হানিমুনে হারিকিরি (পর্ব – ৬)

মৈ মৈত্রেয়ী
ধারাবাহিক, নন ফিকশন
Bengali
হানিমুনে হারিকিরি (পর্ব – ৬)

পূর্ব প্রকাশের পর…

পরেরদিন একটু দেরি করেই বেরনো হলো। প্রথমেই গেলাম রামটেক মনেস্ট্রি। মনেস্ট্রিটাকে দেখলেই মনে হয় যেন এইমাত্র দোল খেলে বাড়ি ফিরলো। লাল, নীল, সবুজ, সাদা, কমলা, হলুদ রাশি রাশি আবির মেখে দাঁড়িয়ে আছে, দরজা খোলার অপেক্ষায়। তার পিছনের গাঢ় সবুজের পাইনের জঙ্গল। গেরুয়া কাপড় জড়ানো, লাল লাল টোপলা গালের নিষ্পাপ শিশুগুলোকে দেখে মনে হয় জড়িয়ে ধরে বলি “তোরাই এই মুক্ত পরিবেশে বড় হওয়ার যোগ্য।“

এদিক ওদিক ঘুরে বেরানোর পর অনি বলল যে সামনের সিঁড়ির ওপর উঠে দাঁড়াতে। বুঝলাম ফটো তুলবে আর সেটাতে আমার তো খুব আপত্তি। তবু কয়েকটা ধাপ উঠে সিঁড়ির বাঁদিক ঘেঁষে দাঁড়ালাম। সামনে ক্যামেরা নিয়ে দাঁড়িয়ে অনি বলল “ মৈ একটু ডানদিকটা চেপে দাঁড়া” সরে এলাম। হোলো না। বলল আরও সরে দাঁড়াতে। আমি আরও সরে দাঁড়ালাম। তারপর দেখি আবার হাত দিয়ে ইশারা করছে সরে যাওয়ার জন্য। এইবার আমি গটগট করে নিচে নেমে বললাম “তোর প্রবলেমটা কী বে? এইবার তো সিঁড়ির ঐ ধার দিয়ে খাদে গড়িয়ে পড়বো।“ খুব আস্তে আস্তে বলল “ আরে সিঁড়ির কয়েকধাপ ওপরে একজন বাচ্চামেয়ে দাঁড়িয়ে আছে দেখেছিস? কী মিষ্টি দেখতে। ভাবছিলাম তাকে নিয়ে তুলবো।“ ও হরি সেটা বলতে কী হয়। আমি গিয়ে বাচ্চামেয়েটাকে বললাম আমার সাথে ফটো তুলবে কি না। সে তো দিব্যি মাথা নেড়ে বলল “হ্যাঁ”। তারপর দুজনে পোজ দিয়ে ফটো তুললাম। তবে মেয়েটা ততটাও ছোটো ছিল না, পাহাড়ি মেয়েদের বয়সের তুলনায় অনেকটাই ছোটো লাগে দেখতে। অনি সেই জন্যই একটু দোনামনা করছিল। অনিকে বললাম “তুই তো মেয়েটাকে জিজ্ঞেস করতে পারতিস।“ বলল “যদি মারধোর দেয়।“ আমি বললাম “সাথে আমি আছি তো। প্রথমে বাঁচানোর চেষ্টা করবো তাতেও যদি কাজ না হয় ব্যাগে ওষুধ আছে লাগিয়ে দেব। চাপ নিস না।“

তারপর এদিক ওদিক ঘুরতে ঘুরতে সন্ধে হওয়ার আগেই গ্যাংটকে ফিরে এলাম। এইবার ক্যামেরা খালি করার পালা। একটা স্টুডিওতে ঢুকে সব ছবিগুলো পেন ড্রাইভে ভরে নিয়ে আবার এদিক ওদিক ঘুরে চলে এলাম হোটেলে। হোটেল থেকেই আগামীদিনের সব কাগজপত্র ধরিয়ে দিল। আমাদের আনন্দ আর ধরে না।

এইবার গাড়িতে সবাই জোড়ায় জোড়ায়। সবাই প্রায় একই বয়সী এবং তাদের মধ্যে তিনজনকে দেখে মনেই হচ্ছে যে তারাও আমাদের মতো নব দম্পতি। মাথা ভর্তি সিঁদুর, হাত ভর্তি চুরি এবং কেন জানি না নতুনদের গায়ে একটা আলাদা গন্ধ লেগে থাকে। আমার এক দিদি বিয়ের পরপরই যখন আমাদের বাড়িতে আসে তখন সেই গন্ধটা পেয়েছিলাম। বিয়ের পরে অনির বাড়িতে পা রাখার পর থেকে, কিছু কচিকচি ননদ আর দেওররা আমার গা ঘেঁষে সর্বক্ষণ বসে ছিল। তাদের মধ্যেই আধোআধো গলায় বলেছিল “বৌদি, তোমার গা থেকে না তি থুন্দর গন্ধ পাচ্ছি, তোমার হাততা একতু আমার গায়ে বুলিয়ে দাও তো তাহলে আমার গায়েও থুন্দর গন্ধ হয়ে যাবে। “ সেই কচি মেয়েটাকে ননদ বলতেও কেমন যেন লাগে। আমি তো চেপে ধরে নিজের কোলের ওপর উঠিয়ে নিয়েছিলাম। তখনই বুঝেছিলাম যে গন্ধটা আমার মনগড়া নয়। নতুন শাড়ি, কপালের চন্দন, সিঁদুরের গন্ধ সব মিলিয়েই হয়তো এই গন্ধটা তৈরি হয়ে যায়।

গাড়ি চলতে শুরু করেছে। ২ ঘন্টার পথ ঠিকই কিন্তু উচ্চতা ১৪,৪১০। তাই গাড়ি যত উঠছে ততই চারপাশের চিত্র পালটে যাচ্ছে। একটা সময় দেখলাম মেঘের ওপরে চলে এসেছি। ওপরে আকাশ, নিচে দেখা যাচ্ছে মেঘ আর তারমাঝে আমরা। এটা বর্ণনা করার জন্য যেরকম ভাষার প্রয়োজন, সেই ভাষার ভান্ডার আমার কাছে এখনও ধরা দেয় নি। মন হয় যে স্বর্গীয় অনুভূতির ভাষা হয় না সেটা শুধু উপলব্ধি করা যায়। ছাংগুকে পাশ কাটিয়ে আসতে গিয়ে, প্রায় ১৭বছর আগের কথা মনে পড়ে গেল। তখন চারচাকার এত  আধিক্য ছিল না, সাইটসিনের জন্য গাড়ি ব্যবহার হলেও বড়বড় ট্যুরের জন্য বাসই ভরসা ছিল। ছাঙ্গুতে ঢোকার মুখেই একটা বাজার ছিল সেখানে ব্র্যান্ডি পাওয়া যেত। সেই প্রথম আমরা ব্র্যান্ডি খেয়েছিলাম। আমাদের যাথে যারা গেছিল তারা অবশ্য বারণ করেছিল কিন্তু বাবার কথা মতো মেয়ের সুস্থ থাকাটা আগে দরকার। তাই অল্প একটু ব্রান্ডি ওষুধের মতো করে গিলে ফেলেছিলাম। বোন অনেকটাই ছোটো তাই ওকে দেওয়া হয় নি। তাতেও যে খুব একটা লাভ হয়েছিল তা নয়। ঐ ঠান্ডায় বোনের, দাঁতে দাঁত লেগে যায়। বাবা নিজের গা থেকে মোটা সোয়েটার খুলে বোনের গায়ে পরিয়ে দিয়েছিলেন। সেই ছবি এখনও আমাদের অ্যালবামে ধরা আছে। তারপর বুকে জড়িয়ে বাসে নিয়ে আসার সময় শুরু হয়েছিল স্নো ফলস। বোন তখন ফুলের মতো। ফর্সা গোলগোল গালটা ঠান্ডায় লাল হয়ে গেছিল। এমনিতেই বোন পুতুলের মতো ছিল দেখতে, সেই সময় বাসে বসে জড়িয়ে ধরার সময় নিজেকে মায়ের মতো মনে হয়েছিল। অবশ্য ছোটো বোন, মেয়ের মতোই হয়। এখনকার ছাঙ্গুর চারপাশে অনেকটাই পরিবর্তন হয়ে গেছে। আগে ছাঙ্গুর চারপাশে কোনো রাস্তা ছিল না। লেকটাকে ঘিরে শুধুই পাহাড়। আর এখন তারপাশ দিয়েই ওপরে উঠে গেছে নাথুলা যাওয়ার রাস্তা।

খানিকটা যাওয়ার পর গুটি কয়েক দোকান ঘিরে একটা ছোট মত বাজার পড়লো। একটা খাবারের দোকান, কিছু শীতের জামাকাপড়ের দোকান আর দুতিনটের মতো ছিল হরেক রকম ঘর সাজানোর জিনিসের দোকান। সব কিছুই খুব রঙ্গিন। গাড়ি থেকে নেমেই সবাই বাথরুমের দিকে ছুটলো। আমরা দুজনেই খাবারের দোকানের সামনে গিয়ে বসে পড়লাম। দুপ্লেট মোমো অর্ডার করে, আরাম করে পা তুলে টুলের ওপর বাবু হয়ে বসলাম। অনি “একটু আসছি” বলে যথারীতি হিসু করতে চলে গেল। নেটওয়ার্কের খুবই খারাপ অবস্থা তাই বাড়ির সাথে যোগাযোগ করা সম্ভব হলো না। একটা মেসেজ ছেড়ে রাখলাম…যখন নেটওয়ার্ক পাবে নিজে থেকেই পৌছে যাবে। অনি আসার পরেই ধোঁয়া ওঠা স্যুপের সাথে গরম গরম মোমো চলে এলো। ঐ ঠান্ডায় গরম স্যুপটা যে কী আরামের তা কী বলব। বাকিরাও এসে জড়ো হল। প্রায় প্রত্যেকের হাতেই রঙিন প্লাস্টিক। যদিও বাজারে এই রঙিন প্লাস্টিকের ব্যবহার হয় একটু অদ্ভুত লাগলো। যাই হোক, রাস্তায় না পড়ে থাকলেই হলো। খানিকক্ষণ বাদে আবার গাড়িতে উঠে বসলাম।

গাড়ি আবার উঠতে শুরু করলো। ছোটোবেলার ছাঙ্গুর অভিজ্ঞতা নিয়ে অনির সাথে সাথে গল্প  করতে করতেই চোখে পড়ল সব থেকে উচ্চতায় প্রায় ১৩০০০ফিট ওপরে অবস্থিত অ্যাক্সিসের এটিএম। দেখার মতোই জিনিস বটে। তারপর সোজা গিয়ে থামলাম নাথুলার সামনে। এতক্ষণ যে কষ্টটা চেপে রেখেছিলাম সেটা প্রকট ভাবে দেখা দিল। প্রচন্ড শ্বাসকষ্ট। অনিকে বললাম “তুই চলে যা আমি সিঁড়িতে বসে আছি। একটু ঠিক হলে আমি উঠছি।“ অনি তো শুনলো না। আমার অবস্থা দেখেই কি না জানি না একজন স্থানীয় লোক বলল যে সামনের ক্যাফেটা খুললে সেখান থেকে ব্ল্যাক কফি খেলে ঠিক হয়ে যাবে। এছাড়াও পপকর্ন খেলে ঠিক হয়ে যাবে। কিন্তু তখন আর পপকর্ন কোথায় পাবো। এদিকে শ্বাসকষ্ট বেড়েই চলেছে। মনে হচ্ছে হেলিকপ্টারে করে কেউ হোটেলে পৌছে দিয়ে এলে বেশ হয়। এটা অবশ্য অত্যাধিক ইংরেজি মুভি দেখার ফল। যাই হোক, সামনে দিয়ে সবাই উঠে যাচ্ছে দেশাত্মবোধক গান গাইতে গাইতে। সত্যি বলতে খুব বিরক্ত লাগছিল কারণ ঐ সুন্দর শান্ত পরিবেশে হেড়ে গলার গানটাকে মোটেই মেনে নেওয়া যাচ্ছিল না। যাই হোক বেশ খানিকক্ষণ বাদে দেখলাম শ্বাসকষ্টটা হঠাৎ করেই কমে গেল। অনিকে বললাম “ চল দেখি, দুনিয়া জয় করে আসি।“

দুজনেই উঠে গেলাম নাথুলায় চেক পোস্টে। দেশের পতাকার সামনে গিয়ে সবাই  প্রণাম করছে। আমরা অবশ্য প্রণাম করি নি কিন্তু পরিবেশের জন্যই কি না জানি না নিজেদের খুব গর্বিত মনে হচ্ছিল, এই দেশে জন্মাতে পেরে। অনেক খুঁত আছে অবশ্যই কিন্তু সেটা মানুষের সৃষ্টি, দেশের কোনো দোষ নেই। অত ওপরের চারপাশটা যে শুধুই বরফ বরফ সেটা আর বলার অপেক্ষা রাখে না।  চৈনিক সৈন্যের সাথেও হাত মেলালাম। ঐ পারের মানে চায়নার দিকে একটা বরফের পাহাড় মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে। তবে আরও একটা যেটা চোখে পড়ে সেটা হচ্ছে চায়নার রাস্তাঘাট। ঝকঝকে পাহাড়ি রাস্তা, আমাদের দেশের রাজপথকেও হার মানায়। আর এইদিকে তাকালে আমাদের রাস্তার দুর্দশার কথা আর কী বলবো। একটাই আশঙ্কা হয় যে যদি কোনোদিন যুদ্ধ বাধে (না হলেই ভালো) তাহলে ওপারের সৈনিকরা শুধু মাত্র যোগাযোগ ব্যবস্থার জন্য কিছুটা লাভেই থাকবে।

ওখান থেকে নামার পথে ক্যাফে থেকে ব্ল্যাক কফি আর পপকর্নের প্যাকেট কিনে নিলাম। বলা তো যায় না, আবার যদি শ্বাসকষ্ট শুরু হয় তাহলে বড়ই সমস্যায় পড়বো। অনি চলে গেলো বাথরুম করতে। এসে বলল “ সর্বোচ্চ উচ্চতায় সবথেকে বেশি নোংরা বাথরুম। এই অনি-র এক স্বভাব, যেখানে যাবে বাথরুমে অন্তত ঢুঁ মারবেই মারবেই। মাঝে মাঝেই তাই ওকে বলি “ ইতনি সুসু তু লাতে কাহাসে হ্যায়।“ তার কথামতো এটি নাকি একটি ক্যালি। যাই হোক নেমে আসতে লাগলাম গাড়ির দিকে। এইবার অনির শ্বাসকষ্ট শুরু হলো। যদিও সেই কষ্টটা ঢাকার জন্য সে বলেই চলেছে “দেখ মৈ, সবার ওঠার সময় হয় আর আমার নামার সময় হচ্ছে। সবই উল্টো আমার।“ পপকর্নের প্যাকেটটা খুলে সামনে এগিয়ে দিয়ে বললাম “ তাই তো! আসলে উল্টোডাঙ্গার পাশেই থাকিস তো তাই ছোঁয়া লেগেছে।“ বেশ খানিকটা সময় বেশ কষ্ট পেয়েছিল। তারপর গাড়ি যখন বাবা মন্দিরের দিকে নামতে শুরু করেছে তখন জানালো যে সে এখন ঠিক আছে। স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললাম।

এইবার গাড়ি নিয়ে নামতে নামতেই পেয়ে গেল বাথরুম। সেই সকাল বেলায় হোটেল থেকে বেরনোর আগে একবার গেছি। তারপর আর যাওয়া হয় নি। কিন্তু আর পারছিলাম না। অনিকে কানে কানে বললাম “ খুব জোরে হিসু পেয়েছে রে।“ সেও বলল – “একটু চেপে রাখ, একটু বাদে বাবা মন্দিরে পৌছে যাব সেখানে গিয়ে করিস।“

-নাহ রে, অনেকক্ষনই চেপে আছি। আর পারছি না। এবার হয়েই যাবে মনে হচ্ছে। তুই কিছু একটা বাহানা করে গাড়ি থামা, আমি চট করে হাল্কা হয়ে নিই।“

অনি তো দোনামোনা করে ড্রাইভারকে বলল যে গাড়িটা যেন একটু দাঁড় করায়, অজুহাত- ফটো তুলবে। ড্রাইভার জানালো যে মাঝ রাস্তায় গাড়ি থামানোর অসুবিধা আছে কারণ আর্মির গাড়ি যাতায়াত করে। অনি খুব কাতর অনুনয় করে বলল “ প্লিজ ভাই। এত সুন্দর দৃশ্য আর কবে দেখবো জানি না। একটু সময়ের জন্য দাঁড়ালেই চলবে।  ফটো তোলার কথা শুনে বাকি যাত্রীরাও একসাথে বলল যে গাড়ি দাঁড় করাতে। গাড়ি থামতে না থামতেই গাড়ি থেকে নেমে অনিকে বললাম “ অন্য কোনো গাড়ি এলে থামিয়ে দিস।“

-“মানে!!”

-“ আরে হিসু করতে দেখলে বিচ্ছিরি ব্যাপার হবে। আর্মির ট্রাক গেলে হাত দিয়ে থামিয়ে দিস।“ কথাটা বলার পরেই বুঝতে পারলাম যে এই ধরণের অন্যায় রাজকার্যের জন্য অনি যে কোনোদিন আমায় ডিভোর্স দিয়ে দিতে পারে। সোজা অনেকটা দৌড়ে চলে গেলাম একটা পাথরের কাছে। আশেপাশটা দেখে নিয়ে বসে পড়লাম। আমি সবাইকে দেখতে পাচ্ছি কিন্তু কেউ আমাকে দেখতে পাচ্ছে না। কিন্তু উল্টোদিক থেকে গাড়ি এলেও বিপদ। যাই হোক, কাজটা সম্পন্ন করে অনির কাছে ফিরে গেলাম। অনি বলল “হ্যাঁ রে, শেষের কথাটা কি তুই ভেবে বলেছিল? আর্মির ট্রাক এলে কী বলে থামাতাম যে ওখানে আমার বউ হিসু করছে তোমরা যেও না। তুই তো যে কোনোদিন আমাকে লকাপে ঢুকিয়ে দিবি।“ আমি হাসতে হাসতে বললাম “ প্রকৃতির ডাক রে ভাই, উপেক্ষা করা মুশকিল।“

গাড়ি এবার নামছে। খানিকটা নেমে আসার পর রাস্তার বাঁদিকে একটা মোড় ঘুরে আবার নামতে শুরু করলো। ঠিক মোড়টায়, রাস্তার পাশে একটা সাইন বোর্ডে হিন্দীতে লেখা “ বাবা হরভজন সিং মন্দির”। একটু এগিয়েই গাড়ি এসে থামার পর দেখলাম বেশ কয়েকটা গাড়ি এসে দাঁড়িয়ে আছে তাই জায়গাটা বেশ ভিড়। মানে নাথুলায় যারা যারা গেছিল সবাই এবার বাবা মন্দিরে চলে এসেছে। জায়গাটা ভারি সুন্দর, একপাশে মন্দির আরেক পাশে একটি ছোটো জলাশয়। মন্দিরের চাতালের একপাশে মানে বাঁদিকে সার দিয়ে তিনটে ঘর, ডানদিকে একজন মিলিটারির সামনে রাখা একথালা নকুলদানা আর সামনেও লাইন দিয়ে কিছু ঘর।

আমার কাছে ভগবান মানে একটা ইতিবাচক শক্তি। দুর্বল মুহূর্তে যাকে সবথেকে বেশি মনে পড়ে এবং যাকে স্মরণ করলে মনের জোর ফিরে আসে তাকেই আমি ইতিবাচক শক্তির আধার বলে মনে করি। মনের শক্তির জন্য আমি, আমার দিদিভাই এবং দাদুভাইকে স্মরণ করে থাকি। তাই এঁরাই আমার কাছে ভগবান। যে কোনো ভাল কাজ করার আগে যেমন তাঁদের স্মরণ করি তেমনি মন খারাপ হলে তাঁদের সাথে ঝগড়াও করি। সে আবার বিশাল ঝগড়া, তাঁদের ছবিও উলটো করে রেখে দিই। কারণ সামনাসামনি তো আর আড়ি করার উপায় থাকে না। আবার রাগ মিটে গেলে চূড়ান্ত অভিমান করে আবার তাঁদের ফটোটা বুকে জড়িয়ে ধরি। আবার যারা মূর্তি পূজোয় বিশ্বাসী তাদেরকেও আমি সম্মান করি। যে যেভাবে নিজের মনের জোর ফিরে পায় সেটাই তো আসল। তাই মন্দির বা ভগবান কাউকেই আমি অসম্মান করি না। নাস্তিক হওয়ার জন্য যে পরিমাণ পড়াশোনা আর মনের জোর দরকার সেটা এখনও আয়ত্ত করতে পারি নি।

এতগুলো কথা বলার কারণ একটাই, বিয়ের তিনবছর আগে বাবার ব্রেন ক্যান্সার অপরেশান হয়। তখন মানসিক ভাবে সাংঘাতিক ভেঙে পড়েছিলাম। খুব খারাপ অবস্থা থেকে ফিরে এসেছিলেন। তারপর প্রতি বছর ভেলোরে যেতে হতো চেক আপের জন্য। এখন অবশ্য আর যেতে হয় না কিন্তু তখনকার পরিস্থিতি আলাদা ছিল। শুনেছিলাম যে বাবা মন্দিরের সামনে একটা জলের বোতল খানিকক্ষণ রেখে দেওয়ার পর সেই জল বাড়িতে রেখে দিলে রোগভোগ বা যাবতীয় বিপদ থেকে মুক্তি পাওয়া যায়। অবিশ্বাস করার আমি কে? দুনিয়ায় অনেক কিছু ঘটে যার যুক্তি খুঁজে পাওয়া যায় না তারমানে তো এটা নয় যেটা অস্বীকার করবো। আমার বাবা তখন অসুস্থ তাই ঐ সময় যুক্তিতর্ক করে ভাবার মতো মানসিক অবস্থাও ছিল না। একটা জলের বোতল কিনে সেটা রাখতে গিয়ে দেখি সারি সারি বোতল লাইন দিয়ে রাখা আছে। আর ঠিক তারসামনেই বাবা হরভজন সিং-এর একটা ফটো। মিলিটারির পোষাক পরা, বুক অব্ধি একটা ছবি। তবে চোখটা খুব জীবন্ত।

বোতল রাখার পর চাতালের চারপাশটা ঘরে নিলাম। পুরোহিত ডেকে পুজোর বালাই নেই। আমরা যেরকম ফটোর পাশে নকুলদানা আর জল রাখি ঠিক সেই রকম ভাবেই হরভজন সিং-এর পূজো করা হয়।  ডানদিকে গিয়ে একটু নকুলদানা তুলে নিলাম। তারপর রাস্তায় নেমে পাশের জলাশয়য়ের ওপরে গিয়ে দাঁড়ালাম। হ্যাঁ, দাঁড়ালামই কারণ জল জমে বরফ হয়ে আছে। আর সেই জলাশয়ের উৎস যে ঝরনাটা সেটাও জমে স্ফটিকের আকার ধারণ করেছে। অনেকটা উঁচু ঝরনা সেটাকে কেউ যেন স্ট্যাচু খেলার অছিলায় দাঁড় করিয়ে রেখে গেছে। মার্চ এপ্রিল নাগাদ আবার সে ঝাপিয়ে পড়বে জলাশয়ের ওপর। এই জলাশয়ের পাশ দিয়েই একটা রাস্তা ওপর দিকে উঠে গেছে। সেটা কোথায় গেছে কে জানে।

দুজনেই গাড়ির কাছে চলে এলাম এবার ফেরার পালা। আমি চলে গেলাম বোতলতা ফেরত নিয়ে আসার জন্য। আসার প্রায় সাথে সাথেই আমাদের গাড়ির এক যাত্রী এসে বলল “ আপনারা কুপুপ দেখতে যাবেন? ড্রাইভার বলল যে কিছু টাকা দিলে সে নিয়ে যেতে রাজী। বাকি সবাইকে জিজ্ঞেস করে নিয়েছি তারা সবাই রাজী তাই আপনারাও যদি…” কথা শেষ করার আগেই দুজনেই হ্যাঁএএএএএএএ বলে লাফিয়ে উঠলাম। সে বোধহয় এতোটাও আশা করে নি যাই হোক আবার গাড়িতে চেপে বসলাম।

উঠতে শুরু করলাম। চারপাশটা আবার বরফে ছেয়ে গেল। খাদটা খুব বেশি নিচে নয় মানে পড়ে গেলে খুঁজে পাওয়া যাবে না ঠিকই কিন্তু খাদের তল দেখা যাচ্ছে। বেশ খানিকটা উঠে যাওয়ার পর প্রায় ২০/২৫ মিনিট বাদে গাড়ি দাঁড়িয়ে পড়লো। রাস্তার চওড়া খুব বেশি নয় একপাশে বরফের পাহাড় আর নিচে তাকালে এলিফ্যান্ট লেক যেটাকে কুপুপ লেকও বলা হয়। লেকের ওপারের পাহাড়টার জন্য ভুটানের সীমানা এখান থেকে দেখা যাচ্ছে না যদিও তবে আরেকটু ওপরে উঠলে অবশ্যই দেখা যাবে। কিন্তু দেরি হয়ে যাবে তাই ড্রাইভার আর রাজী হলো না। যাই হোক এই বা কম কীসে। রাস্তার ওপর পা ঝুলিয়ে খাদের ধারে বসে থাকলে কোথা দিয়ে যে সময় কেটে যাবে তার নেই ঠিক। অদ্ভুত রকমের শান্ত পরিবেশ, গাড়ির আওয়াজ নেই, দূষণ নেই। কলকাতায় আকাশী রঙের আকাশ একমাত্র আঁকার খাতায় দেখা যায়। এখানে সেটার বাড়বাড়ন্ত। নিচে বরফের উপত্যকা আর তারমাঝে জমে থাকা লেক। দুদিকেই বরফের দেওয়াল। অনি বলল “পাহাড়ে উঠবি?” বলে আর উত্তরের অপেক্ষা না করে হাত ধরে টেনে পাহাড়ের ওপর একধাপ একধাপ করে উঠতে শুরু করলো। বললাম “তোর থেকে আমার ওজন কিন্তু বেশি আমি যদি পিছলে যাই তুই কিন্তু আমার সাথে সাথেই ধপাস হয়ে যাবি। তাই হাতটা ছেড়ে দে বাপ। পড়লে একজনই পড়ি দুজনের হাত পা ভেঙে লাভ আছে বল তাই…” বলতে বলতেই যথারীতি ধপাস হলাম। এই ধপাস হওয়াটা আমার বংশের দোষ। আমাদের বাড়িতে যে কোনো সময় যে কেউ পড়ে যায় আমিও তার ব্যাতিক্রম নই। পরিষ্কার রাস্তাতেও পড়ে গিয়ে আমার হাতপা কেটে যায়। আর পড়ে গেলেই খুব হাসি পায় আমার। বোধহয় হরমোনটাই ঐভাবে কাজ করা শুরু করে। যাই হোক এবারও পড়ে গিয়ে আমি হেসে উঠলাম। অনি তখনও হাতটা ধরে রেখেছে। ঠিক সেই মুহূর্তেই দেখলাম ক্লিক। মানে সামনে থেকে একজন দাদা ঐ মুহূর্তটা ধরে নিয়েছে নিজের ক্যামেরায়।  সাথে সবার হাসির আওয়াজও পেলাম। আমরাও হাসতে হাসতে নিচে নেমে এলাম। তারপর ঐ খোলা পরিবেশে শুরু হলো আড্ডা। কার কবে বিয়ে হয়েছে, কে কতবার আমার মতোই আছাড় খেয়েছে, এরপরে কোথায় কোথায় যাওয়ার পরিকল্পনা আছে আরও অনেক অনেক কথা। সারা রাস্তা যে কীভাবে আমরা চুপ করে ছিলাম সেটা ভগবানই জানেন।

হঠাৎ করেই মনে পড়লো যে গ্লাভসটা হাতে নেই। অনির কাছে জানতে চাইলে ও বলল “ব্যাগে ঢুকিয়ে রাখিস নি তো?” আমি তো রাখিই নি উপরন্তু আমি ভেবেছি যে অনি হয়তো ব্যাগে ঢুকিয়ে রেখেছে। সেটাও যখন নয় তারমানে গ্লাভসটা মন্দিরেই কোথাও রাখা আছে। ফেরার পথে ড্রাইভারকে বললাম যে মন্দিরের সামনে যেন একটু দাঁড়ায় কারণ গ্লাভসটা খোঁজ করতে হবে। পেলে ভাল না হলে আবার কিনতে হবে। গাড়ি এসে মন্দিরের সামনে দাঁড়ালো। আমি একাই নেমে জানতে চাইলাম যে কোনো গ্লাভস পেয়েছে কি না। যিনি নকুলদানা দিয়েছিলেন তিনিই জানালেন যে গ্লাভসটা চাতালেই পড়ে ছিল, একজন কেয়ারটেকারের কাছে রাখা আছে। আমাকে দাঁড়াতে বলে নিজেই চলে গেলেন সেটা আনতে। আমি ভাবলাম একা একা দাঁড়িয়ে লাভ নেই তার থেকে বরং ছবির ঘরটা আরেকবার দেখে আসি। পুরো এলাকায় আমি একা, অনিরা গাড়িতে আর একজন মিলিটারিকেও দেখতে পেলাম না।

মন্দিরের সামনে গিয়ে আমার পা আঁটকে গেল। নিস্তব্ধ পরিবেশ। সামনের ঘরটা অন্ধকারাচ্ছন্ন। ফটোর পাশে ধূপ আর মোমবাতি জ্বললেও সেটা প্রায় শেষ হয়ে এসেছে। কিন্তু চোখটা…ফটোর চোখটা মনে হচ্ছে জীবন্ত হয়ে আমার দিকেই তাকিয়ে আছে। পুরো ঘরটা আবছা হয়ে গেল হঠাৎ করে। সামনে শুধু দুটো চোখ আর আমি। সম্মোহিতের মতো শুধু তাকিয়েই আছি আমি নড়তে পারছি না। চাইলেও পারছি না। কেমন যেন একটা জড় বস্তুতে পরিণত হয়ে গেছি। চোখটা আমাকে নড়তে দিচ্ছে না। চারপাশের অস্তিত্ব ধীরে ধীরে বিলীন হয়ে যাচ্ছে… আমার আর কিছু মনে নেই।

কতক্ষণ বাদে এসে অনি ডেকেছে আমি জানি না। এর আগেও নাকি আমাকে ডেকেছে কিন্তু আমি শুনতে পাই নি। গায়ে হাত ছোঁয়ানোর পর মনে হলো যেন জেগে উঠলাম। ঘোর লাগা অবস্থাতেই অনিকে বললাম “ তুই?” তারপর একটু থেমে আবার বললাম ”কতক্ষণ দাঁড়িয়ে আছি রে?” অনি বলল “অনেকক্ষণ তো। ড্রাইভার তাড়া দিচ্ছে তাই বাধ্য হয়ে নেমে এলাম। গ্লাভসটাও তো দেখছি রাখা আছে দানবাক্সের ওপর। তোকে বলে নি?”  আমি বললাম “ তাড়াতাড়ি গাড়িতে চল। আমার ভাল লাগছে না। “ অনির হাত ধরে টলতে টলতে গাড়িতে এসে উঠলাম। অনি জানতে চাইলো আমার কী হয়েছে বা আমি ঠিক আছি কি না। আমি তখনও চোখটার কথা ভেবে চলেছি।

ফেরার পথে পুরোটাই চুপ করে ছিলাম। অনিও কিছু জানতে চায় নি শুধু হাতটা ধরে ছিল। কোনো কোনো সময় নিজেকে সামলে নেওয়ার প্রয়োজন পড়ে আর সেই কাজটা একাই করতে হয়। এই ধরণের কোনো অভিজ্ঞতা আগে হয় নি। তাই মাথার মধ্যে ঘুরে চলেছে যে কেন এরকম হলো। তবে কি অক্সিজেনের অভাব না কি পরিবেশই দায়ী এর জন্য!  কিন্তু সেই মুহূর্তের আগে তো সব ঠিকই ছিল। কিছুতেই ঘটনার কারণটা খুঁজে পেলাম না ভাবলাম রাত্রে অনিকে বললে ও হয়তো সাহায্য করতে পারবে। তবে সেদিন রাত্রেই আবার একটা ঘটনা ঘটলো যার যুক্তি আমরা কেউই খুঁজে পাই নি। যুক্তির সাথে ইন্দ্রিয় ব্যস্তানুপাতিক ভাবে কাজ করে চলছিল সমানে।

(ক্রমশ)

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

মৈ মৈত্রেয়ী। জন্ম কলকাতায়। পেশায় সিভিল ইঞ্জিনিয়ার। গদ্য ও কবিতা লেখার প্রতি দীর্ঘদিনের ঝোঁক। ছোটদের জন্য বাংলা গল্প প্রতিযোগিতায় 'অক্সফোর্ড ইউনিভার্সিটি প্রেস' থেকে সম্মানপ্রাপ্ত।

এই বিভাগের অন্যান্য লেখাসমূহ