হানিমুনে হারিকিরি (শেষ পর্ব)

মৈ মৈত্রেয়ী
গল্প, ধারাবাহিক
Bengali
হানিমুনে হারিকিরি (শেষ পর্ব)

আগের পর্ব পড়তে এখানে ক্লিক করুন

ঝকঝকে রাস্তার ওপর দিয়ে এগিয়ে যেতে যেতে যা চোখে পড়লো তাতে বুঝলাম যে, অন্যান্য জায়গার তুলনায় এখানে পর্যটকের সংখ্যা বেশ বেশি কারণ গাড়ির চলাচলটা খুবই চোখে লাগছে। এক-দু জায়গা ঘুরে চললাম খেচিপারলি লেক। তবে যাওয়ার পথে বাঁধা পড়লো। গাড়ির ভেতর থেকেই বাইরের কোলাহলের আওয়াজ আসছিল। তাই স্বাভাবিক ভাবেই গাড়ির গতি শ্লথ হয়ে এল। একটা বাঁক ঘুরে আমাদের গাড়ি দাঁড়িয়ে গেল। ডানদিকে পাহাড় আর বাঁদিকে খাঁদের ধারে লাইন দিয়ে পর পর সব গাড়ি দাঁড়িয়ে আছে। কয়েকটা গাড়ির মাঝে একটু ফাঁকা জায়গা। সেখানেই বেশ কিছু সংখ্যক লোক খাঁদের ধারে দাঁড়িয়ে, নিচের দিকে তাকিয়ে খুব উত্তেজিত হয়ে কথা বলছে। জটলার শেষে আবার গাড়ির লাইন যার শেষ দেখা যাচ্ছে না। আমি আর এগোলাম না। খাঁদ আর মৃত্যুর সম্পর্ক বড়ই সরল।

অনি এগিয়ে গেল জানতে। ফিরে এসে জানালো যে একটি প্রাইভেট গাড়ি খাঁদে পড়ে গেছে। যদিও এই খাঁদ তেমন গভীর নয় কিন্তু গাড়ির মধ্যে কেউ থাকলে, তার মৃত্যু না ঘটলেও মৃত্যুর কাছাকাছি পৌছে যেত অবশ্যই। গাড়িটি নিউট্রালে রাখা ছিল না আর তাতেই এই বিপত্তি। আমাদের ড্রাইভার জানালো যে এই গাড়ি তুলতে বেশ সময় লাগবে তাই অন্য জায়গা ঘুরে একদম শেষে এখানে আসা হবে। গাড়ি ঘুরিয়ে নেওয়া হলো। এবারের গন্তব্য ইয়াকসম।

সিকিমের প্রথম রাজধানী এই ইয়াকসম। ইয়াকসমের প্রথম যে জায়গাটা আমাদের দেখালো সেটা হলো চিত্রাভিনেতা ড্যানি এর হোটেল। গাড়ির ভেতর থেকেই হোটেলে একবার চোখ বুলিয়ে বললাম “ খায়েঙ্গে না মাথায় মাখেঙ্গে শুনি?” কানের কাছে মুখ নিয়ে অনি বলল “ চেপে যা।“ ড্রাইভারকে বলল যে, এইধরণের দর্শনীয় স্থান আর যেন না দেখায়। তারপর গেলাম হেলিপ্যাড গ্রাউণ্ডে। এইটার দৃশ্য অসাধারণ। গাড়ি থেকে নেমে দেখলাম একটা সরু রাস্তা সোজা গিয়ে অদৃশ্য হয়ে গেছে। এই রাস্তা ধরে ট্রেকাররা যোংরিতে ওঠেন। কাঞ্চনজঙ্ঘার পাদদেশে যাওয়ার সবথেকে ছোটো এবং সবথেকে সুন্দর রাস্তা না কি এটাই। আমরা শুধু চাতকের মতো রাস্তাটার দিকে চেয়ে উঠে পড়লাম হেলিপ্যাড গ্রাউণ্ডে।

ধরা যাক একটি টিটি ব্যাট, টিটি টেবলের ওপর এমন ভাবে রাখা আছে যে ব্যাটের ধরার জায়গাটা টেবিলের ওপর আর বাকি গোল অংশটা সমস্ত মহাকর্ষীয় বলকে তুড়ি মেরে উড়িয়ে দিয়ে দিব্যি টেবিলের বাইরে হাওয়ায় ভেসে আছে। হেলিপ্যাড গ্রাউন্ডটা অনেকটা ঐরকম। ব্যাটের বেধ মাপার জন্যও যদি ঝুঁকতে হয় তাহলে অতল খাঁদে পপাত চ। আর সামনে! দুপাশে! পাহাড়। বরফে ঘেরা পাহাড়। কাঞ্চনজঙ্ঘা অবশ্য ডুমুরের ফুলই হয়ে আছে। চাইলে মেঘকেও কপাৎ করে হাতের মুঠোয় ধরা যেতে পারে। ইচ্ছে ছিল পা ঝুলিয়ে বসে দুজনে আড্ডা মারবো। কিন্তু দেরি হয়ে যাচ্ছে তাই খানিকক্ষণ থেকে আবার গাড়িতে উঠে পড়লাম। এখন ভর দুপুরবেলা হলেও দিনের আলো বেশ কম। যেখানে এসে দাঁড়ালাম সেখানে আমাদের গাড়ি ছাড়া আর কোনো গাড়ি নেই। ড্রাইভার জানালো যে এই জায়গাটা স্থানীয় লোকজনের কাছে খুব পবিত্র হলেও, পর্যটকরা এখানে বেশি আসে না।

গাড়ি থেকে নেমে একটু এগিয়ে গিয়ে দুটো সিঁড়ি উঠে বিশাল গোল একটা মাঠের মতো জায়গা। তবে এই ভর দুপুরেও জায়গাটা অন্ধকারাচ্ছন্ন। আমরা ভেতরে ঢুকে গেলাম। চারপাশে পাথর, আর বিশাল উঁচু সব গাছ। ঠিক তার মধ্যিখানে গোটা রাজপরিবারের সমাধি। মনে হচ্ছিল যে এই আধোছায়ায় মাখা নির্জন পরিবেশটি যেন সোনারকাঠি রূপে রাজার সমাধির পাশে সযত্নে রাখা আছে। কথা বলা আপনা থেকেই বন্ধ হয়ে গেল। কোনো আওয়াজে যদি বনের পাখিগুলো কথা বলা বন্ধ করে দেয়! একমাত্র তাদের গানই নিস্তব্ধতার সাথে মানিয়ে যাচ্ছিল।

স্থানে স্থানে দেখা যাচ্ছে পাথরের ওপর পাথর বসানো। নিচে বড় পাথর তারপর থেকে মানানসই ছোটোছোটো পাথর। এক অদ্ভুত ভারসাম্য বজায় আছে সেই পাথরগুলোর মধ্যে। আমিও হাত লাগালাম। পাথরের অভাব নেই এখানে। অনিও আমার পাশে বসে পাথর কুড়িয়ে আমার হাতে দিতে থাকলো। একের পর এক পাথর দিয়ে গড়ে উঠলো একটা ছোটো শিলাস্তূপ। অনুভব করলাম প্রতিটা পাথর বসাতে সাংঘাতিক ধৈর্যের প্রয়োজন। এটাই হয়তো শিলাস্তুপ গঠনের প্রধান উপকরন। বেশ অনেকটা বড় হয়ে যাওয়ার পর ভাবছি যে শেষ পাথরটা বসাবো না এখানেই ছেড়ে দেব। অথচ হাতে তখনও একটা ছোটো পাথর রয়েছে। না বসানোই বোধহয় ভাল ছিল। যাই হোক, একদম উপরের ছোটো পাথরটা বসানোর সাথে সাথেই সেটা পড়ে গেল। তুলে আবার রাখতে যাব এমন সময় পেছন থেকে গম্ভীর একটা আওয়াজ ভেসে এল “ মাত রাখো।“

চমকে উঠে পিছনে তাকাতে দেখলাম একজন বয়স্ক মানুষ দাঁড়িয়ে আছেন, হাতে একটা লম্বা ঝাঁটা। মুখ দেখা যাচ্ছে না কারণ গাছের ছায়ায় মুখটা ঢেকে গেছে। দুজনেই একসাথে ঘুরে নিজেদের শিলাস্তুপের দিকে তাকিয়ে আবার পিছন ফিরে বলতে গেলাম “ কিঁউ স্যার?” কিন্তু পিছন ফিরে কাউকে দেখতে পেলাম না। খুব অবাক লাগলো। আমরা যেখানটা বসে ছিলাম তার আগে, পিছে ডাইনে বাঁয়ে শুধু গাছ। গাছের গুড়ি অত মোটাও নয় যে আড়ালে চলে গেলে তাকে দেখা যাবে না। আর চলাফেরা করলে আওয়াজ হবেই কারণ মাটিতে বিছিয়ে আছে শুকনো পাতা। আমাদেরই হাঁটতে গিয়ে আওয়াজ হচ্ছিল কিন্তু ওর আসা বা যাওয়ার কোনো আওয়াজ আমরা পাই নি। অনি আবার একটু উঠে গিয়ে দেখেও এলো, কিন্তু কোথাও কেউ নেই। এই জায়গা থেকে বেরোনোর জায়গা একটাই, যেটা দিয়ে আমরা ঢুকে ছিলাম। পুরো জায়গাটাই রেলিং দিয়ে ঘেরা। রেলিং-এর অনেকটা নিচে খালি জমি। লাফালেও আওয়াজ হবে কিন্তু সেই আওয়াজও আমরা পাই নি।  খুব অদ্ভুত লাগলো একটা জলজ্যান্ত মানুষ কীভাবে যেন কর্পূরের মত উবে গেছে! খানিকক্ষণ ঘোরাঘুরি করে আমরা বেরিয়ে এসে ড্রাইভারকে জিজ্ঞেস করলাম যে আমরা ছাড়া আর কেউ ঢুকেছিল কি না। তার উত্তর  “না”। অনি বলল যে লম্বা ঝাঁটা হাতে বয়স্ক কেউ ঢোকে নি?  ড্রাইভার জানালো যে সকালে স্থানীয় একজন এসে গোটা জায়গাটা পরিষ্কার করে কিন্তু এছাড়া সারাদিনে আর পরিষ্কার হয় না। এবার ড্রাইভার আমাদের জিজ্ঞেস করলো “ কিঁউ স্যার?” আমরা উত্তর দিলাম না। কী উত্তর দেব সেটাই তো বুঝতে পারি নি। যাই হোক, ড্রাইভার আমাদের দিকে অদ্ভুত ভাবে তাকিয়ে রইলো কিছুক্ষণ তারপর বলল “ চালিয়ে সাব, লেক যাতে যাতে শাম হো জায়েগা।“ আমরা উঠে পড়লাম গাড়িতে। গাড়িতে আর এটা নিয়ে আলোচনা করলাম না। বাঙালি পর্যটকের ভিড়ে, অন্য রাজ্যের লোকেরা মোটামুটি সবাই বাংলাটা বোঝে।

লেকে আসতে আসতে সন্ধে হয়ে গেল। খাঁদে পড়ে যাওয়া গাড়িটা আর নেই আর এখানেও আমরা ছাড়া আর কোনো পর্যটক নেই। গাড়ি থেকে নামতে নামতে ড্রাইভার বলল যে, আমরা যেন তাড়াতাড়ি ফিরে আসি। সন্ধের পর জায়গাটা ভাল নয়। আমরা এগিয়ে যেতে যেতেই শুনি, মনেস্ট্রির ঘন্টার আওয়াজ। পিছন থেকে ড্রাইভার চিৎকার করে বলল যে আমরা যেন এই লেকটাকে ঘড়ির মতো করে প্রদক্ষিণ করি অর্থাৎ, বাঁদিকে থেকে ডানদিকে।

যত এগোচ্ছি, ডানদিকের জঙ্গল ঘন হচ্ছে। বাঁদিকেও জঙ্গল তবে সেটা অনেকটা ঘাসের মতো। কথিত আছে যে খেচিপারি লেকের চারপাশে এত গাছপালা থাকলেও লেকের জলে একটাও পাতা পড়ে থাকতে দেখা যায় না। পাতা পড়লেও পাখিরা সেটা মুখে করে নিয়ে তুলে ফেলে। অদ্ভুত রহস্য আছে এই লেকের। আমরা এগিয়ে চললাম কিন্তু লেকের দেখা নেই, পাখিরাও বোধহয় ঘরে ফিরে গেছে। অনি খালি বলছে “মৈ ফিরে চল সামনে কিছু দেখা যাচ্ছে না, অন্ধকার হয়ে আসছে।“ আমার মধ্যে তখন তুমুল লড়াই চলছে। কে যেন ভেতর থেকে বলছে ‘সামনেই লেক, এগিয়ে চল।‘ আর সেই টানে আমি এগিয়ে চলেছি। মোহমুগ্ধের মত হেঁটেই চলেছি অথচ নিজে জানি যে সামনে গেলে বিপদ। কীসের বিপদ জানি না কিন্তু অনুভব করছি যে সামনে এগোলেই এমন কিছু আছে যার জন্য পরে পস্তাতে হবে। অথচ আমি থামতে পারছি না। সমস্ত দেহ ছেড়ে দিয়েছে অন্য একজনের হাতে, সে টানছে আর আমি তাকে অনুসরণ করছি। অনি পিছন থেকে বলেই চলেছে “ মৈ ফিরে চল, প্লিজ। আর এগোস না। “ আমি খালি বলছি “ আরেকটু প্লিজ…আরেকটু এগোলেই…”

কতক্ষণ বাদে জানি না অনি বলল “ ঐ দেখ লেক।“ বলার সাথে সাথে ভেতর থেকে যেন একটা জোর ধাক্কা খেলাম। বুঝলাম এগিয়ে যাওয়ার শক্তির থেকে এই শক্তির জোর এই মুহূর্তে সাংঘাতিক তীব্র। লেক আমার চোখে পড়ে নি কিন্তু এক লহমায় পিছন ফিরে বল “ ফিরে চল, পিছনে তাকাস না। সোজা হাঁটা লাগা।“ বেশ খানিকক্ষণ বাদে বেরিয়ে এসে গাড়িতে উঠে পড়লাম। অনি বলল “ তুই দেখেছিলি লেক?” আমি মাথা নাড়লাম।

-“তাহলে! আমার কথাতেই ফিরে এলি?”

– “ হ্যাঁ রে। তবে কেস অন্য।“

হোটেলে ফিরতে ফিরতে অনেকটা দেরি হয়ে গেল। দেরি মানে ওদের ভাষায় দেরি আমাদের কাছে তখন সবে সন্ধে ৭টা। হাতে মুখে জল দিয়ে এককাপ চা নিয়ে বসে অনিকে সবটা বললাম। অবাক হওয়ার কারণ যথেষ্টই আছে। আমি বললাম “ তুই কেন বারবার ফিরে আসতে বলছিলি বল তো? তোরও কি মনে হচ্ছিল যে সামনে বিপদ আছে?”

“ধুর…আমি ভাবছিলাম জঙ্গল থেকে যদি ভাল্লুক নেমে আসে? সেই ভয় বলছিলাম ফিরে চল।“

“হরি হে”

শোন না একটা কথা ছিল।

বলে ফেল।

কালকে তো ৯ তারিখ তাই কালকে যদি আমরা হোটেলেই কাটাই সারাদিন তোর আপত্তি আছে?”

আমি তো খুব খুশি। একের পর এক যা অভিজ্ঞতা হচ্ছে তার থেকে ঘরে বসে আড্ডা মারাটাই ভাল হবে।

এইবার ৯ তারিখের ইতিহাসটা একটু বলি। অনি আমাকে প্রপোজ করেছিল ২০০৪-এর ৯ই ডিসেম্বর। খানিক ভেবে আমি উত্তর দিয়েছিলাম ৯-ই ফেব্রুয়ারি। যদিও তারিখ মিলে যাওয়াটা পুরোটাই কাকতালীয় কিন্তু তারপর থেকে এখনও, প্রতিমাসের ৯তারিখটা আমরা নিজেদের মতো করে আনন্দ করি আর ডিসেম্বর এবং ফেব্রুয়ারি মাসে বেশ বড় করে পালন করা হয় এই ৯ তারিখ। আগামীকাল যে ৯তারিখ সেটা মাথাতেই ছিল না। সেই রাতটা খেচিপারির আর ঐ লোকটার কথা বলতে বলতে কেটে গেল।

ছোটখাটো মুহূর্তগুলোই সম্পর্কের গভীরতা মাপার জন্য যথেষ্ট। সকালে আড়মোরা ভাঙতে না ভাঙতেই অনি উঠে বাথরুমে গেল। দেখা দেবে কি! এই ভেবে উঠে, এগিয়ে গিয়ে জানালার পর্দা সরাতেই…বুদ্ধ শুয়ে আছেন। প্রতিটা ভাঁজ, প্রতিটা খাঁজ, প্রতিটা চূড়া সুস্পষ্ট। চিৎকার করে উঠলাম “ অনিইইইইইইই, তাড়াতাড়ি বেরওওওও।“ মিনিটখানেকের মধ্যে বেরিয়ে অনি বলল “ জোরে পেয়েছে না কি রে? “ আমি ডেকে বললাম “এইখানে আয় আগে”।

প্রায় তিন মিনিট ধরে দেখলাম সেই অপূর্ব দৃশ্য। অনি বলল “ হ্যাপ্পি 9th ।“ ওর কাঁধে মাথা দিয়ে বললাম “এটা সেরা উপহার হলো রে।“ চোখ সরাতে পাচ্ছিলাম না, আবার যদি ঢেকে যায়! তারপর ধীরে ধীরে মেঘ উঠে এল বুদ্ধের গায়ে। তিনি চাদর চাপা দিলেন।

সেই দিনটা সারাদিন দুজনে গল্প করেই কাটালাম। দুপুরে খাওয়ার পর পায়ে হেঁটে  ঘুরে এলাম কিছুটা। সন্ধেবেলা গাড়ির ড্রাইভারকে বললাম যে আগামীকাল আমরা আবার বেরবো।

কোনো কোনো জায়গায় আওয়াজকে খুব অসহনীয় বলে মনে হয়। আমরা চুপ করে থাকতে জানি না, আমরা মিশে যেতে পারি না, আমরা অনুভুতিকে উপলব্ধি করার সময় দিই না। অথচ ঝর্ণায় হাত ডুবিয়ে দিব্যি বসে থাকা যায় ঘন্টার ওপর ঘন্টা, জলের ঝাপটায় শরীর মিশিয়ে অন্তর দিয়ে কথা বলা যায় তার সাথে, শীতল জলে স্নায়ুর উত্তেজনাকেও স্পর্শ করা যায়। কিন্তু নাহ…আমরা এইসব করি না। অসহ্য অট্টহাসি, ফটো তোলার জন্য নিজের সাথে সাথে প্রকৃতির মানহানি করতেও আমাদের বাঁধে না। তারমধ্যেই যতটুকু সম্ভব আড়ালে গিয়ে পাহাড়ের সৌন্দর্যকে উপলব্ধি করে ফিরে এলাম হোটেলে। এসে শুনি, পরশু থেকে অনির্দিষ্ট কালের জন্য পাহাড়ে বনধ। আমাদের ফোনে পায় নি তাই হোটেলে ফোন করে গোপুকাকু জানিয়েছেন যে আমরা যেন কালকেই পাহাড় থেকে নেমে যাই। বাসের ব্যবস্থা হোটেল থেকে করে দিতে পারবে কারণ গাড়ি এই সময় পাওয়া যাবে না। তাই হোটেলের কাঁধেই বাসের দায়িত্ব চাপিয়ে, ঘরে এসে জিনিসপত্র গুছিয়ে নিলাম। আবার একগাদা ব্যাগ। উফফ! খুব শিক্ষা হয়েছে। ৯০শতাংশ জিনিস বেরই করা হয় নি। বেকার বেকার এতগুলো ব্যাগ বয়ে নিয়ে এসেছি।

বাসে উঠে দেখলাম সাংঘাতিক ভিড়। আমাদের সিট বুক করা ছিল তাই রক্ষে। তবে বাসটা বড্ড ছোটো। পর্যটকেরা বসার জায়গা পেয়েছে ঠিকই কিন্তু স্থানীয় লোকজনের সংখ্যাই বেশি। পাহাড়ি রাস্তায় দাঁড়িয়ে যাওয়াটা খুব কষ্টকর। বেশ খানিকক্ষণ বাদে আরেকটা জায়গায় বাস থামলো। বলা হলো যে এই বাসটা আর যাবে না তবে আমাদের যা টিকিট তাতে আর আলাদা করে টিকিট কাটতে না হলেও অন্য বাস বুক করার জন্য লাইনে দাঁড়াতে হবে। ঝামেলা আর কাকে বলে। মালপত্র নিয়ে বসে রইলাম স্ট্যান্ডে। অনি গেল বাস বুক করতে। গাড়ির নাম্বার  পাওয়ার পর আবার বাসে উঠে বসলাম। সেই বাসেই দেখা হলো নাথুলার আরেক দম্পতির সাথে। তাদের আরও তিনদিন থাকার কথা ছিল। ট্রেনও সেই ভাবে বুক করা ছিল কিন্তু পাহাড়ে আর থাকতে দেবে না তাই নেমে আসতে হলো। বনধ হলে পাহাড়ের মানুষদেরই খাওয়া পরার চিন্তা হয়ে যায় সেখানে পর্যটকের দেখভাল করা মুশকিল। যাই হোক, এটা বড় বাস তাই গাদাগাদিটা একটু কম হলেও ভিড় এখানেও আছে। বেশ খানিকটা যাওয়ার পর আবার বাস দাঁড়িয়ে পড়লো। সত্যি বলতে এইরকম অভিজ্ঞতা আগে হয় নি তাই একটু চিন্তায় ছিলাম। বেশ খানিকক্ষণ বাদে দেখলাম এক অদ্ভুত দৃশ্য। বাসের সামনে আর পিছনে দুটো দুটো করে আর্মির জিপ এসে দাঁড়িয়েছে। বাস চলতে শুরু করলো। নিজেদের ভি আই পি মনে হচ্ছিল ঠিকই কিন্তু বুকটা যে দুরুদুরু করছিল, সেটা অস্বীকার করার উপায় নেই। সেবক রোডে পড়তেই চোখ ছানাবড়া হয়ে গেল। যতদূর চোখ যায় শুধু গাড়ি, বাস আর মাঝে মাঝে আর্মি ট্রাক আর জিপ। গোটা পাহাড় মানে দার্জিলিং থেকে শুরু করে সিকিম পর্যন্ত যত পর্যটক ছিল তাদের একসাথে পাহাড় থেকে নামিয়ে আনা হচ্ছে এবং সেটার জন্য যে পরিমাণ সুরক্ষা নেওয়া হচ্ছে সেটা দেখার মতো। আগেই বলেছি যে এই ধরণের কোনো অভিজ্ঞতা আগে ছিল না তাই প্রকৃতিকে দেখব কী!  এ যে এক অভিনব ব্যাপার! হঠাৎ করে পাহাড় কাঁপিয়ে একটা আওয়াজ হলো। ভাবলাম গেল বুঝি। সব গাড়িগুলো দাঁড়িয়ে গেল একসাথে। অত লোক বাসে কিন্তু কারুর মুখে কোনো শব্দ নেই। সবাই আতঙ্কিত। বেশ খানিকক্ষণ বাদে ড্রাইভার জানালো যে সামনের কোনো গাড়ির টায়ার ফেটেছে। হরি ! মনে মনে বললাম আর কিছু ফাটিস না বাপ এতেই রক্ত জল হয়ে গেছিল ভয়। তবে যতটা সময় লাগার কথা তার থেকে অনেক কম সময় আর্মির লোকেরা গিয়ে গাড়িটাকে সাহায্য করলো, টায়ার পাল্টাতে। গাড়ি আবার ছাড়লো। ৪.৩০ ঘন্টার রাস্তা পার হলাম ৮ ঘন্টায়। সকাল ৮টায় বাস ছেড়েছিল সেটা যখন শিলিগুড়ি পৌছলো তখন বাজে বিকেলে ৫টা। গাড়ি থেকে নেমেই অনেকে ছুটলো যার যার জায়গা অনুযায়ী বাসের টিকিট বুক করতে। অনেকে আবার শিলিগুড়ির হোটেলে যাওয়ার জন্য রিক্সা বা অটো ধরলো।

আমাদের জন্য কাকু গাড়ি পাঠিয়ে দিয়েছিলেন তাই আমাদের আর রিক্সা বা অটো খোঁজার জন্য দৌড়দৌড়ি করতে হলো না। বিনা ঝঞ্ঝাটে হোটেলে পৌছে, কাকুর সাথে কথা বলে হোটেলের রুমে পা ছড়িয়ে বসলাম। অনি দেখি এক বালতি উষ্ণ গরম জল পায়ের কাছে এনে বলল “ পাটা ডুবিয়ে বস, আরাম পাবি।“

এই আমাদের হানিমুনের গোটা ঘটনা। দুই বন্ধুর প্রথম ঘুরতে যাওয়ার গল্প।  সেই চোখ, অদৃশ্য কুকুরের কান্না, অ-দেখা ব্যক্তির আওয়াজ আর সামনের অদ্ভুত হাতছানি যে আমাদের ঘোরাটাকে আরও স্মরণীয় করে তুলেছিল সেটা আর বলার অপেক্ষা রাখে না।  তবে এমন কিছু ফেলে এসেছিলাম যেটা পরে আর ফিরে পাই নি। গোপুকাকু মারা গেছেন ক্যানসারে আর সবথেকে উল্ল্যেখযোগ্য যে বাবা মন্দির যাওয়ার দিন পর্যন্ত কোনো স্টিল ফটো আমাদের কাছে নেই মানে নষ্ট হয়ে গেছে। তবে সর্বোপরি এটা বুঝেছিলাম যে দুজনের জুটিটা মন্দ হয় নি।

(সমাপ্ত)

মৈ মৈত্রেয়ী। জন্ম কলকাতায়। পেশায় সিভিল ইঞ্জিনিয়ার। গদ্য ও কবিতা লেখার প্রতি দীর্ঘদিনের ঝোঁক। ছোটদের জন্য বাংলা গল্প প্রতিযোগিতায় 'অক্সফোর্ড ইউনিভার্সিটি প্রেস' থেকে সম্মানপ্রাপ্ত।

এই বিভাগের অন্যান্য লেখাসমূহ