আলো আর আলেয়া

কাকলি ভট্টাচার্য
ধারামুক্ত কবিতা
Bengali
আলো আর আলেয়া

আমি মন্দোদরী

আজ প্রায় মাসখানেক বড্ড অসুবিধায় আছি, আমার উনি ধরে এনেছেন একখানি আস্ত ন্যাকাপনা মেয়ে, ঘরে ঢোকাইনি,
অশোকবনে চেরী গুলোর পাহারায় রাখা ,
পাহারা আর কি!
ওই লোকদেখানো ফিকিড় ,
গতকাল বিকেলে গিয়ে দেখি চেরীগুলোর সাথে এক্কাদোক্কা খেলছে ওই বুড়িধারী ।
বুঝি না বাপু কি করে অন্যের বাগান নষ্ট করে এই সমস্ত ধিঙ্গীপনা !

এইসব কিচ্ছু হতো না _বিয়ে ইস্তক গুচ্ছেক অকালকুষ্মাণ্ড দেওর ননদ নিয়ে আছি ,
একটা তবু বছরে ছ’মাস ঘুমিয়ে রেহাই দেয়, এককাঁড়ি টাকা
খরচ করে শূপুর বিয়ে দিলাম,
অত রাক্ষস পাত পেড়ে সাতদিন চুটিয়ে খেল , ওমা ! কদিন যেতে না যেতেই আবার দাদার কাছে ,
কারন কি বনে মন বসেনা !
তা ভালো কথা এসেছিস ঘরে চুপটি করে থাক , উনি গেলেন ছলাকলায়,

কী হলো ! বংশের নাক নিজের নাক খুঁইয়ে দাদার কাছে নাকিকান্না , পিত্তি জ্বলে আমার ,
বলুক দেখি তোর দাদা কখনো অন্য পুরুষ দেখেছি কিনা !
কুবের ঠাকুরপো আসতেন কি ভালোই না লাগত কিন্তু কালি তো মাখাইনি,
আসলে কি জানেন ভাববার অবকাশ কোথায় ?
দশ মাথায় দশটা মুখে দশ রকম হুকুম ।
একজন বলে _ প্রিয়ে এসো চুম্বন করি ,
শেষ করে উঠতে না উঠতেই আরেকটি মুখ মদিরা চায় ,
এই করতে করতে উদয়াস্ত শেষ ।

সবচেয়ে অসুবিধা হয় জ্বরজারিতে , ওনার শুয়ে শুয়ে মাথায় জল ঢালার বাতিক আছে ,
একহাতে দশ মাথায় জল দেয়া মুখের কথা ! শেষে বিভীষণ ঠাকুরপোর বুদ্ধিতে পাইপ ফিট করে জল ঢালা ।
এই একটা লোক পেটে পেটে যে কি বদ বুদ্ধি কি বলব ! এখন তো আবার দলবদল করেছে, বৌ সরমাকে এদিকের নজর রাখার জন্য রেখে নিজে ধাঁ করে কেটেছে ।
গতকাল বিকেলে গা ধুয়ে একটু সাজগোজ করে গেলাম অশোকবনে , গিয়ে তো তাজ্জব ! দেখি ওই মেয়ে গুটি সাজাচ্ছে খেলার,
অথচ ওকে নিয়েই নিত্যি অশান্তি ঘরে ।
আমি ভাবি __ তোর ওই মেনিমুখো বর, সমানে ছলচাতুরী চালাচ্ছে বসে ,
সেদিন তারা দি জানালো কিভাবে বালী দাকে মেরেছে ,

আর ওর বৌ নিশ্চিন্তে এখানে খেলছে ! আশ্চর্য !
দলবাজ ,মিয়ানো এক পুরুষমানুষ, এমন ন্যাকাবোকা গুলোকে সহ্য হয়না আমার ।
সঙ্গী ভাইটা লব কার্তিক সেজে ঘুরে বেড়ায় , সাথে করে বৌটা পর্যন্ত আনেনি,
শূপুর দোষ ই বা দিই কি করে ?

বেশ মেঘ করে এসেছে যাই ঘরে , সবকটাকে আচ্ছা মতন বলে এলাম , নেচেকুঁদে নয় বসে বসে যা ইচ্ছা খ্যালো ।
ঝামড়ে বৃষ্টি এলো , ভাবলাম আজ রাতে আদর সোহাগ হবে মনে হয় , উনি ঘরে ঢুকলেন সিটি দিতে দিতে , দশটা মুখের একসঙ্গে সিটি পাঁচ লিটারের প্রেসার কুকারও হার মানে,
আস্ত পাঁঠা ফেললে সেদ্ধ হয়ে যাবে ।

ঢুকেই কাব্যি –‘ গা জ্বলে যায় !

” মন্দোদরী _ বাতাসে আজ বাজিছে বাঁশরী
রাঁধো তুমি খিচুড়ি ,
আনিয়াছি গোটা কয়েক ইলিশ
উহাদের করো তুমি পালিশ
ঘনঘোর বরিষাতে
তুমি আমি মজি তাতে”।

ওগো কাব্যি আমারো আসে, নেহাত্ কই নে তবে আজ বলি —

” অশোকবনে রাখিয়াছ যে ছুঁড়ি,
তাহারে দিয়া রাঁধাও খিচুড়ি,
সে মাগী করে কী?
সঙ্গী জুটাইয়া খেলে দেখি,
জনক নন্দিনী , ও নাকি বন্দিনী?
চুলায় বসাও তারে
মরদ বুঝিব তোমারে।”

তিনি গম্ভীর, এতখানি আশা করেননি মেয়েমানুষের মুখে । আর কতকাল চুপ করে থাকব!

 

আমি সীতা

বেশ ছিলাম অযোধ্যায় , হঠাৎ ঝামেলা শ্বশুরের কবে কোন্ সোহাগের ফল!
স্বামী যাবেন বনবাসে।
বসে চিন্তা করলাম তিনটি শাশুড়ি একটি শ্বশুর গুচ্ছের দেওর ননদ নিয়ে প্রাসাদে থাকার চেয়ে আলাদা হবার এই দুর্দান্ত সুযোগ।

স্বামী অনুগামী হবো বায়না তুললাম,
আউটিং ফিলিংস্ একটা।
শুনলাম লক্ষণ যাবে অতএব বাজার দোকানের দিকটা ওই করবে।
নিশ্চিন্তে গোছগাছে মন দিলাম,
তিনি নির্দেশ দিলেন সুটকেস নেওয়া যাবেনা , দুটি একটি কাপড় পুঁটলিতে যা ধরে, কিন্তু গয়নাগুলো এখানে কার ভরসায় রাখব ?
খবর দিলাম নাপ্তেনি বৌকে ।
কানের উপরের দিকে আরো তিনটে ফুটো আর নাকের আগে পিছে এমনকি ভিতরেও ফুটো করো । যা আছে অঙ্গে তাই যাবে সঙ্গে ।

বেরিয়ে পড়লাম তিনজন। আহা কি আনন্দ আকাশে বাতাসে , টলটলে দীঘি ফলফুলে গাছ কি মধুময়। আশ্রম মতন একটা কুটিরে থাকি।

এমনই একদিনে ঘরের সামনে দেখি একটা সোনার হরিণ। আমি তো আত্মহারা আবার বায়না-
প্রাণনাথ প্রণিপাত, দাও মৃগী—

কী করেন পুরুষমানুষের শতেক জ্বালা। দেওরকে বসিয়ে গেলেন আনতে।

এ এক অদ্ভুত লোক তাকায় না কথা বলেনা _
বললাম_ যাও ভাই তোমার দাদার খোঁজ নাও , ভাত ফুটে গেছে ঠান্ডা হলে ঘি দিয়ে খাওয়া মুশকিল।

আমাদের এখনো অযোধ্যার চালেই চলছে , তিনবেলা ফলমূল খাই খালি দুপুরে ভাত ।

কিন্তু গোঁ ধরে বসে রইলো শেষে একটা রেখা টেনে দিয়ে বলে গেল বাইরে যাবেন না।
ঠিক এমন সময়ে এক সাধু বাবা এলেন , সুঠাম বলিষ্ঠ । যাক্ বাঁচা গেছে খানিকক্ষণ গল্প করে কাটবে একজন সুপুরুষ এর সঙ্গে ।
উনি ভিক্ষা চাইলেন এক মুষ্ঠি চাল।
দিতে গেলাম বললেন কাছে এসে ঝোলায় দাও, ব্যাস হয়ে গেল হরণ।
আহা মরণ!
আকাশপথে উড়ছি বেশ উত্তেজনাকর।
কোথা থেকে পিতৃসখা জটায়ুর আগমণ , বাঁধা দেবে কী, বীরলোকটার এক ঝাপটা , ওমনি কুপোকাত।
শুধু বলে গেলেন গয়না ফেলো রাম পথের সন্ধান পাবে। কী করি একধরনের পিতৃ নির্দেশ তাইই ফেললাম কটা ।
এলাম আরেক মনোহর জায়গায় নাম অশোকবন, কটি খর্বাকৃতি মহিলা কে রাখা হলো আমার দেখাশোনা করার জন্য।
ওরা যে কি ভালো কি বলি, মাণ্ডবী শ্রুতকীর্তীর মতনই। চুল বাঁধে সাজায়,
সেদিন বিকেলে কিতকিত্ খেলার খোপ কাটছি শুনলাম কর্তা মা আসছেন, ভারি সুন্দর এক মহিলা বেশ ভালোই লাগল। কি জানি এরপর কী হবে!

আমি মন্দোদরী-

যা হবার তাইই হলো। রাম রাবনের যুদ্ধে সোনার লঙ্কা ছারখার।
সেদিন প্রাসাদে বসে শুনলাম ওনার চিতা সাজানো হয়েছে।
আর কিছু না মেনে চললাম রামের কাছে , ওনার চিতার আগুন নিভলেই তো বিধবা! রোজ রোজ পাতে ডাঁটা চচ্চড়ি ! না বাপু নিরিমিষ্যি হেঁসেলে আমি নেই।

সরাসরি রামকেই বললাম – আপনি নাকি পুরুষ শ্রেষ্ঠ? ছল করে খল আচরণ কেন? কি অপরাধ আমার বলতে পারেন?

আরো বোধহয় কিছু বলেছিলাম আজ আর মনে নেই , শুধু তিনি বললেন- তুমি অমর,কখনো বৈধব্য জীবন হবেনা , রাবনের চিতা কোনোদিন নিভবে না।

পরে শুনলাম বিভীষণও অমরত্বে কব্জা করেছে, সঠিক কারণ আজো জানি না।
একদিন বিয়ের প্রস্তাব দিলো রাজিই হয়ে গেলাম। গান্ধর্ববিবাহ।

যুগের পর যুগ আমি আছি বিভীষণও আছে।
অদৃশ্য একটা কাঠি বিভীষণের হাতে থাকে, কখন কাকে কাঠি করে জানতেও পারিনা ।
বিভীষণের হাত থেকে পালাবার পথ নেই মন্দোদরীদের। কালোত্তীর্ণ বিভীষণরা থাকবেই , ধর্ষণ কর্ষণ সেবনের জন্যে । মন্দোদরীরা আজো অবলা তাইতো বনেবাদাড়ে লাশ পরে থাকে ।

 

আলো আর আলেয়া

পাড়ার কালীবাড়ির দাওয়ায় কিছুক্ষণ বসলে গোটা এলাকার হাঁড়ির খবর উঠে আসে,

মন্দিরে একা থাকেন না মা, পাশেই বাবা,কিন্তু সেপারেট, আঁধারে পাওনাগণ্ডা বুঝে নেন ওনারা ।
বামে মা দাঁড়িয়ে, ডাইনে মহাদেবের লিঙ্গ, বাবার মাথায় জল ঢালার তাগিদে জীন্ন উপোসী শরীল নিয়েই গেছি, ভিড় মারাত্মক, পিছনে লাইন,
মায়ের কাছে একটাই সুবিধে সময় কাটে হু হু করে, দ্রুত খবর আসে পাড়ার আনাচকানাচে কোথায় কী হচ্ছে।
নেটওয়ার্ক স্ট্রং, সব সিম কোম্পানির এখানে ঝুঁটি বাঁধা, বাবার পরশের অপেক্ষায় না থেকে,
মায়ের থানে ঢিপ করে মাথাটা ফেলেই দেখি ও পাড়ার লায়লা,
পালাতে না পারে, কোনো রকমে প্রণাম ডিউ রেখে জিজ্ঞাসা করতে ছুটে আসা—
কী রে,সেদিন যে ছেলেটার সাথে দেখলাম কে-ও?

স্মার্ট ফোনের মতন স্মার্ট উত্তর- আমার বর তো!

অ্যাই ছুঁড়ি- তোর বিয়ে হলো কবে ?

এখন কী বিয়ে হয় নাকি কাকিমা ? থাকাথাকি করছি গো।

বলেই ধাঁ চম্পট- উফ্ কী সাংঘাতিক মেয়েরে!
বসাক গিন্নি ইশারায় বললেন, চেপে যাও , মনোনিবেশ আবারো বাবাতেই।

পাড়ার তিলক মোটরসাইকেল থেকে নামল, মন্দিরে ঢুকেই পূজারী মন্টুকে ধমক।

কী ব্যাপার!
মা বাবা বসিয়ে দিলাম একসাথে, তা ওনারা বসে কী কপচাচ্ছেন !
গতমাসে কতগুলো টাকা ঢাললাম এখানে। কিচ্ছু হলো না, সামনে ইলেকশন, জিতে আসতেই হবে, সেইমতো পূজো চাই, এতো লোক লাইনে, বলি এ রাজ্যে কী নিয়ম নেই? সব ‘শ্রী’রা এভাবে দাঁড়িয়ে থাকবে কেন? – শুনুন কংস-টংস নয়, এখন মামাবাড়ি মানেই মামাটি / মাসিটি সবাই মানুষ।

পূজারির এতক্ষণে সুমতি, নড়েচড়ে বসলেন যেন, তিলকের বক্তব্য তখনও চলছে-

– দেখুন ভাবছি এই অমাবস্যায় জোড়া পাঁঠা দোবো, কিন্তু কাজ যেন হয়,
বলে রাখবেন মা বাবা দুজনকেই রোজ সকাল সন্ধ্যা, চলি ।

আমার দিকে চোখ আসতেই একগাল হাসি, শাসকদলের মুখে সবসময়ই একটা জ্যোতি থাকে, আভায় আশ্বাস আসে।
( যে কোনো শাসকদলের)

ভালো আছেন বৌদি? দুর্বল শরীরে মিষ্টি করে বললাম- হ্যাঁ গো।

বাইকে মিলিয়ে গেল। প্রতিজ্ঞা করলাম মতাদর্শে যতই অমিল থাক, এই ‘বৌদি’ ডাকের জন্যেই চুপচাপ ।

তিলকের আমার প্রতি বদান্যতায় পুরুতমশাই আমার জল ঢালার ব্যবস্থা করলেন শিগগিরই, জল ঢালব কী বাবার মাথা ঘি চন্দনে মাখামাখি, হাত বুলিয়ে আরাম লাগল।

বাতি জ্বেলে, মন্দিরের এককোণে একটু বসলাম, আঁচলের গিঁটে বেঁধে নিয়ে এসেছি এক খামচি বাবা দিয়ে পান,
সারাদিন পর পানে আমেজ আসছে ক্রমশ, তিলককে বললে হতো, ভোটের দিন একটা রিক্সা পাঠাতে— আহা ছেলেটা বড্ড ভালো গো!

মণ্ডপ ছেড়ে হাঁটতে হাঁটতে আসছি, হঠাৎ দেখি রাজবেশে কয়েকজন রাজপুরুষ ।

চার ভাই অর্জুন, ভীম, নকুল ও সহদেব লাপাত্তা হয়ে গেল! বিরক্ত যুধিষ্ঠির মুখটা ভেটকি মাছের মত করে নিকটস্থ সরোবরে গিয়ে দেখেন চারভাই-এর লাশ!

এক ব্রাহ্মণ জানালো সে আসলে এক যক্ষ। ভাইদের প্রাণ ফিরে পেতে গেলে যক্ষের প্রশ্নের উত্তর দিয়ে তাঁকে সন্তুষ্ট করতে হবে।
যুধিষ্ঠির বাধ্য হয়ে যক্ষের প্রশ্নের উত্তর দিতে সম্মত হলেন। বহুবছর আগে এমন আরেকবার এই ঘটনা ঘটেছিল, তখনও যুধিষ্ঠির যক্ষের প্রশ্নের উত্তর দিয়ে ভাইদের বাড়ি নিয়ে গেছিলেন, প্রতিবার এরা ঝামেলায় জড়িয়ে যায়, সব কেস সামলাতে হয় একা যুধিষ্ঠিরকে।

ব্রাহ্মণ বললেন গতবারের উত্তর দেয়া চলবে না। শর্তসাপেক্ষে প্রশ্নোত্তর পর্ব শুরু হলো।

যক্ষ- সূর্য অস্ত যায় কেন?

যুধিষ্ঠির- সূর্যের পার্ট টাইম ডিউটি।
এদিকে হলে অন্যদিকে।

যক্ষ- স্বর্গের চেয়ে উঁচু কি?

যুধিষ্ঠির- দু-ছিলিম গাঁজা।

যক্ষ- মানুষের দেবত্ব লাভ কি প্রকারে হয়?

যুধিষ্ঠির- ভোটে দাঁড়ানোর টিকিট পেলেই, বিশেষ করে এই পশ্চিমবঙ্গে এখন।

যক্ষ- কার পরাজয় অসম্ভব?

যুধিষ্ঠির–সমস্ত সিনেমার কলাকুশলীদের, ধূমকেতুর মতো দেখলেও সবসময় জয়ী।

যক্ষ- মগজের চেয়ে দ্রুত কি?

যুধিষ্ঠির- সন্দেহ।

যক্ষ- অসুস্থের বন্ধু কে?

যুধিষ্ঠির- অসুস্থ সবাই। এক্ষেত্রে শ্মশানবন্ধুরাই আসল বন্ধু!

যক্ষ- সুখী কে?

যুধিষ্ঠির- যাদের হজমশক্তি বেশী, তারাই ।

যক্ষ- কী ত্যাগ করলে মনুষ্য ধনলাভ করে?

যুধিষ্ঠির- নীতি এবং আদর্শ!

যক্ষ- রসিক কে?

যুধিষ্ঠির- জনগণ,
সব বোঝে, তবুও সারাক্ষণ হাসে।

যক্ষ- আদর্শ কর্ম কী ?

যুধিষ্ঠির- কলেবর তৈরি হওয়া মাত্রই জননাঙ্গের খোঁজ।

যক্ষ জড়িয়ে ধরলেন যুধিষ্ঠিরকে, ভাই একটা সিগারেট দে-
যুধিষ্ঠির বলেন- আমি রাজ্য থেকে বরখাস্ত বেশ কয়েক বছর।
এখন লাল সুতোয় বাঁধা বিড়ি খাই, দেব?

যক্ষ- দে তাই দে, আগুন আছে তো?

আগুন আছে, কিন্তু জ্বালানোর মানুষ নেই।

জ্বলবে, দেশলাই বার কর, যক্ষ বলে উঠলেন।

হতাশ যুধিষ্ঠির বলে, আপনারা বিদ্বজ্জন, আপনারা বললেই জ্বলবে। ভরসা পুরতি উৎসব।

যুধিষ্ঠিরের উত্তর শুনে যক্ষ যারপরনাই সন্তুষ্ট হয়ে চারভায়ের জীবনদান করতে চাইলেন।
যুধিষ্ঠির চাইলেন না আর কোনো ভাইকে,
বললেন- ওদের নিয়ে যান, আমি আর পাঞ্চালি থেকে যাই, যুদ্ধেও যাব না ঠিক করেছি।
সে কী! যক্ষ উদভ্রান্ত,
ওরে এগুলোকে নিয়ে আমার কি কাজ হবে? ভীমের খাবার জোগাড় করতে শেষ সময়ে আমাকে চুরিচামারিতে নামতে হবে যে! তারপর এই অর্জুন,
কোথায় রেপ কেস করলেই ফেঁসে যাব আমি!
নকুল সহদেব এ দুটো তো অকম্মার ঢেঁকি। যাত্রাপালায় বিবেকের পার্টও পাবে না।

নে ভাই- ওদের নিয়ে যা। আমাকে এবার মুক্তি দে। আমি আর কখনো কাউকে আটকে রাখব না।

যুধিষ্ঠির দৌড়োচ্ছেন পিছন পিছন যক্ষ ছুটছেন।

অ্যাই অ্যাই কাকলি – বাড়ি যাবে না? অঘোরে ঘুমাচ্ছিলে তো?

চোখ কচলে দেখি, মায়ের মন্দিরে আমি, তাহলে?

সবটাই স্বপ্ন? কিন্তু “আদর্শ কর্মে” ওই উত্তরটি মনে হলো কেন?
হ্যাঁ এবার মনে পড়ছে- গতবছর এই সময়ে আসিফা ধর্ষণ হয়েছিল, পূজারী দ্বারাই।

বলিহারি নিজেকেই- মহাভারত মোট্টে পিছু ছাড়ে না গো!

 

দর্শকের দরবারে

আপনাদের কাছে আগেই বলেছি, সম্প্রতি নিয়মিত গীতা পাঠে আছি।
মনে করুন, সেই যে বাসে বসে গুঁতো খেয়েও গীতা আমার চিত্ত শুদ্ধি করিয়ে বাস থেকে শান্ত মতে নামিয়ে দিয়েছিল!
গীতা আমার সঙ্গী। ওদের ছোটো বোন গুজরাতি নীতার স্বামী মোবাইলের সহযোগিতায় থাকেন যে!

বেদান্তকারীরা বলেন, জলের বিম্ব জলই। মায়াচ্ছন্ন বলেই ভেদজ্ঞান।
রোজ সকালে একপাতা পরিমাণ গীতা পাঠে পতিও মায়া মনে হবে। পিতৃব্য জ্ঞানে দাম্পত্যজীবন শান্ত।

আমাদের গোরুহীন গোশালা থেকে কৃত্রিম সহজপাচ্য গো-দুগ্ধ জনসাধারণে পরিবেশিত হয়, তার নাম ধৈর্য। তবুও যদি খুঁতখুঁত করে তবে ধবল পানীয় মনে করে উদরস্থ করুন।
পৃথিবী প্রগতির পথে তরতর করে ছুটছে। আপনি পিছিয়ে গেলে বসে আঙুল চুষবেন।
এ ব্যাপারে আদালতে কিছু প্রশ্ন নিয়ে উঠেছিলাম। শুনুন আপনারা।

:– মাননীয় ধর্মাবতার, কমলাকান্তের মতন আপনার এজলাসে এলাম এটাই জানতে, মানুষ কী মানুষ? উপনিষদ বলছে মানুষ অমৃতের পুত্র। হোয়াট ইজ অমৃত? যা মন্থন করে দেবাসুরে তুলকালাম কাণ্ড?
:– ইয়েস ডিয়ার, দিস ইজ অমৃত এন্ড ইট ইজ ভেরি টেস্টি।
:– তাহলে ধর্মাবতার আপনি, আমি, বড়বাজারের আড়তদার, পাবলিক বাসের কন্ডাক্টর, বিধানসভা লোকসভায় ঝিমোনো লোকগুলো, টিভি বিতর্কে গালাগালের অংশগ্রহণকারী— মায় বাড়িতে কাজ করা মহিলা সব্বাই অমৃতের পুত্র?

:– দেখো, অসুরদের হাত থেকে ভোগটা মেরে সোজা চম্পট দেবতাদের। সমুদ্রের তলায় ফেলা ছিল সিজনিং এর জন্যে। যত ম্যারিনেট তত সুস্বাদু। সব আঙুরের রস মিষ্টি নয়। তাই যেখানে মিষ্টি নয়, সেখানে নেশা লাগিয়ে দাও। বেয়াড়া প্রশ্নের বেয়াদবপনা কেন মা জননী?

:– আজ্ঞে ধর্মাবতার আমার আর একটা প্রশ্ন আছে?
:– তোমার এই প্রশ্ন করার রোগ কতদিনের? দেখো, সারবত্তা বুঝে নাও। আমরা মানুষ নই, পশু তো নই-ই। আমরা হলাম স্বঘোষিত দেবতা। শিবনেত্রে সব সয়। বাছা কেটে পড়ো এবার। উত্তম গঞ্জিকা সব গঞ্জনা সহিতে পারে।

:– কোথা দিয়ে যাব স্যর? আমি তো বেহালা নিবাসী! যে পথে ঘর, সে পথে একটা সেতু ছিল। সুগ্রীব অঙ্গদের সহায়তায়, কেবল সীতাকে তোলার জন্যে।
সীতার গীতা হবার পর সেতু তাসের ঘরের মতো ভেঙে গেল। দু-বেলা নাকে দড়ি বেঁধে বিভিন্ন বিভাজনের রাস্তায় ঘরে যাই।
— এর প্রতিকার যদি বলেন? আয়ু থেকে একবছর গত। হিসেবে ধরলে ওয়ান ইস্টু টেন।

:– অর্বাচীন নারী, তোমার জিজ্ঞাসার বিষয়বস্তু ভয়াবহ। উদরের অভ্যন্তরে চুলকালে, হাত পৌঁছে চুলকোতে পারো? জানবে, তলদেশের গভীরে চুলকোনো যায় না।
সেতু তোমার নয়। তোমার বাপ ঠাকুর্দা চোদ্দপুরুষের নয়। গণতান্ত্রিক ব্রিজের প্রতিটি নাট-বল্টু জনসাধারণের। লোহার পাতের প্রতি সৃষ্টির আদি লগ্ন থেকেই মানুষের দুর্বলতা।
রাগ করে কলকব্জা খুলে নিলে কিচ্ছু করার নেই। তবে এটাও ঠিক, ধীরে ধীরে খুলতে পারত।
— গোপন খবর আছে, স্বর্গে আলোচনা চলছে— উন্নতমানের প্লাস্টিকের চায়না সেতু নির্মাণ করা যায় কিনা! নতুবা একটি ঢালাই সেতু ফাঁকা জায়গায় গড়ে সুবিধে মতন সকাল বিকেলে ফিট করা। পুরোটাই অর্থনীতিবিদদের মধ্যে আলোচনা পর্যালোচনার পর্যায়ে আছে। বিশ্বকর্মা নাকি স্বয়ং ভাবছেন!

ম্যানহোল আয়ত্তে খানিকটা। অতলে তল নেই, এর বদলে গর্ত ভাবা হয়েছে। ম্যানহোলের বদলে হোলে হোল করে শহরের হলাহল বজায় রাখা। ম্যানহোলের ঢাকনা গুলো আঁধারে ভাইপোরা বেচে দিয়ে বাংলাকে(কালী-মা) জড়িয়ে শুয়ে থাকে।

পথ হলো শোষক, আর গর্ত হলো শোষিত। এইরকম শ্রেণীসংঘাত থাকলেই বিপ্লব দীর্ঘজীবী হবে।
ক্লাসলেস ক্লাস।
নো আপার, নো লোয়ার, মিডিল তো নয়ই! ওগুলো সবচেয়ে তিলে খচ্চর। সরি, লেসের যুগ এখন। সায়ার নিচে ঝুলিয়ে রেখেছিল বহুদিন।
এক শ্রেণীর ঘাতক সীবনশিল্পী। আধুনিক জীবনে এ টু জেড কেবল লেস।
মোবাইল কর্ডলেস।
শরীর ফ্যাটলেস।
চা–সুগার লেস।
মুরগি বোনলেস।

:– আরো জানতে চাও?
— তোমার এই যে হৃদয়ের ধুকপুক এও তো হার্টলেস! বাইপাসের পথে ফাঁকা রাস্তায় জমিতে ফসিল ফসল সব।
তামসিকতা ছাড়ো। মেলা কাজ আছে। জয়ধ্বনি দাও— জয়, নরকের জয়।
— হেঃ হেঃ, আঁটি এবার দামি। আম কম। যদি পাও চুষতে চুষতে হাসিমুখে বাড়ি ফিরে যাও।

(বাস্তব সংলাপ– আমি এখন রাঁচির পথে।)

 

আরে আমি আছি

কিছুদিন যাবৎ গীতা পাঠে মগ্ন আছি। পঞ্চম অধ্যায়ের সপ্তদশ শ্লোকে আটকে।
পড়ছি কিন্তু প্রয়োগ নেই–
সুযোগ এলো, বেলভিউ ক্লিনিক থেকে বাসে উঠে, আমার আমি’টি বাস্তুঘুঘুর মতন ঘাপটি মেরে বাসে উঠলাম, যারা আমাকে একবচন ভাবেন তারা ভুল করেন, আসলে দ্বিবচন। প্রয়োজনে বহুবচন।
গরমে জানলার পাশে সিটখানিতে অনেকটাই এলিয়েই ছিলাম, এক ভদ্রলোক উঠে এসে আমাকে ঠেলতে ঠেলতে চেপে ধরেছেন, কাঁচা কদলি খণ্ডের মতন আমার ঊরুটি জখম, ভুরুটি সঠিক স্থানে রেখে ঊরুটির হেনস্থা অবলোকন, কারণ আমি এখন গীতা পাঠ করছি।
দুর্দশার দ্বিতীয় ধাপ ল্যাপটপ খুলে তার অর্ধেক অংশ আমার কোলে, যেন আমাদের যৌথ প্রজনন!
আমি উদাসীন, কেরামতিতে মত্ত অন্তরে সখা মাধব।
এই মুহূর্তে নিজেকে মনে হচ্ছে ঘরে বসে থাকা বয়স্থা বিবাহযোগ্যা কন্যার ছেলে-ধরা মাতা। কোনওমতেই যেন একে হাতছাড়া করা যাবে না।
কনুইয়ের খোঁচায় হারমোনিয়ামের রিড, সা থেকে সা , ওনার ঘামজামা ঠান্ডা বাতাস দিচ্ছে, গন্ধ স্পর্শ দুটোই সাড়াজাগানো। সকালের পাউডার জানান দিচ্ছে অল্পস্বল্প।
উপবিষ্ট মহামানব মহানগরীতে নির্বিকার, অর্থাৎ গীতা বলছে ওনার আমি’র ফাংশন কাজ করছে না, দুর্যোধন টাইপ।
আমি সাম্যে স্থিত, ব্রহ্মে সমর্পণ। পাশ দিয়ে ” সত্যজিত রায় ধরণী” বয়ে গেল, ওনার বাঁ-পা নাচ্ছে, খুবই বদ অভ্যাস। আমি ডান পা নাচাতে শুরু করলাম, ভিতরে ঘামে জর্জরিত সায়া নাচায় বিদ্রোহ ঘোষণা করল, হে প্রভু–আর গীতাকে ধরে রাখতে পারছি না,সীতা তো কোনো কালেই কাজের নয়! অতএব পঞ্চম শ্লোক থেকে বেরিয়ে, কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধের শ্লোক মনে করি, ‘নাহি যুদ্ধে দিব সূচাগ্র মেদিনি’।

ল্যাপটপ বন্ধ, এবার ঘুম ভাব, এ কী ! ক্রমশ মাথা ঢুলঢুল, সাইনবোর্ডের মতন কেতরে, আমার ডান কানের লতির পাশে ঈষৎ ফাঁকা কাঁধ ওনার বেডরোল, সুড়সুড়ি ওনার উড়ন্ত চুলে, মৃদু গর্জন নাসিকায়, নাসা বিজ্ঞানী কিনা কে জানে! নাকের ভিতরে যা কেশগুচ্ছ আছে, আমার মাথার উপরে তা নেই। আপাতত ওনার হাওয়া বালিশ হয়ে আছি,কারণ আমি গীতা পড়ছি।

এবার ঝোলা থেকে বিদুরের রণনীতি__ শত্রু/ মিত্র/ উদাসীন /মধ্যস্থ/ _ দণ্ড রাজাই নির্ধারণ করবেন।

উনি এবার ঘুমিয়ে হাসছেন, বোধহয় স্বপ্নেই—মহিলা দেখছেন কী !
আমার উপরে অত্যাচার করতে করতে কার সঙ্গে ছলাকলায়? দাঁতের গঠন কিঞ্চিত দৃশ্যমান, সাদা দেখে খানিক ভরসা।
একটু নির্দোষ হালকা গুঁতো দিলাম, শক্ত প্যান্ট ভেদ করে চামড়ায় চামর দিতে যখন অপারগ তখন অল্প কাঁধ নাচিয়ে জাগিয়ে তোলার চেষ্টা।
বাসটি দুলকি চালে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে চলছে, কন্ডাক্টর মায়ের মতন সকলকে ডাকছে।
” ওরে ঝড় নেমে আয় “,
লাল আলোয় স্বস্তির থামা, পিছনে হৈচৈ কম সিগনালের সিম্বলে, সবুজে আবার এগোচ্ছে, নোনাজল দীঘা ছেড়ে কলকাতায় হাজির,
হলুদ আলোয় থামতে নির্দেশ, ঘুম কিন্তু ভাঙছে না!

” আমায় থাকতে দে না, আপন মনে”

রিংটোনে ধড়মড়িয়ে উঠে টাইট প্যান্টের গহ্বর থেকে টেনে ঝটকা মেরে মোবাইল বার করে পথোপকথন—

;—কে রমলা ?আরে বলোনা কী গরম, বাস এগোচ্ছে না একেবারেই, আসছি।

বোঝো রমণীমোহনের অবস্থা! মোবাইলের ঠ্যালায় ডান-পা আমার চটকে চুয়াল্লিশ।
কিছুই বলা যাবে না কারণ এই মুহূর্তে আমি গীতা পড়ছি।

জ্বলন্ত দৃষ্টি দিয়ে গন্তব্যের কাছাকাছি পৌঁছে,ঈষৎ সরতে বললাম।
জিজ্ঞেস করলেন, কোথায় নামবেন?
বললাম- আপনি আমার সম্বন্ধী হবেন? মানে বেয়াই। উত্তরের অপেক্ষা করা গেল না, কন্ডাক্টরের পা-দানির থেকেই মৃদু ঠ্যালা। আমি ধৈর্য ধরে পথে এলাম, সূর্যদেব হাসছেন- বললেন,
আমার ছেলেকে মারবার ষড়যন্ত্রকারীর বই পড়ছিস? যা পুড়ে মর।
আমি কিছুই বললাম না-
কারণ ওই মুহূর্তে গীতাই স্মরণ করছিলাম।

কাকলি ভট্টাচার্য। কবি। জন্ম ১৯৭০ খ্রিস্টাব্দ, ভারতের ঝাড়খণ্ডের হাজারিবাগে। বর্তমান নিবাস কলকাতা।

এই বিভাগের অন্যান্য লেখাসমূহ