পেগ নে না…মোমো দিয়ে খাই।“ এমন ভাবে আমার দিকে তাকালো যেন মনে হয় পান্তা ভাতের সাথে পাঁঠার মাংস খেতে বলেছি। বলল “ থাক…মাতলি শালা। রাত্রে খাবি, ভর দুপুরে মদ খেতে হবে না।“ আমি আরও তেড়ে বললাম “ কেন বে? তুই না পুরুষমানুষ? টাল হলে তুই সামলাবি।“ পাত্তাই দিলো না মাইরি।

যাই হোক আরও এক দফা ঘুরে সন্ধে নাগাদ হোটেলে ঢুকলাম। না ঢুকলেও চলতো কিন্তু ঠান্ডা বাড়ছে তাই আরও মোটা জ্যাকেট চাপাতে হবে। সঞ্জয়কে বলা হোলো যে আগামীকালের জন্য ওকে ফোন করে দেওয়া হবে। কারণ হোটেলেই নাথুলার যাওয়ার জন্য সব কাগজপত্র জমা করেছিলাম তাই আগামীকালের পরিকল্পনা তখনও অনিশ্চিত। হোটেলে ঢুকতেই রিস্পেশান থেকে জানালো যে আগামীকাল যদি আমরা লাচুং-এর দিকে যাই তাহলে হোটেল থেকেই সব বন্দোবস্ত করে দেবে। আর নাথুলার যাওয়ার জন্য সব কাগজপত্র জমা দেওয়া হয়ে গেলেও, পারমিশান পেতে ২দিন সময় লাগবে। আর দেড়ি করলাম না। বলেই দিলাম যাবো। তবে বেশিরভাগ মালপত্র এই হোটেলেই থাকবে। কারণ একরাতের জন্য গোটা লটবহর নিয়ে যাওয়ার কোনো মানে হয় না।

সন্ধেটা একটু এদিক ওদিক ঘুরে ফেললাম। তারপর হোটেলে ফিরে আগামী দুদিনের জন্য দরকারি জিনিসপত্র একটাই বড় ব্যাগে গুছিয়ে নিয়ে…আড্ডা মারতে বসলাম। একটা ব্যাপার খেয়াল করলাম দুজনেই। আমাদের আড্ডা অনেকটা ঘড়ির কাঁটার মতো, চলতেই থাকে। এখনও তার ব্যতিক্রম হয় নি। দুজনে একসাথে বসলে ঘন্টার পর ঘন্টা শুধু গল্প করেই কাটিয়ে দিতে পারি। কলেজের গল্প, বন্ধুদের গল্প, বিয়ের গল্প, রাজনীতি, সিনেমা, সমাজ আরও কত কী যে মিশে থাকে এই আড্ডায় তার ইয়ত্তা নেই। গল্প করতে করতেই রাতের খাবার চলে এলো। চানা মাসালা, তরকার ডাল, আলু ফুলকপির তরকারি আর রুটি। তারপর আরেকচোট গল্প করতে করতেই রাত ১২টা বেজে গেল। শুতে যাওয়ার আগে, জানালার সামনে এগিয়ে গেলাম। আকাশে ভর্তি তারা আর দূরে দেখা যাচ্ছে কাঞ্চনজঙ্ঘার একফালি সাদা টুকরো।

পরেরদিন ৯টার মধ্যেই পৌছে গেলাম ট্যাক্সি স্ট্যান্ডে। হোটেল থেকেই একটা বিল দিয়ে দিয়েছিল। পুরো টাকাটা গ্যাংটকের হোটেলেই পেমেন্ট করতে হলো। বিলের মধ্যেই গাড়ির নাম্বার, ড্রাইভারের ফোন নং সব লেখাই ছিল। ট্যাক্সি স্ট্যান্ডে গিয়ে খুব বেশি খোঁজাখুঁজি করতে হোলো না। পাহাড়ি লোকেরা প্রত্যেকেই ভীষন উপকারী। একজনকে কাগজটা দেখাতেই সে-ই আমাদের গাড়িটা দেখিয়ে দিল। গিয়ে দেখি একটা কালো রং-এর বোলেরো গাড়ির সামনে অনেকেই অপেক্ষা করছে। দুজন দুজন করে মোট ৬ জন। ড্রাইভারকে গিয়ে জানালাম যে আমরা সামনে বসতে চাই। কিন্তু বিধি বাম। গাড়ির সামনের সিটের বসার চাহিদা সবথেকে বেশি থাকে তাই ঐ জায়গাটিই আগে ভর্তি হয়। অগত্যা, মাঝের সিটে বসাই ঠিক হোলো। কিন্তু সবাই চলে এলেও সামনের সিটে যারা বসবে তাদেরই আর দেখা নেই। মনের কোণে আশা উঁকি মারতে না মারতেই মিলিয়ে গেল। পাঞ্জাবী স্বামী স্ত্রী যখন এসে পৌছলো তখন ঘড়ির কাঁটা ১০টা ছুঁয়েছে। তারপর সবার ব্যাগ ঠিকঠাক বাঁধতে বাঁধতেই প্রায় ১০.৩০টা বেজে গেলো। গতবারের অভিজ্ঞতার জন্য অনি আর আমি দুজনেই কোমরে হাত দিয়ে ব্যাগের দড়ি বাঁধার কাজে তদারকি করলাম। শুরু হলো যাত্রা।

আমাদের পাশে দুটি ছেলে। পিছনে দুটি ছেলে এবং নববিবাহিত স্বামী-স্ত্রী। আর সামনে তো আগেই বলেছি পাঞ্জাবী দম্পতি, তারাও অবশ্য নববিবাহিত। আমরা তো নিজেদের মতো হাসি ঠাট্টায় মেতে উঠলাম।

ওপর দিকে উঠছি, আমার কান প্রায় বন্ধ হয়ে গেছে। চারপাশের বর্ণনা আর কী দেবো। যা দেবো সবই সেই স্বর্গীয় দৃশ্যের কাছে তুচ্ছ। ধীরে ধীরে মেঘের ওপরে পৌছে গেলাম। বরফের পাহাড় শুরু হলো। রাস্তায় বরফ জমে আছে তাই গাড়ির গতি খুব কম। শরৎকালের পেঁজা তুলোর মেঘ বোধহয় পাহাড়ের গায়ে বরফ হয়ে নিজেকে জমা দিয়েছে। সেই ফাঁক দিয়ে টুক করে গাছপালাগুলো নিজের মুখ দেখাচ্ছে ঠিকই কিন্তু প্রচন্ড হাওয়ায় তারা আবার সেঁধিয়ে যাচ্ছে বরফের পিছনে। অনি আর আমি অবাক হয়ে অপলক দৃষ্টিতে শুধু তাকিয়েই আছি বাইরের দিকে। প্রায় দুই ঘন্টা বাদে গাড়ি এসে থামলো, পথের পাশে ছোট্ট একটা চায়ের দোকানে। দোকানের ছাউনির ওপরেও বরফ জমে আছে। রাস্তা থেকে বরফ কুড়িয়ে অনি আমার গায়ে ছুড়লো। আমি তৎক্ষণাৎ “তবে রে শালা” বলে বরফের গোলা বানিয়ে ছুঁড়ে মারলাম অনির দিকে। লাগ তো লাগ অনির মুখে গিয়ে পড়লো সেই বরফ। বলল “ ওরে ছাগল দেখে ছোড়”। বলার সাথে সাথে দৌড়ে গিয়ে পিছনে মারলাম এক ধাক্কা। বললাম “তুই পাঁঠা, তোর বাবা পাঁঠা।“ ইতিমধ্যে চা দিয়ে দিয়েছে। তখনই খেয়াল পড়লো যে বাকি সবাই চা খাওয়া ছেড়ে আমাদের দিকে হাঁ করে তাকিয়ে আছে। বোধহয় আমাদের জাত নির্ধারণ করছিল। যাই হোক, এইসব পাগলামি করতে করতেই পৌছে গেলাম লাচুং-এ। ততক্ষণে সন্ধে হয়ে গেছে। সেখানে, আমাদের জন্য অপেক্ষা করছিল আরও এক বিস্ময়।

(ক্রমশ)

মৈ মৈত্রেয়ী। জন্ম কলকাতায়। পেশায় সিভিল ইঞ্জিনিয়ার। গদ্য ও কবিতা লেখার প্রতি দীর্ঘদিনের ঝোঁক। ছোটদের জন্য বাংলা গল্প প্রতিযোগিতায় 'অক্সফোর্ড ইউনিভার্সিটি প্রেস' থেকে সম্মানপ্রাপ্ত।

এই বিভাগের অন্যান্য লেখাসমূহ