হয়তো প্রেমের গল্প

ভজন দত্ত
ছোটগল্প
Bengali
হয়তো প্রেমের গল্প

একেকটা সময় আসে মানুষের জীবনে যখন ন্যায় আর অন্যায় একাকার হয়ে যায়।একটা উজ্জ্বল আলোর মধ্যেই ঘাপটি মেরে থাকে অন্ধকার। এই যে আকাশ পুজোয় বউকে উপহার দিয়েছে যে নতুন গাড়ি, সেটাই নিজে ড্রাইভ করে ওর বউ মেয়েকে নিয়ে বেড়াতে চলেছে দুদিনের জন্য বাঁকুড়ার শুশুনিয়া পাহাড়ে। তারজন্য কত প্যাকিং করেছে জয়শ্রী! খুটিনাটি সব ওদের জন্য ওদের একমাত্র মেয়ের জন্য।

জয়শ্রী কি জানে, আকাশও গোপনে প্যাকিং করেছে এক বিষধর শঙ্খচূড় সাপ! ওই সাপে কামড় দিলে নির্ঘাত মৃত্যু। একটু দেরি হলে অ্যান্টিভেনমও কাজ করবে না। শুনেছে, শুশুনিয়ার এদিকে এরকম সাপও আছে। তাই…

বাঁকুড়া শহর ঢুকতে ডানদিকের বাইপাস দিয়ে সতীঘাট হয়ে কাঠজুড়িডাঙা হয়ে শহরটা পার হতে হতে একটা বাসকে ওভারটেক করার সময় আকাশ দেখল বাসের ওপর থেকে একটা বাচ্চা মাথা বাড়িয়ে বমি করছে। সেদিক থেকে চোখ সরিয়ে গাড়িটাকে যতটা সম্ভব ডানদিকে নিয়ে গিয়ে পার হলো যে গ্রামটি বোর্ডে লেখা তার নাম আঁচুড়ি। ডানহাত স্টিয়ারিংএ রেখে বাঁ হাতের আঙুল দিয়ে মাথার চুল ঠিক করে নেয় ও। চণ্ডিদাসের লীলাভূমি ছাতনা আরেকটু পথ গেলেই। মনে পড়লো, বাংলা কাব্যসাহিত্যের ইতিহাসে শ্রী কৃষ্ণকীর্তনের ভূমিকা নিয়ে আজ আর কোনো বিতর্ক নেই।

একে একে গৌরীপুর কুষ্ঠাশ্রম, শালবনি পার হয়। এশিয়ার সর্ববৃহৎ কুষ্ঠ রোগীদের হাসপাতাল। ছাতনা বাইপাশ ধরে সাঁ সাঁ করে আগিয়ে যায় আকাশের ছোট্টগাড়িটা।

সেই কোন সকাল সাতটায় ওরা বর্ধমান থেকে বেরিয়েছে। জলখাবারও খেয়েছে রাস্তাতেই। আকাশের ছোট মেয়েটা বার কয়েক বমি করে পিছনে মায়ের কোলে ঘুমিয়ে পড়েছে। বেচারা, মনে মনে বলে আকাশ। পিছনে বসে থাকা জয়শ্রীকে উদ্দেশ করে বলে, আর বেশী দূর না। এই তো আর মিনিট কুড়ি। ছাতনা বাইপাশ ধরে মেনরোডে উঠে একটু ডানদিকে গিয়ে বাঁদিকের শুশুনিয়া যাওয়ার রাস্তা ধরতেই আকাশ শিস দিয়ে গান ধরলো, ‘চলতে চলতে মেরে ইয়ে গীত…।’

দুই

পাহাড়ের উল্টোদিকে বেশ মনোরম পরিবেশ এই গেস্ট হাউসটার। সামনে অনেকটা ফাঁকা জায়গা। সেখনা কয়েকটা দোলনা বসানো। বাহারিয়া গাছের পাতাগুলো রোজ ধোয়া হয় এখানে। চকচক করছে সব। শীত পড়েনি এখনো। অক্টোবরের দিনের বেলায় চড়া রোদ আর ভোর রাতে একটা ঠাণ্ডায় ঘুম ভেঙে চাদর টেনে নেওয়া আবহাওয়া।

আকাশ থাকে ব্যাঙ্গালোরে। কম্পিউটার সায়েন্স অ্যান্ড ইঞ্জিনিয়ারিং কমপ্লিট করে ক্যাম্পাস থেকেই একটা আইটি কোম্পানিতে জয়েন করে। কোম্পানি বদল করে করে আজ বেশ উঁচু পদমর্যাদা ও মোটা স্যালারির জব করে। বিয়ে করতে দেরি হলেও পঁয়ত্রিশের মধ্যেই সেরে ফেলেছে। ছত্রিশেই পাপা বন গয়া। জয়শ্রীর সঙ্গে ওর প্রথম আলাপ ফেসবুকে। সেখান থেকেই মন দেওয়া নেওয়া করে দুই বাড়ির সম্মতিতে ধুমধাম করে বিয়ে। বিয়ের আগে, পরেও অনেকবার আকাশ বলেছে জয়শ্রীকে, চাকরি ছাড়ার কথা। প্রতিবারেই জয়শ্রী দৃঢ়ভাবে বলেছে,’না তা সম্ভব না।’

আকাশ চেয়েছিল সারাদিন খাটাখুটি করে ক্লান্ত হয়ে ব্যাঙ্গালোরের বিশাল ফ্ল্যাটটায় যখন সে ফিরবে, তখন ভাববে কেউ তার প্রতীক্ষায় আছে ভেতরে। ছোট্ট নরম দুটি তুলতুলে হাত তুলে টলমল পায়ে তার দিকে আগিয়ে আসবে তার সন্তান, তার আত্মজ। আদরে আদরে ভরিয়ে দেবে তাকে।

আজ তিন বছর হোলো ওদের বিয়ে হয়েছে। সেসব স্বপ্ন আকাশের পূরণ হওয়ার নয় এখন জেনে গেছে সে। রাতে অফিস থেকে ফিরে নেশার গ্লাস নিয়ে রোজ স্কাইপেতে মেয়ের সঙ্গে, বউয়ের সঙ্গে সময় কাটায়। তারপর পনেরোশো স্কয়ারফুট জুড়ে নেমে আসে চাপ চাপ অন্ধকার। দীর্ঘশ্বাসে বিষাক্ত হয় ঘর। মনের মধ্যে তুফান উঠে। শরীর-মন কাছে পেতে চায়  জয়শ্রীকে। দুহাতের স্পর্শ দিয়ে জয়শ্রীকে আদর করতে করতে নিজেকে সম্পূর্ণ সমর্পন করতে চায়। হয় না। আর ঠিক এই ফাঁকে ব্যাঙ্গালোরে তার এক পুরনো কলিগ কাম বান্ধবীর সঙ্গে নিবিড় হয় সম্পর্ক। নানান কথার পর আসে আদর। একে অপরকে দেখার  স্পর্শ করার তীব্র বাসনা জাগে। এখন সে সব ছেড়ে ব্যাঙ্গালোরে আকাশের সঙ্গেই থাকে। লিভ টুগেদার করে। আজ একমাস হোলো, এখনো কেউ জানে না। সম্পূর্ণ গোপন রয়েছে মিতু। অসম্ভব তার আকর্ষণ, মায়াবী আবেদন। জয়শ্রী যা দিতে পারেনি, তার যেসব অপূর্ণতা, তার সব পূর্ণ করেছে মিতু। মিতু চাকরি থেকে ছুটি নিয়ে আছে এখন। মেডিক্যাল লিভ। বলেছে সব ছেড়ে দেবে মিতু মা হলেই। আকাশ ঠিক করেছে সে মিতুকে মাতৃত্ব দেবে, স্ত্রীর মর্যাদা দেবে। কিন্তু জয়শ্রী! কী বলবে তাকে, কীভাবে বলবে সে কথা! ওর কোনো ত্রুটি তো খুঁজে পায় নি সে। ভেবেছিল ফেসবুকে ওর প্রেম আবিষ্কার করে ওকে নাস্তানাবুদ করবে। হ্যাক করেছিল ওর অ্যাকাউন্ট। কিছুই পায় নি। চ্যাটে দেখেছিল, ওর পুরনো বন্ধুদের সঙ্গে গল্পে তার কত টান সংসারের প্রতি। মেয়ের জন্য সে জীবন দিতে পারে। আকাশের কাছে থাকতে না পারার কষ্টটাও জানিয়েছে ওর এক বন্ধুকে।

আকাশ ভাবে, তবে, কীভাবে সরাবে ওর আর মিতুর মধ্যে কাঁটা দু’টিকে।

তিন

শুশুনিয়া পাহাড়টাকে দূর থেকে দেখলে মনে হয় যেন এক বিরাটকায় হাতি, সামনে পা ছড়িয়ে বসে আছে। আকাশ ঘড়ি দেখে এখন রাত প্রায় একটা। চারপাশে ঝিঝি পোকার আওয়াজ ভেসে আসছে। কোথাও কোনো শব্দ নেই। এত নিঃশব্দ স্থানে নিয়ে আসার জন্য জয়শ্রী আজ নিজে থেকেই ওকে অনেক অনেক আদর করেছে। আকাশ তবু কিছুতেই আজ ওর দৃঢ়তাকে খুঁজে পায় না। অতৃপ্ত জয়শ্রী এখন মেয়েকে জড়িয়ে ঘুমের দেশে।

এত নিঃস্তব্ধতার মধ্যে হিসহিস শব্দটা শুনতে পায় আকাশ। অজানা আতঙ্কে সে কেঁপে কেঁপে উঠে। আজ যতবার জয়শ্রীকে জড়িয়ে ধরে গভীর চুম্বন করেছে। প্রত্যেকবারই ওর মনে হয়েছে জয়শ্রীর জিভটা যেন শঙ্খচূড় সাপটার জিভ। সে ঠেলে সরিয়ে দিয়েছে জয়শ্রীকে। বিবাহিত জীবনে কোনোদিন এত অবাক হয়নি জয়শ্রী। আকাশ ভয়ে হাঁপাতে হাঁপাতে সঙ্গে আনা মদের বোতল থেকে সরাসরি গলায় ঢেলে নিয়েছে। সে আজ প্রথম মাতাল হয়েছে জয়শ্রীর কাছে। জয়শ্রী অবাক হয়ে দেখেছে। এই আকাশ! এত অচেনা কীভাবে হয় একটা মানুষ! ছোট একটা বাচ্চার সামনে মানুষ কীভাবে এমন আচরণ করতে পারে! ভাবতে ভাবতে একসময় সে মেয়েকে জড়িয়ে ঘুমিয়ে পড়ে।

মাতাল আকাশ আস্তে আস্তে আগিয়ে যায় হিসহিস শব্দ ওঠা সেই ব্যাগটার কাছে…

এই বিভাগের অন্যান্য লেখাসমূহ