হাসপাতালের সেইসব রাত

সাজিদুর রহমান
কবিতা
Bengali
হাসপাতালের সেইসব রাত

হাসপাতালের সেইসব রাত

আগ্রাসী বিপ্লবী কবিতা না লিখতে পারার ব্যর্থতায় মেঝে ভাসিয়ে রক্তবমিতে ভাসিয়ে যাবো মাটির কার্পেট, হাসপাতালের ভ্যাবসা গা গুলিয়ে আসা বেডে শুয়ে শুয়ে করুণ চোখে,
কার্নিশে, জানালার বাইরে ল্যাম্পপোস্টের দিকে মানুষের কোলাহল দেখতে দেখতে হাঁপিয়ে গেলে একসময়
স্যালাইন ডুকিয়ে শিরায় শিরায় কেটে যাবে জোনাকীহীন রাত!সে রাতে ঈশ্বর নেমে আসবে চোখে, আমি হয়ে যাবো রক্তহীন কলম!

কলমের নিভে “তুমি” এক অমর নিভবল!

দুই

দাঁড়াও জোনাকী আজ রাতে কথা আছে,
ভীষণ ভীষণ জরুরী কথা!

ভেঙেছে ফুটপাত–হাসপাতালে এখন আমি ব্যর্থ কাঁধে শুয়ে আছি
শুয়ে আছি মাথায় নিয়ে হাতুড়ি কাস্তে–আমি কমরেড!পাঞ্জাবির হাতা গুটিয়ে, কপালে ক্ষতের মুখে পটির সিল মেরে কাল সন্ধ্যায় ঝাঁপিয়ে পড়বো অনাহত মিছিলে!

ভেঙেছে ভায়োলিন –সুদূঢ় প্রেমিকার স্তনে–শুনতে পাচ্ছো জোনাকি?কান পেতে রাখো নষ্ট ট্যাবলেটের খোঁসায়–
শোনো আজ তার সন্তান প্রসবের দিন–কি ব্যাথা তার দেহ জুড়ে, চেতনায় তার অমলিন নৃত্য ঠাঁসা!তুমি কি শুনতে পাচ্ছো ধাত্রীর উল্লাস?

ভেঙেছে স্বপ্ন –হাসপাতালের বিবর্ণ আবেগী বেডে!
নার্সের হাতে তিনবেলা সুনীল ওষুধ, বিলাসী জেলের গরাদে
কোমাগত পাগলার পাশে শুয়ে শুয়ে কি লিখে যাবো জোনাকি আমি?কি লিখে যাবো কৃতদাসের ছেঁড়া হাফশার্টে?

কি ঘুমে শুয়ে থাকবো সপ্তসিন্ধুর অতৃপ্ত জল্লাদের করাতে?
কি ঘুমে শুয়ে থাকবো নিঃশব্দ হাসপাতাল,কাকে হারাতে?

তিন

শুয়ে আছি হাসপাতালের বেডে –
কাঁচের ঘরে,
দৃশ্যত যা কোমা,নাকে অক্সিজেনের মাক্স!
বুনো শেয়ালের হাঁকের মতো বুকের বাঁ ধারে সিনগ্যাল দিচ্ছে বিপন্ন স্বদেশ–
মরে যাবে!
খালি হয়ে যাবে নদী নালা!
নার্স,আমাকে যেতে দিন কবরের কাছে,
খুলে ফেলুন আমার রক্তের ব্যাগে মিথ্যা বলে যে প্রেম ভরে দিচ্ছেন দেহে,
ছিঁড়ে ফেলুন নাকের সুঁচালো বেঁচে থাকার প্রতিজ্ঞা,
বিপ্লবী হাত থেকে ব্যান্ডেজ খুলে ফেলুন
বুকের যে স্থান দিয়ে বেরিয়ে গেছে কবিতার বুলেট ও বটগাছ–
গুঁজে দিন সেখানে ছাঁই, বাষ্পীভূত অপার্থিব বৃক্ষ!
যেতে দিন সিলিফিসের নিয়নের তলে ওষ্ঠে জেগে আছে যে শহর
উপকূলের ওপর আঁচড়ে পড়া ঝড়ের ইশারায় আমার চোখ থেকে খুলে ফেলুন জোনাকির জলপটি!
থার্মোমিটার নামিয়ে ফেলুন জিভ থেকে,
অভ্যাসের দিকে ছুঁড়ে দিন রমনীর কপালের ভাঁজে দুঃখিত চিলেকোঠা!
বস্তুত আমি এখন কোমায়
কাঁচের ঘরে
থরে থরে সাজানো অত্যাধনিক মরাণাস্ত্রের বৃদ্ধ স্রোতের নিচে শুয়ে
লিখেছি কবিতা আজ ঋদ্ধ ঘাতকের বুকে!

স্বপ্নের মধ্যেও একজন কমরেড কি করে মেনে নেবে স্বদেশের বুকে জানোয়ারের চোখ,ভয়াল থাবা!

চার

মাথার ভেতরে নেমেছে রাত
গিলে খাবো ওষুধ, লাশের নামে স্বপ্ন
গিলে খাবো বুক পকেটে জমিয়ে রাখা তোমাকে
(গিলে খাবো অসংঙ্গত কবিতার লাইন
গিলে খাবো তোমার শরীর,আপাদমস্তক ভায়োলিন!)

মাথার ভেতরে রাত নেমেছে দ্যাখো–
হাসপাতালের ট্যাবলেটের চাপা গন্ধ,
দুস্থ রোগীদের পচাঁ হাত ভাগবাটরা করে নিচ্ছে পিশাচের ছাঁয়া
(নগরে বন্ধরে ঘুমিয়ে গেছে ততক্ষণে নিয়নবাতি
বদ্ধ রাত কাটে নিশ্চুপ,দেয়ালে ভাঙনের শব্দে কান পাতি!)

মাথার ভেতরে নেমেছে রাত
শুয়ে আছি কাঁচের ওপর ভাঙাচুরা দেহে
স্বেচ্ছামৃত্যু বেছে নিয়ে জোনাকি মরে যাবে আজ রাতে
স্বেচ্ছামৃত লুফে নিয়ে পায়রা উড়ে যাবে আজ রাতে
(স্বেচ্ছা ভাঙনে তালাকের স্ট্যাম্পে ছাড়াছাড়ি হবে বসবাস
মাথার ভেতর রাত নেমেছে,জমে গেছে একা থাকার অভ্যাস!)

মাথার ভেতরে রাত নেমেছে
হাসপাতালে নিভেছে আলো
মেঘবৃষ্টিরর বদলে চোখের মনিতে বিদ্যুত চমকালো!

দূরে কোথায় মানুষের নামে অভিশাপ দিয়ে যাচ্ছে একটানা একটা কুকুর–
দূরে কোথায় মানুষের নামে ঘৃণা জমাচ্ছে হাড়সদৃশ শেয়াল,
পথ ভুলে গেছে নদীর স্রোত, পথ ভুলে গেছে খেয়াল!

মাথার ভেতরে রাত নেমেছে আজ,
হাসপাতালে মানুষের নামে শুয়ে আছি আমি মরা পেঁচা
মাথার ভেতরে আকাশ ভেঙেছে আজ
অসুস্থের নামে এই তো জীবন–মরে মরে বেঁচে থাকা!

পাঁচ

২০ নাম্বার মর্গ থেকে
অশনাক্তকৃত লাশের কটু গন্ধ চুইয়ে আসছে রক্তের ভেতর!

মাঝরাতে আমি কবিতার বই খুলে বসি!

হাসপাতাল কেঁপে ওঠে নিশ্চিত ভয়ে–
কাটা মাথায় বসে থাকে দুঃখী শিশু
নয়মাসের ধর্ষিতা নবজাতক ফ্যাল ফ্যাল করে দ্যাখে আমায়,
জনসম্মুখে রাষ্ট্রের তালুতে খুন হওয়া প্রেমিক
গলার সেলাই টেনে টেনে ছিঁড়ে ফ্যালে,
কুটিল দাতে আমার দিকে তাকিয়ে হাসে বিচারের প্রতীক্ষায় অনশনে ঠেসে যাওয়া বারুদ মুখ!

মাঝরাতে আমি তখন কবিতার বই খুলে বসি!

মর্গ থেকে ছুইয়ে আসে চিৎকার
বিলাপের তরল চমকানো নাট্যসংলাপ
বেওয়ারিশ লাশগুলো উঠান দিয়ে খালি পায়ে
আসে,বসে
আমার পাশে
অনেকের গলা থাকে না,
ঝলসে গেছে মুখ অনেকের,
এসিডের দাগে ছাই হয়ে গেছে বখাটের হাতে উড়ন্ত যুবতী!

মাঝরাতে আমি কবিতার বই খুলে বসি!

রক্তের সাথে আমার শিরায় চুইয়ে ঢুকে পড়ে গগনবিদারী প্রতিরোধ
মর্গ থেকে উড়ে আসে বিল্চিং
কোল্ডস্টোরেজ থেকে থোকা থোকা বরফ নেম আসে গলায়
হাসপাতালটা অত্যন্ত ভয়ে কাপেঁ যেন
আমি মর্গের পাশে শুয়ে থাকি মাঝরাতে
তখন আমার কবিতা পড়ার সময়!
এগারো পারা কবিতা পাঠের বাকি!

আমি ব্যান্ডেজ খুলে উঠে পড়ি বিছানায়
মাঝরাত
বিশ নাম্বার মর্গ থেকে ছেড়া জুতো চুইয়ে আসে আমার রুমে
মাঝরাত
উলঙ্গ রুপলী শরীর ব্যালকনি দিয়ে খোঁজে থ্যাতলা স্বামীর আঙুল
মাঝরাত
আমি বিছানায় রক্ত খুলে উঠে বসি
আমার তখন কবিতা পাঠের সময়!

আমি জেগে উঠি
কবিতা পাঠ করি, মাঝরাত কবিতা পাঠের সময়!
আমি রক্ত দিয়ে
বেয়ালিশ লাশেদের টোকেনে লিখে রেখে আসি স্বদেশহারা কবিতার একেকটা ভয়াল শিরোনাম!

সাজিদুর রহমান। কবি ও শিক্ষার্থী।

এই বিভাগের অন্যান্য লেখাসমূহ

ঝরা পাতা

ঝরা পাতা

  চারিদিকে কোলাহল শূণ্যতা করেছে গ্রাস, বেদনা বিধুর অতৃপ্ত বাসনায় হাহাকার, অজান্তে নীরবতা তোমার স্পর্শে…..