২৩ জুন: বিশ্বাসঘাতক কে

জয়দীপ দে
সৌরভ মিত্র-এর প্রবন্ধ
২৩ জুন: বিশ্বাসঘাতক কে

আজ ২৩ জুন। সকাল থেকে অঝোরে বৃষ্টি হচ্ছে ঢাকায় । জলে জমে কলেজ থেকে বেরুনোর উপায় নেই। ক্লাসে ছাত্র-ছাত্রীও নেই। তাই অখণ্ড অবসর। অবসর উদযাপনের একটি মোক্ষম মাধ্যম হলো ভাবনায় ডুবে যাওয়া ।

ভাবছিলাম, আজ থেকে ২৬১ বছর আগে এমনই দুপুরে পলাশীর অম্রকাননে এমনই বৃষ্টি হচ্ছিল বুঝি! সেই বৃষ্টির পর যে সন্ধ্যা নেমেছিল বাংলার বুকে সেই সন্ধ্যা ২০০ বছরের ইংরেজ শাসনে নিকষ আঁধারে রূপ নিয়েছিল। তাই এ যুদ্ধ নিয়ে বিস্তর আলোচনা হয়েছে। আলোচনার মূল বিষয়ই ছিল শত্রু মিত্র নিরুপণ। আমরা ছোটবেলা থেকে জেনে আসছি মীর জাফরের বিশ্বাসঘাতকতার কারণে এ যুদ্ধে নবাব পরাজয় বরণ করেন। কিন্তু আজ থেকে বছর পাচেঁক আগে সৈয়দ আবুল মকসুদের একটি লেখা প্রথম আমাকে ধাক্কা দেয়। তারপর ইতিহাসের বিভিন্ন সূত্র ধরে বিষয়টি নিয়ে আমি ভাবতে শুরু করি। আগেই বলে নেই, আমি ইতিহাসের ছাত্র নই। আমার চিন্তা ও দৃষ্টিভঙ্গিতে ভুল থাকতে পারে। ভুল থাকলে ধরিয়ে দেয়ার অনুরোধ রইল।

২৩ জুন ১৭৫৭ সাল, বৃহস্পতিবার। কি হয়েছিল সেদিন পলাশীর আম্রকাননে?

চারদিকে রণপ্রস্তুতি । থমথমে একটা ভাব। মেঘলা আকাশ। তার ফাঁক দিয়ে উকিঁ দিলো দিনের প্রথম আলো। যতদূর চোখ যায় শুধু আম গাছ আর আম গাছ। মধ্য দিয়ে বয়ে গেছে ভগীরথী নদী। দিনের আলো পরিষ্কার হতেই দেখা গেলো আম্রকাননের দক্ষিণে মাত্র ৩ হাজার সৈন্য নিয়ে অবস্থান নিয়েছে কর্নেল রবার্ট ক্লাইভের নেতৃত্বে ইংরেজ বাহিনী। সংখ্যায় তারা কম, কিন্তু সুশৃঙ্খল এবং সংগঠিত। এদিকে দক্ষিণের এ কোণটা বাদে পুরো অঞ্চল জুড়ে আছে বাংলার নবাব সিরাজউদ্দৌলার বিশাল বাহিনী। এখানে রয়েছে ৫০ হাজার পদাতিক বাহিনী। ১৫ হাজার ঘোড়া। ঘোড়ার ক্ষুরের শব্দ আর হ্রেষায় ভোরের স্নিগ্ধতা বিপন্ন। অর্থাৎ সৈন্য সংখ্যার দিকে নবাবের বাহিনী ইংরেজ বাহিনীর সাড়ে ১৬ গুণের চেয়েও বড়ো। গোলন্দাজ শক্তিতেও নবাব অনেক এগিয়ে। নবাবের রয়েছে ৫৩ টি কামান। অন্য দিকে ইংরেজের মাত্র ৯ টি!

সকাল ৮ টায়  হঠাৎ করেই মীর মদন ইংরেজ বাহিনীকে আক্রমণ করেন। তাঁর প্রবল আক্রমণে টিকতে না পেরে ক্লাইভ তাঁর সেনাবাহিনী নিয়ে আমবাগানে আশ্রয় নেন। ক্লাইভ কিছুটা বিচলিত হয়ে পড়েন। আত্মরক্ষা করে কোন রকমে টিকে থাকতে চাইছিলেন আর অপেক্ষা করছিলেন আকাশের কালো মেঘগুলো বৃষ্টি হয়ে ঝরার। দুপুর হাতে না হতেই শুরু হয় তুমুল বৃষ্টি। ক্লাইভের মুখে হাসি ফুটে ওঠে। সে কালে তো রেইন কোট ছিল না। মীর মদনের সৈন্যবাহিনী যুদ্ধ ফেলে তাই শিবিরে এসে মাথা গুঁজছিল। রবার্ট ক্লাইভ যেন এ মুহূর্তের অপেক্ষায় ছিল এতোক্ষণ। ইংরেজদের ৯ টি কামান এক যোগে গর্জে উঠল। নবাবের গোলন্দাজ বাহিনীও তৎপর হয়ে উঠল। কিন্তু একটা গোলাও নিক্ষেপ করতে পারল না। সব গোলা বারুদ বৃষ্টিতে ভিজে এক শা। এই আকাশের বৃষ্টি আর গোলার বৃষ্টির মধ্যে মীর মদন ঠিকই ছুটে গিয়েছিলেন প্রতিরোধে। তাকে গোলার আঘাতে প্রাণ দিতে হয়। প্রাণ দেন নবাবের গোলন্দাজ বাহিনীর প্রধান নবে সিং হাজারী ও বাহাদুর খান।  নবাব তখন মীর জাফরকে আদেশ দিলেন ১৫ হাজার অশ্বারোহী নিয়ে ইংরেজদের উপর ঝাপিয়েঁ পড়তে। মীর জাফর জানালেন গোলন্দাজ বাহিনীর সমর্থন ছাড়া ইংরেজদের উপর আক্রমণ করা হবে একপ্রকার আত্মহত্যা। যাদের রণকৌশল সম্পর্কে ধারণা আছে, আমার বিশ্বাস, তারা মীর জাফরের সিদ্ধান্তকে যুক্তিযুক্তই ভাববেন। বিকেলের দিকে নবাবের পক্ষ থেকে যুদ্ধবিরতির আহবান পাঠানো হয়। কিন্তু ক্লাইভ তা প্রত্যাখ্যান করেন। তিনি যুদ্ধ চালিয়ে যান। নবাব প্রতিরোধ গড়া তো দূরে থাক, হাজার হাজার সৈন্যকে রণক্ষেত্রে রেখে মাত্র ২ হাজার সৈন্য নিয়ে রাজধানী বাঁচাতে চম্পট দেন।

দেখুন বৃষ্টি আর গোলা-বারুদ ৫০ হাজার সৈন্যের একটা বাহিনীকে ৩হাজার সৈন্যের একটা বাহিনীর কাছে হারিয়ে দেয়। বলতে পারেন মীর জাফরের বিশ্বাসঘাতকতার কথা। মীর জাফরের সৈন্যদলের বাইরে ৫ হাজার নিজস্ব সৈনিক ছিল নবাবের। নবাব ত চাইলে এই সৈন্য দিয়েই ইংরেজদের পরাভূত করতে পারতেন। কই করলেন না তো!

সৈয়দ আবুল মাকসুদের বিশ্লেষণে নবাবের পরাজয়ের প্রধান কারণ তেরপাল। ইংরেজরা ততদিনে তেরপাল আবিষ্কার করে ফেলেছিল। এই তেরপালের গুণে তাদের গোলা বারুদের কোন ক্ষতি হয়নি। এই তেরপাল যদি নবাবের কাছে থাকত, তাহলে পদাতিক বাহিনী লাগত না, ৫৩ টি কামানের গোলা বর্ষণে ছিন্ন ভিন্ন হয়ে যেত ইংরেজ বাহিনী।

আমার দৃষ্টিতে আরো যেসব কারণ নেপথ্যে ছিল-

  • প্রযুক্তি জ্ঞানের অভাব;
  • নবাবের বাহিনীর প্রশিক্ষণ ও পেশাদারিত্বের অভাব;
  • নবাবের অনভিজ্ঞতা ও সিদ্ধান্তহীনতা;
  • আলীবর্দি খাঁ’র অযৌক্তিক আবেগ। বড়ো কন্যার স্বামীকে রেখে ছোট কন্যার পুত্রকে উত্তরাধিকারী নির্বাচন;
  • কন্যা তিনজনকে তিন ভাতুস্পুত্রের সাথে বিয়ে দেয়া। এতেই প্রাসাদ ষড়যন্ত্র উৎসাহিত হয়;

তাই গৎবাঁধা দোষারোপ আর ষড়যন্ত্রের সংস্কৃতি থেকে আমাদের বেরিয়ে আসা উচিত।  আসুন, আত্মসমালোচনা ও আত্মবোধনের সংস্কৃতির সুচনা করি।

জয়দীপ দে। জন্ম ১৯৮০ সালে। চট্টগ্রামে। রেলওয়ে হাসপাতালে। বাবা ছিলেন রেলওয়ের ইঞ্জিনিয়ার। সে সূত্রে রেল পাড়ায় বড়ো হওয়া। আদিভিটে সিলেটের গোলপগঞ্জ উপজেলায়। অবশ্য পঞ্চাশের দশকের কোন একসময় তা হাতছাড়া হয়ে যায়। পড়াশোনা চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে। বিষয় ছিল চারুকলা। সে সময় সাংস্কৃতিক...

এই বিভাগের অন্যান্য লেখাসমূহ

কলিম খান: সাধারণ থেকে অসাধারণ হয়ে ওঠা এক অত্যাশ্চর্য্য রাজপুত্রের রূপকথা

কলিম খান: সাধারণ থেকে অসাধারণ হয়ে ওঠা এক অত্যাশ্চর্য্য রাজপুত্রের রূপকথা [ কলিম খানের অকাল…..

পূর্ব বাঙলার অসংস্কৃত জনসমাজের আবশ্যিকতা হোসেন মিয়া

পূর্ব বাঙলার অসংস্কৃত জনসমাজের আবশ্যিকতা হোসেন মিয়া

ভূমিকা: লেখাটি পদ্মা নদীর মাঝি উপন্যাসের একটি চরিত্রের বিশ্লেষণ করা হয়েছে। সেখানে উপন্যাসটির শিল্পমান, উপন্যাস…..