এক অন্য প্রেমের গল্প

বিতস্তা ঘোষাল
গল্প
এক অন্য প্রেমের গল্প

ঢেউ খেলানো একরাশ চুলের সিঁথির মত কালো একটা নাগ সাপ হয়ে সোজা এগিয়ে গেছে রাস্তাটা। দিন কয়েক হল এই রাস্তাটা চওড়া করার জন্য পাশের জমি থেকে মাটি নেওয়া হচ্ছে। আশেপাশের বসতি থেকে আসা কুলির দল মাটি কেটে রাস্তা বরাবর জমা করছে। এই কুলিরা মাটিকে নিজের মত কর্ষণ করতে পারে।মাটির মান অভিমান সুখ দুঃখ সবই এরা বোঝে। মাটিকে ঘিরেই এদের সংসার।

মাটি কাটা চলছে তিনদিন ধরে। কোদালের দাপটে মাটির বাঁধন আলগা হয়ে যাচ্ছে। পড়ার সাথে সাথেই সেগুলো ঝুড়ি বোঝাই হয়ে এক জায়গা থেকে পরক্ষণেই আরেক জায়গায় পড়ছে।

এ বছর ক্ষরা লেগেছে।কড়া রোদের দাপটে নদী –নালা শুকিয়ে কাঠ।ক্ষেত জলের অভাবে ফেটে যাওয়া গোড়ালির মত হাড় বের করে আকাশের দিকে তাকিয়ে। দেব রাজ ঈন্দ্রকে আর মানুষ পুজো করেনা। তাই বুঝি তাঁর গোঁসা। তিনিও পণ করেছেন মানুষগুলো মরুক জলের অভাবে।

এক সকালে মাইক বাজিয়ে সরকারের লোক জানিয়ে গেল – মজুর চাই। রাস্তা বাড়ানো হবে।সরকারি কাজ। মজুরদের খাবার ও জল দেবে সরকার। সঙ্গে অস্থায়ী আস্থানা।যারা যোগ দিতে ইচ্ছুক সকাল ন’টায় বড় রাস্তার তাঁবুর সামনে আসবেন।

মুহূর্তের মধ্যেই আশে-পাশের সব লোক জেনে গেল সরকারি রাস্তায় মাটি ফেলা হবে। গেলেই কাজ। দু- তিনটে গ্রাম উজার করে লোকে চলল। বউ বাচ্চা বাসন পত্তর নিয়ে সারি সারি মিছিল তাঁবুর কাছে আছড়ে পরল।

সুবল রাস্তার ধারে একটা গাছের তলায় বসে দেখছিল। তিনকড়ির বৌয়ের কোলে অপুষ্ট বাচ্চা। মায়ের ছেঁড়া শাড়ি তাপ্পি মারা ব্লাউজ সরিয়ে বুকে মুখ ঘসছে। সুবল এক পলক সেদিকে তাকিয়ে চোখ ঘুরিয়ে নেবার আগেই দেখল তিনকড়ি বিরক্তি ভরা মুখে বউকে জোড়ে হাঁটার জন্য তাড়া দিল। শ্যামা ,কার্ত্তিক ,গণেশ ,লহ্মী …সবাই পথে। সবার পেটেই জন্মের ক্ষিধে।

গত দুদিন ধরেই সুবল পাকুড় গাছের তলায় বসে দেখছিল। গাইতি,কোদাল মাথার ওপর উঠছে, নামছে।মাটি ক্ষত বিক্ষত হচ্ছে, তবু ভাঙছে না। আরও জোড়ে কোদাল আছড়ে পরছে, ঘামে ভেজা পেশি ফুলছে, চোয়াল শক্ত। শেষ অব্ধি মাটি বশ মানছে। সুবলের মনে হল মাটি বুঝি আনকোরা এক যুবতী। তাকে অধিকার করছে পুরুষ জোর করে। তার মন হঠাৎ উত্তেজনায় ভরে গেল। সেও এইভাবেই অদমনীয় বেয়াদপ মাটিকে জব্দ করবে বাহুবলে।কিন্তু তার কপালটাই খারাপ। এখানে যারা কাজ করছে সবাই বর –বউ। মরদ মাটি কোপাচ্ছে। মাগী ঝুড়ি করে তা নিয়ে অন্য জায়গায় ফেলে আসছে।তার কেউই নেই। সে একা কত কোপাবে! কত বইবে!

দীর্ঘ একটা শ্বাস ফেলে সামনের দিকে তাকাল সে। নারায়ন কোমরে জড়ানো গামছা খুলে কপাল মুছে লহ্মীর মাথায় মাটি ভরতি ঝুরি তুলে দিচ্ছে। এই তো সেদিন বিয়ে হল। এর মধ্যেই পোয়াতি। মাথায় মাটির বোঝা নিয়ে সে সামনের দিকে থপথপ করে এগুচ্ছে। পা টলমল। তার একবার ইচ্ছে হল ঝুড়িটা নিতে। পরক্ষণেই সামলে নিয়ে দেখল নারায়ণ বউয়ের দিকেই তাকিয়ে। সে যখন মাটি ফেলে ফিরে এল সেই গামছা দিয়ে ঘামে ভেজা লহ্মীর মুখ মুছিয়ে দিল। বউয়ের মুখে ক্লান্ত হাসি। সুবলের খুব রাগ হল। একটা গালাগাল দিয়ে নিজের মনেই বলল, ‘যত সব আদিখ্যেতা’।

কাজ পায়নি সুবল। গাছের তলায় বসে সবাইকে দেখতে দেখতে নিজের কথা ভাবছিল।কত বয়স হল তার! সে নিজেও জানে না কবে তার গোঁফ উঠল, কবেই বা তা শক্ত হয়ে গেল! হারু নাপিত আর তার গোঁফ দাড়ি কাটতে চায়না। বলে কিনা তাকে কাটার পর আর সেই ব্লেডে আর কারোর কাটা যায় না।তার মাথার ঘন চুলও  উঠে গিয়ে সামনেটা এখন অনেক ফাঁকা। দুপাশের ক’টা চুলে পাকও ধরেছে। সে কি বুড়ো হয়ে যাচ্ছে?

– বয়স তো হল অনেক, এবার একটা মেয়েছেলে আন, নইলে যে সব শুকিয়ে যাবে…। বিচ্ছিরি ভাবে হেসে বলে বিশু কাকা।

এই কথা শুনলেই মাথা গরম হয়ে যায় তার। আমার যখন ইচ্ছে মেয়েছেলে আনব, তাতে কার বাপের কি! আর কোন মা-বাপ আমায় জেনে মেয়ে দেবে! না আছে চাল না আছে চুলো। আমি কি মেয়েছেলে চুরি করে আনব!

বিরক্তি নিয়ে গাছের মাথার উপর তাকিয়ে দেখল দুটো কাক বাসা বাঁধছে। একজন ঠোঁটে কাঠি নিয়ে আসছে, আর একজন তা দিয়ে বাসা গড়ছে। ধ্যেত্তেরি! সব কাজেই মেয়ে দরকার। এ ক’দিনে সে বুঝে গেছে মেয়ে মানুষ না জুটলে কাজ পাবে না। তার হঠাৎ জগত সংসারের সব বর বউয়ের উপর রাগ হল।ইচ্ছে করল সবাইকে খুন করে ফেলতে। সে হাতের মুঠি শক্ত করে গাছের গোড়ায় জোড়ে মারল।

না,এখানে অপেক্ষা করে লাভ নেই।মেয়ে মানুষ সাথে না থাকলে কাজ পাওয়া যাবে না।তার থেকে অন্য কোথাও যাওয়া ভাল,এমন জায়গা যেখানে সে একাই কাজ পেতে পারে।গাছের তলা থেকে উঠে সে সামনের দিকে হাঁটা দিল।কি রোদ! চামড়া পুড়িয়ে দিচ্ছে।যেন আগুনের গোলার উপর তাকে কেউ ছুঁড়ে দিল।চারদিক তাকালো সে।

একটা হুইসেল বাজল।কাজ থামিয়ে যে যার মত ছায়া খুঁজছে। শ্যামা পাশের পাকুড় গাছটার তলায় পা ছড়িয়ে বসে শাড়িটা হাঁটু অব্ধি তুলে দিল। পুরুষ্টু দুটো বেহায়া পা। আঁচল দিয়ে মুখ ঘাড় মুছে সে শাড়ির বাঁধন আলগা করে সরকারি কন্ট্রোলের দিকে তাকিয়ে। তার মরদ ভাত নিয়ে আসছে। এলোমেলো একটা হাওয়া এসে তার আঁচল সরিয়ে দেওয়া মাত্র সুবল চোখ ঘুরিয়ে নিল। নকুল দাদা এসে গেছে। সে আবার দেখল। তোবড়ানো অ্যামুমিনিয়ামের থালায় ভাতের উপর কাঁচা লঙ্কা আর পেঁয়াজ। দুজনে এমন ভাবে খাচ্ছে যেন অমৃত খাচ্ছে! আর সে! কাল রাত থেকে এই বেলা অব্ধি জল ছাড়া কিছুই পেটে পড়েনি। এভাবে চললে মাটি কেন কোনো কাজ করার ক্ষমতাই থাকবে না। তার আগেই অক্কা। কিন্তু সবার প্রথম তার একটা মেয়েছেলে চাই। কিভাবে পাবে না জানলেও মেয়ের দরকার এটা সে এই ক’দিনে বুঝে গেছে।

ধুত্তোর, নিকুচি করেছে মেয়েছেলের। কি সব ভাবছি! বিড়বিড় করতে করতে সে খানিকটা এগিয়ে থমকে দাঁড়ালো।

সামনের গাছটার আড়াল থেকে আধচটা শাড়ির অংশ বেরিয়ে। কে ওখানে? সে এগিয়ে গেল সেদিকে। এক মেয়ে মানুষ বসে। তার শাড়ি আর গাছের পাতার রঙ মিলেমিশে একাকার। যেখানেই তাকাই খালি মেয়েদের ভিড়। শান্তি নেই এ জীবনে! একরাশ বিরক্তি নিয়ে চলে যেতে গিয়েও কি ভেবে আবার দেখতে লাগল। কোঁচরে মুড়ি নিয়ে মুখে ফেলছে। হাঁ করার সময় বের হওয়া দাঁতগুলো বেশ ঝকঝক করছে। ঝুটো মুক্তো। নিজের মনেই সে বলল। আর তখনি লক্ষ করল মেয়েটাও তাকে দেখছে। এবার তার অস্বস্তি হল। সে সাধারণত মেয়েদের দিকে তাকায় না। সব কাককে যেমন তার একরকম লাগে তেমনি সব মেয়েকেও। আজ কিন্তু তার মন অন্য কিছু বলে উঠল। কি একটা ভেবে সে একটু চিৎকার করে বলল- ‘এই ভরা বেলায় এখানে একা বসে কি করছিস? ঘর-বাড়ি নাই? কাম-কাজ?’।

‘দেখতেই তো পাচ্ছ সূর্যি ঠাকুর মাথার উপর। ঘর থাকলে কি গাছের তলায় বসতাম! কাজের লেগে এসেছিলাম। নিলে না। বলে আমার মরদ না হলে নেবেক না’। মুড়ি চিবাতে চিবাতে বেশ ঝাঁঝের সাথে উত্তর এল। আঁচল ঘাড়ে দিয়ে সে এখন গলা মুখ মুছছে।

সুবলের মাথায় হঠাৎ কিছু একটা ফন্দি খেটে গেল। এবার সে অপেক্ষাকৃত আস্তে গলায় আর একটু কাছে গিয়ে বলল – ‘আমি মাটি কাটলে তুই বয়ে দিতে পারবি?’

মেয়েটা তার মুখের দিকে অবাক হয়ে তাকিয়ে একটু থেমে, ‘সে দেবো ক্ষণ’ বলে হাসল ।

সুবল এবার আরো কাছে এগিয়ে এল। ‘এখানে তো দেখতেই পাচ্ছিস দু’জন না হলে কাজ নেই। আমরা একসাথে কাম করব। যা পাব দিনের শেষে তুই তার থেকে পাওনা বুঝে নিবি’।

একটুও সময় না নিয়ে সে বলল- ‘ওখানে পুরো টাকাটাই একই ঘরে যাচ্ছে। পয়সা ভাগ হচ্ছে না। এখন তুমি যা বিচার করবে। আমি একা মেয়েমানুষ। না আছে চাল না চুলো। খেতে পরতে পেলেই হল’।

সুবলের মনটা হঠাৎ উদাস হয়ে গেল – ‘ঠিক আছে, আধা-আধি হবে। রাজী?’

সে হেসে উঠল। সুবলের মনে হল এক থোকা সাদা বেলফুল ঝরে পড়ল চারদিকে। বুকে একটা চিনচিনে ব্যথা বোধ হচ্ছে। ঈষৎ গম্ভীর হয়ে সে জিজ্ঞেস করল- ‘তোর নাম কি?’

‘সাবু’।

এবার সে হো হো করে হেসে ফেলল। সুবল আর সাবু। কি মিল! তাকে হাসতে দেখে সাবুও হাসতে লাগল। হাসির দমকে মুখের মধ্যে রাখা মুড়ির টুকরো বাইরে বেরিয়ে আসা মাত্র সুবলের বুকটা আবার চিনচিন করে উঠল।

পরদিন বিকেলে কাজ শেষ হবার পর তাঁবুর সামনে থেকে ‘সুবল’ ডাক আসা মাত্র বুড়ো আঙুলের টিপ সই দিয়ে সারাদিনের কোপানো মাটির পরিমাণ অনুযায়ী টাকা পেল। গামছায় বেঁধে সেই টাকা নিয়ে সে ঘরে এল। ঘর বলতে অন্যান্য মজুরদের মতই মাথায় প্লাস্টিকের ছাউনি দেওয়া বাঁশ দিয়ে আটকানো চালা। সেখানে এসে মাটিতে বসে গামছা খুললো। দশটা দশ টাকার নোট। দু’বার গুনলো সে। একশো টাকা! তার সারাদিনের পরিশ্রমের ফসল। মাটি আজ তাকে প্রচুর খাটিয়েছে। মাঝে মাঝে মনে হচ্ছিল আর বুঝি কব্জা করা গেল না বেয়াদপ মেয়েটাকে। শেষ অব্ধি দাঁতে দাঁত চেপে লড়াই করার ফল এখন তার হাতে।

একশো টাকা। এর আধা পঞ্চাশ। পাঁচটা দশ টাকা নিয়ে আলাদা করল। এটা এক্ষুনি সাবুকে দিতে হবে।সারাদিনে দশ ঝুড়ি মাটি ফেলেছে সে। আরো ফেলতে পারত। কিন্তু মাটি আজ তাদের সাথ দেয়নি। কাল ভোরে গিয়ে জব্দ করতে হবে। সেই সময় খানিকটা ভিজে থাকে।

সাবু চালার একপাশে পা মেলে বসে চুল আঁচড়াচ্ছে। বিন্দু বিন্দু ঘাম সারা মুখে। সুবল তার গোল গোল মোটা পায়ের দিকে তাকিয়ে বলল- ‘তোর টাকা’।

– ‘এটা এখন তোমার কাছেই রাখ। আমি একা মেয়েছেলে। রাতে কোথায় শোব ঠিক নেই। দিনেও বাইরে।শেষে কে নিয়ে নেবে! তার থেকে তোমার কাছেই থাক’।

সত্যি তো! এই চালাটা সুবলের নামে। সাবু রাতে কোথায় থাকবে তার মাথাতেই আসেনি। এখন খেয়াল হওয়ায় তার মনটা ভারি হয়ে উঠল কোনো কারণ ছাড়াই। সে একটু চুপ থেকে খসখসে গলায় বলল –

‘তুই কেন বাইরে থাকবি?একা মেয়েমানুষের রাতে বাইরে থাকা ভাল দেখায় না। তুই ভেতরে শুবি। আমি পুরুষ মানুষ। যেখানে-সেখানে থাকার অভ্যাস আছে। ফুরফুরে হাওয়ায় দিব্যি ঘুমিয়ে যাব। তুই বরং কাক ডাকার আগে উঠিয়ে দিস। আমি গিয়ে মাটি কুপিয়ে রাখব। তুই পরে গিয়ে ফেলে দিবি। আজ বেশি হলনা।কাল পুষিয়ে নেব’।

কথা শেষ করে সে তাড়াতাড়ি অস্থায়ী সরকারি কন্ট্রোলের দিকে ছুটলো। তার খিধে লেগেছিল। মাটি কাটার ধকলে ঘুমিয়ে থাকা খিধে যেন অজগর সাপের মত ফণা তুলে ছোবল মারছিল। বড় একটা সরায় চিঁড়ে গুড় আর এক ভাঁড় জল নিয়ে সে ফিরে এল।

সাবুর কাছে কিছু মুড়ি তখনো। সে চিঁড়ে নিল না।

চিঁড়েতে জল ঢাললো। পুরো মাখা গেল না। জল অল্প। কিন্তু ভাঁড়েও বেশি জল নেই। দুটো মানুষ। কাল ভোর অব্ধি এতেই চালাতে হবে ভেবে আধ মাখা চিঁড়েই মুখে চালান করে গিলতে গেল।

সাবু একটু দূরে অ্যালুমিনিয়মের রঙ চটা বাটিতে জল নিয়ে দাঁড়িয়ে দেখছিল। সুবল যতই গিলতে যায় তা মুখ দিয়ে নামে না। সে কাশছিল। সাবু এবার তার দিকে এগিয়ে গিয়ে নিজের জল দিয়ে বাকি চিঁড়েগুলো ভাল করে চটকে দিল। আঁচলের খুট থেকে একটা লাল লঙ্কা ফেলল তাতে ।

সুবল অবাক হয়ে সাবুকে দেখছিল। এত কাছ থেকে সে কোনো মেয়েকে দেখেনি এর আগে। মাকে তার মনে পড়ে না। বাপ যখন তাকে ফেলে পালাল তখন সে হাঁটতেও শেখেনি। এর বাড়ি তার দোর ঘুরে ঘুরে কখন যেন সে বড় হয়ে গেল। সে এই সংসারে পুরো একা। কি করে খেতে হয় সেটাও ভাল করে জানা নেই তার। এই প্রথম তাকে কেউ এভাবে খেতে দিল। ছুঁড়ে ফেলা বিরক্তির খাবারের থেকে এর স্বাদ একবারে আলাদা…চোখটা কেমন কড়কড় করে উঠল।

তখনি তার খেয়াল হল সাবুর জন্য  চিঁড়ে আনা হয় নি। অর্ধেক খেয়ে বাকিটা এগিয়ে দিল তার দিকে।  কোঁচরে রাখা মুড়ি চেবাতে চেবাতে সাবু বলল – ‘আমার এতেই হবে। তোমার আজ মেলা পরিশ্রম খাটনি হয়েছে। ভাল করে না খেলে ধকল সইবে কি করে?’

ফ্যালফ্যাল করে কিছুক্ষণ তাকিয়ে সুবল আবার গোগ্রাসে খেতে লাগল। প্রায় শেষ করে পাত্রটা সে সাবুর দিকে ঠেলে দিল,- ‘এবার তুই খেয়ে নে’।

সাবু সেদিকে ভ্রুক্ষেপ না দিয়ে নিজের বাকি মুড়িটা বাটিতে ঢেলে আরও খানিকটা জল দিয়ে ভাল করে চটকে বলল –‘যতটা পারো খেয়ে নাও। যেটা পারবে না খেয়ে নেব’।

পেটের জ্বালাটা একটু একটু করে নিভে আসছে। সুবল বার বার সাবুকে দেখছিল। ক্ষয়াটে চিট্ হয়ে আটকে থাকা চিনচিনে একটা ব্যথা বাইরে বেরিয়ে আসতে চাইছে সব আগল ভেঙে।

সাবু এক মনে খাবার খাচ্ছে। গাছের ফোকর গলে ভাঙা চাঁদ সাবুর মুখে,কপালে বিন্দুর মত জ্বলজ্ব্ল।

সুবল গামছা মাথায় দিয়ে চিত হয়ে মাটিতে শুয়ে আকাশে তারার গুনছিল। যতই গোনে ততই আবার এক জায়গায় আটকে যায়। এক দুই তিন …পঞ্চাশ…ষাট…সংখ্যা ভুলে যাচ্ছে। সংখ্যাগুলো এখন প্রজাপতির মত উড়ে বেরাচ্ছে তার চোখের সামনে। কি হচ্ছে আমার! নিজেকেই প্রশ্ন করল।

হঠাৎ-ই পায়ে কারোর হাতের ছোঁয়া পেয়ে সে চমকে উঠে বসল। সাবু তার পা টিপতে টিপতে ওপরের দিকে উঠছে। সে মুহূর্তের মধ্যে পা সরিয়ে নিয়ে বেশ কর্কশ স্বরে বলল- ‘কি চাই এখানে? শিগগিড়ি ভেতরে যা। কি পেয়েছিস তুই? আমি কি তোর মরদ?’। একটু থেমে আগের থেকে মোলায়েম গলায় আবার বলল- ‘জীবনে কেউ আমার হাতেই হাত রাখেনি, পা তো অনেক দূরের। যা পালা এখান থেকে। নইলে অনর্থ ঘটে যাবে কিন্তু…’।

সাবু সে কথা না শোনার ভান করে কিঞ্চিত ন্যাকা গলায়- ‘সে না হয় নও। কিন্তু আমার আশ্রয়দাতা তো বটে। সারাদিন কোদাল চালিয়েছ। একটু দিই না টিপে। আরাম লাগবে’।

সুবল কিছু বলতে গিয়ে থেমে গেল। পায়ের পাতা থেকে হাঁটু…কোমড় থেকে পিঠ সবতেই যেন ব্যথা।এটাই বুঝি তার জীবনে টের পাওয়া প্রথম ব্যথা। আর এ ব্যথা কমাতে পারে কেবল সাবুই। আমি কি সাবুকে ভালবেসে ফেলছি? এই ভালবাসা জিনিসটা ঠিক কি? না, বুঝতে পারছিনা। ধুৎতারি! নিজের মনেই বিড়বিড় করল সে।

সাবু তার সারাদিনের মাটি বওয়া শক্ত হাত দিয়ে থাই টিপতে টিপতে মৃদু স্বরে হুকুমের ভঙ্গীতে বলল –‘নাও এবার উপুর হয়ে শোও। পিঠ আর কোমড়টা দিই। তারপর চালায় গিয়ে শুয়ে পড়বে। আমি এখানেই এক ঘুম ঘুমিয়ে পড়ব’। বেশ জোরে হেসে আবার বলল –‘জান তো সবাই বলে আমি নাকী মেয়ে কুম্ভকর্ণ’।

‘সে আবার কে?’

‘তা আমি কি জানি! তবে শুনেছি সে এত ঘুমতো যে তার গায়ের উপর দিয়ে হাতি চলে গেলেও টের পেত না। তবে আমি অবিশ্যি অতটা নই’।

সুবল কোনো উত্তর না দিয়ে উপুর হয়ে শুলো। কি হচ্ছে তার!  সে যেন টের পাচ্ছে  ভেতরের জমে থাকা গুটিপোকাগুলো খোলস ছেড়ে শুঁয়োপোকা হয়ে উঠছে। নদেতে বান এসেছে। সে এক্ষুনি ভেসে যাবে। হবে।শ্বাস ফুলছে …প্রাণবায়ু চলে যাবার আগেই শক্ত ভাবে মাটি ধরে ফেলতে হবে…।

খানিকবাদে সাবু তাকে চালার ভেতর যেতে নির্দেশ দিল। সুবলের শরীরে এখন কোনোও ভার বা নিয়ন্ত্রণ নেই। সে দম দেওয়া কাঠের পুতুলের মত সাবুর সাথে চালায় ঢুকলো। সাবু ছেঁড়া পোটলার ভিতর থেকে ছেঁড়া শাড়ি নিয়ে বালিশের মত ভাঁজ করে তাকে শুয়ে পড়তে বলে বাইরের দিকে পা বাড়ালো।

তখুনি যেন সুবলের মনে হাই ভোল্টেজ বিদ্যুৎ খেলে গেল। সে কাঁপা কাঁপা হাত নিয়ে সাবুর হাত পেছন থেকে টেনে ধরল। মুহূর্তর মধ্যে বুঝতে পারল মেদ মাংস ভরা একটা শরীর ক্রমে তার বুকে লেপটে যাচ্ছে।একে পাবার জন্য তাকে হিংস্র হতে হয়নি, নোখ- দাঁত-কোদাল কোনো কিছু বের করা ছাড়াই মাটি নিজেই ফলবতী হতে চাইছে।

আশেপাশে সার বেঁধে থাকা ছোটো ছোটো চালাগুলোর মাথায় এক ফালি চাঁদ নিরপেক্ষ ভাবে বিছানা ভেজাচ্ছে। সেই বিছানায় সারাদিনের পরিশ্রান্ত দেহগুলো মরার মত ঘুমিয়ে। কেবল নাক ডাকার তীব্র গর্জনে বাতাস মাঝে মাঝে ভয় পেয়ে থমকে দাঁড়িয়ে যাচ্ছিল।

এখানে নেই কোনো পূ্র্ব রাগ বা পশ্চাত্তাপ, কিম্বা কোনো ছলচাতুরি ভরা মিথ্যে গল্প। কোনো কবিতা বা কল্পনা ছাড়াই বেয়াব্রু রাস্তা সবাইকে নিয়ে যেন এক সুতোয় পুঁথির মালা গেঁথেছে। এমনই এক চালার নিচে সুবল আর সাবুর মিলনে মাটি আরও উর্বর হবার প্রতিজ্ঞা নিয়ে নির্লজ্জ চাঁদের নিবিড় আলিঙ্গনে ।

বিতস্তা ঘোষাল। কবি, গল্পকার ও অনুবাদক। জন্ম ৫ই জানুয়ারি, ভারতের কলকাতায়। ইতিহাসে এম এ, কলেজে সাময়িক অধ্যাপনা। অনুবাদ সাহিত্যের একমাত্র পত্রিকা ‘অনুবাদ পত্রিকা’র সম্পাদক। ‘বাংলা আকাডেমি’, ‘একান্তর কথা সাহিত্যিক', 'চলন্তিকা' পুরস্কারপ্রাপ্ত। বিতস্তার প্রকাশিত বই ২২টি। তাঁর কবিতা হিন্দি, ওড়িয়া, অসমিয়া ও ইংরেজিতে...

এই বিভাগের অন্যান্য লেখাসমূহ

বালির বেহালা

বালির বেহালা

বুড়িমাসি বলেন,জীবনটা বালির ঘর গো।ঢেউ এলে ধুয়ে যায় জীবনের মায়া।তবু বড় ভালবাসা ওদের দাম্পত্যে।রোদের চাদরের…..

তদন্ত

তদন্ত

  এক ড্রইং রুমে বসে রয়েছে সদ্য কিশোর উত্তীর্ণ তরুণ গোয়েন্দা সজীব। সামনের টেবিলে ছড়িয়ে…..