১৯৯ টা আগলী স্পট

মৌ মধুবন্তী
গল্প
Bengali
১৯৯ টা আগলী স্পট

কাল রাতে সুইট সিক্সটিন বার্থডে পার্টি থেকে ফিরে এসে কথা বলি বড়ালের সাথে। বড়ালের জল এত দুষিত হয়ে গ্যেছে যে আমি ঘুমাতে গেলাম। দুই মিনিট কি ঘুমিয়েছি? মনে হয় না। ফোন। আমি রাতে ফোন অফ করিনা। এই কারণে কারো দরকার লাগবেই আমাকে মাঝ রাতে- পড় বন্ধুরা আরান্ধীর কাহিনী।

আপু! ও আমাকে দুই তালাক বলে ফেলেছে। আপু আমি কি করি? কি করবি? কেন তালাক বলল?

আচ্ছা এই খোদ কানাডায় বসে রাত একটায় আমি তালাক শব্দ শুনব কোনদিন ও কি ভেবেছি? তালাক আর তালার মাঝে দারুণ এক বৈপরিত্য আছে। তাই না? তালাক বাঁধন খুলে দেয়। আর তালা আটকে রাখে। এমন বাঁধন খুলে দিলে তুই কাঁদছিস কেন এই একবিংশ শতকে? এরা দেশ ছেড়ে কানাডা, জার্মান, আমেরিকা, পাড়ি জমিয়েছে বটে ভেতরের ডাস্টবিন তো সাথেই নিয়ে এসেছে। আমার নিজের ভেতরে প্রশ্নগুলি কুন্ডলী পাকাতে থাকে। বিয়ে যদি এমন বিরূপ মনোভাব তৈরী করে নারী পুরুষের সম্পর্কে তা হলে এই বিয়ে নামক কাঁচা জাহান্নামের কি দরকার? প্রশ্ন ধুয়া তুলে মুখ তুবড়ে পড়ে থাকে মনে। সে উত্তর দেয়।

শিল্পী: রিয়া দাস

– আপা, সে আমাকে বিয়ে করে টরন্টো এনেছে। আমার দায়িত্ব কেবল কাজ করে ঘরে ডলার আনা। আর রান্নাসহ ঘরের যাবতীয় কাজ করা। আমি গান শুনতে পারব না। পোলাও রাঁধলে তাও খেতে পারবনা। কারণ আমার বাবার বাড়িতে নাকি তাকে উন্নত চালের পোলাও খেত দিতে পারেনি। ছেলে-মেয়ে যা বলবে তা আমাকে শুনতে হবে। আমার কিছুই বলবার অধিকার নেই। ছেলে-মেয়ে আমাকে কাজের বুয়ার মত ট্রীট করে। আপু, আমি কি করি? সপ্তাহে ছয়দিন কাজ করি। কোন ডলারের মালিক আমি নই। আমার একার নামে কোন ব্যাংক একাউন্ট নেই। জয়েন্ট একাউন্টে ডলার জমা হয়। তারপর হাওয়া। ঘরে ঢুকেই রান্না থেকে তাদের জন্য যাবতীয় গুছিয়ে তবেই আমি ব্যায়াম করতে যাই। আমার ব্যায়ামের মেশিন ভেঙ্গে ফেলে দিয়েছে। তবু আমি খালি হাতেই ব্যায়াম করি। রাতে খেয়ে দেয়ে শোবার আগে একটু হিন্দি মুভি দেখি। আর চড় থাপ্পড় খাই সাথে সাথে।

বলিস কি? ফিজিক্যাল এসল্ট? কোন প্রতিবাদ করিস না?

শুধু কান্নার শব্দ।

আরান্ধী, কখন তোকে তালাক বলেছে। উত্তর নেই। কেবল কান্নার আওয়াজ। সেটাই উত্তর? না। তুই তিন তালাক বল। আরেক পা বাড়িয়ে বাইন তালাক বল। অল্প কয়েকদিন আগেই আমি বাইন তালাক শিখেছি বড়ালের কাছ থেকে। বড়াল ভালোবাসাকে বাইন তালাক দিয়েছে। সাথে ব্যাখ্যাও দিয়েছে। খুব মজা লেগেছে। আমি সেদিন এমন প্রাণ খুলে হেসেছি যা অনেকদিন পারিনি। বাইন অর্থ সম্পুর্নভাবে। যে মনিব প্রতিরাতেই মারে তার কাছে বাইন তালাক পর্যন্ত যাবার কি প্রয়োজন আছে বলো?

– কেন আছিস সেখানে?

– বাচ্চাদের মুখের দিকে তাকিয়ে।

– কার বাচ্চা? তোর না মনিবের? মনিবকে ছাড়তে খুব কষ্ট হবে তাই না?

– মা ছাড়া বাচ্চাগুলো কার কাছে যত্ন পাবে?

– তা হলে থাক। ব্যায়াম করিস না। হিন্দি মুভি দেখিস না।

– একটা মানুষ বাঁচার জন্য কিছুত চাই।

– সে কি চায়?

– খেয়েই তার সাথে গিয়ে শুয়ে পড়ি। দিনে দিনে মোটা হব । কেউ আমার দিকে তাকাবে না।

সেদিন ‘স্টারবাক’ থেকে তার জন্য কফি নিয়ে এলাম, বলে তোর বাপ দাদায় কোনদিন কফির নাম শুনেছে?

একথা শুনেই আমার মনে পড়ে গেল আমার মেয়ের কথা। আমার বন্ধু গাড়িতে বসে তার মেয়েকে গালি দিচ্ছে, তোর বাপের গুস্টি কিলাই। আমার মেয়ে বলে, গুস্টি কি? কি বলব? গাড়ি চালাব নাকি হাসব? আমার মেয়ে কিছু জানতে চাইলে উত্তর না পেলে দারুণ আপসেট হয়। বন্ধুই বলল, গুস্টি মানে ফ্যামিলি। আমার মেয়ে বলে, তুমি ওর বাবার ফ্যামিলিকে মেরে ফেলবে? তোমার ফ্যামিলিকে মারো শাস্তি কম পাবে। হা হা হা। বাংগালী লোক তোমরা এতো মিনিংলেস কথা বলো না। বাংলা শেখ ভালো করে।

– আমি শুনেছি, আমি দেখেছি, আমি খেয়েছি সেই যথেষ্ঠ ।এই সেই রাত।শুনেছি, দেখেছি, খেয়েছি। বিভীষীকাময়।
সরবিন্দ বলে, “কফি পান করে তুই আগলি হয়ে যাবি। চল আজ রাতে তোর সাথে আগলি খেলি।”

– আরান্ধী বলে যায় তার সে রাতের আগলি খেলা।

রাত সাড়ে এগারটা। সবে ঘরের সব কাজ শেষ করে বেডরুমে গ্যাছি, আমার কাজের কাপড় আনতে। অনেকদিন ধরেই আমি নীচে ফ্যামিলি রুমে সোফায় স্থান পেয়েছি। তবু আশ্রয় আছে। এই ভেবে পড়ে থাকি ফিটাশ আকারে ছোট্ট লাভ সীটে। যেখানে প্রেমিক-প্রেমিকা, স্বামী-স্ত্রী লাভ মেক করে সেখানে আমি ফিটাস কুন্ডলী। কিন্তু যখন সে নেমে আসে তখন যোনীর দ্বার খুলে দিতে হয় কিচেনের টেবিলে কিংবা সোফার হাতলে। বড় আদর করেই আমার শরীর থেকে একটা একটা করে কাপড় খুলে জানালা দিয়ে বাইরে ছুড়ে দিল। আমি এই আদরের গভীরে মর্মবেদী বেদনা বুঝবার মেধা রাখিনি সেরাতে। শুধু ভেবেছি এই সেই শেষ গন্তব্য। জন্ম থেকে মৃত্যুর মাঝে এই এক দুর্লভ মুহুর্ত। হাসতে হাসতেই আমাকে সোফায় ধাক্কা মেরে ফেলে দিয়ে চতুর্দিক থেকে আলো জ্বেলে দিল। সে গিয়ে বিছানায় ল্যাপটপ নিয়ে বসলো। আপু, আমি ভয়ে শীর্ণ হতে হতে — এই বুঝি ওয়েব ক্যাম অন করে দিয়ে সারা বিশ্বকে দেখাবে আমার আমিকে।

আমি হাত তুলে হিস হিস করে না করতেই, এক লাফে উঠে এসে দুই গালে দুই চড় দিয়ে আমার হাত পা বাঁধা শুরু করে। পাশের ঘরে আমার মা । অন্য ঘরে ছেলে-মেয়ে। চিতকার করলেও কেউ আমাকে সাহায্য করতে আসবে না। আমার মা এসে বলবে, স্বামীর পায়ের নীচে বেহেস্ত। স্বামীকে অমান্য করে বেহেস্ত হারাম করছ। নাফরমান মেয়ে। তাই মৃত্যুর সাথে যুদ্ধ করছি, আমার একাকী শক্তি দিয়ে। মরতে আমি ভয় পাইনি, সেই মুহুর্তে। যদি একটা গুলি করে মেরে ফেলত। কিন্তু এইভাবে সারা বিশ্বকে দেখাবে আমার ব্যক্তিগত আমিকে। না না । এ আমি হতে দিতে পারিনা। আমি গায়ে গতরে ছোট ও হালকা গড়নের। তার ঐ ছয় ফুট উঁচু দেহের শক্তির কাছে আমার দেহ পরাভুত। কিন্তু মন! সে রণ রঙ্গিনী। কিন্তু সে রঙ কেউ দেখেনা। তারপর সে আবার ফিরে যায় তার ল্যাপটপে। আমাকে দেখছে আর লিখছে। নোট করছে। এইভাবে সারা রাত শেষে যখন রাতের কালো ফিকে হয়ে এলো, তখন ল্যাপটপ টা আমার চোখের সামনে এনে চোখ দুটো টেনে ধরে দেখাচ্ছে আমার দেহে কি কি আছে? আমাকে নির্দেশ দেয়া হলো, এক এক করে পড়তে। জোরে জোরে। যাতে পাশের ঘর থেকে মা জানতে পারে। জানতে পারে ছেলে-মেয়ে।

ছেলে-মেয়ে নানীর কাছ থেকে শিখেছে, মায়েরা খাবে পাতিল পোঁছা খাবার। ছেলে-মেয়ের অগ্রাধিকার। এর মাঝে আবার আরো ব্যপার আছে, মেয়ে পাবে শেষে। সবার আগে স্বামী, তারপর পুত্র। তারপর মেয়ে । মা নিজেও খায় সবার শেষে। আমি অনেকদিন চেস্টা করে করে এখন ছেড়ে দিয়েছি। খাবে যখন মায়ের ইচ্ছা। বাবা ছিল না। একাই মা ঢাকা শহরে চারটে ছেলেমেয়েকে বড় করেছে। মা আমাদেরকে মানুষ করেনি। বড় করেছে। নিজের যৌবনকে জলাঞ্জলি দিয়ে চার ছেলে-মেয়ের ঘানি টেনেছে। অনেক আশা নিয়ে মাকে স্পন্সর করেছিলাম। মা এলে শাস্তিটা একটু কম হবে। মায়ের সামনে কিছু করবে না। মা সাপোর্ট দেবে। হায় রে মা।

মায়ের যৌবনের জ্বালা উড়াচ্ছে কি আমার অত্যাচারের উপর দিয়ে? কে জানে। পড়লাম। ১৯৯ টা আগলী স্পট আমার শরীরে। তারপর খুব হাসলাম। হাসতে হাসতে কখন আমি জ্ঞান হারিয়েছি নাকি ঘুমিয়ে গ্যাছি। জেগে দেখি উদোম শরীরের পাশে মা বসে আছে। সে অফিসে চলে গ্যাছে। ছেলে মেয়েকে স্কুলে নামিয়ে দিয়ে। মাকে বললাম বাঁধন খুলে দাও। মা এই প্রথম আমার গায়ে হাত বুলিয়ে দিয়ে বাঁধন খুলে দিলে আমি টলতে টলতে কাজের কাপড় পরে বেরিয়ে যাই উদ্দেশ্যহীন। কোথায় যাব? সেই থেকে হাটছি। এখন রাত একটা । ঘরে ফিরিনি। ১৯৯ টা আগলী স্পট আমার শরীরে কেউ আমাকে স্পর্শ করবেনা। ভয় কি? এবার বলো, এখন আমি কি করব?

সব কিছু ব্যবস্থা করে যখন নিজে বাসায় ফিরি তখন আমি এক ভয়ার্ত চিতকার কেবল। ঘরে ফেরার সাথে এই লেখা শেষ করবার দুরত্ব রাগ গুনকলি। সুরের ধারার সাথে বয়ে যাচ্ছে আমার চোখের জল নিরবধি।

মৌ মধুবন্তী। কবি ও উদ্যোক্তা। পঁচিশ বছরের বেশী দেশ ছেড়ে উত্তর আমেরিকায় বাস। আবৃত্তি ধারণ করেন অন্তরের অন্তঃস্থলে। কবিতা লিখেন বাংলা ও ইংরেজি দুই মাধ্যমেই। তিনি মনে করেন, কাব্য ছাড়া কবির কোন পরিচয় থাকেনা। তাই আত্ম সমালোচনায় প্রত্যয়ী। কবিতাকে ভালোবেসেই...

এই বিভাগের অন্যান্য লেখাসমূহ

বালির বেহালা

বালির বেহালা

বুড়িমাসি বলেন,জীবনটা বালির ঘর গো।ঢেউ এলে ধুয়ে যায় জীবনের মায়া।তবু বড় ভালবাসা ওদের দাম্পত্যে।রোদের চাদরের…..

তদন্ত

তদন্ত

  এক ড্রইং রুমে বসে রয়েছে সদ্য কিশোর উত্তীর্ণ তরুণ গোয়েন্দা সজীব। সামনের টেবিলে ছড়িয়ে…..