গৌর (মালদা) – বাংলার চিত্তাকর্ষক ইতিহাস
বাংলার চিত্তাকর্ষক ইতিহাস সম্পর্কে জানার সময়, গৌরের মতো আর কিছু গন্তব্য হতে পারে না।…..
পূর্ব প্রকাশের পর…
ফুল ছাড়া সাদা রঙটা আমার ঠিক ভাল লাগে না। অবশ্য সাদা রঙকে যদি অন্য কোনো রঙের সাথে মিশিয়ে দেওয়া হয় তাহলে সাদার গুরুত্ব অবশ্যই বোঝা যায়। তবে আমি ঠিক ঐ সাদা আর সাথে নীল মিশিয়ে আকাশি বা লাল মিশিয়ে গোলাপি রঙের কথা বলছি না। জানি না কতটা বোঝাতে পারলাম তাই আরেকটু বর্ণনা করে দিই। রাস্তার স্লেট রঙ, তার ধারে চিরসবুজ পাইন গাছের সারি আর ঠিক তার সামনেই বিস্তীর্ণ প্রান্তরের সাদা বরফ পার করেই নীল তিস্তা (ইয়ামথাং নদীও বলা হয়) আর তারপরেও সুবিশাল পর্বত যার গায়ে লেগে আছে তুষারের আচ্ছাদন এবং মাথার ওপর বুশ ক্লক ভাইন রঙের আকাশ। এখনও চোখ বুঝলে এই দৃশ্য আমার চোখের সামনে ভেসে ওঠে।
গাড়ি থেকে নেমে অত্যাধিক ঠান্ডায় কিছুক্ষণের জন্য জমে গেলাম। সুখের কথা যে হাওয়া থাকলেও তার বেগ অত বেশি নয়। রাস্তার ধারে স্থানীয় দোকান থেকে গরম গরম দুধ চা খেয়ে খানিকটা ধাতস্থ হতেই দুজনেই ঐ বরফের মধ্যে ঝপাং করতে যাচ্ছিলাম এমন সময় পেছন থেকে “নেহিইইইইইইইইইই”-এর চিৎকারে রীতিমত ঘাবড়ে গেলাম। ঐ নিস্তব্ধ পরিবেশে ঐ রকম উচ্চস্বরে চিৎকারটি করেছে আমাদের গাড়ির চালক। এগিয়ে এসে জানালো যে বরফের জুতো পরতেই হবে নাহলে ফ্রস্টবাইট হয়ে যাবে। আমাদের তখন মাথায় হাত কারণ ঐ জুতো তো নেই। গাম্বাট টাইপের জুতো পরেছি ঠিকই কিন্তু বরফের জুতো কোথায় পাব! তীরে এসে তরী দোবার দুঃখে প্রায় কেঁদেই ফেলব এমন সময় একজন মহিলা নিজের দোকান থেকে বেরিয়ে বলল “ইধার আইয়ে”। গিয়ে দেখি থরে থরে রাবারের জুতো সাজানো আছে। দেখতে অনেকটা হান্টিং শ্যু-এর মতো। সেই জুতো ভাড়া করে নিজেদের জুতোর ওপরেই পরে ফেললাম। এইবার যেন মনে হলো যে আমাদের সামনে কেউ লাল কাপড় বাগিয়ে ধরেছে আর আমরা খ্যাপা ষাঁড়ের মত এগিয়ে যাচ্ছি সেই দিকে। ঝপাং।
হাঁটুর নিচ অবধি বরফের তলায় ডুবে গেছে। দুজনেই ঝুরো বরফ নিয়ে গোল্লা গোল্লা করে ছুঁড়ে মারছি এর ওর গায়ে। খানিকবাদে বরফের মাঠে মামা ভাগ্নে নেমে পড়লো। তাদের সাথেও বেশ খানিকক্ষণ খেলা করে এগিয়ে চললাম নদীর দিকে। দুদিকে যতদূর চোখ যায় শুধু সাদা বরফ। এই ভ্যালিতেই মার্চ থেকে শুরু হয় রঙ নিয়ে ছিনিমিনি খেলা। নদীর দিকে যেতে যেতেই দুবার ধপাস হওয়ার পরে অনির হাতটা ধরতেই হলো। অনি বলল – “ছাড়িস না” আমি একটু হেসে সম্মতি জানালাম।
নদীর সামনে হাত থেকে গ্লাভস্টা খুলতে যাব আবার পাশ থেকে “নেহিইইইইই”। এইবার অনি। বলল – “কী করতে যাচ্ছিস তুই! জলে হাত দিবি! তুই কি পাগল?” আমি বললাম “ কিছু হবে না জল ছুঁয়েই হাত তুলে নেব।“
–“ তুলতে হবে না ওখানেই কেটে পড়ে যাবে।“
–“একটু”
–“না”
–“একটু দিই”
–“বলছি না… না।“
–“চেক করি না একটু।“
–করতে পারিস কিন্তু আঙুল নিয়ে বাড়ি ফিরতে পারবি না।“
যে কথাটা বলেছিলাম সেটা আর এখানে বললাম না। মনের দুঃখে আবার গ্লাভসটা পরে নিলাম। নদীর ধার ধরে কিছুটা এগোলেই একটা কাঠের ব্রীজ। এপার থেকে দেখলে মনে হয় যেন ঐ পারে গেলেই পাহাড়টা দিব্যি হাতের নাগালে চলে আসবে। আমরা দুজনেই ঐদিকেই হাঁটতে শুরু করলাম। বাকি দুজন ফিরে গেল, বরফ নিয়ে খেলে তারা বেশ ক্লান্ত হয়ে পড়েছে। খানিকটা এগোতে না এগোতেই পিছন থেকে আবার ডাক। এবারও গাড়ির চালক।
সে এসে যেটা বলল সেটা শুনে আমরা আনন্দে প্রায় নেচেই উঠলাম। গ্যাংটকে যখন জিজ্ঞেস করেছিলাম বলেছিল যে জিরো পয়েন্ট বরফের জন্য বন্ধ আছে। তাই কোনোমতে ইয়ামথাং পর্যন্ত গেলেও জিরো পয়েন্টে যাওয়া মুশকিল। এতটা কাছে গিয়েও লেকটা দেখতে পাব না বলে খুব মনখারাপ হয়ছিল। কিন্তু এখন শুনছি অন্য কথা। যেহেতু বরফ আস্তে আস্তে গল যাচ্ছে এবং হাওয়ার বেগও কম তাই ড্রাইভার তার সাধ্য মতো চেষ্টা করবে যাতে সেখানে পৌছানো যায়। কিন্তু তারজন্য হয়তো আরেকদিন থাকতে হতে পারে লাচুং-এ। জিরো পয়েন্ট এমনিতে দূরে নয় কিন্তু রাস্তার অবস্থা সম্বন্ধে ড্রাইভার অতটা ওয়াকিবহল নয় কারণ আমরাই হয়তো ২০১১ সালের প্রথম পর্যটক যারা জিরো পয়েন্টে পা রাখতে চলেছি। আমরা শুনেই হ্যাঁ করে দিলাম। তারপর এগিয়ে গেলাম গাড়ির দিকে। ঘড়িতে তখন সকাল ১০টা।
গাড়ি ছেড়ে দিল। সমুদ্র থেকে প্রায় ১৫.৩০০ ফিট উচ্চতায় এই জিরো পয়েন্ট। যারা গেছে তারা জানে যে এই পথের দৃশ্য ভাষায় বর্ণনা করা কঠিন। যত উঠছি চারদিকে শুধু সাদা রঙ ছাড়া আর কিছু চোখে পড়ছেনা। রাস্তাতেও বরফের মোটা কম্বল পাতা রয়েছে। গাড়ি চলছে খুব আস্তে এবং সাবধানে। ড্রাইভারের ঘন ঘন মাথা নাড়ানো দেখে গাড়ির ভেতরেও সবাই কেমন যেন থুম মেরে গেছি। প্রায় ১.৩০ ঘন্টা চলার পরে একটা বাঁকে পৌছে ড্রাইভার বলল যে গাড়ি আর এগোনো যাবে না। আমরা তখনও জানি না যে বাইরের অবস্থাটা ঠিক কী।
গাড়ি থেকে সবাই নেমে দাঁড়ালাম। পায়ের তলায় পুরু বরফ। রাস্তার যেদিকে খাদ সেদিকটা ঝুঁকে পড়েও কিছু দেখা যাচ্ছে না। চারদিকে চোখ বোলালেই সেটা কোনো না কোনো পাহাড়ের গায়ে গিয়ে ধাক্কা খাচ্ছে। বাঁক ঘুরলে যে রাস্তাটায় ওঠার কথা ছিল সেটি প্রায় ৭৫ডিগ্রীতে বেঁকে দাঁড়িয়ে আছে। এবং সেই রাস্তার বরফের আস্তরণের উপর দিয়ে আমাদের গাড়ির যাওয়ার কোনো সম্ভাবনাই দেখতে পেলাম না। রাস্তার কিছুটা দেখা গেলেও তার পরে সবই পুরু মেঘে ঢাকা। বাকি রাস্তাটা হয়তো হেঁটে যাওয়াই যেত কারণ ভ্যালি থেকে জিরো পয়েন্টের যেতে গাড়িতে মোটে ১ ঘন্টার মতো লাগে। আমরা যেহেতু ১.৩০ঘন্টার যুদ্ধ চালিয়েছি তার মানে ড্রাইভারের কথা মতো আর কিছুটা উঠলেই জিরো পয়েন্ট। কিন্তু আমরা দুজন ছাড়া আর কেউ রাজি হলো না উপরন্তু যেহেতু জিরো পয়েন্ট অবধি পৌছানো অসম্ভব তাই সেদিনই গ্যাংটকে ফিরে যাওয়ার জন্য সবাই জোর করতে লাগলো। আমরা একদিন আরও থেকে যেতে চাইলেও সেটা সম্ভব হলো না। শেয়ারের গাড়িতে যদি সবার মানসিকতা না মেলে তাহলে খুবই অসুবিধা। ঐখানেই খানিকক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকার পর ড্রাইভারের কথা মতো গাড়িতে উঠে বসলাম।
পাহাড়ি রাস্তায়, বরফের ওপর ওঠা যতটা সহজ, নামা ঠিক ততোটাই কঠিন। রোদ বাড়ছে তাই নিচের দিকের রাস্তার বরফ কমছে আর চাকার পিছলে যাওয়ার সম্ভাবনা । ইয়ামথাং ভ্যালি অবধি পৌঁছতে পৌঁছতেই প্রায় ২ ঘন্টা লেগে গেল। ফলস্বরূপ লাচুং-এ যখন ঢুকলাম তখন ঘড়িতে সাড়ে তিনটে। সন্ধে নামতে আর বেশি দেরি নেই।
ড্রাইভার জানাল যে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব লাচুং থেকে বেরিয়ে পড়তে হবে। ঘরে গিয়ে দেখি এক ফোঁটা জল নেই। জিনিসপত্র গুছিয়ে নিয়ে নিচে নেমে হোটেলের চাতালে দাঁড়িয়ে তাদের দেওয়া উষ্ণ গরম জলে হাতমুখ ধুয়েই খেয়ে নিলাম। দেশি মুরগির মাংস আর রুটি গপাগপ করে গিলে নিলাম। এবার সবাই সময় মতই ঢুকে পড়লাম গাড়ির ভেতর। ঠান্ডার প্রকোপ বাড়ছে, ঘড়িতে তখন বিকেল ৪টে। বলা ভাল সন্ধে ৪টে। রাত্রে পাহাড়ি রাস্তায় গাড়ি নিয়ে নামার অভিজ্ঞতা আগে ছিল না।
খানিকটা রাস্তা যাওয়ার পরে ড্রাইভার গাড়ির স্পিড বাড়িয়ে দিল। বুঝতে পারলাম যে চাকার নিচে বরফ সরে গেছে। কিন্তু পরিবেশ যেন গিলে খেতে আসছে। চারদিকের পাহাড়ের গায়ে কোনো আলো নেই। এতক্ষণ আসার সময় একটা গাড়িও চোখে পড়ে নি। অত রাত্রে এমনিতেই পাহাড়ি রাস্তায় গাড়ির সংখ্যা কমে যায়। অল্প দূরত্ব বা শহরের মধ্যে কোনো অসুবিধা হয় না কিন্তু পাহাড়ের বাঁকে বাঁকে জড়িয়ে থাকা রাস্তায় প্রায় ২ ঘন্টা চলার পরেও যখন অন্য কোনো হেডলাইটের দেখা পাওয়া যায় না তখন বুকের ধুকপুকনি একটু বাড়ে বৈ কমে না। অনির কাঁধে মাথা রেখে আমি শুধু বাইরের দিকে তাকিয়ে আছি যে একটু আলো যদি কোথাও দেখা যায়। অনি খুব আস্তে আস্তে জানতে চাইল যে আমি ঘুমোচ্ছি কি না। আমিও শুধু মাথা নেড়ে জানিয়ে দিলাম – না। তারপর মাথাটা তুলে বললাম “ এই পরিবেশে একমাত্র সাধু পুরুষ ছাড়া আর কেউ ঘুমোতে পারবে না।“
–“তাহলে আমাকে আজকে থেকে সাধুবাবা বলে ডাকিস। কারণ মাঝেই মাঝেই আমি ১০মনিটের ন্যাপ নিয়ে নিচ্ছি।“
রাস্তার দিকে তাকাতে যেখানে ভয় করছে মনে হচ্ছে অ্যাপোক্লিপ্সের পর আমরাই একমাত্র জীবন্ত প্রানী যারা হারা উদ্দেশ্যে এগিয়ে চলেছি, গাড়ির মধ্যে এতটাই নিস্তব্ধতা বিরাজ করছে যে পেটের মধ্যে গুড়গুড়ানির শব্দও বাইরে থেকে শোনা যাচ্ছে সেখানে “মাঝে মাঝেই ১০মিনিটের ন্যাপ” মানুষ কী ভাবে নিতে পারে জানা নেই। তারমধ্যে মাঝে মাঝে গাড়ির গতি এতটাই বেড়ে যাচ্ছে মনে হচ্ছে যেন গাড়ির দুদিকে দুটো পাখা লাগালে সে বুঝি উড়েই গ্যাংটক পৌছে যাবে এবং বাঁক নেওয়ার সময় এতটাই হেলে যাচ্ছি যেন মনে হচ্ছে যে এটাই বোধহয় জীবনের শেষ অধ্যায় হতে চলেছে। উড়বো না মরবো সেটা ভেবেই মাঝে মাঝে পিলে চমকে যাচ্ছে আর এ নাকি মাঝে মাঝে ঘুমিয়ে নিচ্ছে। রাগের মাঝে একটু হিংসাও যে হচ্ছিল সেটা অস্বীকার করার জায়গা নেই। সেদিন থেকে চেষ্টা চালাচ্ছি অনি-র মতো যদি ঘুমটাকে নিজের আয়ত্তে আনা যায়। পারি নি এখনও।
খানিক বাদেই পাশ থেকে গুজগুজ ফুসফুস ভেসে এলো। অনি এবং মামা দুজনেই একটা ব্যাপার খেয়াল করেছে গতকাল থেকে কিন্তু কেউই কাউকে বলে নি। সেই ব্যাপারটা নিয়ে আলোচনা করে দুজনেই এখন একই সিদ্ধান্তে পৌঁছেছে। যাথারীতি কৌতূহল প্রকাশ করার পর যা কানে এলো যা তাতে দ্বিতীয় বার পিলে চমকে গেল। যেহেতু সিকিমে যেখানে সেখানে সিগারেট খাওয়া যায় না তাই ড্রাইভার মাঝে মধ্যেই গাড়ির জানালা খুলে দু/তিনটান মেরে সেটা ফেলে দিচ্ছে (সেটা আমিও খেয়াল করেছিলাম কারণ উচ্চতার জন্য সিগারেট টানছি না ঠিকই কিন্তু গন্ধ পেলেই সেটা মাংসের মতো টেনে নিচ্ছিলাম) এবং তারপর থেকেই তিনি “ফাস্ট এন্ড ফিউরিয়াসের”-এর মতো গাড়ি চালাতে শুরু করছে। ঘটনার পুনরাবৃত্তি এতবার ঘটেছে যে সিগারেট টানতে দেখলেই অনি এবং মামা নিশ্চিত যে গাড়ি এবার উড়বে। এটা জানার প্রায় সাথে সাথেই দেখলাম যে ড্রাইভার বাবু আরেকটা সিগারেট ধরিয়ে নিয়েছেন। মনে হলো এই সত্যটা না জানলেই বোধহয় ভাল হ’তো। দুটান মেরে সিগারেট ফেলে দিয়ে গাড়ি উড়ে চলল এবং একটা বাঁক নিতেই হঠাত করে জোরে একটা ব্রেক কষে গাড়ি দাঁড়িয়ে গেল।
আচম্বিতে গাড়ির গতিবেগ দুম করে থেমে যাওয়ায় আমরা সবাই সামনের দিকে হুমড়ি খেয়ে পড়লাম। দেখি একটা জেবিপি পিছন দিকে এগিয়ে আসছে এবং আরেকটু এগোলেই আমাদের গাড়ির সাথে ধাক্কা খাবে এবং আমরা খাদে গড়িয়ে পড়বো। গাড়ির ভেতর থেকেই সমস্বরে আমরা চিৎকার করে উঠলাম। কিন্তু সবকটা জানালা বন্ধ তাই বাইরে থেকে মনে হয় কিছু শোনা যাচ্ছে না কারণ ঐ বিশাল গাড়ি এগিয়ে আসতে আসতে প্রায় ধাক্কা লাগবে লাগবে করছে। কোনোমতে গাড়ির কাঁচ খুলে ড্রাইভারের উচ্চস্বরে চিৎকারে জেবিপি থামলো ঠিকই কিন্তু আমাদের গাড়ি ততক্ষণে অল্প ধাক্কা খেয়ে গেছে আর গাড়ির মধ্যে ভয় আতঙ্কে আমাদের হাতপা সব জমে গেছে। ড্রাইভার বাবু সামনে এগিয়ে গিয়ে দানব গাড়ির ড্রাইভারের সাথে কী একটা কথা বলতে গেল। অনি বলল নেমে দাঁড়াতে। পিছনের মেয়েটা বোধহয় বমি করবে। ওপাশ থেকে নামা যাবে না কারণ নামার জায়গা নেই।
আমি নেমে দাঁড়ালাম। আমার পিছন পিছন অনি আর মামা ভাগে নেমে এলো। তারপর মাঝের সিটটা মুড়ে দেওয়ার পরে একে একে পিছন থেকে চারজন নেমে এল এবং নামার সাথেই সাথেই মেয়েটা বমি করে ফেললো পাহাড়ের গায়ে। আমাদের সাথে সব সময় জল থাকে। আমি মেয়েটার দিকে জলের বোতল নিয়ে এগিয়ে গিয়ে তার বরকে বললাম চিন্তা করতে বারণ করে মেয়েটার গলায় মুখে জল ছিটিয়ে ভাল করে ভিজিয়ে দিলাম তারপর একটু জল খাওয়ার পরে সে বেশ সুস্থ বোধ করলো। বাচ্চা বরটা তখনও থতমত মুখ করে মেয়েটার পাশে দাঁড়িয়ে আছে, তার চোখে মুখে আতঙ্কের ছাপ স্পষ্ট। অনি এসে বলল যে তার কাছে একটা ওষুধ আছে যেটা খেলে নার্ভের ওপরে চাপ কমে যাবে তাই যদি দরকার পড়ে তাহলে যেন আমাদের জানায়।
তাদের দুজনকে একা ছেড়ে আমরা এগিয়ে গেলাম সামনের দিকে। অনি বলল “ঠিক আছিস?” বললাম – পা এখনও কাঁপছে তবে এমনিতে ঠিক আছি। জানা গেল যে সামনের রাস্তায় সকাল ধস নেমে ছিল। পাথর সড়িয়ে নিলেও দিনের বেলায় রাস্তা ব্যস্ত থাকার দরুন সন্ধের পর থেকে সারানোর কাজ চলছে। দুটো গাড়ির একটারও ঘোরানোর জায়গা নেই। আমরা সবাই পাহাড় ঘেঁষে দাঁড়ালাম। আমাদের গাড়িটা চোখে আড়ালে অনেকটা পিছিয়ে গেল। তারপর আসতে আসতে দানব গাড়ি পিছিয়ে আসতে লাগলো। একটু পিছিয়ে সেও বাঁকের আড়ালে অদৃশ্য হয়ে গেল। বেশ খানিকক্ষণ বাদে আমাদের গাড়িটা আসার পর আমরা আবার উঠে বসলাম। খারাপ রাস্তাটা পার হয়ে যাওয়ার পরেই বাঁদিকের ঝকঝকে আলো চোখে পড়লো। এতক্ষণ রাস্তার পাশের খাদের ওপারের পাহাড়টা গ্যাংটক শহরটাকে আড়াল করে রেখেছিল। হাঁফ ছেড়ে বাঁচলাম প্রায় সকলেই। আবার দেখি ড্রাইভার সিগারেট বার করেছে এবং ধরাতে যাবে এমন সময় সবাই প্রায় একই সাথে সমস্বরে “নেহিইইইইইইইই” বলে চিৎকার করে উঠলাম। ড্রাইভারও থতমত খেয়ে না জ্বালানো সিগারেটটা জানালা দিয়ে ফেলে দিল।এবার আমরা সবাই হো হো করে হেসে উঠলাম। গত দুদিনে এই প্রথমবার গাড়ির ১০জন যাত্রী একইসাথে গল্প করতে করতে বাকি রাস্তাটা খুব সহজেই অতিক্রান্ত হয়ে গেল। বিপদে অনেক পরিচিত মানুষ যেরকম দূরে সরে যায় তেমনই অপরিচিত মানুষ অনেকটা কাছে চলে আসে। মৃত্যুভয় জর্জরিত মানুষগুলো হঠাৎ করেই খুব আপন হয়ে গেল। শেষটা বেশ মনের মত হ’লো। গাড়ি থেকে নেমে সবাইকে টাটা করে যখন হোটেলে এসে পৌঁছলাম তখন বাজে রাত ৯টা।
হোটেলের সবাই আমাদের দেখে চমকে উঠলো। তারা ভেবেছিল যে আমাদের হয়তো অ্যাকসিডেন্ট হয়েছে তাই লাচুং-এর হোটেলে এমন কি পুলিশেও তারা খবর পাঠিয়েছিল যদি কোনো খবর পাওয়া যায় সেই আশায়। যাই হোক অত রাত্রে ঘরে ফিরে গরম জলের তলায় দাঁড়াতেই সারাদিনের অত্যাধিক ক্লান্তি, মানসিক চাপ সব একনিমেষে নেই হয়ে গেল। ইতিমধ্যেই অনি ফোন করে দিয়েছে আগামীকালের সাইট সিনের জন্য। আগামীকাল যাওয়া হবে রামটেক মনেস্ট্রি এবং আরও কিছু কিছু জায়গা বাকি আছে সেই সব জায়গায়। রাত দশটায় খাবার দিয়ে গিয়ে আরেকটা ভাল খবর পেলাম। নাথুলায় যাবার অনুমতিপত্র মিলেছে। তাই পরশুদিনের গন্তব্য বাবামন্দির এবং নাথুলা।
রাত্রে খাবার পরে বেশ কয়েকগ্লাস হুইস্কি খেয়ে শুয়ে পড়লাম। অনির হাতে মাথা দিয়ে বললাম “ জানিস আসার সময় মা বলেছিল যে প্রতিটা মুহূর্ত যেন উপভোগ করি শুধু হানিমুন বলে নয় এমনি সময়েও। কোনো কিছুতে যেন আফসোস না থাকে। আজকে যখন গাড়িটা ধাক্কা খেল ভেবেছিলাম গড়িয়েই গেলাম হয়তো খাদের নিচে। তারপর থেকেই মনে হচ্ছে যে অনেক কিছু করা বাকি আছে এখনও। কী চাই সেটা নিজের কাছেই এখনও পরিষ্কার নয়।“ ঠোঁটে ঠোঁট ডুবিয়ে অনেকক্ষণ কাটানোর পর অনি বলল – “ নিজের যেটা ইচ্ছে সেটা করিস। আর কারুর কথা ভাবিস না। যা করবি আমি তোর পাশে থাকবো আজীবন।“ তখনও আমার বাস্তব মন অনি-র কথা পুরোপুরি বিশ্বাস করে নি। ছোটোবেলা থেকেই পরিস্থিতি এবং পরিবেশ আমাকে অনেকটা বড় করে তুলেছিল। পাছে আমার কোনো সিদ্ধান্তে বাড়ির কেউ আঘাত পায় তাই অনেক সময় নিজের ইচ্ছেটা চেপে রাখতাম। যদিও আমি খুব উদার পরিবেশে বড় হয়েছি কিন্তু কোথাও একটা কাঁটা ছিল যেটা মাঝে মাঝে ফুটতে থাকতো। অনেক কিছু বলার থাকলেও সেটা প্রকাশ পেতে দিতাম না। কিন্তু প্রথমদিন থেকেই অনির কাছে খুব স্বচ্ছন্দ বোধ করি। পচ্ছন্দ অপচ্ছন্দ, ইচ্ছে অনিচ্ছে সব কিছু খুব খোলাখুলি আলোচনা হতো (হয়) আমাদের মধ্যে। কারণ যে মানুষটার সাথে সারাজীবন কাটাবো ঠিক করেছিলাম সে যেমন আমার ভালটা জানবে তেমনি খারাপটাও। কোনো কিছু লুকিয়ে রাখলে সম্পর্কের গভীরতায় চিড় পড়তে তাই প্রথমদিন থেকেই আমি যেরকম ঠিক সেই ভাবেই মিশেছি অনি-র সাথে। অন্ধ ভালবাসার সাথে অন্তরঙ্গতা করতে আমার অসুবিধা আছে। তাই অনি-র কথায় আনন্দ পেলেও উপযুক্ত সময়ের অপেক্ষা করাই ভাল।
পরেরদিন কিছু জায়গা ঘুরে চলে গেলাম বিখ্যাত এম জি মার্কেটে। সবার জন্য পচ্ছন্দ মতো জিনিস কিনে হোটেলে ফিরে এলাম। কেনাকাটার জন্য এরপরে আর সময় পাওয়া যাবে না। কালকে ভোর না হতেই নাথুলা আর তারপরের দিন রাবাংলা। এখন ভাবি যে সেদিনের সেই অভিজ্ঞতা হয়তো সারাজীবনেও ভুলতে পারবো না। এই প্রথবার কিছুক্ষণের জন্য মনে হয়েছিল যে সময়টা হয়তো থেমে গেছে। আজও জানি না যে ঐ সময়টায় আমার ঠিক কী হয়েছিল। কিছুই মনে করতে পারি নি আজও। ঘোরে থাকা বোধহয় একেই বলে, অনি বলে পাঁচ মিনিট কিন্তু আমার মনে হয়েছিল কত যুগ ধরে দাঁড়িয়ে আছি। কেউ যেন আমায়…
(ক্রমশ)
বাংলার চিত্তাকর্ষক ইতিহাস সম্পর্কে জানার সময়, গৌরের মতো আর কিছু গন্তব্য হতে পারে না।…..
স্মৃতি খুব বিশ্বস্ত সঙ্গী। দূরে সরে গেলেও চলে যায় না পুরোপুরি। কোনো মানুষই তাই কখনো…..
ইংরেজি ভার্সান এখানে >>> Welcome to the Pataquerical Night Show (Last Episode) পূর্ববর্তী পর্ব এখানে>>>…..
ইংরেজি ভার্সান এখানে >>> Welcome to the Pataquerical Night Show (Episode-5) পূর্ববর্তী পর্ব এখানে>>> শেষ…..