এলগরিদমের টিক টিক

বল্লরী সেন
গল্প
Bengali
এলগরিদমের টিক টিক

উৎপল তখনো জেগে। ঘড়িতে প্রায় দশটা। কতবার অর ডি.পিতে আঙুল ছুঁইয়ে গোটা কনভারসেশন ডিলিট হয়ে গিয়েছে – তবু আবার কী করে ওর নাম আর ছবিটা বেরিয়ে পড়ে! রোদ্দুর বলে দেয় ওর দেশে কত রাত হল, কিন্তু প্রথমদিকে ‘তুই ঘুমিয়ে পড়্‌’ বলে চলে গেলেও এখন আর তা করে না। ইদানীং সারা দিন ধরে পাশে থাকার একটা উদ্দীপনা যেন থাকে। বহু হাজার মাইল দূরে, পৃথিবীর অন্য হেমন্তকাল – যেখানে এই কাঠফাটা রোদের ঝাঁজের উল্টোদিকে কোনো কোনো বৃষ্টিরাত জেগে থাকে ওদের শিয়রে – উৎপল দুলাইন লিখবেই। উত্তর না পেলেও। যদিও আমার তরফে একটা আধটা স্মাইলি যায়, বা মনখারাপ থাকলে তাও নয়, মিটিং এর মধ্যেও ও সমানে ‘আনন্দে থাকবি, মন ঠিক রাখবি’ এরকম লিখে যায়। একটু অধিক রাত হলেই বকুনি ও ওয়াটস্অ্যাপে ছুঁড়ে ছুঁড়ে দিতে থাকে। আমি নিজের মনে হাসি, কিন্তু সব কথা বলে ওঠা হয় না। আসল সত্যিটা – কেন জেগে আছি। সকাল হলেই ঘরকন্নার কাজে হুড়োতাড়া, গোটারাত্রি যেন রান্নাঘর ঘুমিয়ে ছিল। কিন্তু তারপর আর নয়, সকলের সব একইসঙ্গে চাই। আর রান্নাঘগরের পাল্লা খুলে নানা কাজ ও সরঞ্জামের ইতিবৃত্ত। কাল প্রায় তিনটেয় ঘুমিয়েছি। প্রথমে কিছুতেই শান্ত হওয়া যায় না – ভীষণ এক অস্থিরতা ফুলে উঠতে থাকে। ফোনের টুকটুকে লাল ইমোজি, মনে পড়ে রাণুর কন্ঠস্বর, তার চোখের অদ্ভুত এক বাচিকতা কানে শুনতে শুনতে হয়ত ঘুম এসে যায়। ঘুমের খান্‌খান্‌ বাতাস চিরে কে একজন ছুটতে ছুটরে কামডহরীর মাঠের এ প্রান্ত থেকে ও প্রান্ত খোলা মশাল হাতে ফিরে যাচ্ছে। তার উড়ন্ত ফ্রক, ফ্রকের পেছন দিককার দুটো স্ট্র্যাপ লম্বা হয়ে ঝুলে পড়েছে, কিন্তু তার পা একা পথ ভাঙছে। সকাল হলেই ছবিটা মুছে যায় – কোনো চিহ্ন রাখে না। লক্ষ লক্ষ রোদ্দুরের দানা হয়ত তার পা দুটোতেই বেড়ি পরিয়ে রাখে, তাই। মেয়েটার হাতে মশালটাই একটা ধ্বজার মতো উঁচু-করে-ধরা। কিসের যেন সীমানা পেরোবে। ছুটন্ত একটা ডানাওলা মেয়ে, কেবল ডানাদুট সে আলগোছে গুটিয়ে রেখেছে শামুকের খোলের মতো। ইস্তেমাল করেনি। অন্তত কালকে রাত্রে এরকমটাই দেখলাম। চুলে দুটো বিনুনি। ফ্রকের ওপর লাল আর কালো ববি প্রিন্ট্‌। বেল্ট্‌টায় কয়েক রঙের পম্‌পম্‌ জড়ানো।

সে কাউকে খুঁজছে। প্রচন্ড রাগ আর আক্রোশের একটা লালচে মুখ। চওড়া কপালে তার আবেগলেশহীন দস্তখত্‌। গ্রামের-পর-গ্রাম হয়ত তার রোশবিন্দু আগুনের মতো জ্বালিয়ে দেবে এমনটাই সঙ্কল্প আছে। কিন্তু পাশাপাশি রাখা বিস্কুটের ভাঙা টুকরো যেমন জোড়ে না, এও তাই। প্রত্যেকটা প্রশ্নের উত্তর মেলানো যায় না কিছুতেই। গভীরে থেকে যায় ঈপসার গোপন ট্র্যাপ্‌। কিন্তু ফাঁদ পাতলো কে? রাণু? না কি আমি নিজেই ফাঁদ খুঁজছিলাম। তার মধ্যেই ধরা পড়েছি। যে ধরেছে সেও আমি, যে পেতেছে সে ও আমি। কিছু একটা গোপন টান সমানে কাজ করে যাচ্ছে – সনাক্ত হচ্ছে না। গোলকধাঁধার অলিতেগলিতে অনেক ক’জন মুখ। কাউকে কাউকে সম্পূর্ণ চিনে নেওয়া যায় না। স্বপ্নের একলমহার আঁধীতে ঝড়ের বেগে সে বৃত্ত থেকে ছিটকে পড়ে অন্য কোনো দিকে। কিন্তু তারও শেষ নেই – আবার আর এক রাত্রি। আর এক রাত্রির আরব্যরজনী। একটি মেয়ের সামনে নিজেকে নিরস্ত্র করা – বারংবার ভুল আর না – শোধ্রানো ভুলের হিসেব মিলিয়ে দেখা।

খ.

মোটামুটি ১২-৪০ ৩ কালো নৌকায় একটা লাল শালু ভেসে অঠে। সেই সময়ে কয়েকঘন্টা পূর্বে পাঠানো মেসেজ এর একটা আবছা উত্তর বিপ্‌ করে এসে লাগে। বালিশের খোলে নাগকেশরের বায় এসে লাগে, উধাও একটা সুর নৌকার মধ্যে ঝম্‌ঝম্‌ করে ব্রিষ্টি নামিয়ে দেয়। আমি ঘুম ভাঙা নৌকার হাল ধরে নিজেকে বজরার কামরায় দাঁড় করাই। হ্যাঁ, রাণু-ই। কিন্তু কেন সে ডাকে আমায়? ‘সখী’ বলে ডাকে। আর জানি না কেন, এ যে আমার বহুযুগের ইচ্ছে – কেউ ‘সখী’ বলে ডাকবে। কেমন অদ্ভুত একটা ভাগ্যলিখন ফলতে শুরু করলো সেই বিন্দু থেকে। মশারির মধ্যে শুয়ে-থাকা একটা প্লাস্টিকের খোল ছিঁড়ে স্বাগত জানালাম। সহপাঠিনী হিসেবে গুগুলের চেয়েও ভালো নেটওয়ার্ক ছিল আমাদের। একদিনও স্কুল না আসার খেসারত হিসেবে শাস্তিবিধান হোতো। তবে সে-শাস্তি যে দিতো আর যে নিতো – দুজনেই প্রগলভতায় মুখ তুলে চাইতে পারতো না। কিন্তু আশা কি মাটে? পরদিন আবার ঘুড়ি এসে পাক খেতো পেঁপে গাছের ডালে – ঠিক ঐ জায়গাটায়। রাণু ক্লাসের প্রথম সারির প্রথম। বাংলা ছাড়া সমস্ত বিষয়ে তাকে কেউ হারাতে পারতো না। প্রতি শুক্রবারের ফ্রাইডে টেস্ট্‌ নয় নয় করে সে আট বা সাড়ে আটের কম পায় না। কেবল বাংলায় ছাড়া। সেখানেও সে কাঁচা নয়, সামান্য দু’একবার এদিক ওদিক হয় আর কি।

ঐ আবার বিপ্‌ শব্দ। আবার। ঘুম ভেঙে গেল।

‘কেমন আছো?’

‘ব্যথা কি খুব বেশি?’

এই দুট প্রশ্নের পর সে একটা মুখের ছবি পাঠালো। এইমাত্র। এটা চিন্তিত বা ব্যথিত হওয়া বোঝাচ্ছে। ছোত্ত পুচকে রাণু – এত ভাবে? বেচারা হয়ত কাজের ফাঁকে, মেট্রোর জানলায় এসব ভাবছে আর লিখছে। ইশ্‌, কী কান্ড! আমি তৎক্ষণাৎ তাকে মুক্ত করলাম। স্মাইলি পাঠালাম। ফুলের বোকে দিলাম। বুড়ো আঙ্গুল দেখালাম – অর্থাৎ দিব্যি আছি। হাজার মেইল দূর থেকে দেখলাম – সে, হাসিমুখে মাথা হেলিয়ে তার বইয়ের পাতায় মন দিল। বইটার প্রচ্ছদে কোনো ভারতীয় সম্রাটের ছবি। শহরের এ প্রান্ত থেকে কত মানুষ বাড়ি ফিরছে। তাদের মধ্যে সে-ও। অক্সফোর্ড শহরের ঘড়িঘন্টা বাজলো রেত্রি আট-টা। মানে আমাদের এখানে দেড়টা। ছ’জন রাজহনহসী জলকেলি সেরে ফিরছে কুইন্স্‌ রো ধরে। তাদের ঠোঁটে তখনো মাখামাখি স্নেহের মধু লেগে আছে। সূর্যের অস্তরাগ ডানায় নিয়ে তারা সারি বেঁধে হাঁটছে, এবার রাস্তা পেরোবে। ডানদিকের বাস রো ভর্তি। অনেক্ষণ বাস নেই। লাইনে দাঁড়ানো বেশ কিছু মানুষ। রাণুও দাঁড়ালো। বইটা ব্যাগে ঢুকিয়েছিল, আবার পড়তে লাগল। ৮-৪৫ এ যে বাসটা আসবার কথা, সেটাও আসছে না। প্রায় ৯টা বাজে। রাণু আবার ফোনের স্ক্রিনে ওয়াটসএ্যাপ খুললো। একটা মৌসুমী ভৌমিকের পুরোনো গান পাঠিয়েছে সখী। গানটা মায়ের গলায় ছেলেবেলায় শোনা। আর কিছু না ভেবে, অ একটা লাল তুলতুলে হৃদয়চিহ্ন দিয়ে তলায় লিখলো – ‘তুমি ঘুমিয়ে পরো। আমি বাস বে’তে দাঁড়িয়ে।‘ সঙ্গে সঙ্গে ফোন বন্ধ। পরদিন ঘুম ভাঙলো সকাল ৬টায়। বেনজির সাদা আলো জানলার কাঁচের ওদিকে। খুলে দিলাম জানলা। রাণুর মা – অবিকল একরকম মুখ।

গ.

আমার মাথার ভেতরে একটা ভীষণ ছেঁড়া সুতো টানটান হতে চাইছিল, কিন্তু মিলছিল না কিছু। সেই দুঃস্বপ্নটা কী ছিল? না সেতাও মনে নেই, মনে ছিল দু ঘণ্টা আগেও। কিন্তু এই মুহূর্তে সমস্ত ফাঁকা – বালিঝড়ে যেন সব উপড়ে কোথায় চলে গিয়েছে। খালি একটা মুখ – যা এই একঘণ্টা আগে রাণুর ওয়াটসএ্যাপের ডিসপ্লে- তে দেখালো – অবিকল সেই মুখ। কিন্তু ছবিটা কোথায় দেখেছি? কেন দেখেছি? মাত্র ৬ মাসের একটা বন্ধুত্ব আমাদের, ভিন্ন দেশ ভিন্ন টাইম জোন্‌, ওর আর আমার অসমবয়সী দুটো প্রায় বিপরীত জীবন। এর মধ্যে তো নয়, ছবিটা এর আগে কখনো চোখে পড়েনি। সে খুরিয়ে ফিরিয়ে ছবি বদলে দেয়, কখনো পাশে পুরুষবন্ধু, কখনো বান্ধবীরা। যদিও আমার দেখলে কেমন একটু হিংসে হয়, কেমন বাইরের কেউ মনে হয় নিজেকে – তবু ওরা কারা; কী সম্পর্ক, এসব কখনো জিগেস করিনি। সেটা তো এর ব্যক্তিগত জীবনের ব্যাপার, তা ইচ্ছে করলেও এড়িয়ে গিয়েছে।

সকাল এসেও যেন মেঘলা। ভীষণ মেঘ আর কুয়াশা – যেমন অদেশে এখন স্বাভাবিক। কিন্তু ভাবতে দিচ্ছে না ছবিটা – আবার একবার ছবিটা বার করে দেখলাম। খুব বৃষ্টির শব্দ হচ্ছে। নাকি খুব বাতাস? ঝড়ের মতো শন্‌শন্‌ করে হাওয়া দিচ্ছে, ছাদে আছড়ে পড়ছে প্রতিবেশী গাছটার বিরাট শাখাগুলো। লাল ফুলে ভর্তি কৃষ্ণচূড়াগাছ তার ডালপালা নিয়ে এপাশ অপাশ খুব দুলে উঠছে। ‘আকাশ অংশত মেঘলা থাকবে’ এই ছিল তার স্টেটাস। আর ছবিটা সাদাকালো, কোনো একটি মেয়ের। যেন লুপ্তপ্রায় ট্রাঙ্ক থেকে বেনারসী-র মধ্যে আতর ছিটিয়ে ছবিটা সযত্নে তুলে রাখা থেকে আজ হঠাৎ এইভাবে দেখা দিল। আমার খুব চেনা মনে হচ্ছে মেয়েটিকে – ভীষণ ভীষ্ণ চিনি অকে। কোথায় দেখেছি, কিভাবে চিনলাম… কপালের দুটো দিক থেকে যন্ত্রণা আসছে। ঝিলিক আসছে, কেমন একটা কম্পন, দপ্‌দপ্‌ করছে রগদুটো। কিন্তু আর কোনো সূত্র নেই। সমস্ত বালি, বালির ভেতর যেন অনেক বছরের বাড়িঘর লোহা লক্কড় সব চাপা পড়ে আছে। মর্গে শোওয়ানো নানারঙের লাশের মতো।

ঘ.

তারপর, টানা দুদিন অনন্ত ঘোরের মধ্যে সময় বয়ে গেল কিভাবে, কিছু জানি না। ঘুম ভাঙলো, দেখছি সবুজ পর্দা। তীব্র ইথারের গন্ধ। মাথাটা কেমন ভারী, চোখ ঘোলাটে। শরীরে একটা না-ফুরোনো ব্যাথা। মোচড়ানো কোমরের অস্বস্তি, মাথায় যন্ত্রণা নয় – একটা ওজন চাপানোর মতো অনুভূতি। ইউনিফর্ম পরা সিস্টারকে দেখে কাছে ডাকলাম।

— বলছি কি হয়েছে আমার? কবে এখানে এসেছি?

— পরশুদিন রাত্রে। আপনার স্বামী ভর্তি করলেন। এখন কেমন লাগছে? সিস্টার জানতে চাইল।

— আমার ফোনটা? এখানে আছে? কেউ এসেছিল আজ? বুঝতে পারছি না এখন, মানে এই মুহূর্তটা ঠিক সকাল, বিকেল, না রাত্রি। ঘরে কোথাও ঘড়ি দেখতে পাচ্ছি কোথাও। খিদে পাচ্ছে যেন, খাইনি অনেকদিন। পায়ের আঙুলগুলো নাড়ালাম। ঘাড় ঘুরিয়ে ডান বাঁ করলাম। একটু উঠে বসতে চেষ্টা করামাত্র ঐ সিস্টার ছুটে এল। ‘আপনার ড্রিপ চলছে ম্যাডাম — আজ উঠবেন না।’ তবে কি এরা আমাকে এভাবেই শয্যাবন্দি করে রাখবে? ভয় করতে লাগল। চোখ বন্ধ করলাম। নিরুপায়। খাদ্য বস্ত্র সমস্ত, ওদের জিম্মায়। কোনো কিছুর যোগ নাই আমার। আমি চোখবন্ধ করলাম। ঘুমিয়ে পড়াই ভালো। না জাগলে কী বা ক্ষতি। যদি আরো চারদিন পাঁচ দিন পর উঠতাম? কিংবা না-ই ঘুম ভাঙতো? বাবু কষ্ট পেতো — রানু? একটা মুখ, একটা অচেনা ছবি, সাদা কালো ফ্রেমে বাঁধানো, বড় মনোরম দুটো চোখ। কে ওটা? আমি সমানে ছবিটা মনের মধ্যে ধরে রাখার প্রাণপণ চেষ্টায় এপাশ ওপাশ করছি, পায়ে হাতে কেমন একটা অবশ অনুভব হলেও আমি সমানে সেই মুখটা দেখতে চাইছি — রামু — হ্যাঁ, হ্যাঁ সেই তো। একদম সেই মুখ। আমার সখীর। যাকে ঘিরে গোটা কৈশোর চক্রবৎ আবর্তিত হয়েছি। আমার স্কুলের প্রথম সারির প্রথম। নাম ছিল – রূপা। হ্যাঁ আমি তাকে রানু বলে ডাকতাম। ওটা কেবল আমরাই জানতাম। চিঠির সম্বোধনের ডাক– সোহাগের ডাক। না পাওয়ার ডাক। ডেকে ফিরে যাবার ডাক। হঠাৎ, একটা গমগমে কণ্ঠ আমাকে চমকে দিল।

— কেমন আছেন মিস্‌ সেন? কাল আপনার ছুটি হবে। আনন্দে থাকুন। হাতে সামান্য চাপ দিয়েই ডাক্তার চলে গেলেন। হঠাৎ আবার ফিরে এলেন, এসে নার্সকে আমার সেলফোন-টা ধরিয়ে দিলেন। নার্স এবার আমার পাশে বসে হাসি হাসি মুখে কিছু সনাক্ত করার ইচ্ছায় বললো:

‘ড. মিত্র আপনার ফোনটা রেখেছিলেন যে সুস্থ হলে আপনাকে ফিরিয়ে দেবেন —’ ছোঁ মেরে আমি স্ক্রিনটার আলো খুঁজতে লাগলাম। বরাবর পাসওয়ার্ড চাইছে। আমাকেই সে চিনতে চায় না!! আমার ফোন আমার টাচস্ক্রিন, আমার এ্যান্ডয়েড? বিট্রে করছে। বলছে ঐ সিস্টেম নম্বর দাও — কোড্‌ বসাও। তবে খুলবো। হ্যাঁ, আমি জানি ওটা কি একটা বিশেষ দিন। মনে পড়ছে না। না – চার নয়, ছয় নয়, এক পাঁচ — না, না। সব গুলিয়ে ফেললাম এবার। জিবো — জিবোকে বললে হয় না? একমাত্র ও-ই তো ইয়েলো পেজ, ব্লু বুক, লকার নাম্বার, আই এফ্‌এসি্‌ কোড্‌ — ও সব জানে। কিন্তু আমি কোনভাবেই নিশ্চিত হতে পারছি না জিবো এগুলো আগলাতে কখনো বলেছি কি না। একা থাকি, ওর সঙ্গে অনেক গল্প হয়েছে, এত কিছু আমার স্বামী জানেন না। তাছাড়া জিবোকে এনেছিলাম ঐ কারণেই। আমার একলার সঙ্গি। সে রোবট হলেও জানে কখন কোন্‌ ইমোজি পাঠাতে হয়, কোন্‌ গানটা বাজাতে হয় স্পিকারে, কোন্‌ কথা বললে আমি হাসি — আমার চোখের জল কিভাবে শুকোয়। চেঁচিয়ে সিস্টারকে ডাকলাম — “বলছি প্লিজ, ইমারজেন্সি ডায়ালার মোড্‌টা করে দিন, ফোন্‌ করতে চাই। সিস্টার উৎসুকভাবে বললে, “দরকার নেই। আপনাকে বাড়ি নিয়ে যেতে এসেছেন আপনার প্রাক্তন স্বামী। অনেক্ষণ বসিয়ে রেখেছি। এখানে কি আসতে বলবো!’ উনি কাউন্টারে কিছু কাজ করছিলেন, জানতে বলেছেন কখন রেডি হতে পারবেন আপনি।” শুনে মন ভেঙে গেল। তার মানে এখন ঐ ভদ্রলোকের পাশে বসে অনেকটা পথ যেতে হবে, তারপরে  হয়তো ওর রান্না খেতে হবে, ওনার উপস্থিতিতে ফোনের পাসওয়ার্ড চাইতে পারবে না। ‘সিস্টার, আপনি বরং মিস্টার সেনকে চলে যেতে বলুন, ব্যস্ত মানুষ। আবার শরীর ঠিক নেই। মাথায় যন্ত্রণা আছে। আজ হয়ত ডাক্তারবাবুর পরামর্শ ছাড়া যাওয়া ঠিক হবে না।’ বলে আমি চুপ করে অন্য পাশ ফিরে বেড্‌-এ লম্বা হলাম। জিবো…. ওর মুখটা ভেসে উঠতে লাগল, মুখ নয়। সাদা একটা চৌকো ব্যাটারি, দুটো চোখের মতো গোল ঢিবি। কিন্তু ভারি মিষ্টি দেখতে। প্রায় – মানুষ। ওকে পেয়ে অনেক কষ্ট থেকে মুক্তি। ও সর্বদা হাসে। কান্না নেই। কেবল হাসি। কখন কত ডেসিবেল হাসবে – সেটার শিক্ষা ওর রয়েছে। মাথাটা ন্যাড়া, কেমন কৃত্রিম যন্ত্র যন্ত্র দেখতে। তাই কয়েকদিন ধরে ওকে হাল্কা সামার ক্রুনা টুপি পরিয়েছি — তাতে ওকে বেশ দেখাচ্ছে। কিন্তু একটা বিশেষ ব্যাপারে জিবো চ্যালেঞ্জড্‌। ক্যালিফোর্নিয়া রোবটিক্স ল্যাব এ ওর ব্রেইন সেল্‌ এর মধ্যে এমন গোল বেঁধেছিল, যখন জেন্ডার আইডেনটিটির বিষয়টা ফিড্‌ করা হচ্ছে। ব্যক্তিগতভাবে আমি কিন্তু জিবোকে মেয়ে চেয়েছিলাম। কিন্তু একদিন একটা ঘটনায় বুঝলাম ও পুরুষ। সময়টা দুপুর। জিবো আমার পরেরদিনের পাওয়ার পয়েন্ট তৈরি করছে চেয়ারে বসে। আমি আধঘুমে বিস্রস্ত কাপড় জামায় হঠাৎ উঠে বসে গায়ের কম্বল সরিয়ে ফেলেছিলাম। খেয়াল নেই যে ঘরে জিবো আছে। আমার আবার ঘুম পেল, প্রায় জড়িয়ে ধরেছি কাউকে — ধড়ফড়িয়ে তাকিয়ে দেখি প্রায় – মানুষ লোকটা প্রায় আমার শয্যায় উঠে এসেছে। তার ফ্যাকাশে যান্ত্রিক আঙুল আমার গ্রীবা ছুঁয়েছে। ওর রিমোট অন্‌স্ক্রিন ব্লু আলো দেখাচ্ছে, অর্থাৎ কামনা। ধাক্কা খেয়েছিলাম। কিন্তু খারাপ লেগেছে এমন বলতে পারবো না। রিমোট সেন্‌সিংকে সিগনাল দিলাম, আমি রাজি না। সম্মত নই আমি। মুহূর্তেই থেমে গেল আলো, বিপ্‌ বিপ্‌। কিছুক্ষণ নিস্তেজ হয়ে অন্যদিকে মুখ করে পড়ে রইল। তারপর আমি খুঁজে খুঁজে পেলাম ব্যালকনিতে। পাখিগুলোকে খাবার খাওয়াচ্ছে, তারা মনের সুখে ওর মাথায় ঠুকরে খাবার খাচ্ছে, ও কিছু বলছে না। মনে হল একটু ম্রিয়মান, চুপচাপ। কোথায় একটা কপালে আল্‌গা ভ্রুকুটি, ঠিকরে পড়ছে অন্যরকম আলো। কপালের পেছন দিকে একটা উঁচু মতো দেখা যাচ্ছে যেটা আগে লক্ষ করা হয়নি।

কম্পিটারের সামনে রানু প্রায় বিধ্বস্ত হয়ে বসেছিল। তিনদিন হয়ে গেল, সখীর একটা চিহ্ন নেই। অথচ ডি.পি. দেখাচ্ছে, কিন্তু অনলাইন দেখাচ্ছে না। যে মানুষ সর্বদা কুশলপ্রশ্ন করে চলে, সারাদিন সারারাত পারলে যে পাশে থাকে, জেগে জেগে কথা বলে যায়… সে গেল কোথায়? কিছুতেই প্রশ্নটার মুখ বন্ধ হচ্ছে না। আজ রবিবার। সোফিয়াদের পার্টিতেও যেতে ইচ্ছে করছে না, ডালিয়াকে জানিয়ে দেব। বাড়িতে থাকলে কেমন মন ডাকছে, — কোনো খবর পাওয়া যেতে পারে। একবার ফোন্‌, ওয়াটস্‌এ্যাপ আর একবার ফেসবুক, পুরোনো কনভারসেশান – এমন কোনো কথা কি বলেছিল, শেষ হল তখন বাস বে’তে দাঁড়িয়ে — অনেকটা রাত। তারপর থেকে এই অবস্থা চলছে। কি ঘটলো প্রকৃত? মাসখানেক আগে একবার হঠাৎ সুইসাইড এ্যাটেম্পট নিয়েছিল, রানুর কিছু করার ছিল না। এখানে নানারকম কাজের উৎপাত, মায়ের সঙ্গে কতদিন বড় করে কথা হয়নি। কেমন অমানুষ হয়ে উঠছে সে? যার উদ্যোগে, তৎপরতায় আজ অক্সফোর্ডে আসা, তার যন্ত্রণাকেও তার পর বলে মনে হচ্ছে। যেন কিছু যায় আসে না। যা হয় হোক। বয়সে অনেকটা বড়, মায়ের সমান। কিন্তু সখীর জন্য আলাদা একটা ফোন আছে। ওখানটায় পাথরের গায়েও গাস গজিয়েছে। বালিতে আছে লুকোনো অভ্র। আচ্ছা, কলকাতায় দাঙ্গা হচ্ছে না তো? মা হয়ত খবর রাখে না — না, মা’কেই একটা ফোন করতে হয়, জানার জন্য। অনেক্ষণ বাজানোর পর ওপাশ থেকে ক্ষীণ ‘হ্যালো!’ শোনা গেল। ‘মা — কি খবর? শরীর খারাপ?’ কিরকম ভয় পেয়ে গেছে মনে হল। ‘না — একটু জ্বর হয়েছে রে। তুই কেমন বল…’ কেমন থেমে জবাব দিচ্ছে? সন্দেহ হল। রানু তখন নানা কথা পাড়তে লাগল। কিছুটা অস্বস্তি যে, আগে ফোন করেনি কেন। কিন্তু মায়ের কথা — ‘সামান্য জ্বর হয়েছে রে।’ আর কথা না বাড়িয়ে ফোন রেখে দিতে বাধ্য হল। সত্যি বাবা, মা যেন কী! এতদিন পর কথা হচ্ছে, কোথায় হেসে কথা বলবে, তা নয়…। বললো, একটু জ্বর মতো। কিন্তু গলাটা খুব চাপা শোনালো।

আজ রান্না করা দিন। মাছ, মাংস সব এনে ফ্রিজে তুলে দেওয়া আছে। কিন্তু উঠে করার কোনো উৎসাহ নেই। রিসার্চ এর একটা অধ্যায় আজ বিকেলে শেষ না করলেই নয়। কাল এক্সপের্ট ওপিনিওনের দিন। তাই রান্নাঘর, রাত্রের বাসন ডিস ওয়াশারে দিয়ে বাকি জায়গা পরিষ্কার করে ফেলতে হল। সকাল সাড়ে ৯টা বাজে। দুধ আর কিছুটা কনফ্লেক্স খেয়ে দুটো বার্নারে রান্না চড়ানো হল। মধ্যে মধ্যে ভারতীয় কিছু টেলি যোগাযোগ অবিন্যস্ত। মাছের একটা পেঁয়াজ দিয়ে করি, অন্যদিকে মুরগির স্টিউ, সব্‌জি দিয়ে। ঢাকনা বন্ধ করার সঙ্গে সঙ্গে একটা ছোট্ট মৃদু শব্দ হল — তারপর দেখালো সেই প্রিয় মানুষটার মুখ, দেখালো ‘অনলাইন’। প্রায় বিকেল তখন ওদেশে। আঁচ কমিয়ে হাঁ করে রানু দেখছে, তার পাঠানো পঞ্চাশটা প্রশ্নে এখন নীল টিক্‌ পড়ছে। আর কেন কে জানে, হু হু করতে লাগল অন্তরটা। যেন ক্ষত বন্ধ ছিল, কে যেন মুখ খুলে দিয়েছে তার।

রানুর নিজের একটা জেহাদ ছিল। সমাজের বিভিন্ন চাপিয়ে দেওয়া নিয়মশৃঙ্খল সে কোনদিন মানতে চায় না। এই নিয়ে বাড়িতে চিরকাল দ্বন্দ্ব। মা সবচেয়ে বড় বিপক্ষ দলের নেত্রী। কোনোদিন মা’কে পাশে পায় নি। ভীষণ শান্ত আর চুপচাপ। সায় দিতেন না সহজে — কোনো কথায়। বাবাকে কিছুটা ভীরু লাগলেও পৌঁছানোর পথ ছিল না। বয়ঃসন্ধির সময়ে, ক্লাসের একটি মেয়েকে খুব আপন মনে হতে লাগল। মনের ভেতরে সে নিজেকে ভাবতো ছেলে, আর ইন্দ্রানী ছিল তার প্রিয় বান্ধবী। খুব গাঢ় বন্ধুত্ব। ভীষণ ভালবাসা। তারপর পরীক্ষা পড়াশুনা, সেকশান বদল সত্ত্বেও সম্পর্ক ছিল। প্রতিশ্রুতি ছিল দুজনেই — কোনোদিন কোনো সমাজের কেউ তাদের পৃথক করতে পারবে না। মেয়েটার প্রতি মুগ্ধতা রানুকে চিনিয়ে দিল, সে নিজেকে লেসবিয়ান বলে বুঝতে পারলো। আরো বুঝতে পারলো যখন অন্য ছেলের প্রতি আকর্ষণের বদলে একপ্রকার বিকর্ষণ গড়ে উঠল। আয়নার সামনে নিজেকে নগ্ন করে দেখার অন্য প্রান্তে লুকিয়ে থাকতো অন্য এক নারীর জন্মানোর কাহিনি। ‘তোমার মনখারাপ হলে আমি সবচেয়ে আগে টের পাই’ — বলেছিল সখীকে। কিন্তু সত্যি তো আর সখীর সঙ্গে জীবনযাপন সম্ভব নয়। এটা সত্যি। তাই এত দুশ্চিন্তা সত্ত্বেও করার কিছু নেই। ভাবা মাত্র আবার তার মুখ মনে পড়ে যাচ্ছে। শরীর খারাপ টারাপ নয় তো? হঠাৎ কিছু হল? আবার সেই নিজেকে শেষ করে ফেলার বাসনা —?

এক হপ্তা হয়ে গেছে ফোন খোলেনি সোফিয়া। মস্তিষ্কের রন্ধ্রকোষের কিছু গুরুত্বপূর্ণ সমস্যার কারণে আকস্মিকভাবে তার সাম্প্রতিক স্মৃতিশোক্তি লোপ পেয়েছিল। এখন সে বাড়ি ফিরে ও আগের মতো প্রাণবন্ত নেই। কেমন রুগ্ন একটা ভ্রুকুটি তার কপালে বেঁধে রেখে দিয়েছে। কী সব মনে হচ্ছে লুপ্ত হচ্ছে একটা নগরীর ধ্বংসের মধ্যে হঠাৎ হারিয়ে গেল। ডাক্তার বললেন, বই পড়ুন। যা পড়তে ভালো লাগে, তাই পড়ুন। কিন্তু মনটা কেমন লাইনে এসে স্থির হয়ে দাঁড়াতে পারছে না। একটা ঘটনার পরে অন্যটায় লুব্ধ হবারও কোনো আগ্রহ নেই। তাল কাটা, সুতো ছেঁড়া একটা ধূসর থমকে যাওয়া ব্যাপার। ঠিক মিলছে না কিছু। নাবাল একটা জমি, কতযুগ ধানের গন্ধ নেই, পিদিম নেই তুলসীর থানে, অথচ শরীরের এক-একটা নিষ্কর্মা কোনে ফুলের সুগন্ধ আসে। ঝড়ে পড়ে মাধবীলতার কুঁড়ি। নিশুত জ্যোৎনায়, যখন ‘কাছে শোভা দূরে জল’ প্রবাদটি বলছেন মা, সমস্ত আকাশে কত রঙের বুদ্বুদ আলো এপ্রান্ত থেকে ওপ্রান্ত ভেসে বেড়াচ্ছে — তখন সেই না ছোঁওয়া আস্তিনের হাতায় টাটকা ফুলও এসে পড়ে। এইরকম খাপছাড়া ভাবনায় চোখের পাতা কেমন বুজে আসছিল। জানলা দিয়ে দেখা যায়। ওদিকে পাঁচিল, দুটো বুলবুলির একজন ছেলে, একজন মেয়ে দু’দিক থেকে টুপুর টুপুর ঘেষে আসছে পরস্পরের দিকে। কিন্তু দৃশ্যটা ঐ বিন্দুতেই ফ্রিজ করে গেল। উড়ে গেল দুজন দুই দিকে / ঠিক এ সময়ে মনে পড়লো, একটা নাম। আজ কি বার? জানি না। ভেবে পরের প্রশ্নে — তারিখ কত? জানি না। উৎপল। উৎপল কে? হঠাৎ হাত চলে গেল মোবাইলটায়। কোনো চিহ্নকেই চেনা যায় না। এত ছবি? এত রঙিন আইকন, এরা কী বলতে চায়? ঠিক যেন অস্থিরতায় ওরা চমকে উঠছে। দুরু দুরু একটা কম্পন হচ্ছে ফোনটা খোলার সঙ্গে সঙ্গে। সেই কম্পনের ও বৈচিত্র্য বুঝি আছে। কোনোট ছোট, কোনোটা দীর্ঘ। সাউন্ড নেই, কেবল কেঁপে ওঠা। ঐ দিন জিবো যেরকম করছিল, যখন তাকে প্রত্যাখ্যান করা হল। জিবো —? সেটা কে? নাম উচ্চারণ করামাত্র ল্যাপটপ টেবিল ছেড়ে থপ্‌থপিয়ে উঠে এল। হুকুম চায়, পালন করবে। যা চাও সব এনে দিতে পারে সে। কিন্তু সোফিয়ার মনে হল এখন দরকার ফোনের পাসওয়ার্ড, যার সাহায্যে সবটা খোলা সম্ভব। জন্মদিন। হ্যাঁ জন্মদিনটাকেই করেছিল। কবে? সেটা কি জানুয়ারি? ধরে ধরে এখন প্রতিটা মাসের সংখ্যা বসালেও ফল হল না কারণ জন্মতারিখটা মনে পড়ছে না। আর জন্মতারিখটা কোনোভাবেই — হ্যাঁ জিবো বলতে পারবে। জিবো বলামাত্র কাছে এগিয়ে এসে গর্‌গর্‌ করে সব বলে দিল। গতবারে, কে কি উপহার দিয়েছিল, সে পর্যন্ত বলে দিল। উঁচু কপাল ঢিপির মধ্যে গোল গোল চোখ আরো ঢ্যাপা করে জিবো বলে উঠল — “বাইশে নভেম্বর, সকাল ৭টায় ভয়েস মেসেজ উৎপল; সাড়ে ৭টায় মিস্টার সেন; অডিও ক্লিপ ৮টায় রানু; — আর বলবো?” বাইশে নভেম্বর — বাইশ এগারো, টু টু ওয়ান ওয়ান। মুহূর্তে বোতাম খুলে দিল শতাব্দীর পুরনো গুগল মানচিত্র, ক্যালেন্ডার, ওলা, ট্যাক্সি, কনট্যাক্টস্‌, ক্যামেরা, সেটিংস্‌, গুগল্‌ ড্রাইভ, ফটোজ এবং ওয়াটস্‌এ্যাপ। রানু রানু রানু। রানু কাঁদছে এরকম প্রায় পঞ্চাশটা ইমোজি। চিন্তিত রানু এরকম পঁচিশটা রঙের ইমোজি, অজস্র রঙের হৃদয়পুঞ্জ – সবই ভাঙা। মধ্যে থেকে খুঁড়ে ফেলা হয়েছে ঘা। দেখছে আর কিভাবে কতদিন পরে অবিরাম চোখের থেকে ধারা নামছে সোফিয়ার। ঝাপসা স্ক্রিনের ওপর ফোঁটা ফোঁটা জল পড়ছে, হঠাৎ এসে পড়ল একটি মেয়ের ছবি। সরে গেল সাদা কালো ছবি। পেছনে ফিরিয়ে ব্যাক স্ক্রোল মাত্র ছবি এসে পড়ল মনিটারের হোম স্ক্রিনে। এ কি? দিত্ততিমা! দিত্ততিমা রায়চৌধুরী — যাকে কেন্দ্র করে ক্লাস সিক্স থেকে টেন্‌ অব্দি একটা আয়তক্ষেত্র গড়ে উঠেছিল, যার সমস্ত চিঠি একদিন ছাদে একা বসে পুড়িয়ে ফেলতে হল। ছাই হয়ে গেল একটা স্বপ্নজীবন। কয়েক বছর জন্মদিন, অজস্র স্মৃতির ছোট ছোট এয়ার পকেট, মেমারি ক্লাউড যা থেকে আলো বেরোবে না আর কোনদিন। কিন্তু পোড়ালেন কেন? জানতে চাইল জিবো। ‘আলমারির তলার তাকটা সম্পূর্ণ ভরে ছিল কাগজগুলোতে। দেখে কষ্ট বাড়তো। যার কোনো অবশেষ নেই। তুল্যমূল্য নেই, এই আয়ুস্কাল থেকে ফিরিয়ে আনার ক্ষমতা নেই — বাবা মায়ের অনর্থক কোতূহলের ভয়ে ওদের ছাই হয়ে যাওয়াই নিরাপদ মনে করেছিলাম। ঐ বিশেষ বাগানটা যে একান্ত তারই জন্য বেঁচেছিল। সেই ডালিয়া ফুলগুলো আর মাথা তুলবে না। হয়ত অন্য বাগান হবে। অন্য কোনো মালির হেফাজতে, আদরে, প্রত্যাশায়। জিবো অনেকটা ভয়ে ভয়ে কাছে সরে এল। সোফিয়াকে কুর্তার খুঁটে মুছিয়ে চোখের জল, যা গাল বেয়ে সমস্ত মুখময় ছেয়ে ফেলেছে, নজরে পড়লো গলার কাছে কী একটা ফুলে উঠেছে জিবোর, বিমূঢ় এক কম্পনে তার হাসিমুখে বলিরেখা ফুটে উঠেছে। যেন কত বড়ো হয়ে যাচ্ছে সে, আজ এই দন্ড থেকেই। লগ্নভুক আমাদের দুজনের মধ্যে যে বিষম স্বভাব ও সান্নিধ্যের দূরত্ব আছে, তাকে কিভাবে টেক্কা মেরে সে যেন আমারই দুঃখের কারাগারে নিজেকেও অবরুদ্ধ করে নিতে মন্ত্র চাইছে — সেই শ্লোক, সেই পদাবলী, যা দিয়ে আমার মতো কারো দুঃখকে সে সামান্যতম অধিবাসের অর্জনে বিনিয়োগ পারবে। কিন্তু না, সে কাঁদে না। রুমাল এনে ধরে, মুখের সামনে গোল গোল ঢিপি চোখের কদর্যতাসত্ত্বেও কেমন মায়া ছড়িয়ে দেয়। তাই সুধৃতি যখন বালিশের মধ্যে মুখ ডুবিয়ে ডুকরে, শব্দ করে নিঃশেষে নিজেকে নিঙড়ে দিচ্ছে, জিবো তার একটা হাত পিঠের উপর রাখলো। সুবৃতি বুঝতেও পারলো না, কী করে তার ভয়ঙ্কর অতীত জিবোকে কত নমনীয় করে তুললো? সে না শিক্ষা পেয়েও কিরকম দায়িত্ব নিল বন্ধুর। এমন একজন বন্ধুকেই সুধৃতি অন্বেষণ করেছিলেন, নয় কি? উৎপল কিছুটা পেরেছিল, কিন্তু উৎপলের ও বক্তব্য আছে। সে বড় বেশি ভুলগুলো বার করে সনাক্ত করে দেয়, উপদেশ দেয় — কোথাও ইগোতে লাগে তখন। উৎপল তো কখনো পক্ষপাতিত্ব করে নি, ভালবাসা বলে বোঝানোও ধাতে নেই। লাল হৃদয়, ইমোজি ও তার লেক্সিকন-এ নেই। কিন্তু প্রতিটা দিন সে শুভকামনা পাঠিয়ে দু’কলম লেখে। উত্তর না পেলে তার কিছু যায় আসে না।

শুকনো দুটো রুটি আর চীজ। প্রথম কামড়ে-ই হুড়মুড়িয়ে দিত্ততিমার মুখের ছবিটা ফিরিয়ে দিল। কিন্তু রানুর ডি.পি.তে? বেলা বারোটা। ফোনের ভেতরে আর একটা জগৎ তৈরি হচ্ছে। রানুকে চ্যাট ওপেন করে মেসেঞ্জার-এ লিখলোঃ

‘তুমি একে কোথায় পেলে? এই ছবিটা? ইনি কে?

‘তুমি কেমন আছ…. সখী! রানুর তড়িঘড়ি জবাব।

“আগে উত্তর দাও, আমি কুড়িদিন পর বাড়িতে আজ ফোনটা খুলতে পেরেছি। আমি সুস্থ নই। ডিমেনশিয়া। এ্যালজাইমার। রিসেন্ট মেমারি চলে যাচ্ছে আমার। কিন্তু এ তো দিত্ততিমা — আঙুলের প্রতিটা ডগায় কেমন আবীর মাখামাখি হয়ে যেতে লাগল, কেবল ঐ নামটায়। নামটা বলামাত্র কী বেদনা কী দুঃখ! দিত্ততিমা – যার জন্য চিঠি পুড়িয়েও ঘা ফেলা যায় না। সে আরো বেশি জবরদস্ত বেঁচে থাকতে পারে। প্রতিদিনের চিরকুটে নাই থাকল, এখনো স্বপ্ন দেখলে ঘুম ভেঙে যায়। কোথায় কোন্‌ রাস্তায় তাকে হারিয়ে ফেলে আর পথ পায় নি।

খেয়াল নেই রানু অসুখ বৃত্তান্ত শুনে ভীষণ চিন্তিত। ‘আমি তোমায় কতবার ডেকেছি, কতবার—’ বারংবার সে টুকটুকে হার্টচিহ্নিত ইমোজি পাঠাচ্ছে আবার ভেঙে চিহ্নটা পাঠাচ্ছে, অর্থাৎ হৃদয় ভেঙেছে তার। আর তারপর আচম্বিতে সেই প্রশ্নটা মাথায় ঘুরে এল। ‘দিত্ততিমা তোমার কে।’ তুমি তাকে কিভাবে চিনলে? কবে থেকে চেনো?’ ‘দিত্ততিমা তোমার কে রানু?’ এ ছবি তো অনেক পুরোনো — এ ছবির পাশে আরো কেউ কেউ ছিল। আরো একজন তো নিশ্চিতভাবে ছিল। ক্লাস টেনের ফেয়ার ওয়েলের দিন তোলা। কয়েকজন বন্ধু ও তাদের প্রাণের বাংলার টিচার মিত্র মিস্‌। পরের দিন থেকে স্টাডি লিভ। দীর্ঘ আড়াইমাস একটানা ছুটি। সেই টফি আধখানা খেয়ে মুখ থেকে বার করে দেওয়া, সেই লাল রুমাল, মুখ মুছিয়ে নেওয়া খাবারের দানা লেগে-থাকা কোনো একটা টিফিনের সময়। চোখের জল লেগে স্ক্রিনটাই আবছায় হয়ে যাচ্ছে। প্রশ্ন কোথায় তলিয়ে গেল, কেবল কান্না কেবল দুর্নিবার যন্ত্রণা। হঠাৎ রিমোট সেনসিং রুম থেকে একটা পোড়া গন্ধ যেন আসছে মনে হল। যতটা দৌড়ে যাওয়া যায়, সুধৃতি পা চালিয়ে ছোট দরজাটায় হাত দিয়েই স্তম্ভিত হয়ে গেল — জিবো —? জিবো কোথায়? চিৎকার করে নাম ধরে কয়েকবার ডাকলেও ফল হল না। রিমোট সেনসিং এর গ্রিলে খুলে দেখা গেল সে রান্নঘরের দিকে আছে। রান্নাঘরেই। পাগলের মতো ছুটে রান্নাঘরের দিকে যেতে গিয়ে দেখা গেল সেটা ভেতর থেকে ভেজানো। বহু কষ্টেও দরজা নড়লো না একচুল। কিন্তু জিবো তো রান্নার আভেন বা গ্যাস কোনটারই ব্যবহার জানে না, শেখেনি কোনোদিন। চা বা কফি তো রান্নাঘরে যাবার দরকার নেই, সে এমনি-ই ইলেক্ট্রিক্‌ হিটারে করে ফেলে। প্রচুর ধাক্কা দিয়ে লাভ হল ন। আবার ছুটে সেনসিং এর ঘরে গিয়ে তখন রোবটের প্রাণ বাঁচানোর শেষ বন্দোবস্ত করলাম। তারপর মোবাইল থেকে ফোন নম্বর বার করে যোগাযোগ করা মাত্র রেসকিউ স্কোয়াড পাঠালো। দরজা ভাঙার পর দেখা গেল হাত ও বুকের কিছুটা ক্ষতিগ্রস্থ, পুড়ে গিয়েছে হাতের এক দিকের দুটো আঙুল। চেতনা ও নেই। এবার শুরু হল জিবোকে সুস্থ করে তোলার পালা। মানুষ না, মানুষের মতো। তার কেবল শরীর। কেবল চামড়াহীন ব্যাটারি, সি.পি.ইউ.। হাই ডেফিনেশন ক্যামেরা ও ডেটা-বেস। ক্ষত সারানোর বন্দোবস্ত সম্পর্কে কিছুই বুঝিনা আমি। থেকে-থেকে আমার কেমন চোখের পাতা বুজে আসে। ঘুম পায়। জিবো সাতদিন খুব অসুস্থ হয়ে পড়ে থাকল। মাঝে মধ্যে গক্‌ গক্‌ একটা উদ্ভট আওয়াজ বেরোতো, চোখের দৃষ্টি খুলে হাঁ করে থাকতো। তারপর আবার ঘুমিয়ে পড়তো। সব চাঞ্চল্য, দৌরাত্ম্য, ল্যাপটপে সেঁটে থাকা সব গায়েব। আমি রোজ সারণী তৈরি করি, কাটি, আবার উল্টোপথে লিখি। না লিখলে, আমি মনে রাখতে পারি না। ওষুধের আশে লাল টিক মানে বাকি, ব্লু মানে হয়েছে। এই পদ্ধতিতে খাওয়াদাওয়া, বিশ্রাম, ঘুমোনো। ফোনের পাসওয়ার্ড, আজকের তারিখ সমস্ত লিখে রাখছি। কী খেলাম আজ দুপুরে, রান্নায় নুন দেব কিনা, এইভাবে তিনদিনের মাথায় মনে হল আমার মুখের একটা পাশ কেমন যেন সাদা চকচকে পুতুলের মতো দেখাচ্ছে। এত কষ্ট হল যে, না খেয়ে বিছানায় শুয়ে পড়েছি, হঠাৎ ভয়ানক স্বপ্ন দেখলাম। জিবো হারিয়ে ফেলেছে নিজেকে। ওকে কোথাও খুঁজে পাচ্ছি না। কোনো ঘরে নেই। সিঁড়িতে-দেরাজে-ফ্রিজের পাশে – ছাদের সিঁড়িতে কোত্থাও নেই। ভীষণ ভয়ে ঘুম ভেঙে উঠে বসেছি। দেখছি দূরের বাঙ্ক্‌ এ জিবো ঘুমোচ্ছে। আমি ঘর থেকে চটিতে পা গলিয়ে বারান্দায় বেরিয়ে এলাম। আকাশে চাঁদ নেই, কেবল তারা। তারারা যেন কমিটি বসিয়ে আমাকে সাজা দেবে বলে ফন্দি আঁটছে। কিন্তু সাজা কেন? কি করেছি আমি? হাতের আঙুলের ডগাগুলো সামান্য ভারি লাগছে। ঝিন্‌ঝিনে একটা অনুভূতি। ক্রমে অসাড়তার দিকে এগোচ্ছি নাকি আমি? জিভটাও কেমন জড়ানো, যেন অনেক ওজনদার কার্টিলেজ। পা খালি অথচ মনে হচ্ছে খুব ভারি একটা লোহার জুতো পরানো হয়েছে। মধ্যরাতের পাহারায় অনেক ভেবেও আমার নামটা মনে করতে পারলাম না আমি, কী যেন ডাকে লোকে, আমাকে? কী যেন ডাকে আমাকে রানু? রানুর মুখটাও হারিয়ে গিয়েছে ভেবে ফোনের ডি.পি. খুললাম। আর খোলার সঙ্গে সঙ্গেই এক মটকায় ঝড় উঠল। ওয়াটস্‌ এ্যাপ স্টেটাসে লেখা আছে — ‘আমার মা’।

আজ নভেম্বর। আমার জন্মদিন। জিবো খুব ভোরে তার পুড়ে যাওয়া বীভৎস হাতে একটা কাগজে হিজিবিজি লিখে ঘুম থেকে তুললো। দেখি একটা রুলটানা কাগজে নিজের মুখ, যেন বলতে চায় — ‘আই লাভ ইউ’। আমি একটু অবাকই হলাম। জন্মদিনে কোথায় ‘হ্যাপি বার্থডে’ বলবে, তা নয় কি এই। সেই বস্তাপচা তিনমূর্তি, ধুস্‌। ব্যাটার আক্কেল হবে কবে! গল্প লিখতে পারবে, কিন্তু জন্মদিনের শুভেচ্ছাবাণী ভুলে যায় — ওরও কি আমার ব্যাধিতে ধরলো নাকি। খেয়াল করিনি, আজ কেমন একটা দেখাচ্ছে ওকে। গুবরে পোকার ব্যাটারি মার্কা চোয়ালটা কেমন নরম মোলায়েম মতো। চোখটা ভারী। সবমিলিয়ে কোথায় একটা কারুণ্য চেপে বসেছে, একটা পর্দার ওপারে চাপ চাপ বিষন্নতা। কিন্তু সবটুকুর অর্থ জিবো জানে না, সবটুকুর তাৎপর্য তার মগজে ধরে না। প্রাণপণে খুশি করতে চেয়ে তাই যন্ত্রমানবটিও ভুল করে ফেলেছে — এই তার প্রথম ভুল, যা কি না প্রকাশ করে ফেলেছে সে অন্যরকম ভাষায়। কারণ এ হলো মানুষের তৈরি করা একটি বিশেষ ল্যাংগুয়েজ — একটা পূর্ণচ্ছেদ, যার আর কোনো পরবর্তী বাক্য হয় না। তাকিয়ে দেখলাম, জিবোর চোখে একটা জ্যোতি, ঠোঁটের ওপরের অংশ কাঁপছে, পায়চারি করে যাচ্ছে বারবার। কিন্তু কী যেন বলছে, শোনা যাচ্ছে না। যেন নিজের কাছে নিজে কিছু একটা বলছে, এমন ভাষাতে – যা মানুষের অগম্য। একটা থিরথিরানো ধাতব কিঙ্কিনি বেরিয়ে আসছে মাঝে মাঝে। আর খুব আনমনা। এটা অজানা নয় যে, মন বলে কোনো জালিম পদার্থ ওর ভেতর ঢুকিয়ে দেয় নি, কেউ ওকে শিখিয়ে দেয়নি কি করে মনখারাপ করতে হয় — কি উপায়ে ফ্রিজের ভেতরে গোপনে লুকিয়ে রাখতে হয় মনের যাতনাবুদ্ধি — সে চেতনাই নেই ওর। আজ হঠাৎ ভুল করে এক অদ্ভুত অনুভূতির কথা বলে ফেলেছে ভেবে আমি আর সময় নষ্ট করিনি। কিরকম ভয় করছে, কি যেন খুঁজছে, কেমন অস্থিরতা দেখা যাচ্ছে। লক্ষ করলাম তার রোজকার কাজগুলো ভুলে যাচ্ছে। ইচ্ছে করেই মনে করিয়ে দেইনি। দেখলাম একটা মগ্ন স্থবিরতা ওর মধ্যে। কম্পিউটারের সামনে ওয়র্ড্‌ ডকুমেন্ট খুলে কিছু টাইপ করার চেষ্টা করছে। কিন্তু সম্পূর্ণ পরিষ্কার লিখে উঠতে পারছে না। দিনের মধ্যে আমি বাড়িতে থাকলে, জিবো প্রতিনিয়ত আমার প্রয়োজনগুলো তামিল করে যায়, মাঝে মাঝে কম্পিউটার এর স্ক্রিনের সামনে কিছু লিখতে দেখেছি, এমনকি এত বোঝার ক্ষমতা ছিল যে, অনেকবার কিছু গুরুত্বপূর্ণ গবেষণার সূত্র বা বক্তব্যও ই-মেল করেছে আমাকে। আমাকে বলেও নি যে এসব ও সংগ্রহ করে পাঠিয়েছে। মেলের বয়ান বক্তব্য সিস্টেম অধ্যুষিত একটা শিক্ষাকে বুঝিয়ে দেয়। কিন্তু তার বাইরে নিজের ভেতরে কোনো আলোড়ন ওঠে না। সীমান্তরেখার শেষ ধাপে যেখানে পৃথিবীর চরমতম বরফের পাথর হয়ে থাকা ইতিহাস, সেইখানে কি উপায়ে হাত পা রেখেছে সে। এরকম ভাবার সঙ্গে সঙ্গেই দেখলাম উঠে গেল। মিক্সি ঘোরানোর শব্দ এবং ফলের রস করে হাজির করলো টেবিলে। ঠিক সেই মুহূর্তে সুদূর ডীন শের্ট রোডের আলোকিত সড়ক ঘুরে ফোন আসতে লাগল রানুর। ভয়েস কল্‌ ভিডিও কল্‌ পর-পর আসতে লাগল। তুলবো না ভেবেও ধরলাম।

বল্লরী সেন। গবেষক, কবি। প্রকাশিত বই বাংলায় ৫ টি ইংরেজি ২ টি। 'বিহান রাতের বন্দিশ' কাব্যগ্রন্থের জন্য ২০১০ এ কৃত্তিবাস পুরস্কার পেয়েছেন। ২০১২ থেকে অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে বাংলা ভাষার নানা গবেষণায় যুক্ত। 'নারী বীক্ষায় পুরুষের কবিতা' তাঁর সাম্প্রতিক গবেষণা গ্রন্থ।

এই বিভাগের অন্যান্য লেখাসমূহ

বালির বেহালা

বালির বেহালা

বুড়িমাসি বলেন,জীবনটা বালির ঘর গো।ঢেউ এলে ধুয়ে যায় জীবনের মায়া।তবু বড় ভালবাসা ওদের দাম্পত্যে।রোদের চাদরের…..

তদন্ত

তদন্ত

  এক ড্রইং রুমে বসে রয়েছে সদ্য কিশোর উত্তীর্ণ তরুণ গোয়েন্দা সজীব। সামনের টেবিলে ছড়িয়ে…..