আত্মহত্যার আগে

ভজন দত্ত
ছোটগল্প
Bengali
আত্মহত্যার আগে

“সব রাঙা কামনার শিয়রে  যে দেয়ালের মতো এসে জাগে ধুসর মৃত্যুর মুখ;”

রাত কত হবে! আলো জ্বালিয়ে ঘড়িটা দেখে নেয় কিংশুক। আড়াইটা বাজতে একটু দেরি আছে। দোতলার  ব্যালকনিতে এসে সিগারেট ধরায়। রাত্রির এক অপরূপ সৌন্দর্য্য আছে। আছে একটা মোহ, একটা অপেক্ষা। রাঙা আলোর অপেক্ষা। নিঃশব্দে একটা আস্তদিন লুকিয়ে থাকে রাতের পেটের ভিতর।

নাগরিক ট্রেনের হুইশেল এইমাত্র নিস্তব্ধতা ভেঙে টুকরো টুকরো করে ছড়িয়ে দিলো নগরের কোণায় কোণায়। একাকী এক শহুরে কুকুর ভৌ ভৌ করে ডেকে উঠে যেন জানতে চাইলো, ‘কটা বাজে হে!’

নীচের বস্তিটা এখন একদম চুপচাপ। গৃহস্থের নারকেল গাছগুলো মাথা তুলে যেন নগর পাহারা দিচ্ছে। গৃহস্থী-রক্ষণে সে যেন সবার আগে! ল্যাম্পপোস্টের আলো এসে পড়েছে পাশের প্রায় মজে যাওয়া এক ডোবায়। হ্যাঁ, একদা পুকুর কেমন কেমন একটু একটু করে মজে ডোবা হয়ে যায় তা কিংশুক দেখেছে। যেটুকু জল আছে সেই ডোবায় তাই আলোছায়া মেখে বড়ো মায়াময় লাগে ওর। সেখানে কোনও আন্দোলন নেই, কম্পন নেই নিস্তরঙ্গ, স্থির। যেন যুগযুগ ধরে সে এমনই অন্ধকারে আলোছায়া মেখে এক অনন্ত যাত্রার উদ্দেশ্যে বসে আছে! কেউ কি তাকে নিয়ে যাবে, হাত ধরে বলবে, ‘চলো, ঢের হলো, এবার হাঁটা যাক!’

চাঁদটা এখন সম্পূর্ণ একটা বৃত্ত হয়ে যেন দূর থেকে কিংশুককে ভেংচি কেটে যাচ্ছে। রাত্রির প্রকাণ্ড গহ্বরে চাঁদ যেন একটা নিভুনিভু মোমবাতি! ওই মোমবাতি হাতে কালো কালো পথ আলো করে হেঁটে যাবে বলে ভেবেছিল যে কিংশুক, সেই কিংশুক আজ কেন ভাবছে, আত্মহত্যার কথা!

‘ওই দূর নক্ষত্রের কাছে সব বলে আজ আমার মুক্তি!’– মনে মনে কথাক’টি বলে কিংশুক মশারি তুলে আবার বিছানার পেটের ভেতর আশ্রয় নেয়।

নীচ থেকে একটা শব্দ হলো যেন! লাইটটা কি কেউ জ্বালালো! চোখ খুলে ভালো করে ঠাওর করার চেষ্টা করে। না, কেউ না। সোজা হয়ে শুয়ে তাকিয়ে সিলিং ফ্যানটার দিকে তাকায়। ভাবে, ‘ওটাতে যদি ঝুলে পড়ি, তাহলে কি সেটা ওর সত্তর কেজি ওজনের দেহটার ভার নিতে পারবে! কিন্তু কেন! মরবো কেন! মরলে কী হবে! নাহ! বেঁচে থেকেই সামনে থেকে মোকাবিলা করতে হবে সমস্যার। বর্ণনাকে বলতে হবে, ‘আমি তো এমন চাইনি! তবে…!’

কিংশুক শুয়ে শুয়ে আনমনে ভেবে যায় মৃত্যুকথা।

”চারিদিকে বেজে ওঠে অন্ধকার সমুদ্রের স্বর,-
নতুন রাত্রির সাথে পৃথিবীর বিবাহের গান।”

দুই

“আলোর চুমায় এই পৃথিবীর হৃদয়ের জ্বর
কমে যায় ;- তাই নীল আকাশের স্বাদ-স্বচ্ছলতা-
পূর্ণ করে দিয়ে যায় পৃথিবীর ক্ষুধিত গহ্বর ;”

কিংশুক বর্ণনার বিয়ে হয়েছিল প্রেমের বিয়ে, ভালোবাসার বিয়ে। তখন আলোয় আলোয় অজানাকে জানার, বন্ধনে মুক্তির মুগ্ধতায় ঝংকৃত হয়েছিল তাদের জীবনবীণার তার। জাদুময়তার সেই সুর ছড়িয়েছিল সংসারে। পৃথিবীর সমস্ত প্রশান্তি মেখে এক ফুটফুটে সন্তানের জনকজননী হয়েছিল দু’জনে। ঝড়ঝাপটায় শুধু পালে চোখ রেখে কাটিয়েছে দীর্ঘ বাইশবছর। ছেলের বয়স এখন কুড়ি। সে চলে গেছে বাইরে মেডিকেল পড়তে। সুখের সংসার ওদের। তবুও কিসের এক অতৃপ্তি নিয়ে বর্ণার এত ক্ষোভ! কেন! কেন সে ল্যাপটপ নিয়ে বসে থাকে ঘণ্টার পর ঘণ্টা! শুয়ে শুয়ে ভাবতে ভাবতে বুকের বাঁদিকেই ব্যথা অনুভব করে কিংশুক।

আঃ! যদি এই ব্যথাতেই শুয়ে শুয়ে সে মারা যেত, তাহলে একটুও দুঃখ থাকতো না। আহা! সে বড়ো মনোরম মৃত্যু! এই পঞ্চাশোর্ধ জীবনে তার তো আর পাওয়ার কিছু নেই। হারাবারই কি কিছু আছে! কেন বর্ণার হৃদয় ওকে ‘ব্যাধের মতো ব্যথা’ দেয়! কী দিইনি ওকে! কীসের অতৃপ্তি। এখন তো ওর শরীর ঘুমোয় কুম্ভকর্ণের ঘুম। আমি জেগে থাকি তৃষ্ণার্ত চাতকের মতো। না-কি, রোজকার ডাল-ভাত-তরকারি খেয়ে খেয়ে বিরক্তি থেকে স্বাদ বদল, না-কি, অভ্যস্ত জীবন বাঁচতে বাঁচতে ক্লান্ত! কী পাও বর্ণা! এতো রাত জেগে ল্যাপটপ কোলে! চ্যাট! ছিঃ! আমি ঘেন্না করি। তোমার কি অত-সব কথা সেখানে! পিওর ন্যাকামি, আঁতলামি, আর ভারচুয়াল যৌনতা কি!

ছেলে বড়ো হওয়ার অজুহাতে এবং রাত জেগে সকালে উঠতে যাতে না-হয়, সেজন্য দু’জনে বিছানা আলাদা করে নিয়েছে অনেকদিন! একজন একতলায়, আরেকজন দোতলায়। বর্ণার হাঁটুতে ব্যথা বলে সে একতলায়। আর কিংশুকের সেসবের বালাই নেই। এখনো রোজ সকালে পাঁচটায় বেরিয়ে তার পাঁচ কিমি হাঁটা চাই। হেঁটে ফেরে যখন তখনও বর্ণা বিছানায়। পাশে পড়ে থাকে তার ল্যাপটপ।কখন ঘুমোয় কে জানে!

তিন

কিংশুক এখনো একেকদিন তৃষ্ণার জলের জন্য হাত পাতে বর্ণার কাছে। কখনো বৃষ্টি নামে কখনো শুধু ধুধু খরা। তবুও সে কোনোদিন জোর করে না, জোর খাটায় না। সে চাতক পাখি হয়েই বৃষ্টি কখন জল হয়ে নামবে তার প্রতীক্ষা করে।কেন, কেন,তাকে চাতক পাখি হয়ে থাকতে হবে! সে কি পরিযায়ী! বর্ণা কী জানে না, তার তৃষ্ণা, তার খিদে! কেন, কেন তুমি একটি  দূরতম নক্ষত্র হয়ে থাকবে!

এসব ভাবনার ভেতরে ঘুম শুধুই বুড়বুড়ি কাটে, সে এসে দুচোখের পাতায় বসে না কিছুতেই।কিছুতেই ঘুম আসছে না  কিংশুকের।এই শাশ্বত রাত্রিতে তার জীবনাবসান হলে কার কিইবা এসে যাবে! সে তো জানে,

“মৃত্যু এক শান্ত খেত-সেইখানে পাবো নাকো তারে!”

ঘড়ির কাঁটা স্তব্ধতা ভেঙে এত জোরে জোরে টিকটিক করছে! চিন্তায় ছেদ পড়ে কিংশুকের। আজকের এই রাতটিই কি তার জীবনের শেষ রাত! ওর মনে পড়েঃ

আমারে খুঁজিয়াছিলে তুমি একদিন, –
কখন হারায়ে যাই- এই ভয়ে নয়ন মলিন
করেছিলে তুমি!’

সেই বর্ণা আজ কোথায়! বাড়ি ফিরতে পাঁচ মিনিট দেরি হলে অভিমানে যার ঠোঁট ফুলে থাকতো! কোথায় সে বর্ণা! আজ সেসবই অতীত স্মৃতি। বিষণ্ণ সময় পড়ে গলে যায় অলস মাছির মতো। এই রাত শেষ হলে আমায় আর পাবে না বর্ণা!

আচ্ছা, সিলিং ফ্যান থেকে ঝুলে পড়ে মৃত্যু কি খুব কষ্টের,বেদনার! তাহলে কি ঘুমের বড়ি ভালো হবে! একঘুমের দেশ থেকে আরেক দেশে সহজ চলাচল! রাঙা মৃত্যুর বিষন্নপুরী কি এখন ওরই প্রতীক্ষায়!

কিন্তু ঘুমের বড়ি তো নীচে! মায়ের ঘরে, ওষুধের বাক্সের ভেতর। তাহলে, কীহবে! নাঃ! গলাটা আবার শুকনো লাগছে, বুকের চিনচিন ব্যথাটাও জ্বালাচ্ছে। এটা কি গ্যাসের প্রভাব! ঘুম না আসার পার্শ্ব প্রতিক্রিয়া! ওঃ! এটা যদি সিভিয়র হৃদয়জনিত সমস্যা হতো! তবে বাঁচা যেত! বিছানা থেকে উঠে পড়ে কিংশুক, এটাচড বাথরুমে গিয়ে ভালো করে হাত পা ধুয়ে চোখে মুখে জল দিয়ে আবার একটা সিগারেট ধরিয়ে ব্যালকনিতে এসে দাঁড়ায়।

আবার ডেকে ওঠে সেই একাকী কুকুর। ভৌ ভৌ সুর তুলে সে জানতে চাইলো আবার, ‘ক-টা-বা-জে-হে?’ বড়ো বিষণ্ণ সেই ডাক! কখন সকাল হবে, তার আকুতি ও মিনতি  মিশে আছে এই ডাকে। এখন জ্যোৎস্না যেন মেঘের আড়াল ডিঙিয়ে কাকজ্যোৎস্না  হয়ে গেছে! একেই কী বলা যায়, বাঁধভাঙা  চাঁদের হাঁসি! কোথাও কোনো কোলাহল নেই, নিঃসাড়। এই নিস্তব্ধতায় বড়ো বেমানান ঘড়ির টিকটিক। সময়ের তালে তালে কিংশুকের বুকে হাতুড়ি পেটার শব্দ আর টিকটিক মিশে একাকার! দোলাচলে কিংশুক। সে ওপর থেকে নীচে নেমে এসে মায়ের ঘরে ঢুকবে,নাকি পাশের ঘরে গিয়ে বর্ণার কাছে গিয়ে দাঁড়াবে, ওকে ডেকে তুলবে! ওখানেই সমুদ্রের পারে এখনো দাঁড়িয়ে আছে প্রিয় ভালোবাসা। সে কোন দিকে যাবে, কোন পথে যাবে! কিংশুক ভেবে পায় না, সে কী করবে!

সম্পাদনা: রাখি রশিদ

এই বিভাগের অন্যান্য লেখাসমূহ

পটচিত্র

পটচিত্র

  সৌম দাদুর কাছে থাকতে ভালোবাসত। গ্রামের নাম পাঁচুন্দি।আশেপাশে প্রচুর গ্রাম।সবাই সকলের খবর রাখে।সৌমদীপ এখানকার…..