ইমন কল্যাণ
পরিচ্ছেদ ৬ অনেক রাতে ফিরেছিল কল্যাণ ওরফে শহীদুল।গাড়িটা শেডে রাখার পর দু’বার হালকা করে মা…..
রাত্রে দুজনে একটা স্কচ নিয়ে বসার পর অনিই কথাটা তুলল। “ অতক্ষণ একই ভাবে দাঁড়িয়ে ছিলিস কেন রে? সারা রাস্তাতেও চুপচাপ ছিলিস। কিছু হয়েছে??“
বললাম “অনি , খুব অদ্ভুত একটা অভিজ্ঞতা হলো রে, কীভাবে বোঝাব জানি না।“
অনি বলল “ বল না…আমি শুনছি।“
“ঐ চোখ আমি জীবনে ভুলবো না। শুধু চোখ ছাড়া আমি আর কিছুই দেখি নি। একটা সম্মোহন শক্তি ছিল চোখটার মধ্যে। কিছুতেই মন থেকে বের করতে পারছি না।“
কিছুক্ষণ চুপ করে থাকার পর বলল “আগে কোনদিন এইরকম টাইপের অদ্ভুত অভিজ্ঞতা হয়েছে তোর?” বললাম “হঠাৎ এই কথা জিজ্ঞেস করছিস কেন”
“ অনেকেই আছে যারা অন্যরকম জিনিস টের পায় তাই বলছিলাম। ওখানে তো অনেকেই ছিলাম, আর কারুর তো এইরকম কিছু হয় নি। শুধু তোর যখন হলো তারমানে তোর মধ্যে কিছু একটা আলাদা ব্যাপার আছে। খারাপ ভাবিস না কিন্তু। আমি জাস্ট যুক্তি খোঁজার চেষ্টা করছিলাম, তোকে অবিশ্বাস করি নি মৈ। প্লিজ ভুল বুঝিস না।“
আমি ওকে আশ্বস্ত করে বললাম “ নাহ রে পাগল। ভুল বুঝি নি। আমি তোর জায়গায় থাকলে আমিও এটাই করতাম। যুক্তি পাচ্ছি না বলেই তো খুব অস্বস্তি লাগছে পুরো ব্যাপারটা। আর আগের অভিজ্ঞতা…” চুপ করে গেলাম।
“ থামলি কেন? কিছু থাকলে আমায় নিশ্চিন্তে বলতে পারিস। “
ওকে যেটা বলেছিলাম সেটা হচ্ছে আমার দাদু যখন মারা যায় সেই সালটা ছিল ১৯৯৯। সেদিন উঠেছিল সেই সময়ের সবথেকে বড় চাঁদ। কাগজেও বেরিয়েছিল যে গত শতাব্দীর সব থেকে বড় চাঁদের দেখা মিলবে ২২শে ডিসেম্বর, ১৯৯৯। আমরা দুজনে দুজনের প্রাণভোমরা ছিলাম। দাদু মারা যাওয়ার পরের দুদিন আমি একটু অন্যরকম হয়ে গেছিলাম। দাদুর বিছানার ওপরে চুপচাপ বসে থাকতাম। সবাই চিন্তায় পড়ে গেছিল। কিন্তু ধীরে ধীরে সব স্বাভাবিক হয়ে যায়। শাস্ত্রমতে মেয়েদের কাজ হয় তিনদিনের মাথায়। আমি বলেছিলাম যে আমিও দাদুর কাজ করবো। তাই পুজোতে আমিও বসেছিলাম। সব কাজ মিটে যাওয়ার পর আমরা ভাইবোনরা দোতলায় বসে আছি। বাকিরা নিচে। এমন সময় একটা সুন্দর মিষ্টি গন্ধ ভেসে আসে। আর কেউ পেয়েছে কি না সেটা আর জিজ্ঞেস করি নি কারণ গন্ধের তীব্রতা এতোটাই বেশি যে সবাই পাবে এটাই আশা করেছিলাম। ঐখানে আমিই ছিলাম সবথেকে বড়। আমাদের বাড়িতে কেউ মারা গেলে শোকপালন করা হতো। বাড়িটাই গানের বাড়ি ছিল। তাই রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বা অতুলপ্রসাদী বা দ্বিজেন্দ্রগীতি দিয়ে শোকসভা পালন করা হোতো। পাশে জ্বালান থাকতো ধূপ, ধুনো, আর যে মারা গেছেন তার ফটো এবং একরাশ ফুল। একান্নবর্তী পরিবার ছিল বলেই অনেক মৃত্যুই চোখের সামনে দেখছিলাম। শোকসভা পালন করা হতো চৌদ্দ দিন পরে কিন্তু সেটা তখন মাথায় নেই।বয়সটাও কম ছিল তখন, সবে ক্লাস ৯। ভেবেছি সবাই বোধহয় জড়ো হয়েছে নিচে আর সেখান থেকে ধূপ আর ফুলের গন্ধ মিলিয়ে এত সুন্দর একটা গন্ধ তৈরি হয়েছে। নিচে নামার সাথে সাথে গন্ধটা আর পেলাম না। সিঁড়ি দিয়ে দুধাপ ওপরে উঠে এলাম। আবার গন্ধটা নাকে এলো। একটু অবাক হলাম। যাইহোক, হলঘরে গিয়ে দেখি কোথায় কী সবাই তো দাদুর ঘরে বসে আছে। হলঘর ফাঁকা। মাকে জানলাম ঘটনাটা। মা বলল “ শাস্ত্রমতে মারা যাওয়ার পর প্রথম জল পায় তিনিদিনের মাথায় আর সে যদি চায় তাহলে তাঁকে টের পাওয়া যায়।“ ভয় পাই নি। শুধু মনে মনে বলেছিলাম “দাদু, যদি তুমি যদি এসেই থাকো তাহলে দেখা দিও না প্লিজ। স্বপ্নে এসো কিন্তু সামনে নয়।“ কারণ যার শরীরটা গরম থেকে ঠান্ডা হওয়া অব্ধি জড়িয়ে ধরে রেখেছিলাম, কেউ ছাড়াতে পারে নি, যার শরীরটাকে ঠান্ডা গাড়িতে ঢুকিয়ে দিয়েছি, যে আমার সবথেকে আপন ছিলেন তাঁকে ঐ রূপে দেখলে মন থেকে মেনে নিতে পারবো না। ভালবাসা ছাপিয়ে তখন ভয়টাই পড়ে থাকবে সেটা কিছুতেই হতে দেওয়া যায় না।
অনি শুধু শুনলো। আমি আবার বললাম “সারা রাস্তা ঐ চোখটা আমায় তাড়িয়ে বেরিয়েছে। চোখ বুজলেই খালি ভসে উঠছে সেই উজ্জ্বলচোখ দুটো। অনি হাতটা ধরে বলল “ চল পাহাড় দেখি, মনটা হাল্কা হবে।“ জানালার সামনে গিয়ে দাঁড়ালাম। পরিষ্কার আকাশ কিন্তু কাঞ্চনজঙ্ঘার ওপরে মেঘের আনাগোনা। বাকি পাহাড়গুলো হাতে আঁকা ছবির মতো কালো বর্ডার আর বাকিটা ঝাপসা। নিচের রাস্তা জনমানুষ নেই। এমনকী কুকুরও নেই। রাস্তা পুরো খালি। অবশ্য সিকিমের রাস্তায় ঐ ঠান্ডায় রাত ৮টা মানে অনেকটা রাত। বেশ লাগছিল দাঁড়িয়ে থাকতে। খানিকক্ষণ বাদে অনি বললও “ মৈ রে হাগু পেয়েছে। “ উফফ, রোম্যান্টিকতার এমন অদ্ভুত নিদর্শন আর কোথাও পাওয়া যাবে কি না সন্দেহ আছে। বলল “ দু মিনিটের মধ্যেই ফিরে আসছি।“ আমি বললাম “তোর ঐ ধড়াচুড়ো ছাড়তেই দুমিনিটের বেশি সময় লাগবে। ভাল মতো করে আয় নাহলে রাত্রে এক লেপের তলায় শোওয়া যাবে না।“ হাসতে হাসতে বাথরুমের উদ্দেশ্যে রওনা দিল। আমি দাঁড়িয়েই রইলাম জানালার সামনে। রাস্তার দুদিকই ফাঁকা। ওদিকে কাঞ্চনজঙ্ঘাও ঢুকে যাচ্ছে মেঘের তলায়। আমি আর কী করি, ফিরে এলাম বিছানায়। বসার সাথে সাথেই একটা কুকুর অদ্ভুত গোঙানির মতো শব্দ করে কেঁদে উঠলো। এবং সেই আওয়াজের তীক্ষ্ণতা এতটাই বেশি, মনে হচ্ছে সেটা আমাদের হোটেলের বাইরের রাস্তা থেকেই ডাকছে। অথচ কয়েক সেকেন্ড আগেও সেখানে কুকুর ছিল না। ঘাড় বেয়ে একটা ঠান্ডা স্রোত নেমে যাচ্ছে, সমস্ত রোমকূপ জেগে উঠেছে। কেন?? জানি না। কোনো ব্যাখ্যাই নেই আমার কাছে তো দেব কী। দৌড়ে গেলাম জানালার সামনে। বিছানা থেকে চার পায়ের দূরত্ব। কোথাও কোথাও কেউ নেই। কুকুরটা যদি দৌড়ে পালায়ও তাহলেও তাকে দেখা যাবে। অনি বাথরুম থেকে শুধু বলল “মৈ ঠিক আছিস?”
“ তুই শুনেছিস!!”
“হ্যাঁ, সেই জন্যই জিজ্ঞেস করলাম।“ একটু থেমে আবার বলল
“ আমি আসবো?”
ঐরকম আতঙ্কের পরিবেশের মধ্যেও হেসে ফেললাম “ ওরে মাঝপথে উঠিস না, প্যান্টে হাগু লেগে যাবে তো। তারপর আবার ঠান্ডায় স্নান করতে হবে। ভালভাবে করে আয়। আমি ঠিক আছি।“
সচরাচর, এমন কেউ যার সাথে সেরকম কোনো সম্পর্ক ছিল না তাই সময়ের সাথে সাথে যোগাযোগও কমে গেছে তাদের দেখে আমি চিনতে পারি না। এরকম ঘটনা আমার সাথে বহুবার ঘটেছে। বিয়ের আগে থেকেই আমরা তিন বন্ধু মানে আমি, অনি আর আরেক বন্ধু পরিবার সমেত বছরে একবার না একবার কোথাও বেড়াতে যেতাম। একবার গাদিয়ারাতে গেছি, একটি মেয়ে এসে বলল “ কী রে আমায় চিনতে পারছিস?” আমি ধরেই নিলাম যে হয় সিনিয়ার বা সহপাঠী কেউ হবে। কিন্তু তুই না তুমি বলে সম্বোধন করব সেটাইতো বুঝতে পারছিলাম না। শেষে একটু হেসে ওকে জিজ্ঞেস করেছিলাম যে “তোমাকে না আমি ঠিক চিনতে পারছি না। তুমি সিনিয়ার ছিলে?” সে খুব অবাক হয়ে বলল “ আমি তোর পাশে বসতাম স্কুলে। তোর মনে নেই মৈত্রেয়ী?” ওর গলা দিয়ে মর্মাহতের মতো আওয়াজ বেরিয়েছিল। নিজের ওপরে খুব রাগ হয়েছিল তখন। কিন্তু বুঝেছিলাম যে এই ভুল শোধরানোর কোনো উপায় নেই বা দুঃখ প্রকাশ করলেও এই আঘাত ও জীবনে ভুলবে না। পুরোনো বন্ধুকে দেখতে পেয়ে যে সাগ্রহে এগিয়ে এল আর পুরনো বন্ধু তাকে চিনতেও পারলো না এটার জন্য মনে হয় ও আর কোনদিন কোন বন্ধুর সামনে গিয়ে বলতে পারবে না যে “ কী রে আমায় চিনতে পারছিস?” ইচ্ছে করছিল জড়িয়ে ধরে বলি ‘ক্ষমা করে দে প্লিজ।“ কিন্তু সেটাও পারলাম না। শেষে ওর হাত ধরে শুধু বলেছিলাম “ ভাল থাকিস।“ পিছনে মা দাঁড়িয়ে ছিল। মা এগিয়ে এসে অবস্থার সামাল দেয়। মা খুব সহজেই চিনতে পেরেছিল মেয়েটা আর মেয়েটার পরিবারকে। মা স্কুলে খুবই জনপ্রিয় ছিল। সবাই মায়ের হাত ধরে হাঁটতে ভালবাসতো আর আমার খুব রাগ হোত। একমাত্র বোন ছাড়া আর কেউ মায়ের কাছে আসবে সেটা আমি মেনে নিতে পারতাম না, এখনও পারি না। তাই মা চিনতে পারলেও আমি পারি নি। আমি পাশ থেকে সড়ে গেছিলাম তখন। পরে মা আলাদা করে ডেকে খুব বকে ছিলেন। কিন্তু আমি সত্যিই চিনতে পারি নি আর এর জন্য নিজেকে আজও ক্ষমা করি নি।
কিন্তু ঐ চোখদুটো আমার আজও মনে আছে, আজও মাঝে মাঝেই তাড়া করে বেড়ায়। আজও আমি ভুলতে পারি নি তাঁর চোখ। অনি বাথরুম থেকে বেরিয়ে এসে বলল “ এইরকম ভয় জীবনে পাই নি বিশ্বাস কর।“ কিছু বলতে যাব এমন সময়, খাবার চলে এলো। আমি ছেলেটিকে বললাম “হোটেলে কোনো কুকুর আছে?” এই রকম প্রশ্ন যে আশা করে নি। অবাক গলায় বলল “ নেহি তো দিদি।“ আমি আর কিছু বললাম না। তারমানে কুকুরটা আমাদের হোটেলের ভেতরেও ঢোকে নি তাহলে গেল কোথায়? খাবার রাখার পরে অনির হাতে একটা বিল ধরালো ছেলেটা। বিলটা হাতে নিয়ে অনি বলল “ কালকে রাবাংলা যাওয়ার গাড়ি পাওয়া গেছে। কাল সকাল দশটায়।“
“ কখন গাড়ি ঠিক করতে গেলি! জানি না তো!”
“তুই যখন ফ্রেশ হতে গেছিলি তখনই নিচে গিয়ে কথা বলে এসেছিলাম।“
“ওহ।”
কালকের জন্য ব্যাগ গুছিয়ে নিলাম। আবার সেই একগাদা ব্যাগ নিয়ে…ধুর। খাওয়া দাওয়া করে শুয়ে পড়লাম। দুর্ভাগ্যবশত, পরেরদিন ঘুম ত্থেকে উঠতে বেশ দেরি হয়ে গেল। তাড়াহুড়ো করে বেরিয়ে পড়লাম ঠিকই। কিন্তু হোটেলের বিল মেটানোর ছিল তারপর ট্যাক্সি পেতেও দেরি হলো। যখন পৌঁছলাম তখন প্রায় ১০.৩০টা বাজে। ড্রাইভার ভদ্রলোক দেরি দেখে এমনিতেই রেগে গেছিলেন এবার ব্যাগের পরিমাণ দেখে আরও ক্ষেপে গেলেন। অন্যায় করেছি তাই চুপ করে থাকা ছাড়া গতি ছিল না। যদিও পাহাড়ি ভাষা বোঝার মতো ক্ষমতা নেই কিন্তু রাগের আর ভালবাসার ভাষা বোঝার জন্য স্বনের ওঠাপড়াই যথেষ্ট। কানের কাছে মুখ নিয়ে অনি বলল “মেয়েটাকে দেখ মৈ…কী মিষ্টি দেখতে।“ মাইরি, ঐ বিজ্ঞাপনের কথা মনে পড়ে গেল ‘ Men will be Men’। গাড়িটা ছিল লোকাল গাড়ি মানে একশহর থেকে আরেকশহরে স্থানীয় লোকজন এবং মালপত্র নিয়ে যাতায়াত করে। তাই এমনিতেই গাড়ির মাথায় স্থানীয় লোকজনের মালপত্র চাপানো তার মধ্যে আমাদের ব্যাগ। এদিকে অনি আর মেয়েটা যে দুজন দুজনকে দেখে চলেছে সেটা বেশ বুঝতে পারছি। এটা প্রকৃতির নিয়ম… বাঁধা দেওয়ার কিছু নেই ঠিকই কিন্তু রাশটা তো আমার হাতেই ( হে হে)। খানিকক্ষণ বাদে দেখলাম মেয়েটা ড্রাইভারের পাশে গিয়ে চাপা গলায় কী একটা বলল। ড্রাইভার কথা থামিয়ে দিল ঠিকই কিন্তু চোখমুখ দেখে বুঝলাম যে বিন্দুমাত্র রাগ কমে নি।
গাড়ির সামনের সিটে বসলাম। ড্রাইভারের পাশে অনি আর জানালার ধারে আমি। গাড়ি চলতে শুরু করেছে। আমরা হাসাহাসি আর আড্ডা শুরু করেছি। অনি প্রথমেই বলল “ দেখলি? ঝারি মারার ফল? মেয়েটা নিশ্চয় আমাদের হয়ে কিছু বলেছে তাই ড্রাইভার থেমে গেল।“
“হু। এটা ঝারি মারার সুফল হিসেবে বিবেচিত হোলো।“
বেশ খানিকক্ষণ বাদে কানের কাছে মুখ নিয়ে বলল “ মৈ রে… আমাদের ভবিষ্যত অন্ধকার মনে হচ্ছে।“
“ কেন!!”
“ আরে গজগজ করা থামিয়েছে ঠিকই। কিন্তু যেভাবে গিয়ার টানছে, মনে হচ্ছে এই বুঝে গেল।“
আমি অবাক হয়ে বললাম “ মানে!!”
ওর চোখ অনুযায়ী তাকিয়ে দেখি বেচারার দুপায়ের ফাঁকে গিয়ারটা রয়েছে। আর অনি খুব সাবধানে নিজের সম্পত্তি চেপে ধরে বসে আছে। দেখেই আমি হাসিতে ফেটে পড়লাম।
আমার হাসি দেখে বেচারা কাচুমাচু মুখ করে বলল “ তোর হাসি পাচ্ছে?”
আমি বললাম “ আবার পিছনের মেয়েটার হেল্প নে। ও যদি কিছু করতে পারে।“
“শালা।“
এত হাসাহাসি, ড্রাইভার ভদ্রলোকের মোটেই পচ্ছন্দ হচ্ছিল না। পারলে সে চোখ দিয়ে ভস্মই করে দিত হয়তো বা ক্ষমতা থাকলে গাড়ি থেকে ধাক্কা মারতেও বোধহয় পিছপা হত না। যাই হোক রাবাংলা এসে পৌছলাম। গাড়ি আরও ভেতরে যাবে তাই আমাদের মালপত্র নামানোর জন্য বেশ খানিকক্ষণ দাঁড়াতে হোলো গাড়িটাকে। রাস্তা থেকে হোটেলটা বেশ খানিকটা ওপরে। হোটেলে যাওয়ার জন্য সিঁড়ি আছে। মালপত্র নামানোর পর অনি উঠে গেল ওপরে। মালপত্র সমেত নিচে দাঁড়িয়ে চারপাশে চোখ বোলাতে শুরু করলাম। যেদিকে আমাদের হোটেল ঠিক তার পাশেই একটু ওপরে পুলিশ স্টেশান। আর ডানদিকের রাস্তায় সারি সারি দোকান। একটু বাদেই অনি নেমে এলো সাথে একটা ছেলে। তিনজন মিলে মালপত্র নিয়ে সিঁড়ি দিয়ে উঠতে উঠতে দেখলাম হোটেলের বাঁদিকে একটা এসবিআই-এর এটিএম। হোটেলটা বেশ ছিমছাম। আমাদের ঘর ছিল একদম ওপরে। ঘরে ঢুকতেই দেখলাম ঘরটা বেশ ছোটো কিন্তু উডেন ফ্লোর আর এত সুন্দর সাজানো যে আপনা থেকেই একটা আরামদায়ক অনুভূতির সমাবেশ ঘটে। সেদিন আর কোথাও বেরোলাম না। গত কয়েকদিন ঘোড়া দৌড় গেছে। আগামীকাল সকাল না হতেই পেলিং-এর উদ্দেশ্যে যাত্রা করতে হবে। তাই ঠিক করলাম যে ঘরেই থাকবো। জানালা দিয়ে দেখা যাচ্ছে টি গার্ডেন, পরিষ্কার আকাশ আর সামনে পাহাড়। এই তো জীবন কালীদা।
সারাদিন আড্ডা মেরেই কাটালাম। রাত্রেও তাড়াতাড়ি খেয়ে শুয়ে পড়লাম। হোটেলে আমরা ছাড়া আর কেউ নেই। পরেরদিন ব্রেকফাস্টের জন্য ফোন করা হোলো। আলুর পরোটা হবে শুনে সেটাই অর্ডার দিয়ে দিলাম। প্রথম আলুর পরোটা খেয়েছিলাম পাঁচমারিতে গিয়ে। কিন্তু রাবাংলার পরোটার স্বাদ আজও মুখে লেগে আছে। এই হোটেলের পরিবেশ কোনদিন ভুলবো না। হোটেলেই বলে রেখেছিলাম পেলিং-এ যাওয়ার জন্য গাড়ির ব্যবস্থা করতে হবে। নির্দিষ্ট সময় গাড়িতে উঠে বসলাম। পাগল আর কেউ দেরি করে।
রাবাংলা থেকে পেলিং মোটে ২ঘন্টার মতো। প্রথমবার যখন পেলিং গেছিলাম তখন হোটেল সংখ্যা ছিল হাতে গোনা। বাবার ইন্সপেকশান কোয়ার্টারের একটা ছবি দিয়ে রাখি আগে। প্রধান রাস্তা থেকে বেশ কিছুটা ভেতরে। ছোট্ট একটা কুঁড়ে ঘর। যারা ভাড়া দেয় ঐ ঘরটা, তারা পশুপালন আর ঐ ভাড়ার টাকায় সংসার চালায়। তাদের মুরগি, ছাগল সবাই মোটামুটি ঐ ঘরটায় এসে তাদের আড্ডা জমায়। তাই এই ঘরে মানুষ থাকতে পারবে না। এদিকে তখন বাবার হাতে গোনা টাকা। এটিএম ব্যবস্থা ভবিষ্যতের খাতায় জমা আছে। রাত হয়ে গেছে তাই ব্যাংকে যাওয়ারও উপায় নেই। আর পেলিং-এর হোটেলের ভাড়াও বেশ বেশি। কিন্তু উপায় নেই। যে হোটেলটায় ঢুকলাম সেখানে বিদেশি ছাড়া আর কিছু চোখে পড়ে নি। বলা ভাল যে অত ভালো হোটেলে আগে কোনদিন ঢুকি নি। সব জায়গাতেই বাবার ইন্সপেকশান কোয়ার্টার থাকার দরুন হোটেল বিশেষ থাকাও হোতো না। সব কোয়ার্টারগুলোই ছিল খুব সাজানো গোছানো। রেডিও থেকে শুরু করে কুলার পর্যন্ত থাকতো। কিন্তু পেলিং একটু অফবিট জায়গা আর তখনও মানুষের অত বেশি নজর পড়ে নি তাই ব্যবস্থাও একদমই উন্নত ছিল না।
কিন্তু এখন দেখলাম দুপা অন্তর অন্তর ভাল ভাল হোটেল। আমাদের হোটেল বুক করাই ছিল তাই গাড়ি এসে থামলো সোজা হোটেলের সামনে। আমরা ছিলাম মিডল পেলিং-এ। হোটেলের বাইরেটা বেশ রঙচঙে। হোটেলের সব থেকে ভাল রুমটাই গোপুকাকু আমাদের জন্য বুক করে দিয়েছিলেন। পর্দা সরালেই কাঞ্চনজঙ্ঘা। যদিও দেখা যাচ্ছে না কারণ সে তখনও মেঘে ঢাকা।
সব মালপত্র রেখে হাঁটতে বেরোলাম। সুন্দর ঝকঝকে রাস্তা। অনিকে অতীতের পেলিং-এর গল্প করতে করতে হাঁটছিলাম আর নজর রাখছিলাম সেই দামী হোটেলটার দিকে। কিন্তু এত হোটেলের মধ্যে ১৭/১৮ বছরে আগের পেলিংকে খুঁজে বার করাটা খুব বোকামি। এগোতে এগোতেই একটা হোটেলের সামনে দেখলাম রাজার মতো শুয়ে আছে একটা বিশাল বড় কুকুর। চকচক করছে পশমের মতো কালো রঙ। ডবল কোটেড জার্মান শেপার্ড হার মানাবে এই রাস্তার কুকুরের কাছে। সামনে আরেকটু এগোতেই তিনি মুখ তুলে চাইলেন। চোখটা কটকটে লাল। আমি একটু দাঁড়িয়ে গেলাম, দেখলাম লেজ তো নড়ছেই না বরং বেশ বিরক্ত আর কি। মানে কাঁচা ঘুম ভাঙালে আমার যেরকম মুখভঙ্গি হয় অনেকটা ঐরকম। আমি আর বিরক্ত করলাম না কারণ আমার মতো সেও যদি খ্যাক খ্যাক করে ওঠে তাহলে মুশকিল।
পাশের দোকান থেকে কিছু লজেন্স আর পান কিনলাম। যদিও ঝালপাতা কিন্তু অনেকদিন বাদে পেলাম তাই কিনেই নিলাম। হোটেলে ঢোকার সময় আগামীকালের সাইটসিনের জন্য গাড়ি বুক করা হলো। তারা জিজ্ঞেস করলো দুপুরে কী খাবো। মাছ মাংস যাই খাবো তারা বানিয়ে রাখবে। মাছের নাম শুনেই অনির বাঙালি মনের মধ্যে লালা ঝরতে শুরু করলো। আমি বারবার বারণ করলাম যে এখানে মাছ খাওয়ার দরকার নেই, কবেকার মাছ তার নেই ঠিক তার থেকে মাংস বা ডিম খা। তিনি তো শুনলেন না। আমি মাংসের অর্ডার দিলাম আর তিনি রুই মাছের।
ফলস্বরূপ বিকেল থেকেই বাথরুম আর ঘর, ঘর আর বাথরুম। বলে “শালা তোর মুখই খারাপ।“ আমি শুধু “হুঃ” বলেই ক্ষান্ত দিলাম। ওষুধ খেয়ে তবে তিনি সুস্থ হলেন। কাঞ্চনজঙ্ঘা তখনও দেখা দেয় নি। পরেরদিন গাড়ি নিয়ে যাত্রা শুরু হলো। আমরা একাই ছিলাম গাড়িতে তাই হাত পা ছড়িয়ে গানের লড়াই , মেমোরি গেম খেলতে খেলতেই এগোতে থাকলাম। সেই চোখের ঔজ্বল্য ধীরে ধীরে কমে আসতে লাগলো কিন্তু এখানেও যে ঐরকম কিছু অভিজ্ঞতা অপেক্ষা করে আছে সেটা ঘুণাক্ষরেও টের পাই নি।
চলবে…
পরিচ্ছেদ ৬ অনেক রাতে ফিরেছিল কল্যাণ ওরফে শহীদুল।গাড়িটা শেডে রাখার পর দু’বার হালকা করে মা…..
পরিচ্ছেদ ৫ আকাশে এখন আর মেঘ নেই। হাওয়া হচ্ছে।কদিন পরেই বর্ষা নামবে।একদিন হাসপাতাল থেকে ফিরতে…..
পরিচ্ছেদ ৪ ভোর হয়ে আসছে।রাতে ভালো ঘুম হয়নি।ঘুমের ঘোরে মনে হচ্ছিল দম বন্ধ হয়ে আসছে।এরকম…..
বাংলার চিত্তাকর্ষক ইতিহাস সম্পর্কে জানার সময়, গৌরের মতো আর কিছু গন্তব্য হতে পারে না।…..