হানিমুনে হারিকিরি (পর্ব – ৪)

মৈ মৈত্রেয়ী
ধারাবাহিক, নন ফিকশন
Bengali
হানিমুনে হারিকিরি (পর্ব – ৪)

পূর্ব প্রকাশের পর…

দাদুভাই-এর হাতের কাজ ছিল অসাধারণ। দেশলাই-এর বাক্স দিয়ে এতো সুন্দর বাড়ি বানাতেন যে মনে হতো যেন সেই বাড়িতেই ঠাই নিয়ে নি। বাড়ির দেওয়াল ছিল দেশলাই বাক্সের। দুটো দেশলাই বাক্স জোড়া থাকতো রূপালি রঙের রাংতা দিয়ে। ঠিক যেন দুটো ইটের মাঝখানে সিমেন্টের প্রলেপ দেওয়া। ফাঁকা চতুষ্কোণের চারদিকে চারটে দেশলাই বাক্স ঘিরে রাখা। সেই ফাঁকা জায়গায় পরপর চারটে দেশলাই কাঠি বসিয়ে জানালার গরাদ বানানো। আহা…মনে হয় বড়ির মধ্যে ঢুকে সেই জানালায় বসে বসে অমলের মতো রাস্তার দিকে চেয়ে থাকি সারাদিন। তিনতলার বাড়ির চারদিকে জানালা। আর ছাদের মেঝেতে ছিল রূপালী রাংতা, রেলিঙে দেওয়া দেশলাই কাঠি। আর ছিল একটা বড় চাতাল। দাদুভাই সবার জন্য বানিয়ে দিয়েছিলেন একটি করে বাড়ি।

লাচুং-এর হোটেলটা ছিল অনেকটা সেই রকম। মনে হচ্ছিল কে যেন তিনতলা বাড়িটা অন্য কোথাও বানিয়ে পরে এইখানে বসিয়ে দিয়ে গেছে। আশেপাশে তাকানোর মতো শারীরিক অবস্থা তখন আর ছিলো না। হোটেলের ছেলেগুলো এসে বললো যে তিনটে বড় ঘর, তিনজন বিবাহিতদের জন্য রাখা আছে। একতলার ঘরটা বড়…ছেলেটার কথা শেষ হতে না হতেই পাঞ্জাবী দম্পতিটি বলল যে তাদের একতলার ঘরটাই লাগবে। একটা ছেলে তাদের জিনিসপত্র নিয়ে তাদের সাথে চলে গেল। একতলার আরও একটা ঘরে অন্য দুজন ছেলের ঘর ঠিক হয়ে গেল। বাকি থাকলাম দুজন দম্পতি আর আরও দুজন ছেলে, যারা আমাদের পাশে বসেই এসেছে। দোতলায় উঠে গেলাম। করিডরের প্রথম বাঁদিকের ঘরটায় দুজন ছেলে ঢুকে গেল। আমরা এগিয়ে গেলাম। করিডরের শেষ প্রান্তে একটা রেলিঙ দেওয়া তার দুপাশে দুটো ঘর। হোটেলের ছেলেটি বলল ডানদিকের ঘরটি হানিমুন স্যুইট। এখানেও দেখলাম একই ব্যাপার ঘটলো। স্যুইট-এর ট শেষ হতেই অন্য দম্পতি বলল যে ঐ ঘরেই তারা থাকবে। ঘরের দরজা ভেজানো ছিল। তারা ঢুকে গেল। আমরা ঢুকলাম বাঁদিকের ঘরটায়। হোটেলের ছেলেটি হিন্দীতে বলল যে ওরা তো পুরো কথাই শেষ করতে দিলো না, ঐ ঘরের সামনের জানালা কাঠ দিয়ে আটকানো। কিছুদিন আগেই হাওয়ার ধাক্কায় জানালার শার্সি ভেঙ্গে গেছে। অবশ্য বেশি সময় লাগলো না। ঐ ঘরের ছেলেটি এসে, হোটেলের ছেলেটির ওপর বেশ হম্বিতম্বি করে গেল। আমরা আর কথা না বাড়িয়ে দরজা বন্ধ করে দিলাম। যে কোনো হোটেলে গেলেই দুটো কাজ আগে করি। অনিকে বললাম – বাথরুমটা দেখে নে তো একবার পরিষ্কার আছে কি না? আর আমি চলে গেলাম জানালার পর্দা সরাতে।

সামনে কেউ দাঁড়িয়ে থাকলে, পিছন থেকে ধাপ্পা দেওয়ার মজাই আলাদা। অনেকে ধাপ্পা দিয়ে ছেড়ে দেয় অনেকেই আবার ধাপ্পা দিয়ে পিছন থেকেই জড়িয়ে ধরে। সামনের দৃশ্যটা একদম সেরকম। গাড়ি থেকে নেমে কিছুই বুঝতে পারি নি। এখন দেখি সামনে একটা ব্রীজ। তার নিচে লাচুং নদী। যদিও সেটা দেখা যাচ্ছে না এখান থেকে। কিন্তু আওয়াজ পাচ্ছি। ব্রীজের পরেই দুটো পাহাড় এবং তার মধ্যে দিয়ে একটা রাস্তা ঢুকে গেছে। সেই পাহাড় দুটির গায়ে টিমটিম করে জ্বলছে হোটেল এবং স্থানীয় বাসিন্দাদের বাড়ির আলো। আর তারপরেই ধাপ্পা দিয়ে জড়িয়ে ধরার ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে আছে এক সুবিশাল বরফের পাহাড়। মনে হচ্ছে যেন সামনের পাহাড়গুলো জানেই না যে পিছনে এসে দাঁড়িয়েছে তাদের দাদু। যার গোটা শরীর বরফ সাদা কাপড়ে ঢাকা আর সামনের দুদিকের দিকে কিছুটা প্রসারিত হয়ে আছে তার বরফের হাত। আচমকা ধাপ্পা দিলে যদি বাচ্চাগুলো লাচুং নদিতে পড়ে যায় তাই তাদেরকে আগলানোর বন্দোবস্ত সে আগেই করেই রেখেছে। অনি পিছন থেকে দু কাঁধে হাত দিয়ে শুধু বলল “অপূর্ব”। অবশ্যই চমকে যেতাম যদি না ঐ হাত দুটো ছুঁয়ে থাকতো। তারপরে বলল “ তোর পায়ের অবস্থা দেখি আগে। দরকার হলে এইখানে বসেই জুতো খোল, মোজাটাও খুলিস। আমি অন্য সেট বার করে দিচ্ছি।“ ধাপ্পা না ঠিকই কিন্তু বরফের পাহাড়ের স্নেহ, আমি নিজের মধ্যেও সমান উপলব্ধি করলাম।

পায়ের অবস্থা সত্যিই খারাপ। ফুলে ঢোল। ইতিমধ্যে হোটেলের ছেলেটি এসে হাফ বালতি গরম জল দিয়ে গেল। হে হে, এরে কর রানিং হট ওয়াটার। যাই হোক, চোখে মুখে জল দিয়ে আমরা নিচে এসে বারান্দায় দাঁড়ালাম। হোটেলের একজনকে ডেকে বললাম চা দিতে। অনি গেল পাশের একটা দোকানে স্ন্যাক্স কিনতে। পায়ের পাতার ব্যথা তখনও যায় নি তাই উঠে বসলাম রেলিং-এর ওপরে। এর মধ্যেই, ওপরের ঘরে থাকা দুটো ছেলেও বারান্দায় চলে এলো। অচেনা লোকদের সাথে আমি খুব ভাল কথা বলতে পারি। বারান্দায় আমাকে একা দেখে তারা একটু থতমত খেয়ে গেছিল। তাই তাদের আড়ষ্টতা আমিই কাটিয়ে দিলাম। তাদের নামধাম জিজ্ঞেস করতে করতেই অনি চলে এলো। দেখি এক গাদা চিপস কিনে এনেছে। দুপুরেও সেই ভাবে খাওয়া হয় নি। তাই চিপসের একটা প্যাকেট প্রায় সাথে সাথেই খুলে নিলাম। চার কাপ চা-ও এসে হাজির। চারজনে একসাথে খেতে খেতেই আবার আড্ডা শুরু হোলো। ছেলেদুজন মামা ভাগ্নে, মুর্শিদাবাদের বাসিন্দা। ভাগ্নের পরীক্ষা শেষ তাই মামা সাথে করে বেড়াতে বেড়িয়েছে।

গল্প করতে করতেই মামা একটু ইতিস্তত করে বলল – যদি অভয় দাও তো একটা কথা জিজ্ঞেস করি?

অনি বলল – অভয়টভয় আবার কেন! এমনিই জিজ্ঞেস করো দাদা।

–  তোমাদের সম্পর্কটা ঠিক কী একটু বলবে? দিদির মাথায় সিঁদুর আছে অথচ তোমাদের দেখে ঠিক স্বামী স্ত্রী বলে মনে হচ্ছে না।

–  সে কি!! তাহলে কী মনে হচ্ছে?

–  নাহ মানে…সেটাই তো ঠিক বুঝতে পারছি না। প্রথমে তোমাদের কথা শুনে মনে হোলো ভাই বোন কারণ তুই তুই করে কথা বলছো। তারপর মনে হোলো যা নাহ…ভাইবোন হবে না… তাহলে হয়তো দুই বন্ধু মানে সারা রাস্তা যে ভাবে কথা বলতে বলতে এলে ঐ গরু ছাগল পাঁঠা…কিন্তু…সেটাও যেন জমছে না কারণ আর যাই হোক দিদির মাথায় সিঁদুরটা তো আছে। হিসাবটা ঠিক যেন মিলছে না। স্বামী-স্ত্রী বলে ঠিক মানাও যাচ্ছে না আবার অন্য কোনো সম্পর্ক আছে কি না…মানে পুরো ঘেঁটে গেছি অনিমেষ। তোমারাই খোলসা করো।

আমরা দুজনেই শব্দ করে হোহো করে হেসে উঠলাম। অনেক কষ্টে হাসি থামিয়ে অনি বলল – একটা জায়গায় ঠিকই ধরেছো দাদা। ৭ বছর সম্পর্কের পর গত ২৬তারিখ বিয়ে হয়েছে। তাই আমরা বন্ধুই। পালকের মতো শুধু বিয়েটা শুধু যোগ হয়েছে কিন্তু তাতে বাকি কিছুর পরিবর্তন হয় নি।

তখনও মনে হয় মামার ঘোর কাটে নি। বলল – বাড়িতে কিছু বলে না? মানে বিয়ের পরেও তুই-তোকারি করছো!

এবার আমার বলার পালা কারণ অনি-র তখন মুখ ভর্তি চিপস। বললাম – নাহ দাদা। ডাকাডাকিটা সম্পূর্ণ ব্যক্তিগত ব্যাপার। তবে দুই বাড়ির বাবা-মায়ের যে আপত্তি নেই সেটা একটা ভাল। নইলে তাদেরকেও অবশ্যই বোঝাতে হতো। ‘তুই’ শুনতেই তারা স্বচ্ছন্দ। আর বাকি কেউ কিছু বললে অত পাত্তাই দিই না।

অবাক হয়ে বলল – ওহ!

অনি বলল – আমরা একটু ঐ দিকটা যাবো। তোমরা যাবে তো চলো।

কিন্তু তারা ক্লান্ত তাই বারান্দাতেই বিশ্রাম নেবে। আমি আর অনি হাঁটা লাগালাম ব্রীজের দিকে। হোটেল থেকে নেমেই রাস্তা। নদীটা পাশেই কিন্তু রাস্তা থেকেও দেখা যাচ্ছে না তবে আওয়াজটা বেড়েছে। দশ পা হাঁটার পর ডানদিকে সামান্য বাঁক নিলেই ব্রীজ। কনকনে ঠান্ডা হাওয়া বইছে। মাফলারটা বেশ ভালো করে মাথা আর গলায় পেঁচিয়ে নিলাম। ব্রীজের কাছে পৌছতেই হাড় অব্ধি কেঁপে গেল। তখনও নিচে নদী নেই শুধু পাথর। এগোতে থাকলাম ব্রীজের ওপর দিয়ে। এবার অনির হাতটা শক্ত করে ধরলাম। কারণ জলের আওয়াজ তখন রীতিমত হুঙ্কারে পৌছেছে। খানিকটা এগোনোর পরে কেউ আর কারুর কথা শুনতে পেলাম না। এসে দাঁড়ালাম ব্রীজের মাঝখানে।

লাচুং নদী তীব্র বেগে বয়ে যাচ্ছে ব্রীজের তলা দিয়ে। জলের ফেনায় তার তলা দেখা যাচ্ছে না। এতো তীব্র গতি দেখেছিলাম আরেক জায়গায়। জোরথাং-এ রঙ্গীত নদীর তীব্রতা ছিল ঠিক এই রকমই। তবে সেটা দেখেছিলাম দিনের বেলায়। কিন্তু লাচুং-এ এখন রীতিমত রাত। দিনের আলোয়, শব্দের তীব্রতা থাকলেও তার গভীরতা টের পাওয়া যায় না কিন্তু রাত্রে প্রতিটা শব্দ তার স্বকীয়তা বজায় রাখতে সক্ষম। এই মুহূর্তে চারপাশে আর কোনো শব্দ নেই কারণ ব্রীজের ওপর কোনো গাড়ি চলাচল করছে না। আর করলেও এই নদী চারপাশের কৃত্তিম শব্দ ঢেকে দিতে সক্ষম। কারণ রাতটা তার নিজস্ব, এই পরিবেশ তার নিজস্ব, এই গুরুগম্ভীর আওয়াজ তার অস্তিত্বের পরিচয়। হাওয়ার তীব্রতা এখানে এতোটাই যে অত নীচের ক্ষরস্রোতা নদী থেকে উড়ে আসছে জলের কণা। জ্যাকেটের গায়ে জমে উঠেছে জলবিন্দু। ব্রিজের মিটিমিটে ল্যাম্পপোস্ট থেকে আলো পড়ে সেই কণাই হয়ে উঠেছে হীরের মতো উজ্জ্বল। রূপমুগ্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়েও আমার পা কেঁপে চলেছে। নাহ ঠান্ডায় নয়…ভয়। জলে আমার ভীষণ ভয় অথচ খুব ভালবাসি এই জল। এ এক অদ্ভুত সম্পর্ক আমার জলের সাথে। পুকুর বা নদীর জলে পা ডুবিয়ে বসতে আমার ভয় লাগে। মনে হয় কেউ বোধহয় নিচের দিকে টেনে নিয়ে চলে যাবে। সমুদ্রে গেলে প্রথমে খানিক থতমত খেলেও পরে সেটা ঠিক হয়ে যায় কারণটা মনে হয় সমুদ্রের ঢেউ-এর সেই প্রবাদ। ‘ যা সে নেয় সেটা সে ফিরিয়ে দেয়’। তাহলে কি মৃত্যু ভয়! জানি না ঠিক। শাওয়ারের তলায় দাঁড়িয়ে থাকতে পারি ঘন্টার পর ঘন্টা। কিন্তু চোখ বন্ধ করে রাখতে পারি না বেশীক্ষণ। মনে হয় আমি যেন অন্ধ হয়ে যাবো।  অথচ জল আমি সত্যিই খুব ভালবাসি। অনি পাশ থেকে হাত দিয়ে কাছে টেনে বলল – “আমি আছি। ভয় পাস না।“ মুগ্ধতার ঘোরে কতক্ষণ দাঁড়িয়ে ছিলাম জানি না। ফেরার পথে অনিকে বললাম এবার ঘরে গিয়ে বসবো। পাহাড়ের দিকে হেলান দিয়ে।

ঘরটা যেন বেশি ঠান্ডা মনে হোলো। জানালার পাশে মুখোমুখি দুজনে বসলাম। ফোনে টাওয়ার নেই কারুরই। মাঝপথে একবার নেটওয়ার্ক পেয়ে তখনই ভাগ্যিস বাড়িতে ফোন করে নিয়েছিলাম নাহলে তারা খুব চিন্তায় থাকতো। হঠাৎ করেই অনি হো হো করে হেসে উঠে বলল – ভাই বোন ভেবেছে রে পাগলা। তারপর আবার আরেকচোট হাসি। ওর কথার ভঙ্গীতে আমিও হেসে ফেলে বললাম – “মাইরি, এটা বড়িতে গিয়ে সব্বাইকে বলতে হবে।“ তারপরে কী মনে করে অনি চেয়ার ছেড়ে উঠে পড়লো।

– কোথায় যাচ্ছিস রে? বস না একটু। তোর পায়ে ব্যথাও হয় না রে?

দেখি ব্যাগ থেকে লেদারের দু-জোড়া গ্লাভস বার করে বলল – কালকে লাগবে তো। তবে দোকান থেকে বলল যে ভাগ্য ভালো থাকলে তবেই ইয়ামথ্যাং ভ্যালিতে নামা যাবে।

চেয়ার ছেড়ে প্রায় লাফিয়ে উঠে বললাম – সে কি রে! কেন!

– হাওয়ার বেগ সেখানে সাংঘাতিক বেশি। এতোদিন বরফের জন্য রাস্তা বন্ধ ছিল দু-দিন আগেই রাস্তা খুলেছে। গতকাল দুটো গাড়ি গেছিল ঠিকই কিন্তু হাওয়ার জন্য কেউই ভ্যালিতে নামতে পারে নি। রাস্তাতেও নাকি বেশীক্ষণ দাঁড়ানো যায় না।

-তারমানে কেস জন্ডিস।

-হুম। তবুও আমরা সব নিয়েই যাবো। নামা গেলে ভালো নাহলে দূর থেকেই দেখবো। এখনই মন খারাপ করার দরকার নেই।

সিগারেট ধরাতে না ধরাতেই দরজায় ধাক্কা পড়লো। হোটেলের ছেলেটি ডাকতে এসেছে খাওয়ায় জন্য। ঘরেও খাওয়া যায়। কিন্তু আমরা ঠিক করলাম যে ওখানে গিয়েই খাবো। তবে সবে তখন রাত ৮টা। যেখানের যা নিয়ম।

খাওয়ার ঘরটি বেশ বড়। ফায়ারপ্লেসে আগুন জ্বলছে। কিছু বলার আগেই ভাত পড়লো প্লেটে। আমরা জিজ্ঞেস করলাম যে রুটি পাওয়া যাবে কি না। বলল পাওয়া যাবে, রুটিও বানানো হচ্ছে। কিন্তু বাঙালিরা ভাত খেতে পচ্ছন্দ করে তাই আমাদের প্লেটে সে আগেভাগেই ভাত দিয়ে দিয়েছে। আমাদের টেবিলেয় সামনের চেয়ারে বসলো মামা-ভাগ্নে। আমরা জানালাম যে অসুবিধা নেই কিন্তু এরপর আর ভাত নেবো না, রুটিই ভালো। মামা বলল – “তোমাদের তো দেখি সব নিয়মই ভজঘট।“ অনি বলল – “আমরাই যে ভজঘট দাদা।“ থালার পাশে রাখলো গরম ধোঁয়া ওঠা ডাল আর একটা গরম তরকারি। আহা…খুব তৃপ্তি করে খেয়ে নিলাম। ক্ষিদেটা বেশ ভালোই পেয়েছিল শুধু টের পাই নি আগে। তারপর এলো গরম মোটা রুটি আর মুরগীর ঝোল। সত্যি বলতে মুরগীর ছালটা দেখে একটু কেমন জানি লাগছিল। অনি পাশ থেকে বলল – “মাংসের দিকে না তাকিয়ে খেয়ে নে। খুঁতখুঁত করে খাস না তাহলে কালকে ভ্যালিতে গিয়ে হাগবি।“ কড়া চোখে তাকিয়ে শালা বললাম ঠিকই কিন্তু ঐ হাগুর কথাতেই কি না জানি না, মাংসটা অতটা খারাপ লাগলো না। কারণ রাস্তায় আমার হিসুও হয় না সেখানে পেট খারাপ হলে আর দেখতে হবে না।

খাওয়াদাওয়ার পরে নিচের বারান্দাতেই আমরা চারজন সিগারেট খেলাম। বাকিরা সব যে যার ঘরে চলে গেল। তবে তারাও একই কথা বলল যে আমাদের ড্রাইভারের সাথে তাদের কথা হয়েছে যে কালকে হাওয়া ঠিক থাকলে তবেই ভ্যালিতে নামা যাবে। এখন আর ভেবে লাভ নেই। মনকে সান্ত্বনা দিলাম যে বরফ ঢাকা ভ্যালি দেখতেও মন্দ লাগবে না। ঘরে এসে গ্লাস নিয়ে বসলাম। তবে ক্লান্তিতে কি না জানি না দশটা বাজতে না বাজতেই ঘুম চলে এলো। পরেরদিন সকাল ৬টায় বেরোতে হবে। বেলা বাড়ার সাথে সাথে নাকি হাওয়ার জোরও বাড়ে। কী হবে রে ভগা!

পরের দিন ৫.৩০টার মধ্যে তৈরি হয়ে নিচে চলে এলাম। কলে জল আছে কিন্তু সেটা বরফ হয়ে গেছে। তাই ঐ রানিং হট ওয়াটারই ভরসা। নিচে নেমে দেখলাম তখনও কেউ নামে নি। সারা রাত বরফ পড়েছে তাই রাস্তা পুরো সাদা। ভাবলাম দৌড়ে একবার নদীটা দেখে আসি। ততক্ষণে আরেকদফা চা দেওয়ার কথা বলা হয়ে গেছে। অনিকে বলতেই ও বলল  – “দৌড় লাগা দেখি।“ দুজনের দৌড় দিলাম ব্রীজের দিকে। নদীর পাশটা বরফে সাদা হয়ে গেলেও নদী তার মতোই বয়ে চলেছে, জমাট বাঁধে নি। আবার দৌড়ে চলে এলাম হোটেলে। বেশ ঝরঝরে লাগলো। এসে দেখি একে একে সবাই চলে এসেছে কিন্তু পাঞ্জাবী দম্পতির দেখা নেই। এইবারেও তারা দেড়ি করছে। অথচ বেলা যত বাড়বে ভ্যালিতে নামার সুযোগও তত কমবে। একটু রাগই হচ্ছিল। আমাদের চা খাওয়ার পরেও যখন তারা এলো না তখন ড্রাইভার নিজেই চলে গেল তাদের ডাকতে। কিছুক্ষণ বাদে দেখি তাদেরকে নিয়েই ড্রাইভার ফিরে আসছে।

শুরু হোলো যাত্রা। যদিও ২ ঘন্টার রাস্তা কিন্তু বরফের জন্য গাড়ির গতি কম। সব কটা জানলার কাঁচ ওঠানো। তাই হাওয়ার বেগ ভেতর থেকে বোঝা যাচ্ছে না। রাস্তার দুপাশে জমাট বাঁধা বরফ কিন্তু রাস্তার বরফ কিছু কিছু জায়গায় কাঁচের মতো। সেখানেই বিপদের আশংকা সব থেকে বেশি। খুব বেশি দূর অব্ধি দেখা যাচ্ছে না কারণ সাদা মেঘের আস্তরণে তখনও সূর্যের আলো পৌছোয় নি। যদিও পড়াশোনা করেই এসেছি কিন্তু ড্রাইভারের মুখ থেকে শুনতে বেশ লাগছিল। এই ভ্যালি বিখ্যাত প্রায় ২৪ রকম রঙের রডোডেনড্রন ফুলের জন্য। মার্চ থেকে প্রায় জুন পর্যন্ত এই ভ্যালিই হয়ে ওঠে ফুলেদের স্বর্গরাজ্য। একে বলা হয় সিকিমের কাশ্মীর। ‘দ্য ভ্যালি অফ ফ্লাওয়ার’। আমাদের বলল এখন নাকি শুধু বরফই দেখা যাবে আর কিছু নেই। কিন্তু তাকে কী করে বোঝাই যে এই বরফ দেখার জন্যই তো এখানে আসা। পাহাড়ি লোকেদের কাছে বরফ যতটা সাদামাটা একটা ব্যাপার আমাদের কাছে সেটাই এক বিস্ময়কর দৃশ্য। বাবা যখন পাহাড়ে ছিলেন তখন বাড়ি ফিরে একটাই কথা বলতেন, এখনও বলেন যে  “পাহাড় কথা বলে”। আমরা শুনে চলেছি ড্রাইভারের কথা। কিন্তু চোখ বাইরের দিকে। হাওয়া কি সঙ্গ দেবে? ভ্যালি কি ফিরিয়ে দেবে আমাদের? রডোডেনড্রন কি দেবে তার জায়গায় পদচিহ্ন দেওয়ার সুযোগ? আর কিছুক্ষণের অপেক্ষা। ভ্যালি এগিয়ে আসছে।

(ক্রমশ)

মৈ মৈত্রেয়ী। জন্ম কলকাতায়। পেশায় সিভিল ইঞ্জিনিয়ার। গদ্য ও কবিতা লেখার প্রতি দীর্ঘদিনের ঝোঁক। ছোটদের জন্য বাংলা গল্প প্রতিযোগিতায় 'অক্সফোর্ড ইউনিভার্সিটি প্রেস' থেকে সম্মানপ্রাপ্ত।

এই বিভাগের অন্যান্য লেখাসমূহ