হেমন্তের কবিতা

দেবাশিস মুখোপাধ্যায়
কবিতা
Bengali
হেমন্তের কবিতা

হেমন্তের কবিতা

আলতো করে অক্ষর সরাই
তবুও বেশ শব্দ
মর্জিনার ঘুম ভাঙতে ভাঙতে
শিউলিতলার অন্ধকার
টুপ শোনে
আর ভেজা ঘাসের খুব আরাম
গরুর ক্ষুরে চটকে যায়
আঁচলভর্তি আজান
মন্দিরের সাদা সিঁড়িতে উপুড় শিখছে
এখানে কোথাও হেমন্ত নেই

 

দুই.

ভিড় থেকে সরে এক ভোরে পৌঁছালে
মাথাভর্তি শালুক নিয়ে জলক্ষেত
রাত্রির সব ক্ষত ধুয়ে দেয়
তারপর সে অনাবিল হাসি ফোটানো
চা বালক
তার ছেঁড়া গেঞ্চিতে দেশের ম্যাপ
দেখায়
যা চলে গেছে তার পেট পর্যন্ত
আগুনের তীব্র আঁচ অস্বীকার করে
সেও যেন কোটি টাকার লৌহ পুরুষ
বোকা বোকা বকগুলি এখানে ওখানে
মেয়ে মাছ খোঁজে চুমুর খাতিরে
তার সবুজ পৃথিবীর ওপর পাথর
আর ইট আর কাচের জানালার পাশে এক দীর্ঘ নালা মাছিদের ডেকে রুপকথার গল্প শুরু করে
মমতাময়ী যেভাবে শিশুভুলানো
ছড়া ছড়িয়ে সম্মোহন করে রাখে
নর্দমার কীট
হে গান কোথায় বাজে বুকে বুলেট এঁকে
এ কোন সকাল ….

 

তিন.

নীরবতার মধ্যে একা ছেড়ে আসছে স্টেশন
ঘোষণাহীন তার আসার দিকে
চেয়ে আছে নেড়িকুত্তার দল
বন্ধ দোকানের ঝাঁপের নীচে
গুটিশুটিমারা ভবঘুরে

বৃষ্টির জলে ভেসে আসছে তার কালো মুখ
গত ঘূর্ণিবায়ুতে হারিয়ে যাওয়া
প্রেমিকার কথা ভেবে
সে তার ভিতর ঘরে বাজিয়ে যাচ্ছে
ভায়োলিন

তার মাথার কাছে উড়ে গেল চামচিকে
কিছু শ্যামাপোকা
মরাঘাসের রাস্তায় ভেজা পায়ে
সে এঁকে নিচ্ছে ভবিষ্যৎ

একটা পাকা চালার ঘর
তার জন্য লিখছে
আপাতত নামহীন একটা ছোটগল্প

 

চার.

চোখের জানালায় বসে আছে বিড়াল
পাখিদের কুয়াশা নিয়ে নিলে
অপেক্ষায় থাকি কেউ গলিয়ে
দেবে রোদের কাগজ

খুলে দিচ্ছ মেলার খাতিরে
সেসব বাস যার ভেতরে
তোমার আমার গন্ধ মিশে আছে
একটা ছাদের তারে
বেজে উঠেছে পাহাড়ের গান
খুব দূর বাতাসে

শীত এসে গেছে
শুয়ে থাকা লেপ কম্বলে
তাদের তুলে থাকা কথায়
তানপুরা সেলাই করছে
নতুন কাপড়ের গন্ধ

 

পাঁচ.

দেয়ালের গল্প দোয়েলের হতে পারে না
রাত্রি এক দীর্ঘ সংলাপ
হলুদ পাখি মেয়েটি সেখান থেকে
বেরিয়ে এলে
ডানার সম্পর্ক বুঝিয়ে দেয়
কিছু ছিঁড়ে আসা পালক
উড়তে উড়তে নদীর কাছে
আটকে থাকা পাথরের
বুকে জীবাশ্ম
পারি না ফিরিয়ে দিতে হারানো
উদ্যানে বকুলের গন্ধ
বাবুই বাসাগুলি ক্রমশ ইতিহাস
স্মৃতির ঝুলনায় মাঝে মাঝে
দোল খায় রঙের উৎসব ছাড়াই
এই যে কবিতায় মেলানকলি
বাজাচ্ছে কেউ
তুমি তাকে মায়ের ছায়া দাও
যমের দুয়ারে কাঁটা দিয়েও
যারা ফিরল না
তাদের জন্য একটা অশ্রু নদী গাও

ছয়.

তাড়াহুড়োর কাছে কুয়াশামাখা ভোর রাখি
বেরিয়ে আসতে গিয়ে বেড়া
ভাঙতেই হয় ভালোবাসার
ঘুমগুলি ফুটতে পারে না
চা চুমুর স্বপ্নে
ও গো পাখি তুমি পশমিনার
আদরে অস্থির রাখো ডানা
তোমার ঠোঁটের কাছে বাতাস
শচীন কত্তার বোল ধরে
রঙ্গিলা

আলো এলো ফুলের গা পথে
এতো হাসি নাচের মুদ্রায়
বাহবা বাহবা বা পদ পেয়ে যায়
বাইরে বেরিয়ে এলে নদী
এই যে পাহাড় রাজা
মনে হচ্ছে সরু পথের শেষে
একটা ঝরণা না রে না রে বলে
নাচ দিচ্ছে
তাকে দিলাম একটা সমবেত মুগ্ধতা
বেরিয়ে আসার মানে

 

সাত.

কান পেতে থাকি হেমন্তে
ডাক আসতেই থাকে
অন্ধকার জানাজার নামাজের
ঘুঘু আর কাদাখোঁচা বকের
ফুটতে ফুটতে আলো
ধরে টুপ করে ঝরে হলুদ ফুল
ট্রেন আসার শব্দ তাকে
ঢাকতে পারে না যতটা মেখেছে শিশির
শির নামিয়ে দেখি জল রোদে
সে ঝিকমিক
হারমনিয়ামের পাশে কাশির শব্দ
বাজাচ্ছে শীত আসার সংবাদ
পাশ দিয়ে ভ্যানওয়ালা চলে গেলে
খবরের কাগজের পড়ার জোর
কলে জল এসে ধুয়ে দেয়
না খেতে পাওয়া মানুষের মৃত্যুগল্প
আর পাশের ফসলহীন ক্ষেত
কিছুই ফাটাতে পারে না
শব্দবাজি ছাড়া
চুপরাতে কোন দূর সমুদ্রের কান্না
ঘুমুতে দেয় না
শরীরের জমা জল বেরিয়ে যায়

আট.

শালুকমাখা কুয়াশা এখনও আলোর মুখ দেখে নি
বৃহস্পতিবার বন্ধ দোকানের
ঝাঁপের কাছে গামছামুড়ি মানুষ
ঘুমের উপর রোদের স্বপন
মাছি উড়িয়ে নিয়ে যাচ্ছে
গাছের ভিজে পাতার নীচে
হলুদ মুখো পাখি ঠোঁট দিয়ে
বসে আছে সঙ্গিনীকে
রাখালহীন গরুর পিঠে কাক
চষে ফেলছে শূন্য ক্ষেত
আর কলতলা থেকে যে মেয়েটি
জল নিয়ে দেখিয়ে গেল তার ভাঁজ
তার চোখের নীচে কালশিটে
কাল রাতে মারা শাঁখামুটি এখনো
রাস্তায় গাড়িতে পিষে পিষে পেষ্ট
চারপাশে কার যে চোখের জল
আটকে রাখে পুকুরের জালে
মুক্তি নেই বিড়ি খেতে খেতে বলে
বলরাম পাল
তার সাথে ধোঁয়া আর কুয়াশা
পাশাপাশি বসে দেখে
অস্পষ্ট দাহকার্য কাছারি শ্মশানে

 

নয়.

খোলা জানালায় পুকুর মাছরাঙা
জালের শরীর ঝেড়ে ফেলতেই
কিছু মুক্তি চোখের সিনেমার
মার কথা আসতেই আবার জল
কল্পনায় হামা দেয় হামলা জমাতে
মাতে মাতোয়ারা প্রায় একটি
ছায়া থেকে চায় ছায়াছবিতে
এমন স্নেহময় আশ্রয় সব জানালা
টেনে আনে ঘুঘু শালিক পায়রা
আবার খুলে পরিয়ে দেয় ডানার নুপূর পুরবাসী জাগো বলে
বলের রঙ পাল্টাতে থাকে ক্রমশ
শব্দ দিয়ে তৈরি হয়ে যায় বাঁশিওয়ালা আর রাজহাঁসগুলি
লম্বা গ্রীবা তুলে হেঁটে যায় আলপথে সকালের সুবর্ণে উজ্জ্বল
জলমাখা ঘাস জলফড়িং খেলায়

 

দশ.

সমুদ্রের বাড়ি থেকে নীল
পরিস্কার দেখতে পাও তুমি
শুধু ধরা পড়ে যায় স্বল্প বসনে
জল হয়ে যাওয়া
একটা রাসের চাঁদ আর তুমি
কোথায় যেন এক
আর হারিয়ে যাবার পর
একটা বিরাট শূন্য

এতটা হাহাকার জমতে পারে না
যখন গল্প
হাঁটি হাঁটি করে পরিণত
ক্লাইম্যাক্স এর কাছে পৌঁছনোর পর
হা হা করে হেসে ওঠে
জোকারের আলখাল্লা
খোলা গা বেগমকে বোঝাই
দিনকাল
ভালো নয় বলার কেউ নেই
এই মজা স্রোতে

দেবাশিস মুখোপাধ্যায়। কবি। জন্ম ভারতের পশ্চিমবঙ্গরাজ্যের কলকাতার কুলটিতে এবং বর্তমান নিবাস হাওড়ার বাগনান। তাঁর কবি জীবন শিশুকাল থেকে। কলকাতার ইন্দ্রাণী পত্রিকায় ১৯৮৩ সালে দশম শ্রেণিতে লেখাপড়াকালীন তাঁর প্রথম কবিতা প্রকাশ হয়। প্রকাশিত বই: কবিতার একখণ্ড মুখ, আজকাল পরশুর গল্প, শূন্য কিন্তু শূন্য নয়, ভূমিকা প্রেমের...

এই বিভাগের অন্যান্য লেখাসমূহ

ঝরা পাতা

ঝরা পাতা

  চারিদিকে কোলাহল শূণ্যতা করেছে গ্রাস, বেদনা বিধুর অতৃপ্ত বাসনায় হাহাকার, অজান্তে নীরবতা তোমার স্পর্শে…..

ফ্রেম

ফ্রেম

দেবী না পরিণীতা রাতটা একা থাকে এবং নিঃসঙ্গ অন্ধকার মানে রাত; তাহলে অন্ধকার নিজেও একা…..