হিমাদ্রী চৌধুরীর ছয়টি কবিতা

হিমাদ্রী চৌধুরী
কবিতা
Bengali
হিমাদ্রী চৌধুরীর ছয়টি কবিতা

যেহেতু তুমি কথা বলতে চাও

যেহেতু তুমি মানুষের কথা বলবে — তোমাকে সাহসী হতে হবে আরো
কয়লার আগুন বিছানো পথে মিছিল নিয়ে এগুতে হবে নির্ভীক।

তোমাকে প্রস্তুত হতে হবে, ভুলে যাও তুমি —
আঘাতের ব্যথা

পরাধীন স্বাধীনতায় তোমার স্বদেশের কর্কট রোগ; শাদা কবুতরহীন আকাশ তার

“জীবনের অপব্যাখ্যায় মৃত্যুর মানে ম’রে যাওয়া” — এমন তত্ত্বকে পা’য়ে পিষে
তুমি ফুলের মিছিলে শহীদ হয়ে যেও; আফসোস নেই।

তবুও তোমাকে পাড় হতে হবে পোতা মাইন
সজোরে লাত্থি মে’রে গুড়িয়ে দিতে হবে টর্পেডো, ব্যারিকেড, সাজোয়া ট্যাঙ্ক
তোমার দৃষ্টিতে থাকবে আগুন আগুন খেলা
ইশারায় ভূপাতিত হবে মিগ 29.

যেহেতু তুমি শুদ্ধতার কথা বলবে — ওরা তোমাকে সন্ত্রাসী বলবে, বিচ্ছিন্নতাবাদী আখ্যা দেবে
উড়োচিঠি, কাফন, মামলা, ডিজিটাল আইসিটি অধ্যাদেশ অক্টোপাশের মতো তোমাকে জড়িয়ে ধরবে।

টর্চার সেলে তোমাকে রুটির মতো বেলা হলেও তুমি হটে যেওনা
তুমি বিশ্বাস করোনা সমঝোতায়, তুমি আস্থা রেখোনা আশ্বাসে
তুমি স্লোগাণ তুলো, প্রয়োজনে মরতে মরতে স্লোগাণ তুলো…

কবে কখন কোথায় যুদ্ধ শেষ হয়েছিলো বলো?
কবে কখন কোথায় থেমে গিয়েছিলো বিষাক্ত বাতাস?
যেহেতু তুমি ন্যায্যতা, সত্য, এবং মানুষের পক্ষে কথা বলতে চেয়েছো
পাখির ঝাঁকের মতো অজস্র বুলেট অবধারিত ভাবেই ধে’য়ে আসবে

সুতরাং তুমি ভুলে যাও — মৃত্য বলে কিছু আছে
তুমি প্রস্তুত হও দ্বিতীয় যাত্রার
নেরুদার মতো তুমিও চপাটাঘাত করো
লোরকা মতো তুমি চিৎকার করো

আগুন বিছানো পথে, শাদা কবুতরহীন আকাশের নিচে — পাখির ঝাঁকের মতো বুলেট,
চোরা মাইন, টর্পেডো, সাজোয়া যান কে অগ্রাহ্য করে দালালের হাড়ের উপরে এসে দাঁড়াও ;
স্লোগানের ঝান্ডা তুলে ধরো, ছিনিয়ে আনো কাঙ্ক্ষিত সূর্যোদয়।

জীবন মোমবাতির মতো — তবুও তুমি মানুষের মুখে মুখে গান হয়ে ছড়িয়ে পড়বে ধুলোয় ধুলোয়, জলকাদায়, অসীম আকাশের মহা বিস্ময়ে।

লাথি

মূহুর্তের চাকা ঘুরতে না ঘুরতেই ঝ’রে পরে অজস্র ফুল, আবার শূন্যস্থান জুড়ে জন্ম নেয় নতুন পুষ্পোদ্যান

পথিকের পায়ে হাঁটা পথ বদলে হয়ে যায় হাসপাতাল, ব্রোথেল, নাগরিক যানজট,
প্রার্থনাসভা, শস্যভূমি, শ্মশান…

মিছিল বদলে যায় কনসার্টে
ধর্ম হয়ে উঠে রক্তের মিনার
ঈশ্বর বিভাজিত হয় দৃশ্যে-অদৃশ্যে
মানুষ ই প্রভু, আবার প্রভুই নির্ধারণ করে মানুষের দাসত্ব

অরণ্যের এই পৃথিবীতে বৃক্ষের লাশে ছয়লাব
আধুনিক শহর
ইট-পাথুরে অট্টালিকায় শ্রমিকের রক্তের চুনকাম

বদলে গিয়েছে
বদলে যাচ্ছে
বদলে যাবে

মনে পরে লেলিনের কথা
মনে পরে মাও সে তুং কথা
মনে পরে আর্নেস্তো চে, ফিদেল কাস্ত্রো

বিপ্লবের স্লোগান চুর্ণ হচ্ছে শোষনের জাতাকলে
কালো হাত গুলোর অধিকারে চলে গেছে রাষ্ট্র
শাসকের সংবিধান পাঠ করছে টর্চাচসেলে

যে’দিকে চোখ যায় — কেবল সাম্রাজ্যবাদী প্রভূদের পতাকা
আর্তনাদ – মূকাশ্রু – যন্ত্রণার ক্যাকটাস

বদলের ধর্মেই বদলে যাবে সব।

কবিতার রঙ বদলে যাবে, দৃষ্টিতে আগুন, অশ্রুর বদলে পেট্রোল নেমে আসবে পৃথিবীর কোণায় কোণায়
শোষিতের হাত হবে গদাধর ভীম

সেদিন সাম্রাজ্যবাদের পোঁদে লাথি দিয়ে
শেকল ভাঙার গান গাইবে মানুষ।

 

চিত্র

সমবেত উল্লাসে রাষ্ট্রের মৃত্যুশোক এক ফেরারি পাখি
প্রকাশ্য দিবালোকে চাপাতি হয়েছে হত্যার চারুকলা
অন্ধ আইনের ফাঁদে বিচারালয়ে চাপা কান্নার সাইরেন
তবুও বিকানো আঙুল লিখে দেয় রায় বেকসুর ফয়সালা।

অজস্র রক্তের স্রোতে অর্জিত এই স্বদেশের পতাকায়
হামলা মামলা গুম খুনে কাঁদে ভূলুন্ঠিত
মানবতা
সবুজ শ্যামল রুপসী বাঙলার রূপ হয়ে গেছে চুরি
দূর্নীতি আর দুরাচিত্রের তাপে বাতাসের আহাজারি।

রক্ত ঘামের স্বাধীনতায় আজ কালো-বাজারির থাবা
পার্লামেন্টে ধোঁকা পাস হয় যেন দেশের মানুষ হাবা
জাল জুয়োচুরি মিথ্যে আশায় নিদ্রা হয়েছে
লুট
কৃষকের বুকে দাঁপিয়ে বেড়ায় পুঁজিবাদী কালো বুট।

মরছে মানুষ খুব মারছে ওরা পাখির হিসেব মেনে
জ্বলছে আগুন মানচিত্র জুড়ে জ্বলছে আগুন প্রাণে।

স্বচ্ছ আলপনা

কোন অপরিচিত সংলাপের ভিড়ে নিজেকে শরীরশূন্য মানুষ মানুষ লাগে

সবাই সবার দিকে তাকায়, কথা বলে, হাসে,
যত্ন করে রুমালে পুষে রাখে ঘাম।

শ্বাস আছে
আশ আছে
কাম জাগে
প্রেম ছোঁয়

তবুও — পথিমধ্যে জুতো হারানো যুবকের মতো
উদ্বাস্তু মনে হয় এই বাঁচা

কারো উচ্চারণের আদি বাক্যে নাই
ফুলের হাসিতে কিংবা রংধনুতে নাই
আশায় নেশায় দিশায় প্রবাহে নাই
চুম্বনে জ্বলে ওঠা আগুন স্নানে নাই
বে-ওয়ারিশ টিস্যুর লিপস্টিকে নাই

থমকে যাওয়া বাতাসের অট্টালিকার চূড়ায় বসে
বয়সের সমান অভিজ্ঞ পেন্সিলে তির্যক উনুনের গল্প লিখে নিম বনের সুস্থতার মন্ত্র জপি।

একদা আমার হাতেও রং-পেনসিল ছিলো
অজানায় এঁকেছি কত মেরিলিন মনরো সুস্মিতা সেন, দেহ চুল্লীর মশাল, গজা বিস্কুট, রাজা কনডোম

জিপার বিহীন প্যান্টে ওরা স্বর্গ দেখে হেসে উঠতো, ছোট মজা খালে মাছের স্বজাতি হয়ে
খুলে দিতাম আশ্চর্য ভূলোগ

সময়ের ডাস্টারে মুছে গ্যালো কত কাল — মুছে যাবে দৌঁড়াতে থাকা পৃথিবীর পা।

বৃক্ষ স্বভাবের এই আমায় কেউ অকারণ দেখেনা আর উচ্ছ্বাস ভাঙা পদ্মের পাতায়
নিভন্ত চুল্লীর মতো আমি জমা করছি স্বীয় ছাই, স্মৃতির কয়লায় সেই স্বচ্ছ আলপনা।

 

 (অ)দরকারী

মগজ ভর্তি সব অদরকারী শব্দ
প্রতিনিয়ত বাদ দিচ্ছি, ভুলবার চেষ্টায় মুছে দিচ্ছি
তবুও কিছু তার কাদায় মাছের মতো গা ঢাকা দ্যায়, আড়াল থাকে।

পৃথিবীতে শব্দের মতো যৌনকাতর এবং উর্বর গর্ভাশয় নেই
আলো ও অন্ধকার; যুগপৎ(এ) — সঙ্গম সাড়ে

অযাচিত স্মৃতি, বেয়াড়া দুঃখ, ক্ষোভ, হতাশা
সহ নানাবিধ কথামালার জন্ম হয়

আবার উকুন বাছার মতো আমিও শব্দ বাছি ;
মুছে দিই, ফেলে দিই
মাথা ব্যথা হয়ে, ভনভন করে মাছিদের ভাষায়
ওসব আমি বুঝিনা।

একদিন নিজেই নিজের মগজ খুলে বসে
পেট্রোল দিয়ে জ্বালিয়ে দেবো — (অ)প্রয়োজনীয় শব্দগুচ্ছ, ফোল্ডারে জমা স্মৃতি হতাশা এবং তুমি প্রাসঙ্গিক ডালপাল।

 

ইচ্ছে

প্রার্থনার মনুম্যান্টে দাঁড়িয়ে আমার
লাশটি সবুজ পায়রা হয়ে উড়ে যাক

কবর বলে কিছু না থাকুক
না থাকুক কোন এপিটাফ
কেবল মানুষ বুকের দ্রাঘিমা জুড়ে —

উড়তে থাকুক
উড়তে থাকুক উড়তে থাকুক
সেই পা য় রা…

হিমাদ্রী চৌধুরী। কবি ও শিক্ষার্থী। জন্ম ও বাস বাংলাদেশের ঢাকায়। লেখাপড়া করছেন ইংরেজি সাহিত্যে। তিনি স্বপ্ন দেখেন পৃথিবী হবে ক্ষুধা ও বৈষম্যমুক্ত। তিনি বিশ্বাস করেন, ভুল বোধের প্রাচীর ভেঙে একদিন আলো আসবেই।

এই বিভাগের অন্যান্য লেখাসমূহ

ঝরা পাতা

ঝরা পাতা

  চারিদিকে কোলাহল শূণ্যতা করেছে গ্রাস, বেদনা বিধুর অতৃপ্ত বাসনায় হাহাকার, অজান্তে নীরবতা তোমার স্পর্শে…..