আদরবাসা

শ্বেতা সরকার
ছোটগল্প
Bengali
আদরবাসা

হাঁসফাঁসে চৈতি সাঁঝে মেসেন্জার পিং করে ওঠে। মৌসমের ম্যাসেজ আসে,

ম্যাডামের কি করা হয়?

ছাদে বসে সূর্যাস্ত দেখছিলো গুঞ্জা। অস্ত যাবার পর আকাশ জুড়ে মায়াবী আলোর খেলা। এই সময়টা গুঞ্জার ভারী ভালো লাগে। চুপ করে আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকে সে। মনে হয় এইভাবেই অনন্তকাল মায়বী আলোয় ডুবে যাক সে। গুঞ্জা টাইপ করে,

সংসার ধর্ম করি আর ভ্যারেন্ডা ভাজি।

আগে কি করা হত?

সেরম কিছু না, তবে কালচারাল গ্রুপের সাথে যোগাযোগ ছিলো, ওই শখের আবৃত্তি, কোরাসে গলা মেলানো, এখন সব বন্ধ, শুধু রান্না আর বাচ্চা।

দুটো স্মাইলি যোগ করে গুঞ্জা।

আর বর, নাকি বর্বর

হাহাহা, ওই আর কি, সে তার নিজের খেয়ালে থাকে।

আমি তো ভেবেছিলাম গান করেন।

হিহিহি নিজের শখের গিটারে টিংটাং করার অভ্যাস আছে বলে কি সবার তাই আছে।

এই রে আপনি ওই সব বোকাবোকা ভিডিও গুলো দেখেছেন নাকি।

হুম দেখিতো, আমার বেশ ভালো লাগে।

তাহলে আপনার ভালো লাগাটাও বলুন। গান যখন নয় তাহলে নিশ্চই লেখেন।

ধুর, ওই ডায়েরির পাতায় দুচারটে আনাড়ী লেখা, পনেরো ষোল বছর উল্টেও দেখিনি।ভুলভাল যত।

আবার উল্টে দেখা হোক, হোকনা কিছু ভুলভাল, লিখে আমাকে দেবেন, আমি পড়বো।

হাহাহা, আচ্ছা আচ্ছা লেখা পেলে লিখবোখন।

সকালে বরের টিফিন মেয়ের স্কুল সব সামলে গুঞ্জা একটু বসে। অনিতা কাজ করতে আসে তখন। বসে বসে হোয়াটসআপের একগাদা গুডমর্নিং দেখে, ভিডিও দেখে, খুব ভালো কিছু পেলে মৌসমকে পাঠায়। দিন পনেরো হলো ফোন নম্বর দেওয়া নেওয়া হয়েছে। তাও আবার গুঞ্জার লেখা পাঠানোর শর্তে। পণ্ডিত রবিশঙ্করের একটা ভিডিও দেখে মৌসমকে ফরোয়ার্ড করে গুঞ্জা। কিছুক্ষন পর ম্যাসেজ আসে।

গুডমর্নিং গুঞ্জা, তুমি এতো নিখুঁত কিভাবে, তোমার সাথে বড় দেরীতে কিন্তু খুব ভালো সময়ে যোগাযোগ হলো।

নিখুঁত??

গোটাচারেক স্মাইলি পাঠায় গুঞ্জা।

আমি ভুলে ভরা হাহাহা।

একলা দুপুরে পুরোনো ডায়েরিটা খুলে বসে গুঞ্জা। আজ সকালেই একটা ভীষণ ভালো কবিতা মৌসমকে সেন্ট করেছিলো সে। বকা খেয়েছে খুব।

বলেছিতো, অন্য কারোর লেখা পাঠাবে না আমায়, শুধু তোমার লেখা পাঠাবে।

কি যে মুশকিলে পড়েছে গুঞ্জা। ডায়েরিটা নিয়ে আপনমনে উল্টে যাচ্ছে। কবেকার সব ভুলভাল কথা লেখা আছে। পড়লে হাসি পায় তার। ফোনটা নিয়ে মৌসমকে নক করলো

হাই

পিং করে একটা হাই তোলার ইমোজি এলো।

হিহিহি এটা কি।

এটা হাই।

কি করছো।

কি আর করবো, অফিসে চেপ্টে গেছি, খাবার সময় পাইনি।

যাহ্, বেলা হয়েছে যে।

হুম গো দেখি একটু পরে, খুব চাপ।

বুবুনের উদাসীনতা ভীষণ খারাপ লাগে গুঞ্জার।বুবুন সব কিছুতেই ভীষণ তাচ্ছিল্য করে গুঞ্জাকে। অথচ গুঞ্জা যথেষ্ট যত্ন নিয়ে সংসার করতে চায়। কিন্তু সমস্ত কিছুতেই খুঁত ধরা বুবুনের উৎকট স্বভাব। প্রেমটাও তুচ্ছ তার কাছে। প্রতিপদে নিজের স্বামীত্ব জাহির করতে পারলেই ধন্য হয় বুবুন। আজকাল ভীষণ একলা বোধ করে গুঞ্জা। খুব অসহায় লাগে নিজেকে। কিছু একটা হাতড়ে বেড়ায় সে। একটু ভরসা, একটু ভালোলাগা, একটা বাড়িয়ে দেওয়া হাত খুঁজে বেড়ায় গুঞ্জা।

গুম হয়ে বসে গুঞ্জা গান শুনছিলো, শুনছিলো বলা ভুল তবে ইউটিউবে গান চালিয়ে হেডফোন কানে গুঁজে স্বাভাবিক হবার চেষ্টা করছিলো। টিংটং করে মৌসমের ম্যাসেজ ঢুকলো।

কি খবর, অন হয়ে আছো কিন্তু পাত্তা নেই।

ভাবলাম অফিসে আছো, কাজে বিরক্ত করি কেন।

তাই কি? নাকি মুড অফ

নাহ্ কিছু না।

বুঝলাম বুঝলাম, কি গান শোনা হচ্ছে।

চমকে ওঠে গুঞ্জা। মৌসম বোঝে কিভাবে!

ওই অনুপমের নতুন গানটা।

তুমি কি করছো।

তোমার সাথে কথা বলছি।

হিহিহি, বস দেখলে চাকরী যাবে, কাজে ফাঁকি হচ্ছে।

তাই বুঝি? তা তোমার কথা বললেনা কিন্তু।

সত্যি বলছি কিছু হয়নি।

তাই বুঝি?
“এবার ভালোবাসতে এলে
অকারণে ভীষণ দুষবো
ভালোবাসার খাঁচার ভেতর
এবার ১টা চাঁদ পুষবো। “

লেখা পড়ে আবার চমকায় গুঞ্জা। অন্যরকম একটা ভালোলাগা জড়িয়ে ধরে তাকে।

ওরেবাবা, শখ কত, চাঁদ পুষবে।

হুম তো

তাই বুঝি?
” ভালোবাসার খাঁচায় ভিতর
পুষতেই পারো ১টা চাঁদ
ভালোবাসা কি খাঁচার গরাদ?
খাঁচা হলেই… ভালোবাসা বাদ।” হিহিহি বুঝলে?

তাই না? খাঁচা হলেই ভালোবাসা বাদ বুঝি?

এই ছকবাঁধা জীবনে ভালোবাসা আসে?

কেন তোমার বর তো বেশ আসে, আসেনা?

ওই আর কি, প্রেমিক হওয়ার ইচ্ছে তার কোনদিনই নেই, ওসব অনুভূতিকে গুরুত্বহীন ব্যাপার মনে করে। স্বামী হতেই সে বেশী ভালোবাসে।

আকাশ ভেঙ্গে ভরা শ্রাবণ নেমেছে। অনিতা কাজ সারছিলো। গুঞ্জা হেডফোনে গান শুনছে, “এমন দিনে তারে বলা যায়/ এমন ঘনঘোর বরষায়… ” । খুব প্রিয় গানটা মৌসমকে সেন্ট করলো। কিছুক্ষন পর মেসেন্জার পিং করলো।

আজ দুপুরে কি ফ্রি আছো?

আছি তো।

তাহলে ফোন করা যাবে কি? বেশ আড্ডা দেওয়া যেত।

যাবে যাবে, ফোন কোরো।

একটা রিকোয়েস্ট ছিলো।।

কি?

ওখানে বৃষ্টি পড়ছে?

হুম গো, প্রচণ্ড।

এই বৃষ্টিতে যদি তোমার একটা ছবি পাওয়া যেত।

হিহিহি, আমি মোটেই সুন্দরী নই, প্রোফাইল পিকগুলো বিউটি মুডে তোলা, ডিপি দেখে ক্র্যাস খেওনা।

যাহ্, তাহলে দেখা হলোনা।

হাহাহা, আচ্ছা আচ্ছা দেবোখন, কাজ সারি টাটা।

দুপুরে বারছয়েক চেষ্টায় পছন্দ মত একটা সেলফি হলো। হোয়াটসঅ্যাপে সেটা পাঠিয়ে দিয়ে টাইপ করলো

হ্যালো।

দুমিনিট প্লিজ ,ফোন করছি।

ও কে।

কিছুক্ষণ স্তব্ধতা। নিস্তব্ধ ঘরে একা গুঞ্জা ঘড়ির টিকটিক আর হার্টবিট টের পেল। রিংটোনের শব্দে চমকে উঠলো সে। নিজেকে যথাসম্ভব সামলে নিয়ে “হ্যালো” বললো গুঞ্জা। ওপাশ থেকে ভীষণ চেনা একটা স্বর ভেসে এলো। যদিও এই প্রথম তারা ফোনে কথা বলছে। তবুও মৌসমের গলা খুব চেনা খুব আপন মনে হলো।

“হ্যাঁ হ্যালো, যা বৃষ্টি পড়ছে বাপরে, দুলাইন হবে নাকি, হোক দুলাইন ইনস্ট্যান্ট”।

গুঞ্জা হাসে, তারপর বলে,

“হতে পারে, যদি তুমি গাইতে পারো “।

“বেশ ইনস্ট্যান্ট লেখার সাথে ইনস্ট্যান্ট গাইবো না হয়, আগে তুমি বলো “।

“কি সব ভুলভাল লেখা, দাঁড়াও ভাবছি “।

“নানা ,আরাম করে বসে আছি দাঁড়াবো কেন “।

“হাহাহাহা, গলা ছেড়ে হাসে গুঞ্জা, বসেই থাকো, কি যে বলি… “

একটু ভেবে গুঞ্জা থেমে থেমে ভাবতে ভাবতে বলে,

“অনেক দিন নদীর কাছে যাইনি।
ধূ-ধূ বালুচর তিরতির নদী অলস ঢলে পড়া দিগন্ত,
অনেক দিন নদীর কাছে যাইনি।
তীর ছাড়া নৌকা, ছুটোছুটি শৈশব, বালিখেলা কৈশোর,
অনেক দিন নদীর কাছে যাইনি।
এখন ব্যস্ত দিন ব্যস্ত অবকাশ ব্যস্ত আমার মন,
অনেক দিন একলা সময় পাইনি।
অনেক দিন নদীর কাছে যাইনি।। “

গুঞ্জা চুপ করে। ওপাশ থেকে মৌসমের খুশি খুশি গলা শোনা যায়।

আরে বাহ্, এই তো, চলো ইনস্ট্যান্ট লেখার সাথে ইনস্ট্যান্ট গান। গিটারে টুংটাং সুর তোলে মৌসম। তারপর গেয়ে ওঠে,

“আমি জনি তুমি আমার নয়
আজ অন্য কারোর পরিচয়
তবে হারাতে কিসের সংশয়
যখন নিয়েছি মেনে পরাজয়
আমি আলেয়ার থেকে আলো ধারেও আনতে পারি
যদি একবার বলো আমি যে তোমার
আমি সারারাত জেগে তারাদের গুনতে পারি
যদি একবার বলো আমি যে তোমার… “

কত কথা যে হলো তারপর,

“আরে নচিকেতার শেষ গানটা, ওই যে এক পুরোনো মসজিদে, কি ভালো যে গেয়েছে “

হ্যাঁ হ্যাঁ তুমি থ্রি ইডিয়টস দেখেছো নিশ্চই, ওই যে বেবীটা যখন আমিরের হাতে এল ! কেঁপে উঠলো! উফ গায়ে কাঁটা দেওয়া সিন “

“তোমার সেদিনের লেখাটাও দারুণ ছিলো, এভাবেই লেখো, যা মনে আসবে লিখবে “

কিভাবে যে দুঘন্টা শেষ হয়ে গেল বোঝা গেলোনা। অনেকদিন পর বন্ধুদের সাথে পুরোনো আড্ডার দিনগুলোর কথা মনে পড়ছিলো গুঞ্জার। বিয়ের এতবছর পর এই প্রথম সে প্রাণভরে বকবক করলো। মৌসম বললো,

“অনেকক্ষণ সময় দিয়েছো আজ, আবার পরে কথা হবে, আমাকেও একটু বেরোতে হবে, বাই “

হুম বাই, কিন্তু তোমার ছবি চাই, ওই সানগ্লাস মার্কা ছবি নয়, ও আমার মোট্টে পছন্দ নয়, সানগ্লাস খুলে ছবি দাও “।

“আচ্ছা আচ্ছা, তোমাকে সানগ্লাস খুলে ছবি দিতে হবে, বেশ দিচ্ছি “।

ফোন অফ হয়। হোয়াটসআপে ছবি আসে। সাথে ম্যাসেজ,

গুডবাই, পরে কথা হবে।

অনিতার কাজ সারা হলে একগাদা জামা কাপড় ধুয়ে স্নান সেরে গুঞ্জা ছাদে এলো, বেলা দেড়টা বাজে। বুবুনের ফিরতে এখনো ঘন্টাখানেক। জামাকাপড় মেলে গুঞ্জা টাইপ করলো,

গুড আফটারনুন ডিয়ার।

সাথে সাথেই মৌসমের ম্যাসেজ এলো,

এই রে

তারসাথে গোটাকতক জিভকাটা ইমোজি।

কি হলো?

আমি দেখলাম তুমি গুড আফটারনুন ডার্লিং লিখেছো।

ওটা মনে হয় তোমারই বলার ইচ্ছে হয়েছে ,তাই দেখেছো।

সত্যি বলছি, তাই দেখলাম।

ভালো তো, ওসবই ভাবো, কাজ আছে অনেক চললাম।

পালালে ডার্লিং।

বললামনা, তোমারই বলতে ইচ্ছে করছে।

তাই তো।

খানকতক জিভকাটা ইমোজি আসে আবার।

এবার জিভটাই কেটে যাবে, বুঝবে মজা।

কি আর বুঝবো, সবই কপাল।

সত্যি বলছি, কাজ আছে, বুবুন ফিরবে, টাটা।

বিড়লা।

রিলায়েন্স হিহিহি।

রাতে খাওয়া শেষ করে সব গুছিয়ে মশারি টাঙিয়ে বারান্দায় বসলো গুঞ্জা। কাল একগাদা রান্না। নিজের জন্মদিনে নিজেকেই রেঁধে শশুড়বাড়ীর একগাদা লোককে খাওয়াতে হবে।মাঝেমাঝে গুঞ্জার ভারী ইচ্ছে করে জন্মদিনটায় দুরে কোথাও পালিয়ে যেতে।বিয়ের পর তা সম্ভব নয়।বসে বসে ফেবু দেখছিলো সে। মৌসম অফ আছে। ব্যাস্ত আছে বোধহয়। মেয়েটার জ্বর হয়েছিল। এখনো সারেনি। ছোট মেয়ে অসুস্থ হলে ঘ্যানঘ্যান করে। বাবাকে ছাড়তে চায়না। হেডফোন গুঁজে গুঞ্জা ফানি ভিডিও দেখছিলো আর হাসছিলো।পিং করে ম্যাসেজ ঢুকলো।

হ্যাপি বার্থডে ডার্লিং, মেনি মেনি হ্যাপি রিটার্ন অফ দি ডে।

সাথে অনেকগুলো লাভ ইমোজি আসে।

থ্যাঙ্কউউউউ, কিন্তু সে তো কাল।

বারোটা বেজে গেছে ডার্লিং।

ওহ্ তাইতো। মেয়ে কেমন আছে।

একটু বেটার, ঘ্যানঘ্যান করছে, ঘুম পাড়িয়ে এলাম, কি চাই বার্থডে গার্ল এর।

আমাকেও ঘুম পাড়িয়ে দাও।

এসো এসো, ঘুম পাড়িয়ে দেবো,কিন্তু…

কিন্তু কি?

যদি পাহারাদার চুরি করে তাহলে।

সে আমি জানিনা, আমি জাপটে ধরে ঘুমিয়ে থাকবো, চুরি করতে পারবেনা।

তোমার কানগুলো আদরে ভরালেও কি চুরি হবেনা?

জানিনা, কেন এসব বলে আমাকে ভয় দেখাও, তোমাকে হারাতে ভয় করে।

কি বিপদ, হারাবো কেন?

জানিনা, তুমিও ওই সব পচা লোকগুলোর মত নাকি, যারা যা তা বলে, তারপর আর খোঁজ নেয়না।

সবাই কি একরকম হয়। বলেছিতো ডার্লিং ভালোবাসি, এটা আমার ভীষণ ভালোলাগার জায়গা গো।

মৌসম ভয়েজ ম্যাসেজ পাঠায়। গুঞ্জা শোনে মৌসম গাইছে,

“আমি ছুটতে ছুটতে থেমে গেছি
উড়তে উড়তে ঘেমে গেছি
আমার পালকে ছুঁয়েছে আলোকে
মুছে দাও ক্লান্তি আমার
আমি বদ্ধ আলো মধ্যরাতে
চাঁদ মেখেছি এ দুহাতে
মেঘের মিনারে চাঁদের কিনারে
বসন্ত হয়ে নামবো আবার
Kiss me close your eyes
Miss me close your eyes… “

জন্মদিনের সেরা উপহার পেয়ে গুঞ্জার চোখে জল আসে। বারবার শোনে গানটা। তারপর টাইপ করে।

যদি কখনো সময় পাও, জড়িয়ে রেখো আমায় বুকের মাঝে, জানি তোমার একটু অস্বস্তি হবে হয়তো একটু ছটফটানিও, তবুও জড়িয়ে রেখো আমায়, এটুকুই চাই আমি।

ফোন অফ করে শুয়ে পড়ে গুঞ্জা। “ভালোবাসি ” বলতে পারার কষ্টমেশা আনন্দ নীরবে চোখ দিয়ে ফোঁটায় ফোঁটায় গড়িয়ে পড়তে থাকে।সকালে ম্যাসেজ দেখে গুঞ্জা,

তাই হবে, আজীবন…, এই ভাবেই বয়ে যেও তুমি, ভালোথেকো, ভালোরেখো আগামীকে।

বক্স খাটের ভিতর পরিষ্কার করতে গিয়ে পুরোনো অ্যালবাম পেল গুঞ্জা। মাধ্যমিক দেওয়ার সময়ের একটা ছবি পেয়ে সেটা হোয়াটস অ্যাপের ডিপিতে লটকে দিলো। কিছু পরে মৌসমের ম্যাসেজ,

ওরেনাআআআআআ….

অতো আ টেনোনা, ওটা মাধ্যমিকের সময়ের ছবি, তোমার তখন ক্লাস সিক্স, বড়োই হওনি বুঝলে।

খান কতক হ্যা হ্যা করা ইমোজি পাঠায় গুঞ্জা।

রিপ্লাইতে একগাদা ঘুঁসি পাকানো ইমোজি ঢোকে।

একা একা হেসে গড়িয়ে পড়ে গুঞ্জা। তারপর লেখে,

হিহিহিহি পুঁচকে ছানার কত্তো রাগ।

এবার খানকতক অ্যাংরি ইমোজি আসে।

তারপর মৌসম লেখে,

বিছানা জানে পুঁচকে বড়ো হয়ে গেছে।

তোমার বৌ জানে বলো, আচ্ছা আচ্ছা ক্ষেপাবোনা, বলোনা প্লিজ কবে বড়ো হয়েছো?

ক্লাস সেভেন।

মানে আমি তখন ক্লাস ইলেভেন, ইস তখন দেখা হলে কলেজে বেশ একখানা কচি বয়ফ্রেন্ড নিয়ে ঘুরতে পারতাম।

তাই তো, সবই কপাল।

জানো, আমি ক্লাস ফোরের ফাইনাল দেওয়ার সময় টেন প্লাসে বড় হয়েছি। তখন আমার কোন বোধই ছিলো, কিছুই জানতামনা।

তাই তুমি লিখতে পারো আর অন্যরা রান্না করতে পারে।

হাহাহাহা, আমিও রান্না করতে পারি গুরুমশাই। ঘরে এসো বিরিয়ানি করে খাওয়াবো।

আমি পাতি বাঙালির ডাল আলুপোস্ত বেশী পছন্দ করি যে।

আচ্ছা তাই খাওয়াবো, কতবার আসতে বলেছি, কিছুতেই আসোনা।

বাড়ি গেলে যদি অন্য কিছু খাওয়ার শখ হয়।

হিহিহিহি, হবে না, কারণ বুবুনের সামনে সেসব খাওয়া যাবেনা বুঝলে।

তাইতো, সবই কপাল হাহাহাহা।

পৌষালী দুপুরে ফোন করে গুঞ্জা। আজ মৌসমের জন্মদিন। ফোনে হ্যাপি বার্থ ডে না বললে মনটা খচখচ করছে গুঞ্জার। ফোন ধরতেই গুঞ্জা বলে ওঠে,

“কি খবর না জন্মানো, তুমি তো সেই বিকেলে হবে, এখনো হওনিতো।”

“তাইবুঝি, বলে যাও শুনছি। “

“একদম, শুনেই যাও, চুপ করে, জন্মাওনিতো এখনো, কথা কইবে কি, হিহিহিহি “।

খিলখিলিয়ে হাসে গুঞ্জা।

মৌসম রাগ দেখিয়ে বলে,

“পাই একবার, বোঝাবো মজা “।

“হাহাহাহা, তুমি তো জন্মাওনি, কি মজা বোঝাবে, একটু পরে ট্যাঁ ট্যাঁ করে হসপিটালের বেডে শুয়ে থাকবে, হিহিহি তখন চুমু খাওয়া তো দূরের কথা, হামি খেলেও হিসু করে দেবে, বুঝলে না জন্মানো হিহিহিহি”।

মৌসম বলে ওঠে,

“আচ্ছা বলে যাও, আমারো সময় আসবে”।

গুঞ্জা ভারি মজা পেয়েছে। হেসে গড়িয়ে পড়ছে। গুঞ্জার খিলখিলে হাসি ভারি জ্বালা ধরায়। মৌসম বলে,

“প্লিজ হেসোনা, প্লিজ হেসোনা, দেখো, আমিও মানুষ, অতি কষ্টে সব ইচ্ছেগুলো চেপে রেখেছি, ওভাবে হেসোনা প্লিজ।”

থেমে যায় গুঞ্জা। ইচ্ছেগুলো যে তারও চাপা পড়ে আছে সমাজ নির্দিষ্ট গণ্ডীতে। নিজেকে সামলে বলে,

“হ্যাপি বার্থ ডে ডার্লিং, লাভ উ “।

মৌসম ফিসফিসিয়ে বলে,

“থ্যাঙ্ক ইউ থ্যাঙ্ক ইউ, মি টু “।

ফোন রেখে গুঞ্জা চোখ বন্ধ করে বসে থাকে। ইচ্ছেগুলো সাপুড়ের বিনের ইশারায় হিলহিলিয়ে ফণা তুলতে চায়।
রাতে গুঞ্জা ম্যাসেজ পাঠায়,

“দুজনে কখনো যদি হারাই,
তুমি আমি আর সাথে খোয়াই,
মেঠো বাঁশি আর মহুয়া মাদল তালে,
হিসেবি সভ্যতা তফাতে রেখে
হারাই যদি শাল পিয়ালের আদিমতায়।
তোমার অতল হৃদয়ে ডুবে যাবো সেদিন
দিনান্তের আভা গায়ে মেখে।
কিছু ঝরা পলাশ দিও আমায়
গেঁথে নিয়ে পরবো আমি গলায় কানে,
কিছু ফুল জড়াবো খোঁপার বাঁধনে।
অরণ্য সুন্দরী আমি সেদিন
আমায় জড়িও নরম ভালোবাসায়,
চোখ বুঁজে মিশে যাবো তোমার হৃদস্পন্দনে।
পূর্ণ চাঁদ হেসে উঠুক আচেনা বাউলের গানে,
…..”যার মন ভালো নয়, যার দিল ভালো নয়
সে পিরিতের মর্ম কি জানে “।

(কৃতজ্ঞতা স্বীকারঃ তিনখানি উদ্ধৃত অংশ অর্ণব সেনের লেখা ও ‘আলেয়া’ এবং ‘ছুটতে ছুটতে থেমে গেছি’ মিউজিক অ্যালবাম থেকে নেওয়া।)

শ্বেতা সরকার। জন্ম ১৯৭৮ সালের ফেব্রুয়ারি। স্থান, বাবার কর্মস্থল টিকিয়াপাড়া রেল কোয়াটার, হাওড়া,বাংলা, ভারত। পাড়ার প্রাথমিক বিদ্যালয়ের পাঠ শেষ করে হাওড়া নরসিংহ কলেজ থেকে বায়ো-সায়েন্সে স্নাতক। ছোট বেলা থেকেই নাচ,গান, আবৃত্তি, ছবি আঁকা, ফটোগ্রাফিতে ছিল শখ। বিবাহসূত্রে খড়্গপুরের বাসিন্দা। আঞ্চলিক...

এই বিভাগের অন্যান্য লেখাসমূহ

পটচিত্র

পটচিত্র

  সৌম দাদুর কাছে থাকতে ভালোবাসত। গ্রামের নাম পাঁচুন্দি।আশেপাশে প্রচুর গ্রাম।সবাই সকলের খবর রাখে।সৌমদীপ এখানকার…..