অতঃপর ভালোবাসা, মাতৃত্ব এবং সন্তান

মেহেরুন্নেছা
নারী, প্রবন্ধ
Bengali
অতঃপর ভালোবাসা, মাতৃত্ব এবং সন্তান

ধরুন লক্ষ লক্ষ বছর আগে গহীন পাহাড়ের পাদদেশে বয়ে চলা কোনো স্রোতস্বিনীতে পেটানো শরীরের এক যুবক মাছ শিকার করছে। কাছেই কোনো পাহাড়ের আড়াল থেকে আরেক যুবতী মুগ্ধ ও বিস্ময়ে চেয়ে আছে যুবকের ধারাল-ভরাট শরীরের দিকে। হঠাৎ যুবকটি বুনো জানোয়ারের কবলে পড়ে গেলো। যুবক নিজেকে বাঁচানোর জন্য প্রাণপণ লড়াই করছে। এমনসময় জানোয়ারটিকে কোথা থেকে একটা তীর এসে বিদ্ধ করে। নিস্তেজ হয়ে পড়ে পশুটি। যুবক ওঠে দাঁড়ায়। অবাক হয়ে দেখে তার সামনে অপরূপা এক যুবতী।

তখনো মানুষ কথা বলতে শিখেনি। মনের ভাব প্রকাশ করতো আকার-ইঙ্গিতে। এটা সে সময়কার ঘটনা যখন আদিম মানুষ জন্তু-জানোয়ার ও প্রকৃতির রোষানল থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য দলবদ্ধ হয়ে বাস করতো। কাঁচা ফলমূল খেতো। শিকারের পর শক্তিশালীরাই জোর খাটিয়ে নির্দয়ভাবে বেশটুকু সাবাড় করে ফেলতো। অপেক্ষাকৃত দুর্বলরা হয়তো উচ্ছিষ্ট খেয়ে জীবন ধারণ করতো। তারা ইচ্ছেমতো যৌনাচারে লিপ্ত হতো। মানুষে-মানুষে, গোত্রে-গোত্রে, প্রতিকূল পরিবেশে টিকে থাকার জন্য প্রতিনিয়ত তাদের লড়াই করতে হতো। কেবল বেঁচে থাকার জন্য কি দুঃসহ ছিলো সে টিকে থাকার লড়াই!

ভীত-সন্ত্রস্ত যুবক পালাতে উদ্যত হতেই মেয়েটি ইঙ্গিতে বুঝিয়ে দিলো সে যুবকের জন্য মোটেই বিপদজনক নয়। তারপর দুজনে হাঁটতে লাগলো।

কিছু পরে যুবক বিদায় নিয়ে তার গোত্রের সদস্যদের সাথে মিলিত হওয়ার জন্য গোত্রমুখী হলো। এদিকে মেয়েটি যুবকের পথপানে নিবিষ্টচিত্তে তাকিয়ে রইলো। মনে হচ্ছে ধাবমান পুরুষটি তার ভেতরের সর্বস্ব কেড়ে নিয়ে চিরতরে হারিয়ে যাচ্ছে। মেয়েটির ভেতরটা মোচড়ে উঠলো। হঠাৎ তার চেহারায় অস্পষ্ট কিছু অভিব্যক্তি ফুটে উঠলো। সে দৌড়াতে লাগল যুবকের দিকে। যুবক মেয়েটির আগমন টের পেয়ে থামে। অতঃপর মেয়েটি দন্ডায়মান ছেলেটির সামনে হাঁটু গেঁড়ে বসে। ছলছলে দৃষ্টিতে মুখ তুলে তাকায়। তার গন্ডদেশ বেয়ে গড়িয়ে পড়ে কফোঁটা জল। এটাই বোধহয় পৃথিবীর প্রথম কোনো নারীর ভালোবাসার জল। অবাক হয়ে যুবক এই বুনো মায়াবিনীকে দেখে। যুবকের চোখে-মুখেও তখন আদিম রুক্ষতার পাশাপাশি সম্মুখের নারীর প্রতি অন্যরকম টান। হয়তো ধরার বুকে মানব-মানবীর হৃদয় দিয়ে হৃদয়ের সাথে ভাব বিনিময় এভাবেই শুরু হয়েছিল। প্রাচীন দূনিয়ায় এভাবেই বোধহয় মানব-মানবী ভালোবাসার দৃষ্টি নিয়ে দুজন দুজনের দিকে তাকিয়েছিলো। তারপর তারা খোলা আকাশের নীচে মেতে ওঠে উদ্দাম-আদিম মিলন খেলায়। মিলন শেষে ক্লান্ত ছেলেটি আবার পাড়ি জমায় তার গন্তব্যের উদ্দেশ্যে। মেয়েটি রাজ্যের তৃপ্তি ও আনন্দ নিয়ে ফিরে আসে স্বগোত্রে। কিন্তু এখানে মেয়েটির সাথে বিভিন্ন সময় বিভিন্ন পুরুষ জবরদস্তিমূলক যৌনতায় লিপ্ত হয়। পুরুষের পেশীশক্তির বাহুল্য, জবরদস্তি এবং অনাচার সেই আদিম নারীকেও মেনে নিতে হয়।

একসময় মেয়েটি সন্তান জন্ম দেয়। সন্তানকে কোনোরকম সামাজিক বাধা-বিঘ্ন ছাড়াই সহজাত স্বভাবের শৃঙ্খলে বন্দী মেয়েটি অনায়াসে লালন-পালন করে। তার অপত্যের পিতা কে এমন প্রশ্নের সম্মুখীন হওয়ার মূল্যবোধ তখনকার বুনো সমাজে ছিলোনা। ছিলো কেবল মাতৃত্বজনিত সহজাত আচরণ। পৃথিবীতে তখনো মনুষ্য প্রজাতির মাঝে মায়া-মমতা-পরিবার গড়ে ওঠেনি। কিন্তু মানুষের মাঝে এক ধরণের সহজাত আচরণ দেখা যেতো যা জগতের প্রায় অন্যসব প্রাণীদের মাঝেও কমবেশি বিদ্যমান ছিলো।প্রজাতি হিসেবে টিকে থাকার জন্য প্রাণী তার বংশের ধারা অক্ষুণ্ন রাখতে এই সহজাত আচরণে লিপ্ত হয়। জ্বী! আমি প্রানীর বাৎসল্য আচরণ বা Parental behaviour –এর কথা বলছি। জীবন সংগ্রামে টিকে থাকার জন্য প্রাণীর এ সহজাত আচরণ একধরনের অভিযোজন। জীবজগতে স্তন্যপায়ী প্রাণিতে বাৎসল্য আচরণ সবচেয়ে উন্নত। তবে আশ্চর্য হলেও সত্যি যে, মাছ-পতঙ্গ-উভচর-সরীসৃপ এমনকি পাখির মাঝেও এ বাৎসল্য আচরণ পরিলক্ষিত হয়। আমাদের বুঝতে হবে বাৎসল্য আচরণ মানে সদ্যপ্রসূত সন্তান বা অপত্যের প্রতি যত্ন যেটাকে ইংরেজিতে বলে Care of youngs. সুতরাং এটা স্পষ্ট যে, প্রকৃতি তার সৃষ্ট জীবকে টিকিয়ে রাখার জন্য সহজাত আচরণকে জীনের মাধ্যমে জীবের মাঝে প্রোথিত করে দিয়েছেন।

ক্রমান্বয়ে মানুষ তার অর্জিত জেনেটিক তাড়না দ্বারা জীবকূলের মাঝে নিজেদের অনন্য হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করে চলেছে। আজ এই মনুষ্য প্রজাতি বিবর্তনের ক্রমধাপ পেরিয়ে উন্নত মস্তিষ্ক নিয়ে সহজাত আচরণের বাহিরেও জ্ঞান-মর্যাদা-মায়া-মমতা সমৃদ্ধ এক শ্রেষ্ঠ প্রজাতিতে উপনীত হয়েছে। কিন্তু কালের পরিক্রমায় স্তন্যপায়ী ও যৌন দ্বিরূপী মানুষের মাঝে পুরুষকূল হয়ে ওঠেছে নারীর প্রতি অতিরিক্ত বিদ্বেষপ্রবণ। সমাজ ও সভ্যতার চরম শিখরে পৌঁছলেও নারীরা আদিম কাল হতে বর্তমান সময়ের যৌক্তিক ও মানবতার উন্নত প্রেক্ষাপটে এসেও পুরুষের বাহুবল দ্বারা নীপিড়ন ও বৈষম্যের ক্রমশিকার হয়েই চলেছে। বিশেষ করে নারীর যৌনতা-সন্তান ধারণ-সন্তান পালনে এ বিষয়গুলো প্রকট আকার ধারণ করেছে।

এক্ষেত্রে অনিবার্যভাবে একটা অংশ অপর অংশকে দূর্বল সাব্যস্ত করতে লাগলো। সোজা কথায় বললে ব্যাপারটা শেষ পর্যন্ত এই দাঁড়ায় যে, জৈবিক বৈশিষ্ট্যে ভিন্ন নারী, পুরুষ কর্তৃক অন্যায়ভাবে বৈষম্যের শিকার হলো। এই বৈষম্য প্রাচীনকাল থেকে অদ্যাবধি সভ্যতার এই পর্ব পর্যন্ত চলে আসছে। অথচ প্রতিনিয়ত এই গ্রহের বাসিন্দারা দাবী করে থাকে তারা সভ্যতার চরম শিখরে অবস্থান করছে। কিন্তু নারীর প্রতি যে সামাজিক অমানবিকতার গভীর আঁচড় ফুটে ওঠে তাতে একটা প্রশ্নই জেগে ওঠে মনে, সমাজটাকে কি আদৌ নারীবান্ধব করতে পেরেছে এই সভ্যতা ? নারীকে তার প্রাপ্য মর্যাদার সবটুকু কি ন্যায় ও বিচারমতো দেয়া হচ্ছে?

আমি মনে করি, জৈবিক বৈশিষ্ট্যের ভিন্নতার মধ্যে নারীর কামরূপ ও পুরুষের কামরূপের পার্থক্যের প্রকটতা সমাজকে নারীর প্রতি আরো বেশী বৈষম্য সৃষ্টিতে উস্কে দিয়েছে; নারীর প্রতি পুরুষকে সহিংস করে তুলেছে। যদিও প্রকৃতির খেয়াল পুরুষ এবং নারীর দৈহিক গঠনে এনেছে আমূল বৈচিত্র্য অথচ তার খেসারত নারীকে হয়তো পৃথিবী নিশ্চিহ্ন হওয়া পর্যন্ত দিয়ে যেতে হবে।

প্রকৃতির অপূর্ব সৃষ্টি এই নারী। জগতের শোভা নারী। রূপে, যৌনতায়, কোমলতায় নারী হয়ে উঠেছে পৃথিবীর একমাত্র প্রিয়দর্শিণী। এমনকি জৈবিক গবেষণা ও পর্যবেক্ষণে পুরুষের তুলনায় নারীর যৌনক্ষমতা অধিক বলে প্রতীয়মান হয়েছে। শুনতে এবং মানতে কষ্ট হলেও নারী সম্পর্কে  নিগূঢ় সত্য হলো, নারীর প্রতি পুরুষের ঈর্ষামূলক মনোভাবের জন্য নারীর রূপের পাশাপাশি নারীর যৌনশক্তিও কোনো অংশে দায়ী কম নয়।পৃথিবীর ইতিহাসে নারীর সাথে ঘটে যাওয়া নেতিবাচক কর্মকান্ডগুলো অন্তত এই সত্যের দিকেই ইঙ্গিত হানে।

এই উপমহাদেশীয় সমাজে ধর্মীয় ও কট্টর সামাজিক শৃঙ্খলে বন্দী নারীর যৌনশক্তি বেশিরভাগ ক্ষেত্রে অবদমিত থাকে। বপনকৃত বীজের ন্যায় যত্নের অভাবে সুপ্ত থাকে। সুপ্ত রাখতে নারী বাধ্য হয়। কেননা নারীর যৌনসুখ উদযাপন নির্ভর করে তার পুরুষ সঙ্গীর উপর। এক্ষেত্রে হয়তো উন্নত দেশে নারী সঙ্গী নির্বাচনে স্বাধীন হলেও আমাদের দেশে নারীদের অবস্থা খুবই নাজুক। ধর্ম এক্ষেত্রে ডিভোর্সের বিধান রেখে নারীর পক্ষে থাকলেও আমাদের রক্ষণশীল সমাজ নারীর পক্ষাবলম্বন করেনা। সমাজ নারীর ডিভোর্স এবং দ্বিতীয় বিয়েকে সুনজরে দেখেনা; অথচ ধর্মে স্পষ্টভাবে ডিভোর্সের উল্লেখ রয়েছে। এই এতোকাল পরেও সভ্যতার ক্রমবিকাশের সেই নদীটিতে যখন অনেক জল গড়িয়ে গেলো তখনো অবশেষে এ সমাজকে পুরুষের ক্ষেত্রেই বড্ড বেশি  নীরব ও সহনশীল ভূমিকায় তৎপর হতে দেখা গেলো।

আরেকটা কথা না বললেই নয়, ধর্ম ও সমাজ কোনো অবস্থাতেই বিবাহবহির্ভূত সম্পর্ককে অনুমোদন করেনা। মেনে নেয়না। ফলে এই যৌনসুখ  কিংবা মনের সুখের জন্য অনেক সময় নারী প্রথাবিরোধী হয়ে ওঠে।বেপরোয়া হয়ে গোপনে নিষিদ্ধ পথে হাঁটে। তখন তাকে সামাজিক অপদস্ততার  কবলে পড়ে ব্যাভিচারীর মতো ন্যাক্কারজনক অশ্লীল বাক্যবাণে জর্জরিত হতে হয়। এখানেও একতরফাভাবে নারীকেই ঘায়েল করা হয়। নারীর নিষিদ্ধ পথের সঙ্গী একজন পুরুষ হলেও তার প্রতি সমাজ সমভাবে কপট ভূমিকায় অবতীর্ণ হয় না। 

সবচেয়ে কষ্টদায়ক হলো জীবিকার প্রয়োজনে যৌনতাকে পেশা হিসেবে নিলে নারীকে বেশ্যা‘, ‘মাগী‘, ‘খানকিএসব শব্দ প্রয়োগে সামাজিকভাবে হেয় ও নাস্তানুবাদ করা হয়।  আদতে এই শব্দগুলোর কোনো পুরুষবাচক শব্দও নেই।

তাহলে নারীর প্রতি এই ন্যাক্কারজনক বৈষম্যের মৌলিক মনস্তাত্ত্বিক বিশ্লেষণটা কি দাঁড়ায়?

প্রকৃতপক্ষে যৌনতায় শক্তিশালী নারীর কাছে দূর্বল পুরুষের আধিপত্য ও অন্যায় অধিকার টিকিয়ে রাখার স্বার্থে বেপরোয়া-অযৌক্তিক পুরুষতন্ত্র বরাবর ধর্ম ও সমাজকে নারীকে অবদমনের হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করে আসছে।

দেখুন, তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায় তাঁর বিখ্যাত কবিউপন্যাসে নারীর যৌনতাকে কিভাবে ব্যাখ্যা করেছেন—

রূপোপজীবিনী নারীর আজীবনের বহু ভোগের নেশা। সুরুচিসম্পন্ন বেশভূষা, সুশ্রী লোকটিকে দেখিয়া বসন্তর মনে অভ্যাসের নেশা জাগিয়া উঠিল। কটাক্ষ হানিয়া মুচকি হাসিয়া বসন্ত তাহাকে হাত ধরিয়া ঘরে লইয়া গেল।

মাসিও হাসিল। সে তো জানে, এ বিষ একবার ঢুকিলে—প্রেমের অমৃত সমুদ্রেও তাহাকে শোধন করা যায়না। বসন্তর শরীর ভালো হইয়া গিয়াছে।”

হে পাঠক! উপরোক্ত উক্তিতে স্পষ্ট প্রতীয়মান হলো, তারাশঙ্করও প্রথাগত ভাবনার বাহিরে আসতে পারেননি। তিনি নারীর জৈবিক চাহিদার তৃপ্তির বিষয়টাকে নেতিবাচকভাবে তুলে ধরেছেন। নারীর যৌন তৃপ্তি ও প্রশান্তিকে বিষবলে নারীর স্বাভাবিক যৌনাকাঙ্ক্ষাকে অমর্যাদা করেছেন। খুব কৌশলে যৌনতার পেশায় নিয়োজিত নারীকে সরাসরি বেশ্যানা বলে রূপোপজীবিনীবলেছেন। অথচ এই রূপোপজীবিনীবসন্তভালোবাসে কবিয়াল নিতাইকে। জীবন ও জীবিকার তাগিদেই বসন্তকে ইচ্ছাবিরুদ্ধ বহুগামিতায় নামতে হয়েছে। এ নিয়ে বসন্তর ভেতরে আছে চরম আক্ষেপ।

তারাশঙ্কর তাঁর কবিউপন্যাসে নারীর এই পেশাকে বহু ভোগের নেশাবলেছেন। এটা নারীর প্রতি বিষোদগার ও অন্যায়। কারণ, ইচ্ছাবিরুদ্ধ এই পেশা প্রকৃতপক্ষে নারীর অমোঘ নিয়তি। যেখানে বাধ্য হয়ে নারীকে এই অসম্মান ও সামাজিক স্বিকৃতীহীন পেশাকে বেছে নিতে হয় সেখানে নারীকে এভাবে উপস্থাপন করাটা অবশ্যই নারীর প্রতি অবিচার।

অথচ আদিম নারী ছিলো স্বাধীন। সে তার ভালোলাগার মানুষের সাথে নির্বিঘ্নে রতিক্রিয়ায় লিপ্ত হতে পেরেছে। যদিও গোত্রের মধ্যে তাকে কতক পুরুষ কর্তৃক জোরপূর্বক যৌন লালসার শিকার হতে হয়েছে। ফলশ্রুতিতে যে সন্তান হলো সে সন্তানের পিতা কে তা ঐ জন্মদাত্রীর পক্ষে জানা সম্ভব ছিলোনা। তখনো সমাজ বৈধআর অবৈধএর ঘেরাটোপে পড়েনি। কিন্তু ঐ আদিম নারী যে সন্তান জন্ম দিলো তার মা কেবল ঐ আদিম নারীই। অর্থাৎ পৃথিবীতে সন্তান জন্ম দিতে পারে কেবল একজন নারী এবং একমাত্র ঐ নারীই হলো সেই সন্তানের মা। প্রকৃতি জন্মদাত্রী মাদুইজন হওয়ার কোনো সুযোগ রাখেনি। এটাও নারীর জন্য প্রকৃতির এক মর্যাদাপূর্ণ উপহার। নারী তার সহজাত সন্তান বাৎসল্যতা এবং মাতৃত্বের অনুভূতির অংশ হিসেবে মায়া-মমতায় জড়িয়ে গর্ভপ্রসূত সন্তানকে বড় করে তোলে।

একজন আদিম নারী আর একজন আধুনিক নারীর জৈবিক তাড়নার মাঝে কোনো তফাৎ নেই। মাতৃত্বের অনুভবও তাদের একই সূত্রে গাঁথা। কিন্তু এই তাড়না নিবারণে আদিম নারীর প্রেক্ষাপট ছিলো অনেকটাই অনুকূল। এর স্থলে আধুনিক নারীর প্রেক্ষাপট অনেকক্ষেত্রে একেবারে বিপরীত। যেমন —আধুনিক নারীর বিবাহবহির্ভূত  সন্তান নির্বিঘ্নে লালন-পালনের প্রশ্নই আসেনা।এ ব্যাপারে ধর্ম ও সমাজ মা ও শিশুর প্রতি মারাত্মক কঠিন ও নির্বিকার।

আধুনিক সভ্যতায় এখনো আমাদের মতো দেশে বিবাহবহির্ভূত সন্তানকে অবৈধআখ্যা দিয়ে সামাজিকভাবে নরকে নিক্ষেপ করা হয়। আমরা ভুলে যাই মানবশিশুর জন্মের উপর তার কোনো হাত নেই। জন্মটা অবশ্যই প্রকৃতির একটি দৈব-দুর্বিপাক ঘটনা। সুতরাং যে শিশু মাতৃজঠর হতে ধরার বুকে পিঠ ছোঁয়ালো তার মধ্যে কোনো পাপের বোঝা চাপিয়ে দেয়া সভ্য সমাজে কাম্য হতে পারেনা। আর অবৈধ সন্তানএর জন্মদাত্রী মায়ের পরিণতি হয় আরো ভয়াবহ। প্রখ্যাত ঔপন্যাসিক শওকত ওসমান তাঁর জননীউপন্যাসে এমনি এক জননীর করুণ চিত্র তুলে ধরেছেন। উপন্যাসের কেন্দ্রীয় চরিত্র দরিয়াবৌদারিদ্র্যের করাল থাবায় নিষ্পেষিত হয়।  ঘটনাচক্রে এক লম্পট ও অবিবেচক পুরুষ যে কিনা তার স্বামীর দিকের আত্মীয়, সহানুভূতির ছদ্মবেশে দরিয়াবৌ-এর দিকে লোলুপ দৃষ্টি হানে। একসময় সে অসতর্কতাবশতঃ ঐ পাপিষ্ঠ পুরুষের খপ্পরে নিপতিত হয়। তার কয়েকমাস পরে রাতের আঁধারে সমাজের ঘৃণা, শাস্তি ও রক্তচক্ষুর ভয়ে রান্নাঘরে অবশেষে নিজেই নিজের গর্ভকে ভারমুক্ত করে ! দরিয়াবৌ কেবল স্বহস্তে প্রসব ঘটিয়ে নিস্তার পায়নি, ধর্ম ও সমাজের নিষ্ঠুর-নির্মম গ্লানি থেকে বাঁচতে আত্মহত্যার পথও বেছে নেয়। তবে জননী হয়ে দরিয়াবৌনিজেকে চিরতরে নিঃশেষ করতে পারলেও সন্তানকে সে সর্বনাশের পথে নিয়ে যেতে পারেনি। এখানেই মাতৃত্বের বিজয় ফুটে ওঠেছে। শওকত ওসমান তার কালজয়ী এই জননীউপন্যাসে মাতৃত্বের জয়গান গেয়েছেন। দরিয়াবৌ তার আগের সন্তানদের যেভাবে নিয়তির কাছে সমর্পণ করলো ঠিক সেভাবে তার সদ্য প্রসূত সন্তানকেও যে কিনা সমাজের চোখে ছিলো অবৈধ তাকেও একইভাবে পৃথিবীর বুকে রেখে গেলো।

তাহলে প্রশ্ন ওঠে দরিয়াবৌএর এই করুণ পরিণতির জন্য দায়ী কে? অবশ্যই এদেশের দারিদ্র্যপীড়িত-ধর্মান্ধ-অনগ্রসর সমাজ। সমাজের নষ্ট পুরুষতন্ত্রের করাল থাবা দরিয়াবৌকে পৃথিবী থেকে চিরতরে নিশ্চিহ্ন করে ছেড়েছে।

সভ্যতা এগিয়েছে বটে কিন্তু বিবাহবহির্ভূত ভালোবাসাকে মর্যাদা দেয়া এবং বিবাহবহির্ভূত সন্তানকে স্বাভাবিক শিশুর মর্যাদা পুরুষতান্ত্রিকতায় বন্দী এ সমাজ আজো দিতে পারেনি। নর-নারীর ভালোবাসা এবং তাদের ভালোবাসার ফসল সন্তান কখনো অবৈধ হতে পারেনা। ভালোবাসা এবং জন্ম— দুটোই মানবজাতির জন্য প্রকৃতি নির্ধারিত আশীর্বাদ। অথচ ক্ষেত্রবিশেষে এ দুটোতেই মানবজাতি কেবল নারীকে দমিয়ে রাখার জন্য অন্যায়ভাবে পাপের সিলগালা লাগিয়ে দেয়। ধর্ম ও সমাজ কর্তৃক এক তরফা নির্ধারিত অবৈধ ভালোবাসাঅবৈধ সন্তানএর খেসারত সবশেষে তথাকথিত দূর্বল (পুরুষ কর্তৃক আরোপিত) নারীকেই দিতে হয়। আবহমানকাল হতে ধর্ম ও সমাজকে পুরুষতান্ত্রিকতা সেভাবেই চালিত করে আসছে।

আমি এমন সমাজের স্বপ্ন এঁকে যাই, যে সমাজে অবৈধ ভালোবাসা‘, ‘অবৈধ সন্তান‘ ‘অবৈধ মাবলে কোনো কিছুর অস্তিত্ব থাকবেনা। সেটাই হবে সত্যিকারের ন্যায়ভিত্তিক-বৈষম্যহীন-উদার-আধুনিক-আলোকিত সমাজ। পারবে কি এ দেশ তেমন সমাজ গড়তে?

মেহেরুন্নেছা। গল্পকার ও শিক্ষক। জন্ম ও বাস বাংলাদেশ। পেশাগত জীবনে তিনি কুমিল্লা ভিক্টোরিয়া সরকারি কলেজে উদ্ভিদবিজ্ঞান বিভাগে সহযোগী অধ্যাপক হিসেবে কর্মরত।

এই বিভাগের অন্যান্য লেখাসমূহ

নারীর আপন ভাগ্য জয় করিবার: নারীজাগৃতি ও রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের কবিতা।

নারীর আপন ভাগ্য জয় করিবার: নারীজাগৃতি ও রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের কবিতা।

নবজাগরণের সঙ্গে নারীর জাগরণ, নারীর মর্যাদা ও সুরক্ষা, এবং নারীমুক্তি ওতপ্রোতভাবে জড়িত। ভারতে এই নবজাগরণের…..