১৯৮৪ : সর্দার গদ্দার হে (পর্ব ১)

দেবশ্রী চক্রবর্তী
উপন্যাস, ধারাবাহিক, পডকাস্ট
Bengali
১৯৮৪ : সর্দার গদ্দার হে (পর্ব ১)

বড় রাস্তা থেকে বাঁ দিকে যে গলিটা ঢুকে গেছে তার মুখে একটা বিশাল বট গাছ। গাছের নীচে একটা অটোরিকশা জ্বলছে। সন্ধ্যে ছটা নাগাদ আগুন জ্বালানো হলেও এখনো তার থেকে কালো কুণ্ডলী পাকানো ধোঁয়া উঠে এগিয়ে চলেছে গলির মুখ দিয়ে। আজ সুলতানপুরিতে একটাও স্ট্রীট লাইট জ্বালেনি। রাস্তার দুই ধারে পাশাপাশি মুখোমুখি বাড়িগুলোর দরজা জানালা সব বন্ধ। এই রাস্তায় তিনটে বাড়ি পার করে পম্মি কৌরের বাড়ি। কাল পাম্মির মেয়ে জসবিন্দরের বিয়ে, তাই এই বাড়ি অন্য বাড়ি গুলো থেকে ব্যতিক্রম, সে নববধূর মতন সেজে উঠেছে ঝলমলে আলোতে। পাম্মি কৌরের বাড়ি থেকে যেটুকু আলো এসে পরছে রাস্তার মুখে তাতে দেখা যাচ্ছে গলির মুখে কুণ্ডলীকৃত কালো ধোঁয়া এগিয়ে আসছে তাদের বাড়ির দিকে। পাম্মির ছোট ছেলে টিক্কু ছাদে আলো ঠিক করতে করতে তাকিয়ে আছে সেই দিকে। আজ পয়লা নভেম্বর, দিল্লিতে প্রাত ১২ ডিগ্রী তাপমাত্রা চলছে, কিন্তু টিক্কুর মাথার ওপর ছোট ছোট ঘামের বিন্দু জমা হচ্ছে। বুকের ভেতরটা কেঁপে উঠছে, এক ভয়ঙ্কর কিছুর আভাস যেন সে পাচ্ছে। টিক্কু মনে মনে গুরু গ্রন্থ সাহেব থেকে মন্ত্র জপ করতে লাগল, “ইচ্ছা পোড়াক সরব সুখ-দাতা হর জা কাই ভাস হে কামধায়না। জপ মন সৎ নাম সদা সৎ নাম।” টিক্কু কথা গুলো বলতে বলতে চোখ বন্ধ করে মনে মনে কিছু একটা বলল। এমন সময় পাম্মি কৌর ছেলে পেছনে এসে দাঁড়িয়ে ওর পিঠে হাত দিল। টিক্কু এতে প্রচণ্ড ঘাবড়ে গিয়ে মুখ থেকে একটা আওয়াজ বার করে পেছনে সরে দাঁড়াল। পাম্মি দেখতে পাচ্ছে তার ছেলের সারা শরীর ঘামছে, সে খুব জোড়ে জোড়ে নিঃশ্বাস নিচ্ছে। তার নিঃশ্বাস দিয়ে একটা আর্তনাদ যেন বেড়িয়ে আসছে।

এই লেখার অডিও শুনুন এখানে:

 

পাম্মি তার ছেলের দিকে এগিয়ে আসতে আসতে বলল, কি হয়েছে বেটা, শরীর খারাপ লাগছে নাকি?

পাম্মি দেখতে পাচ্ছে তার ছেলে তার থেকে পিছিয়ে যাচ্ছে আর তার মুখ দিয়ে একটা গোঙ্গানির আওয়াজ বের হচ্ছে। মা হয়ে সে তার ছেলেকে চেনে, এখন তাকে জোর করে কোন লাভ নাই, বরং তাকে নিজের মতন ছেড়ে দেওয়া ঠিক হবে। কিছুক্ষণ পর টিক্কু নিজে থেকেই সব বলবে। বিকেলে এই পাড়ায় কি ঘটনা ঘটেছে তা সবাই জানে। কিন্তু মেয়ের বিয়ে নিয়ে এত ব্যস্ত সে, যে কারুর কথায় কান দেওয়ার মতন সময় তার নেই। জসবিন্দরের বিয়ের দোপাট্টায় জড়ির পার বসাতে দিয়েছিল সে কাল্লুর মাকে, তা আনা হয়নি। এদিকে হাতে এত কাজ যে নিজে গিয়ে আনবে তারও কোন উপায় নেই। ছেলেকে কয়েকবার ডাক দিয়েও যখন তাকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না, তখন তার সর্দার জি তাকে বলল ছেলে ওপরে আছে, ছাদের আলো ঠিক করছে।

একটা পোড়া গন্ধ ডানদিক থেকে আসছে, পাম্মি জোড়ে জোড়ে সেই গন্ধ শুকতে শুকতে ডান দিকে ঝুঁকে দেখল গলির মুখটা কালো ধোঁয়ায় ঢেকে গেছে। টোনি সিং এর অটো রিক্সা ওখানে রাখত, আজ সন্ধ্যে বেলায় টোনির অটোরিকশায় একদল মানুষ এসে আগুন জ্বালিয়ে দিয়েছে। এই খবরটা সে শুনেছে, কিন্তু পাম্মি বুঝতে পারছে না এটা কারা করতে পারে। টোনি সিং লোকটা খারাপ না, তাই কোন ব্যক্তিগত শত্রুও তার থাকার কথা না। এরকম সর্বনাশ কে করল। পাম্মির মনের কথা মুখ দিয়ে বেড়িয়ে এলো। মনে মনে কষ্ট হলে তার কান্না পায়, এখন টোনি সিং এর পরিবারের জন্য তার ভীষণ কষ্ট হচ্ছে।টোনির বৌ ভাবনার সাথে পরিচয় আছে তার, গুরুদ্বরাতে দেখা হলেই ভাবনা নিজে থেকে কথা বলে। মহল্লার বাকি সর্দারনদের মতন ভাবনাও নিজের সংসারের কথা সবার সাথে আলোচনা করেন। তাই টোনি সিং এর সংসারের অন্দরমহলের সাথে পাম্মির পরিচয় আছে।

মুখের মধ্যে ওড়নাটা চেপে ধরে পাম্মি কৌর বলল, টোনি সিং এর পুরো সংসার নির্ভরশীল তার ওপর। এখন কি হবে? টোনি সিং হয় তো আগের লোণ শোধ করতে পারেনি, আবার একটা রিক্সা সে কি করে কিনবে?

টিক্কু কেঁদে উঠল, সে বলল, বিজি টোনি সিংকে রিক্সার ভেতরে ওরা জীবন্ত পুরিয়ে মেরেছে। টোনির লাশের টুকরোও খুঁজে পাওয়া যাইনি।

পাম্মি কৌরের দুটো চোখ যেন স্থির হয়ে গেল। এ কি ভয়ংকর অলক্ষণে ঘটনা ঘটে গেল তার জস্যির বিয়ের আগের দিন। ভাবনার জন্য খুব কষ্ট হচ্ছে তার। কিন্তু টোনি সিংকে কেন আক্রমণ করা হল, এটাই সে বুঝে উঠতে পারছে না। টিক্কু নিজের চোখে জল মুছতে মুছতে তার বিজির কাছে এসে একটু ঝুঁকে বলল, বিজি, সব কিছুর পরিকল্পনা তৈরি। এবার ধীরে ধীরে আক্রমণ আরম্ভ হবে। টোনি সিং এর মৃত্যুটা একটা মোহরা।

পাম্মি সহজ সরল মানুষ, নিজে ছেলে মেয়ে সংসার নিয়ে সে সব সময় ব্যস্ত, শহরে ঘটে যাওয়া নিত্য ঘটনার সাথে সে খুব একটা পরিচিত না, তবে ছেলে কলেজে যায়, তাই তার মুখ থেকে সে যেটুকু খবর পায়। কিন্তু এখন টিক্কু যা বলছে তা বেশ গুরুত্বপূর্ণ বলে তার মনে হচ্ছে। পাম্মি ছেলেকে বলল, তুই কি করে জানলি?

– মহল্লার সবাই জানে বিজি। তুমিই শুধু জানো না। টিক্কুর মনে হল বড় রাস্তার বাঁ দিক থেকে বহু মানুষ চিৎকার করতে করতে আসছে। টিক্কু বলল, বিজি শুনতে পাচ্ছ।

টিক্কুর চোখ দুটো ভয়ংকর অস্বাভাবিক লাগছে, সে তার বিজির মুখের সামনে মুখটা ঝুঁকিয়ে তার বাঁ হাতটা পেছনের দিকে তুলে দেখিয়ে বলল, বিজি, আওয়াজটা শুনতে পাচ্ছ। ওই দিক থেকেই আসছে। দেখেছ তো আমি যা বলেছিলাম তা এক বর্ণও মিথ্যে না।

পাম্মির ছেলের কথা গুলো শুনে এবার খুব ভয় লাগল। সে নিজেও শুনতে পাচ্ছে যে বড় রাস্তার বাঁ দিক থেকে একটা কোলাহলের আওয়াজ এগিয়ে আসছে। সুলতানপুরির সরু গলির মধ্যে থেকে একটা কুকুর জোড়ে চিৎকার করে উঠল। পাম্মি শুনতে পাচ্ছে কুকুরটাকে অনুসরণ করে আশেপাশে গলি গুলোর কুকুর গুলোও সমস্বরে ডেকে উঠল। এরকম ভাবে কুকুরের ডেকে ওঠা এক অশুভ ইঙ্গিত। পাম্মি ছেলের হাত ধরে সিঁড়ি দিয়ে নীচে নেমে এলো। কাল তার মেয়ের বিয়ে তাই আত্মীয় স্বজনরা সকলে এসে গেছেন। বাড়ির পুরুষরা বসার ঘরে বসে টিভিতে খবর দেখছে। সাদা কালো টিভির পর্দায় প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর ছবি দেখা যাচ্ছে, খবরে কি বলছে পাম্মি তাতে মাথা না ঘামিয়ে সে সদর দরজায় দু খানা তালা লাগিয়ে মেয়ে ঘরের দিকে চলল। মেয়ের ঘরে ঢোকার মুখে সে জস্যির হাসির শব্দ পেল। পাটিয়ালা থেকে জস্যির মামার মেয়ে সিম্মি এসেছে, চণ্ডীগড় থেকে এসেছে তার পিসির মেয়ে হ্যাপি। তারা সবাই প্রায় সম বয়সী। পাম্মি বুঝতে পারে ওদের আনন্দের রহস্য, অল্পবয়সী মেয়েরা বিয়ের সময় কি কি গল্প করে মজা করে তা সে সব জানে। তাই মেয়েকে বিরক্ত না করে সে শুধু দরজার পাশ দিকে উঁকি দিয়ে মেয়ের মুখটা একবার দেখল। আজ সকালে মেহেন্দির রসম হয়েছে। জস্যি সবুজ রঙের সিল্কের সালোয়ার কামিজ পরে বসে আছে। তার হাত লাল মেহেন্দির রঙ খুব উজ্জ্বল। পাম্মি মনে মনে ভাবল, মেয়ে আমার খুব সুখি হবে, মেহেন্দির এত উজ্জ্বল রং সে এর আগে কারুর হাতে দ্যাখে নি। জস্যির রঙ কাঁচা হলুদের মতন আর তার ডান কাঁধ দিয়ে এক ঢাল সোনালী চুল এসে সামনের দিয়ে তার ডান দিক ঢেকে রেখেছে। মেয়ের দিকে বেশিক্ষণ তাকিয়ে থাকা ঠিক হবে না, এতে নজর লেগে যেতে পারে। পাম্মি আবার জস্যির হাতের লাল টকটকে মেহেন্দির রঙের দিকে তাকাল। এখন তার মনে কিছু আশঙ্কার মেঘ আবার নতুন করে জমা হচ্ছে। মেয়ের হাতের এই লাল রং যেন তার চোখকে ঝলসে দিচ্ছে। পাম্মি এবার অস্থির হয়ে রান্না ঘরে দিকে গেল, ওখানে পাম্মির বৌদি, ননদ, জা বসে রাতের রান্না করছেন। পাম্মিকে হন্তদন্ত হয়ে রান্না ঘরে ঢুকতে দেখে সবাই নিজেদের কাজ থামিয়ে তার দিকে তাকিয়ে দেখল। পাম্মি এবার রান্নাঘর থেকে বেড়িয়ে বাড়ির অন্যঘর গুলোর মধ্যে কিছু একটা খোজার চেষ্টা করল। নিজের সব থেকে বড় সম্পদকে সে লুকোতে চাইছে, যা সে সারা জীবন ধরে নিজের বুকের মাঝে আগলে রেখেছে। কাল তার বিয়ে, কত স্বপ্নের বিনুনি বুনেছে সে এই বিয়ে নিয়ে। সারা পৃথিবীর সব রকম অশুভ প্রভাব থেকে সে লুকিয়ে রাখতে চায় তার প্রাণের টুকরোকে। পাম্মি খাটের তলা থেকে বড় ট্রাঙ্কটা বার করে তার থেকে বাসনপত্র সব বার করতে করতে একটা চিৎকার শুনতে পেল। পাম্মি মন দিয়ে সে চিৎকার শুনছে, এ আওয়াজ সে চেনে, কাক্কু ভাইয়ের বড় মেয়ে সুরজিতের চিৎকার। সুরজিত কারুকে অনুরোধ করছে, সে চিৎকার করে কাক্কু ভাইয়ের নাম করছে। এই ঘরের জানালার পাশে বড় প্রাচীর তাই চেষ্টা করলেও কিছু দেখা যাবে না। পাম্মি নিজের কাজ থামিয়ে আবার বসার ঘরে এলো দরজায় তালা লাগানো, আর চাবি দুটো দেওয়ালে ঝুলছে। টিভিতে এখন একটা আলোচনা চলছে , সেই আলোচনা কেন্দ্র বিন্দু মিসেস গান্ধী। কারন দু একবার তার নামটা কানে এলো। পাম্মি সিঁড়ি দিয়ে ছাঁদে উঠতেই তার বাড়ির চারপাশ থেকে ভয়ঙ্কর কোলাহলের শব্দ ভেসে এলো। সে তার বাড়ির ছাদের ডান দিকে ঝুঁকে দেখল তাদের সুলতানপুরির গলির মাঝে জ্বলন্ত টায়ার গলায় নিয়ে এক সর্দারজি আর্তনাদ করছেন, তার দুই হাত পেছন থেকে বাঁধা। সে পালানোর চেষ্টা করছে কিন্তু পাচ্ছে না, কারন চারপাশ থেকে কিছু মানুষ তাকে ঘিরে রেখেছে। এদের প্রত্যেকের হাতে লোহার রড। হাতে সাদা সাদা প্যাকেট। সেই প্যাকেট থেকে পাউডারের মতন কিছু তারা ছিটিয়ে দিচ্ছে সর্দারের গায়ে, তাতে আগুন আরো তীব্র হয়ে জ্বলে উঠছে।

চিত্র: রিয়া দাস

পাম্মি দেখতে পাচ্ছে কাক্কুভাইয়ের ১৬ বছরের মেয়েটিকে। সুরজিত হাত জোর করে একটা লোকের সামনে কাঁদছে, লোকটাকে পাম্মি চেনে, ভোটের সময় কয়েকবার এসেছিল তাদের মহল্লায়। লোকটার নাম দয়ানন্দ ভগত। লোকটার চোখ দুটো দিয়ে আগুন বেরোচ্ছে, তার মুখে হিংস্র হাসি। যে সার্দারজী জীবন্ত জ্বলছে তিনি কাক্কুভাই, এই কাক্কুভাই পাম্মির রাখী ভাই। পাম্মির খুব কান্না পাচ্ছে , সে মুখে ওড়না চেপে কাঁদতে লাগল। কাক্কুভাইয়ের শরীর দূর্বল হয়ে যাচ্ছে, সে এক সময় পরে গেলে ভিড়ের ভেতর থেকে দু একজন এসে লোহার রড দিয়ে কাক্কু ভাইকে খুব জোড়ে আঘাত করে আরো কিছুটা সাদা পাওডার ছিটিয়ে দেয় তার শরীরের ওপর। পাম্মি দেখতে পাচ্ছে কাক্কুভাইয়ের সারা শরীর দাউ দাউ করে জ্বলছে। ভগত বলে লোকটা কাক্কুভাইয়ের মেয়ের দোপাট্টা ধরে টান দিলো। সুরজিত তার বাবার জ্বলন্ত দেহের দিকে ছুটে যাবার চেষ্টা করতেই ভিড়ের ভেতর থেকে কয়েকজন এসে তাকে কাঁধে তুলে নিল। পাম্মি তাকিয়ে দেখল তাদের বাড়ির সামনে অনেক মানুষ দাঁড়িয়ে, দরজাটা কখন খুলে গেছে, সেই খোলা দরজা দিয়ে আলো এসে পরছে লোক গুলোর গায়ে। পাম্মি চিৎকার করে উঠল, বায় গুরু, রক্ষা কর আমার পরিবারকে। কে যে দরজা খুলে দিল এই ভাবে। প্রলাপ করতে করতে সে সিঁড়ি দিয়ে নেমে আসার সময় তার সর্দারজির গলার আওয়াজ পেল। সে আর্তনাদ করে বলছে তার মেয়েকে ছেড়ে দিতে। পাম্মি সিঁড়ি থেকে নেমে দ্যাখে এক দল লোক জস্যির শরীর থেকে জামা কাপড় খুলে নিচ্ছে। পাম্মি হাত জোর করে বলল যা নেবার আপনারা সব নিয়ে নিন , কিন্তু আমার মেয়েকে ছেড়ে দিন।পাশের ঘরে হ্যাপি আর সিম্মির চিৎকার আসছে। পাম্মি গিয়ে দ্যাখে পাশের ঘরের দরজা বন্ধ। বাড়ির মহিলারা সেই ঘরের বাইরে দাঁড়িয়ে কান্নাকাটি করছেন। ভগত বলে লোকটা এবার ঘরে ঢুকে বলল, আজ ভালো দিনেই আমরা এসেছি। কাল শুনলাম আপনাদের মেয়ে জসবিন্দরের বিয়ে।

জস্যির বাবা হাত জোর করে কাঁদতে কাঁদতে বলল, আপনাদের যা নেবার নিয়ে যান, কিন্তু মেয়ে গুলোকে ছেড়ে দিতে বলুন, আমরা আপনাদের প্রজা, এইভাবে আমাদের সর্বনাশ করবেন না।

ভগত একটা খালি চেয়ার দেখে সেখানে গিয়ে বসল, তারপর পায়ের ওপর পা তুলে বলল, ভাইরা, নতুন কনের হাত পা সব কিছু ভেঙ্গে ফেলো। এর জন্য তোমরা প্রত্যেকে হাজার টাকা করে পাবে।পাম্মি আর তার সর্দারজি এসে ভগতে পায়ে মাথা ঠুকতে লাগল। ভগতের মুখে আবার সেই হিংস্র হাসির ঝলকানি দেখা দিল। সর্দারজি বললেন আমরা আপনাদের প্রজা, সারা জীবন আপনাদের সমর্থন করে এসেছি, এভাবে সর্বনাশ করবেন না। ভগত চেয়ারের হাতলের ওপর দুটো হাত রেখে ,বলল, সারা জীবন তোমাদের সেবা করার প্রতিদানে আমাদের নেত্রীকে গুলি খেতে হল। ভগত যেন এবার একটু উত্তেজিত হয়ে উঠল। সে ঝুঁকে সর্দারজির মাথার পাগড়ী মুঠো করে ধরে বলল, এক দুটো না ২৮ টা গুলি খেতে হয়েছে নেত্রীকে, সারা শরীর ফুটো হলে গেছিল, তার থেকে রক্ত ফিনকি দিয়ে বেরিয়েছিল। তার খেসারৎ তো তোমাদের দিতেই হবে সর্দার। ভিড় থেকে কয়েকজন হাতে রড নিয়ে এসে জস্যির হাঁটুতে রডের বারি মারতে লাগল। জস্যি আর্তনাদ করছে। টিক্কু তার দিদির এই অবস্থা আর সহ্য করতে পারল না, সে ছুটে আসতেই একজন তার পেটের মধ্যে লোহার রড ঢুকিয়ে দিল। সর্দার তার ছেলের দিকে ছুটে যেতেই ভগত সর্দারের পাগড়ি টেনে খুলে দিল। পাগড়ীর কাপড়ের ওপর নিজের জুতোটা চেপে ধরে সর্দারের চুল মুঠো করে টেনে তার পেছনে লাথি মারতে লাগল। বৃদ্ধ সর্দার উন্মাদের মতন চিৎকার করছে, তার চোখের সামনে পুরো সংসারটা শেষ হয়ে যাচ্ছে।টিক্কু মুখ থুবড়ে পরে গেল মেঝের ওপর, পাশের ঘরের দরজা খুলে গেল। সিম্মি আর হ্যাপির গলার আওয়াজ আর পাওয়া যাচ্ছে না। কিন্তু সিম্মি আর হ্যাপির মায়েরা কান্নাকাটি করছে, এ কান্না শুনে অনুমান করা যায় এক সন্তানহারা মায়ের অন্তরের যন্ত্রণা। জস্যির হাত পা ভাঙ্গা হলে তাকে কাঁধে তুলে নিয়ে কিছু মানুষ বাড়ি থেকে বেড়িয়ে যায় আর বাকিরা জস্যির বাবা, মামা, পিসেমশায়কে বেঁধে গায়ে কেরোসিন তেল ঢেলে আগুন জ্বালিয়ে দেয়। পাম্মির চারপাশ অন্ধকার হয়ে আসছে, সে কিছু দেখতে পাচ্ছে না, টিক্কুর পিঠের ওপর মাথা রেখে সে জ্ঞান হারাল, এখন সে শুধু শুনতে পাচ্ছে কিছু জ্বলন্ত মানুষের আর্তনাদ।

পাম্মি কউর সহ সুলতানপুরি অঞ্চলের অন্যান্য বাড়িতে যখন আগুন জ্বলছে, তখন দিল্লির অল ইন্ডিয়া ইন্সটিটিউট অফ মেডিক্যাল সায়েন্সের সামনে একদল মানুষ জমা হয়েছেন তাদের প্রিয় নেত্রীকে শেষবারের মতন একবার দেখার জন্য। এদের মধ্যে কেউ হিন্দু, কেউ মুসলিম তো কেউ শিখ। ধর্ম যাই হোক, তারা প্রত্যেকে শোকাহত ভারতবাসী। এমন সময় ভিড়ের এক প্রান্ত থেকে আওয়াজ উঠল, সর্দার গদ্দার হে। একপ্রান্ত থেকে ঢেউয়ের মতন একদল মানুষ ছুটে আসছে আরেক প্রান্তের মানুষদের দিকে। তাদের সমবেত উচ্চারণে এক ভূমিকম্পের সূত্রপাত হল দিল্লির মাটিতে, যার কম্পন ছড়িয়ে পড়ল সারা দেশে।

দেবশ্রী চক্রবর্তী। কবি, লেখক ও ঔপন্যাসিক। দেবশ্রীর জন্ম ১৯৮২ সালের ৯ ই এপ্রিল। উত্তর ২৪ পরগণার ইছাপুরে। আদি নিবাস বাংলাদেশের ব্রাহ্মণবাড়িয়া। কৈশোর কেটেছে ইছাপুরে। ইছাপুর নবাবগঞ্জ বালিকা বিদ্যালয় থেকে উচ্চমাধ্যমিক পাশ করার পর ব্যারাকপুর রাষ্ট্রগুরু সুরেন্দ্রনাথ কলেজ থেকে ইতিহাসে অনার্স...

এই বিভাগের অন্যান্য লেখাসমূহ