হৃদয়ের কথার শিল্পিত প্রকাশই কবিতা: শামসুর রাহমান

জুনান নাশিত
সাক্ষাৎকার
Bengali
হৃদয়ের কথার শিল্পিত প্রকাশই কবিতা: শামসুর রাহমান

কবি শামসুর রাহমানের সাক্ষাৎকার:

হৃদয়ের কথার শিল্পিত প্রকাশই কবিতা: শামসুর রাহমান

আমাদের প্রিয় কবি শামসুর রাহমানের শ্যামলীর বাড়িতে গিয়েছি বেশ ক’বার। প্রায় প্রতিবারই কুশল বিনিময় আর টুকটাক কথা ছাড়া তেমন কোন আলাপ জমেনি তাঁর সাথে। এর কারণ হয়তো ওনাকে একা না পাওয়া। অথবা কারণ আমারও কারো না কারো সঙ্গী হয়ে তাঁর কাছে যাওয়া। অথচ কবির সঙ্গে কবিতাসহ নানা প্রসঙ্গে আলাপ করার ইচ্ছে। একদিন সাহস করে একাই চললাম কবির বাড়িতে। কথা বলতে, আলাপ করতে, প্রিয় বিষয় কবিতা সম্পর্কে জানতে।

সেই একদিন ২০০০ সালের অক্টোবরের ৭ তারিখ। কবির জন্মমাস। ১৯২৯ সালের ২৩ অক্টোবর কবির জন্মদিন। কিন্তু আমি যখন সাক্ষাতকারটি নেই তখন পর্যন্ত কবির কোন মৃত্যুদিন ছিলনা। এখন সেটি ২০০৬ সালের ১৭ আগষ্ট। এ দিন কবি আমাদের সকলকে শোকগ্রস্ত করে পাড়ি দিলেন পরপারে।

যাবার আগের দিন টেলিফোনে কথা বলে সময় ঠিক করে নিয়েছিলাম। কথামতো সকাল ১০ টার দিকে কবির বাড়ি গিয়ে সোজা চলে গেলাম দোতলায়। দেখলাম কবি বসে আছেন তাঁর পড়ার টেবিলে। কবির শোবার ঘর। মাঝখানে বিছানা। চারপাশে বইয়ের শেলফ। দরোজা লাগোয়া পড়ার টেবিল। কবি স্মিত হেসে জিজ্ঞেস করলেন, কেমন আছো? বললাম, ভালো। আপনি কেমন আছেন? জিজ্ঞেস করতেই পেছন থেকে কে যেন বললো, শরীরটা ভালো নেই ওনার। শর্দি লেগেছে। সে সঙ্গে কিছুটা শ্বাসকষ্ট। পেছন ফিরে দেখি তাঁর পুত্রবধূ টিয়া দাঁড়িয়ে। চোখাচুখি হতেই কুশল বিনিময় হলো ওনার সঙ্গে। বললেন, কবি বেশিক্ষণ কথা বলতে পারবেন না। কষ্ট হয় ওনার। ‘বেশি কথা বলবো না, আশ্বস্ত করলাম’।

কিন্তু যে’কটি প্রসঙ্গে কথা বলবো ভেবেছিলাম শেষ পর্যন্ত শরীর বেশি খারাপ হয়ে পড়ায় তা আর হলো না। তিনি অনবরত কাশতে লাগলেন। কথা বলছেন আর রুমাল দিয়ে শর্দি মুছছেন। একপর্যায়ে আর পারলেন না। আমাকেও থামতে হলো। ভেবেছি পরে আবার যাব। কিন্তু আর হয়ে উঠলো না।

তবু যা বলতে পেরেছি তাই পাঠকদের সঙ্গে শেয়ার করতে ইচ্ছে হল। কিন্তু প্রশ্ন, এতোদিন পর কেনো? সহজ সত্যটিই বলছি। ফাইলটি খুঁজে পাচ্ছিলাম না। কী করে কীভাবে যেন অনেক কাগজের ভিড়ে তলিয়ে ছিল। শেষ পর্যন্ত পেলাম। এটুকুই স্বস্তি। -জুনান নাশিত

প্রশ্ন: কবিতা প্রসঙ্গে আপনার ভাবনার কথা জানতে চাই। কিছু শুনতে চাই।

শামসুর রাহমান:  কবিতাতো মানুষের ভাষা নিয়ে লেখা। সেই ভাষা যা দিয়ে মানুষ প্রকাশ করে তার জীবনের কথা। তার বোধের কথা, অনুভবের কথা। তার আশা-নিরাশার কথা। স্বপ্ন ও দুঃস্বপ্নের কথা। আসলে কবিতা জীবনের মতই অশেষ। এর কোন সীমা নেই। তবে কবিতা একেক জনের কাছে একেক রকম। কেউ কেউ বলেন, Best words in best order is poetry.   আসলে কবিতা পুরোপুরি তাও না। কবিতা আরো ব্যাপক এবং অপরিসীম। ভাষার মাধ্যমে মানুষের হৃদয়ের কথা, ভাবনার কথা শিল্পিত উপায়ে প্রকাশ করাই হলো কবিতা।

প্রশ্ন: কবিতায় প্রাণ প্রতিষ্ঠা জরুরি নাকি অলংকার?

শামসুর রাহমান: দুটোর কোনটাকেই আলাদা করা সম্ভব নয়। একজন সুন্দরী নারীর নাক, মুখ আলাদা করে নিয়ে যেমন কোন সৌন্দর্য খুঁজে পাওয়া যাবে না তেমনি কবিতার ব্যবচ্ছেদ ঘটিয়ে কোন পূর্ণাঙ্গ কবিতা পাওয়া সম্ভব নয়। যদিও সমালোচকরা তা করতে চান। কবিতায় অলংকার যেমন দরকার তেমনি সবার কথা হতে হলে কবিতার প্রাণটাও লাগবে। অলংকার তার সঙ্গে এমনভাবে মিশে যাবে যা কোনভাবেই আলাদা করা যাবে না।

প্রশ্ন: তথ্য প্রযুক্তির এ যুগে কবিতা কি তার নিজস্বতা হারাবে?

শামসুর রাহমান: কবিতা ততদিনই থাকবে যতদিন মানুষ মানুষ হিসেবে পৃথিবীতে বেঁচে থাকবে, যন্ত্র হিসাবে নয়। মানুষের কিছু কিছু স্বাভাবিক বোধ যেমন- ভালোবাসা, ঘৃণা, প্রেম এগুলো আগেও ছিল। এখনও আছে। থাকবে। বোধ একই থাকবে কেবল এর প্রকাশভঙ্গি বদলাবে। সেজন্যে কবিতাও থাকবে। হারাবে না। কেবল কবিতার ধরন পাল্টাতে পারে। তবে আমি আরো মনে করি বোধের ধরন যেভাবে পাল্টাতে পারে তেমনি নতুন বোধেরও সৃষ্টি হতে পারে। তাই বলে কবিতা গন্তব্যহীন হয়ে পড়বে এটা আমি বিশ্বাস করি না। কারণ কবিতা সবসময়েই কতিপয় লোকের মাঝেই ছিল, যা এখনো আছে।

প্রশ্ন: হালের পোস্ট মর্ডানিজম প্রসঙ্গে যদি কিছু বলেন। 

শামসুর রাহমান: কবিতায় বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন ধারণা আসতেই পারে। হয়তো ভবিষ্যতেও এ ধারণা পাল্টে আরো অন্য কিছু আসতে পারে। যে আন্দোলন, যে ধারণাই কবিতায় থাকুক না কেন সর্বোপরি একটি কবিতাকে আগে কবিতা হয়ে উঠতে হবে। কবিতা যদি কবিতাই না হলো তাহলে যে কোন আন্দোলনই অসাড় হয়ে যাবে।

প্রশ্ন: কবিদের সামাজিক দায়বদ্ধতা রয়েছে, এ কথায় আপনার বিশ্বাস কতোখানি?

শামসুর রাহমান: কবিরা কবি হলেও মানুষ। মানুষ হিসাবে তার পরিবার, তার সমাজ, তার স্বসমাজের প্রতি একটি দায়িত্ব রয়েছে তা ঠিক। তবে একজন কবি যখন টেবিলে বসে ঘাড় ঝুঁকিয়ে কবিতা লেখাতে মগ্ন থাকেন তখন তিনি একেবারে নিঃসঙ্গ এবং তার প্রতিবেশ, পরিবেশ থেকে বিচ্ছিন্ন থাকেন, ঠিক ওই সময়ে একজন কবি তেমনভাবে দায়বদ্ধ থাকেন বলে আমি মনে করি না। কিন্তু আবার যখন আমি টেবিল ছেড়ে পরিবারের কাছে যাচ্ছি, সমাজের কাছে যাচ্ছি তখন অনেকটা দায়িত্ববান আমাকে হতে হয় বৈকি! কিন্তু কবির কবিতা লেখাটাই মুখ্য কাজ বলে আমি মনে করি। অন্যান্য আর কিছু কাজ হিসেবে দ্বিতীয়।

প্রশ্ন: সাম্প্রতিক কবিতা বিষয়ে আপনার ভাবনা জানতে চাই।

শামসুর রাহমান: সব যুগেই অনেকেই এক সঙ্গে লেখেন। কিন্তু সবাই সমান প্রতিভাবান থাকেন না। এর মাঝে ক্ষমতার তারতম্য থাকে। কারো লেখার হাত বেশ ভালো থাকে কারো তেমন থাকে না। এ সময়ের কবিতা সম্পর্কে আমি আশাবাদী। কারণ মানুষের যাত্রাতো কোথাও এসে থেমে যায় না। যাত্রা এগিয়ে যায়। তবে সত্যিকারের সাধক পথিক সব সময়ই কম। ধারা বজায়ের জন্য অনেকেই থাকেন। শেষ পর্যন্ত বিশেষ কাউকে শনাক্ত করার জন্যে পাওয়া যায়  হাতে গোণা ক’জনাকে।

প্রশ্ন: কবিতা লিখতে এসে কাক্সিক্ষত কোন গন্তব্যে পৌঁছাতে পেরেছেন বলে কি মনে করেন?

শামসুর রাহমান: দীর্ঘসময় ধরে কাব্য চর্চা করে আসছি ঠিক, তবে গন্তব্যে পৌঁছেছি কিনা বলতে পারবো না। আমি এখনও হাঁটছি। এ হাঁটা নিরন্তর। প্রথম জীবনে কবিতা লেখার শুরুতে অনেকেই ছিলেন। কিন্তু ওই যে বললাম সার্থক পথিক সবাই হতে পারে না। আমাদের সময়ে অনেকেই লিখতেন। তবে বিশেষভাবে একজন মেয়ের কথা আমি বলবো, যিনি ঐ সময়ে বেশ ভালো লিখতেন। কেন লেখা ছেড়ে দিলেন আমি জানি না। কিন্তু লেখার হাত খুব ভালো ছিলো। তার নাম লতীফা রশীদ। আমার লেখা ছাপা হওয়ার পরে ঢাকা থেকে যে দু’জন মানুষ প্রথম চিঠি লিখে তাদের ভালো লাগার কথা জানান তাদের একজন এই লতীফা রশীদ। অন্যজন শরফুল হক। যিনি শৈলী পত্রিকা সম্পাদনা করেন। লতীফা রশীদের কোন সংবাদই এখন আমি জানি না।

– শেষ

জুনান নাশিত। কবি ও সাংবাদিক। জন্ম ১লা অক্টোবর ১৯৭৩ সালে কুমিল্লায়। লেখকের প্রকাশিত বই: কাব্যগ্রন্থ: কুমারী পাথর (২০০১), অন্য আলো অনেক দূরের (২০০১), পলকাটা অন্ধকার (২০০২), বাতাসে মৃত্যুর মায়া (২০০৫), কাঁটাঘন চাঁদ (২০০৮), জলন্ত ভ্রুণ (২০১২)। প্রবন্ধ: রবীন্দ্রনাথ: রোগশয্যায় (২০১১,...

এই বিভাগের অন্যান্য লেখাসমূহ

বেশিরভাগ সাংবাদিকই রাজনৈতিক দলের করুণাপুষ্ট – শাকুর মজিদ

বেশিরভাগ সাংবাদিকই রাজনৈতিক দলের করুণাপুষ্ট – শাকুর মজিদ

শাকুর মজিদের নানা পরিচয়। পেশায় স্থপতি হলেও নাট্যকার, কথা সাহিত্যিক, আলোকচিত্রী, চলচ্চিত্র নির্মাতা হিসেবেও তাঁর…..