ফিরে এসো
আমার বাবা ছিলেন অত্যন্ত সাহসী একজন লড়াকু মনের মানুষ।শত অভাব অভিযোগেও তাকে কোনোদিন ভেঙ্গে…..
রুদ্রের মুখের দিকে ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে আছে রোদেলা। তার চোখদুটো ঠিকরে পানি গড়িয়ে পড়ছে। বৃষ্টির ফোঁটা নয়, শিশির দানার মতো ওজনদার সে জলের ফোঁটা, একদম স্বচ্ছ কোয়ার্টজ এর মতো।
টিউশনের কাজটা এখনো সে ধরে রেখেছে, যেমন করে মা ধরে রাখে তার সন্তানের হাত। এটুকু যে তার নিজেকে জানান দেয়ার একমাত্র উপায়। চুপচাপ মরার মতো পড়ে থাকে সে সংসারের আনাচে-কানাচে, তবু সপ্তাহে পাঁচদিন একদল বাচ্চাদের পড়ায় রোদেলা। উপার্জন যা, তা দিয়ে শোধ করে নিতে পারে সংসারে তার এখনো উপস্থিত থাকার ভাড়া। ছেলেটা ছোট, দশ বছর হলো কেবল। এখনো অনেকটা পথ টেনে নিতে হবে সময়ের সাথে পাল্লা দিয়ে। থমকে দাঁড়াতে হয় প্রায়শই রোদেলাকে অবহেলা-গ্লানিতে। আবারো নিজ গায়ের জোরেই উঠে দাঁড়াতে হয়। মাঝেমাঝে রোদেলা ভাবে, পৃথিবীর সব মানুষ যদি একদিন এক পা’য়ে হাঁটতো, তবে কেমন দেখাতো পৃথিবীটা?
-সারাদিন তো শুয়েই থাকো! ভাতটা চড়াতে পারোনি?
-শরীরটা ভালো লাগছিল না।
-শরীর কবে ভালো লাগে তোমার? বছরের কোনদিন তোমাকে ভালো দেখি? এ আমার কপাল!
-ভাত ছিলো তো ফ্রিজে। খেয়ে নিতে পারতে।
-কাজ থেকে ফিরে আমাকে কাল রাতের ভাত খেতে বলছো?
তোমার আর কী কাজ? এক ক্রাচ নিয়ে ফ্লোরে ঠকঠক করা আর নিচের তলার ভাড়াটের অভিযোগ শোনা। ভাতটা বসাতে পারোনি তুমি?
রুদ্রের এমন মেজাজ আজ নতুন নয়। ঠিকঠাক মতো খাবার তৈরি না হলেই তার মেজাজ চরম খারাপের দিকে যায়। তাছাড়া, চাইলেও সে রোদেলাকে ছাড়তে পারছে না। বিয়ের সময় রোদেলার পরিবার তাকে ব্যবসা শুরু করতে আর্থিকভাবে পুরোটাই সাহায্য করেছিল। যে বাড়িটাতে আজ তারা থাকে, সে বাড়িটাও রোদেলার নামেই তার বাবা রেখে গেছেন। রুদ্রের বিবেক তাই মাঝেমাঝে মাথা নাড়া দেয়, রোদেলাকে না চাইলেও ধরে রাখে সংসারে। তবে সংসারের সব কাজ ঠিকঠাক মতো না হলেই ক্ষেপে যায় রুদ্র।
বিছানার সম্পর্কটাও তাদের অন্যরকম। দুই জনের আলাদা ঘর, আলাদা বিছানা। কারো সাথে কারো মনের মিল নেই, তাই শরীরও হয়তো মিলনে গোলমাল পাকিয়ে যায়। তাছাড়া, রুদ্র টগবগে যৌবন ধরে রেখেছে চল্লিশ এর কোঠায়। সেক্ষেত্রে রোদেলা অনেকটাই নেতিয়ে পড়েছে। শরীর তাকে দুর্বল করতে না পারলেও দিন দিন আরো অভিমানী করে তুলছে। তাই এখন আর জেদ ধরে না, বরং এডজাস্ট করতে শিখেছে।
রোদেলার মা বলেছিল, ‘ছেড়ে দে।’
রোদেলা সম্মত হয়নি। বলেছিল,
-মা! এক পা! কতদূর এগোনো যায়, বলো তো?
-মানুষ পায়ে হেঁটে এগোয় বুঝি রোজ?
-মা! অমাবস্যা-পূর্ণিমার দিনের সমুদ্রের ফুলে ওঠা গর্জন শুনেছো? বলো তো অন্যান্য দিনগুলিতে অন্তরজল কমে যায় কেন?
সেদিন রোদেলার মা শুধু মেয়ের মুখের দিকে তাকিয়েই ছিলেন। কিছু বলেননি। হয়তো মেয়ের অন্তর্দৃষ্টিকে মোকাবেলা করার সাহস ছিল না তার।
তবু মায়ের বুকের ব্যথা তো অস্বীকার করা যায় না! চাইলেই যে মেয়ে মুক্তি পেতে পারে সকল দায়বদ্ধতা থেকে, সে মেয়ে কেন আঁকড়ে ধরে আছে সংসার, তা তাকে বিচলিত করে রোজ।
যার নাম রাখা হয়েছিল রোদেলা। আদর করে মা ডাকেন রোদ। আজ সে রোদের জীবনে কোন রোদ নেই, যা আছে তা কেবল ঘন কুয়াশায় মোড়া সকাল, দুপুর, রাতের গল্প।
এসব কিছুই ভাবায় না রোদেলাকে। সে জানে, নতুন করে শুরু করার সময় এটা নয়। এখন যা শুরু হয়ে গেছে, তা শেষ করার সময়ও নয়। এখন কেবল নিজ সত্তায় নিজেকে ধরে রাখা। তুমুল ঝড়ের বজ্রপাতে বৃষ্টি পড়ার শব্দে ছন্দপতন হয়। তাই বলে কি বৃষ্টি থেমে যায়? নাকি বজ্রপাত থামানো যায়?
জীবন তো এমনই। হাসতে হাসতে স্বপ্ন নিয়ে বেড়ে উঠা। তারপর স্বপ্নগুলোকে বাস্তবে রঙ দিতে কল্পনায় জলছবি আঁকা। আঁকতে আঁকতে হারিয়ে যাওয়া, ভুল পথে নদীর স্রোতের মতো! তারপর আর ফিরে আসা হয় না। ভেসে যেতে যেতে কোথাও না কোথাও থামতে হয়, নোঙর ফেলতে হয়।
ভুলকে শুদ্ধ করতে গিয়ে মানুষ বার বার ভুল করে। তারপর ভুল নিয়েই বেঁচে থাকে।
সংসার, সম্পর্ক-কেবল ১৬৪ স্কয়ারফিটের একটা ঘর। নয় কি? এই ঘরের চার দেয়ালেই ছোপ ছোপ লেগে থাকে সকল ব্যর্থতা! অক্ষমতা! অভ্যন্তরীণ বিপ্লবের রক্তস্নাত সকাল, দুপুর, রাত। কে দেখে?
এখানে ফিরে ফিরে আসে নাইটিঙ্গেল। জন উইলিয়াম-তাঁর ভায়োলিনে সুর তুলতেই ডানা ঝাপটে উড়ে যায় পাখি, নিজের মতো করে। দিন-রাত এই সুর ধরে রাখে কতশত রোদেলা, রোদের তাপ গায়ে মাখাবে বলে।
ভাবনারা আজকাল টেনে নিয়ে যায় রোদেলাকে শূন্য মাঠে হুটহাট। অন্যমনস্ক রোদেলা বিছানা ছেড়ে উঠার চেষ্টা করে। ওদিকে রুদ্র তার মুখের দিকে তাকিয়ে আছে সেই কখন থেকে।
-রুদ্র! তুমি ভাতটুকু চড়িয়ে দাও না কেন? আমি তো রোজ দিই।
-সারাদিন কাজ শেষ করে বাড়ি ফিরে এটাও আমাকে শুনতে হবে রোদ?
-প্লিজ! রোদ, আমার মা ভালোবেসে ডাকেন। তুমি বলো না।
-কেন? আমি কি ভালোবাসি না তোমাকে?
-মনে পড়ে না রুদ্র!
-এতদিনের সবকিছু অস্বীকার করছো তুমি?
-স্বীকার করেছিলাম কবে রুদ্র?
রোদেলা এবার ক্রাচে ভর করে উঠে দাঁড়ায়। উঠতে গিয়ে হোঁচট খায় ডান পায়ে। বাম হাঁটুতে হাত বুলায়। নিচের অংশটুকুর দিকে তাকায়! সব শূন্যস্থান পূরণ হয় কি?
রোদেলা ডাকে, রুদ্র!
ঘর থেকে বের হতে হতে পিছনে ঘুরে তাকায় রুদ্র।
-হ্যাঁ বলো!
-আমিও কিন্তু কাজ করি। উপার্জন করি রুদ্র। এখনো নিজেকে নিজেই টেনে নিচ্ছি। আমিও চাইলে তোমার মতো করে বলতে পারি! কিন্তু বলি না! কেন জানো? কারণ- হিসেবে বড্ড গড়মিল হয়ে গেছে, নতুন করে হিসেব কষতে গেলে ফলাফন শূন্যের কোঠাতেই যাবে। জানো তো, যোগ বিয়োগের খাতায় যোগের ফলাফলটা আমার-ই থাকবে। তোমার সেটা ভালো লাগবে না রুদ্র! তুমি নিশ্চয়ই আমার কাছে হারতে চাইবে না।
রোদেলা জানালার গা ঘেঁষে দাঁড়ায়। বাইরে আজ তুমুল ঝড় হচ্ছে। ঝড়ের দাপটে বৃষ্টির ফোঁটা জানালা ডিঙ্গিয়ে এসে পড়ছে রোদেলার গায়ে।
আজ মেঘদূত নিযেছে আড়ি। সেই সকাল থেকে ক্রমাগত বৃষ্টি হচ্ছে। থামার কোন নাম নেই। বৃষ্টির সাথে প্রেম-বিরহ ও মন খারাপের কেমন যেন একটা অনড় সম্বন্ধ রয়েছে। বৃষ্টি চিরকালই হৃদয়ে আছড়ে দেয় এক পশলা স্মৃতি। বিশুদ্ধ বৃষ্টি জলে ভিজে যে মেয়েটি হেসে কুটিকুটি হতো, সে আজ জলের আত্মচিৎকারে জ্বলে যেতে চায়।
ক্রাচ দুটোতে ভর করে রোদেলা বের হয়। ঘুটঘুটে আঁধারে বৃষ্টির সাথে বাতাস বইছে। বৃষ্টির ফোঁটা আর তার ভেতরের অভিমানী জলফোঁটা-মিলেমিশে একাকার হচ্ছে। রোদেলা দাঁড়িয়ে আছে উঠানে একা। ভিজছে। বাম হাঁটুর নিচটায় জড়িয়ে থাকা পাজামার অবশিষ্ট অংশবিশেষ-বাতাসে দুলছে। রোদেলার ডান পা’য়ে শরীরের ওজন, ভারী হচ্ছে।
আমার বাবা ছিলেন অত্যন্ত সাহসী একজন লড়াকু মনের মানুষ।শত অভাব অভিযোগেও তাকে কোনোদিন ভেঙ্গে…..
ভার্সিটির বাস ধরতে হয় আমাকে খুব সকালে। বাড়ি থেকে একটু হেঁটেই রিকসা। তারপর বাস। হাঁটা…..
আজকের সন্ধ্যাটা থমকে যাওয়া মেঘেদের। ঝিরিঝির বৃষ্টি ছিল দিনভর। ঢাকা শহরের পথঘাট জল কাদায় মাখামাখি।…..
জোছনা করেছে আড়ি আসে না আমার বাড়ি গলি দিয়ে চলে যায়, গলি দিয়ে চলে যায়…..