জমিলার মেয়েরা

শেলী সেনগুপ্তা
গল্প
Bengali
জমিলার মেয়েরা

জমিলা স্তব্ধ হয়ে বসে আছে। সামনে অনেকগুলো নোট ছড়ানো। বস্তির অন্যরা লোভী চোখে টাকাগুলোর দিকে তাকিয়ে আছে। জমিলা একবার টাকার দিকে দেখছে আরেকবার চারপাশে ঘিরে থাকা মানুষগুলোকে দেখছে। আঁচল দিয়ে মাথা ঢেকে প্রার্থনার মতো বসে আছে বস্তির মহিলারা। পুরুষগুলো ঘেমে নেয়ে গেছে কিন্তু য ন গা চুলকাতেও ভুলে গেছে। ছেঁড়া লুঙ্গী চুইয়ে ঘাম পড়ছে।

নদী ভাঙ্গনে জমিজমা হারিয়ে জমিলা মাস ছয়েক আগে ঢাকা এসেছে। সাথে ছিলো ওর স্বামী তমিজউদ্দিন। তিন মেয়েকে সাথে নিয়ে ওরা দু’দিন কমলাপুর রেল স্টেশনে ছিলো। তারপর এক দালালের সাহায্য নিয়ে বস্তির এই ঘরটা ভাড়া নিয়ে চলে এসেছে। মাথাগোঁজার ঠাঁই তো হলো, এখন দরকার পেটের সমস্যা সমাধান করা। হাতে করে যে টাকা নিয়ে এসেছিলো তা প্রায় তলানীতে পৌঁছে গেছে। তমিজউদ্দিন কাজের খোঁজে অনেক জায়গাতে দিয়েছে। কোথায় পেলো না। পরে বস্তির এক ঠ্যালাগাড়িওয়ালা জব্বার ওকে সহকারী হিসেবে নিলো। তাতে দিন শেষে যা আসে তাতে ঘরভাড়া দিয়ে একবেলার খাবারের যোগান দেয়াও কঠিন হয়ে গেলো।

জমিলা দেখে বস্তির মহিলারা সকালে উঠে যেন কোথায় যায়। বিকেলে ফিরে আসে, সাথে থাকে প্লাস্টিকের বাক্সভরা খাবার। মা ফিরে এলেই ছেলেমেয়েরা সে বক্সের উপর হামলে পড়ে। কাড়াকাড়ি খায়। বেশ কিছুদিন দেখে বুঝলো ওরা বাসাবাড়িতে ছুটা কাজ করে। সারাদিন বিভিন্ন বাসায় কাজ করে যা খাবার দাবার পায়, তা নিয়ে আসে। তাতে বেশ ভালোওই চলে ওদের।

জমিলা অনেক ভেবে তমিজউদ্দিনের সাথে পরামর্শ করলো। তারপর ওদের একজনকে গিয়ে ধরলো একটা কাজের জন্য।

: বু, আমারে কাম ঠিক কইরা দেও, কাম না করইলে যে মাইয়াগুলান লইয়া না খাইয়া মরমু।
পাশের বাসার মিজানের মা বললো,

: বু, তোর তো কোলে মাইয়া, হ্যারে লইয়া কেমনে কাম করবি?

: আমার বিন্তি খুব শান্ত মাইয়া, যেহানে বোয়াইয়া রাখমু হেইহানেই বইয়া থাকবো। আমি কাম করমু। বু, ঠিক কইরা দেও।

: আইচ্ছা, দেহি, সাততালার বেগমসাব ছুডা কামের বেডির কতা কইছিলো। কইয়া দেহি, বাইচ্চা লইয়া কামে রাইখবো নি।

কয়েকদিন পর মিজানের মা ওকে একবাসায় নিয়ে গেলো। লিফট না কি যেন একটা করে উঠতে হয়। কি সুন্দর ঝকঝকে তকতকে ঘর। ওখানে জমিলার চাকরি হয়ে গেলো। সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত থাকতে হবে। সবকাজ করতে হবে। সেখানেই খাওয়াদাওয়া, আসার সময় রাতের ভাত নিয়ে চলে আসবে। বেতন তিন হাজার টাকা। এতোটাকা একসাথে কখনো আয় করে নি জমিলা, একবাক্যে রাজি।

কিন্তু বেগমসাহেব বিন্তিকে আনতে নিষেধ করলো। তখন জমিলা কেঁদে ফেললো। মেয়েটা মা’কে না দেখে থাকতে পারে না। অনেক বলে কয়ে মেয়েকে সাথে আনার অনুমতি পাওয়া গেলো কিন্তু শর্ত একটায় সারাদিন রান্নাঘরের পাশের বারান্দায় বসে থাকতে হবে। সেখান থেকে আর কোথাও যেতে পারবেনা। জমিলা সে শর্তে রাজি হলো। ওর কাছে কাজটায় জরুরি, যেভাবেই হোক। পরদিন থেকে কাজে যাওয়া শুরু করলো। প্রথম কয়েকদিন মিজানের মা শিখিয়ে দিলো কিভাবে রাস্তা পার হতে হবে, কিভাবে লিফটে উঠবে। ধীরে ধীরে জমিলা সব বুঝে গেলো। খুব মন দিয়ে কাজ করে। মা যতক্ষণ কাজ করে বিন্তি বারান্দায় বসে থাকে, বস্তি থেকে কয়েকটা পাথর কুড়িয়ে নিয়ে আসে। আপন মনে বুবুদের মতো চাক্কু বাটা খেলার চেষ্টা করে। ছোট ছোট হাতের মধ্যে পাথরগুলো ধরে না। কয়েকবার চেষ্টা করে রেখে দেয়। তারপর রেলিঙে দাঁড়িয়ে গাড়ি দেখে। কাজের ফাঁকে ফাঁকে মা’র সাথে বসে রুটি তরকারি খায়। টেবিলে কত খাবার, কত রকমের মিষ্টি থাকে, ওর খুব ইচ্ছে করে মিষ্টি খেতে, কেউ দেয় না। মা বলেছে, না দিলে কিছু চেয়ে খেতে হয় না। বেগমসাহেব গ্লাস ভরে দুধ নিয়ে ছেলের পেছনে পেছনে ঘুরে। ছেলে শুধু দৌড়ে পালাই। একদম খেতে চায় না। আর দুধ দেখলে বিন্তির জিভে জল চলে আসে। খুব ইচ্ছে করে একচুমুক দিয়ে কিছুটা খেয়ে নিতে। কিন্তু ওকে তো কেউ খেতে দেয় না।
বিন্তি এসব ভাবতে ভাবতে আবার গাড়ি দেখায় মন দেয়।

আজ অনেক বাজার এসেছে। তিন রকমের শাক, ছোটমাছ আর হাঁস। শাক বেছে রাখতে হবে। ছোটমাছ কুটেবেছে বক্স করে ফ্রিজে রেখে সময় নিয়ে হাঁস বাছতে হবে। বেগমসাহেবের ছোটভাইএসেছে। ভাইএর জন্য হাঁস আর চালের রুটি করতে হবে। বেগমসাহেব বারবার বুঝিয়ে দিয়েছে কিভাবে রান্না করতে হবে। ভুল হলে খুব রাগ করবে।

হাঁস বাছতে বাছতে জমিলা একবার বিন্তিকে দেখে নিলো। মেয়েটা মেঝেতে ঘুমিয়ে পড়েছে। আহারে, সেই সকালে একটা রুটি খেয়েছে আলুভাজা দিয়ে, আরকিছু খাওয়া হয়নি।এরমধ্যে দু’বার রান্নাঘরের দরজায় এসে মাকে দেখে গেছে। বোধহয় ক্ষিদে পেয়েছে। ব্যস্ত দেখে মুখ ফুটে কিছু বললো না।

বিন্তি শুয়ে আছে লালজামা পরে। গতবছর ঈদে তমিজউদ্দিন জামাটা কিনে দিয়েছে। তিনমেয়ের মধ্যে বিন্তি একটু ফর্সা।যা পরে খুব সুন্দর লাগে। বিন্তি হুওয়ার পর শাশুড়ি খুব রাগ করেছিলো। বেশ রেগেমেগে বলেছে,

: আলো তম্যা, ফালাইয়া দে, তর বউএর পেডে শত্তুর আইছে, তিনডারে বিয়া দিইয়া ফহির অওন লাগবো।

কিন্তু তমিজউদ্দিন একটুও মন খারাপ করেনি। পরম আদরে বুকে টেনে নিয়েছে। মা’কে সান্ত্বনা দিয়ে বলেছে,

: চিন্তা করিস না মা, আল্লার মাল আল্লায় দেখবো, আমরা কিছু না। তুই হ্যাগোরে দোয়া কর।

তমিজউদ্দিনের মা মুখে পান নিয়ে গজ গজ করতে পাড়া বেড়াতে চলে যায়।

ফকির ওরা হয়েছে, তবে মেয়ে বিয়ে দিয়ে নয়, নদীভাঙ্গনের কারণে। ধানীজমি তো আগেই গেছে। যখন ভিটাটাও গেলো তখন সরকারি একটা ঝুপড়ি বানিয়ে মা’কে রেখে ওরা ঢাকায় চলে এসেছে। ভেবেছে শহরে কাজ করে টাকা জমিয়ে আবার গ্রামে ফিরে যাবে। কিন্তু শুরু থেকেই সব এলোমেলো হয়ে যাচ্ছে। জমিলা কাজে আসার সময় মেয়েদের পই পই করে বলে আসে ঘরের বাইরে না যেতে। সে যতক্ষণ কাজে থাকে মনটা আইটাই করে মেয়েদের জন্য। বস্তির লোকগুলো কেমন যেন। সারাক্ষণ মেয়েদের দিকে কেমন করে যেন চেয়ে থাকে। যখন তখন দরজার কাছে চলে আসে, বিড়ি টানতে টানতে দু’এক কলি গানও গেয়ে ওঠে। মাঝে মাঝে রাতের বেলা দরজায় টোকা দেয়। সব মিলিয়ে জমিলা খুব চিন্তার মধ্যে থাকে। তমিজউদ্দিনকে কিছু বলে লাভ হয় না। আর বললেই বা সে কি করবে। ঠান্ডা মেজাজের মানুষটা ঢাকা শহরে এসে কেমন যেন হয়ে যাচ্ছে। কথায় কথায় রাগ করে, মেয়েদের বকাবকি করে।

বস্তিতে মাত্র দু’টো পায়খানা। সকাল থেকে লাইন ধরে সবাই যায়। গোসল করে কলপাড়ে, একপাশে নীল পলিথিনের পর্দা দেয়া, তাতে না দেখার চেয়ে দেখার সুযোগই বেশি।বড় মেয়ে বীণা আর মেঝো বকুল কলপাড় খালি পেলে কয়েকদিন পর পর গোসল করে। তাও বস্তির ঘর থেকে অনেক বয়স্ক পুরুষও ওদের দিকে হাঁ করে চেয়ে থাকে আর হাত চলে যায় লুঙ্গির ভাঁজে।

একদিন বকুল কল থেকে পানি আনতে গেলে পাশের বস্তির এক ট্রাক ড্রাইভার ওর হাতে জোর করে বিশ টাকা গুঁজে দিয়ে বিকালে দেখা করতে বললো। বাসায় এসে বীণার কাছে বলতেই বকুলের গালে কষে চড় মেরে দিলো। পনের বছরের বীণা যা বুঝেছে বারো বছরের বকুল তা বুঝে নি। বড়বোনের চড় খেয়ে সারাদুপুর কাঁদলো।

সন্ধ্যায় জমিলা যখন বস্তিতে ফিরে এলো তখন সব শুনে মাথায় হাত দিয়ে বসে পড়লো। রাতে তমিজউদ্দিন ফিরে এলে দু’জনে অনেক শলাপরামর্শ করলো। পরদিন সকালে দু’মেয়েকে নিয়ে তমিজউদ্দিন গ্রামে চলে গেলো। কিছু টাকা দিলো আর লাউডগার মতো বেড়ে ওঠা মেয়ে দুটোকে মায়ের জিম্মায় রেখে এলো। তমিজউদ্দিনের মা মেয়েদের পছন্দ করে না, কিন্তু রাখতে আপত্তি করলো না,হয়তো ভেবেছে মেয়েরা থাকলে কখনো সখনো ছেলের মুখ দেখতে পাবে। অথবা বড় হয়ে ওঠা মেয়েগুলোর ছত্রছায়াটা খুব দরকার ছিলো।

তমিজউদ্দিন সেই সকালে পান্তাভাত খেয়ে ঠ্যালা নিয়ে বের হয়ে গেলে বস্তির ঘরে তালা দিয়ে জমিলাও কাজে যায়। মায়ের আঁচল ধরে বিন্তি পেছন পেছন হাঁটে। আজকাল বিন্তি খুব খুশি থাকে, বেগমসাহেবের ভাই মাঝে মাঝে বিন্তিকে কাছে ডেকে এটাসেটা জিজ্ঞেস করে। টেবিলের খাবার থেকে এটা সেটা হাতে দেয়।সেটা শুধু করে বেগমসাহেব বাসায় না থাকলে। তখন বিন্তিও সারা ফ্ল্যাটে ঘুরে বেড়ায়, বেগমসাহেবের ভাইএর সাথে বসে টিভি দেখে। মাঝে মাঝে বিন্তির হাসির শব্দ ভেসে আসে। মেয়ের আনন্দ দেখে জমিলার ভালো লাগে।

আজ বাসায় অনেক মেহমান আসবে। বেগমসাহেব ড্রাইভারকে দিয়ে বাজার পাঠিয়ে দিয়েছে। দরজায় কলিং বেল বাজতেই মাথায় কাপড় দিয়ে জমিলা দরজা খুলে দিলো। হাত বাড়িয়ে বাজার নিচ্ছিলো। বিন্তিও এগিয়ে এলো।মায়ের সাথে হাতে হাত মিলিয়ে কয়েকটা ব্যাগ রান্নাঘরে নিয়ে গেলো। ড্রাইভার এক গ্লাস পানি চাইলো। জমিলা বিন্তিকে দিয়ে পাঠিয়ে দিয়ে বাজার গুছাতে শুরু করলো।

বেগমসাহেবের ভাই নিজের রুমে বসে টেলিভিশন দেখছে। বেশ শব্দ করেই টিভি চালিয়েছে। জমিলা বাজার গুছাতে গুছাতে একবার দরজার দিকে তাকালো। প্রতিদিন এ সময় ভাইয়া চা চায়, আজতো চাইলো না। জমিলা কাজের চাপে নিজে থেকে চা বানিয়ে দিয়েও আসে নি। চা দেয়া দরকার ছিলো।

বেলা হয়ে গেছে,এখন ভাত খাওয়ার সময়, চা খাবে কিনা কে জানে। একবার ভাবলো জিজ্ঞেস করবে। হাতের কাজ কিছুটা কমিয়ে ভাইয়ার দরজাতে নক করলো। এতো জোর শব্দে টিভি চলছে যে শব্দ শোনা যাচ্ছে না। অনেকক্ষণ পর দরজা খুললো।

: ভাইয়া, চা খাইবেন নি?

একটু রেগেই জবাব দিলো,

: আমি কি চা চেয়েছি, যাও, বিরক্ত কোরো না।

জমিলা রান্নাঘরে চলে এলো। দুপুরের খাবার টেবিলে সাজিয়ে দিলো। মেয়েটাকে অনেকক্ষণ দেখছে না। কি জানি কোথায় কি দুষ্টামী করছে। কয়েকবার ডেকেও সারা পেলো না। কিছুক্ষণের মধ্যে বেগমসাহেব আসবেন। এসেই রান্না শুরু করবেন। এখনো মসলা বাটা হয়নি। আগের দিন কাবাবের মাংস সেদ্ধ করা আছে। তাও বাটতে হবে। সব গুছিয়ে নিয়ে জমিলা বাটতে বসে গেলো। মেয়েটা যে কোথায়, কপালে চিন্তার রেখা জেগেছে, কিন্তু কাজের চাপে তা বিস্তৃত হতে পারছে না। দ্রুত হাতে বাটনা বাটছে। ঝুঁকে ঝুঁকে দ্রুত গতিতে বেটে বেটে মসলার বাটি ভর্তি করছে। তখনই দরজায় বেলের শব্দ। হাতের উলটো পিট দিয়ে ঘোমটা টানতে টানতে দরজা খুলে দেখে বেগমসাহেব দাঁড়িয়ে আছে। হাতে ফলের ঝুড়ি। জমিলা হাত বাড়িয়ে ঝুড়িটা নিয়ে ডাইনিং টেবিলে রেখে আবার বাটনা বাটায় মনোযোগ দিলো।

কিছুক্ষণের মধ্যে বেগমসাহেব রান্নাঘরে এসে রান্নায় মনোযোগ দিলো। খাসির রেজালা , মুরগির রোস্ট শেষ। পোলাউ রাতে রান্না হবে। আর কিছু খাবার সাহেব ফেরার সময় বাইরে থেকে নিয়ে আসবেন। শোকেস থেকে কাঁচের প্লেটগ্লাস বের করে ধুয়ে রাখছে। জমিলা দ্রুত হাতে সালাদ কাটছে। রোস্টের গন্ধটা খুব চমৎকার, জিভে পানি এসে যাচ্ছে। মনোযোগ কেটে যাচ্ছে, ভাবছে ‘ খালাম্মা যদি দু’এক পিস দেয় বাসায় নিয়ে যাবে। বিন্তির বাবাকে সাথে নিয়ে খাবে। কতদিন মাংস খাওয়া হয় না। এমন মজার রোস্ট পেলে বিন্তির বাবা খুব খুশি হবে’। কাজ করতে করতে আবার বিন্তির কথা মনে হলো। কি জানি মেয়েটা কোথায় কি করছে। ঘরের জিনিস নষ্ট করলে খালাম্মা খুব রাগ করবে। আশেপাশে দেখ যাচ্ছে না ওকে।
খালাম্মার ভাই বাসার বাইরে যাচ্ছে। যাওয়ার সময় ডেকে বলে গেলো,

: বুয়া দরজা বন্ধ করো।

পেছন থেকে খালাম্মা বললো,

: এখন কোথায় যাচ্ছিস? খাওয়ার সময় হলো তো।

: একটা কাজ আছে, আসছি।

: তাড়াতাড়ি ফিরিস,টেবিলে খাবার দিচ্ছি।

জমিলা দরজাটা বন্ধ করে রান্নাঘরে আসার সময় এদিক ওদিক দেখছে। বেগমসাহেব বলে,

: কি দেখছো?

: বিন্তিরে বিছরাই, হেরে হেই সময়তে দেহি না।

: আছে কোথাও, হয়তো ঘুমিয়ে পড়েছে। পরে ডেকে নিও। এখন কাজ শেষ করো।

জমিলা আবার দ্রুত হাতে পেঁয়াজ কাটছে। চুলায় এখন ভাপা ইলিশ হচ্ছে। আঁচ কমিয়ে দিয়ে বেগম সাহেব বোরহানি বানাচ্ছে। ওকে তাড়া দিচ্ছে পুদিনাপাতা ধুয়ে দেয়ার জন্য। বোরহানি বানানো শেষ।

বেগম সাহেব এখন বেডরুমে। জমিলা রান্নাঘর গুছাচ্ছে। বেগম সাহেব খাবার দিয়ে দিয়েছে। এখন সে বস্তিতে যাবে। সন্ধ্যায় বাসায় মেহমান আসবে, তখন আবার আসতে হবে। বিন্তিকে ওর বাবার কাছে রেখে আসবে, নাহলে মেহমানের সামনে না জানি কি করে সে।

খাবার গুছিয়ে বস্তিতে ফেরার সময় বিন্তিকে খুঁজে পেলো না। ফ্ল্যাটের কোথাও নেই। জমিলার কাঁদোকাঁদো অবস্থা। বেগমসাহেব বললো,

: দেখো সে একাই বস্তিতে চলে গেছে কিনা।

জমিলা ভাবতেই পারছে না বিন্তি একা যেতে পারে। তাও অস্থির পায়ে বস্তির দিকে ছুটে গেলো। সেখানেও বিন্তি নেই। বস্তির সব বাসায় খোঁজা হলো। ছোট ছোট বাচ্চাদের জিজ্ঞেস করা হলো। কেউ বলতে পারে না সে কোথায়। ওরা দেখেই নি। জমিলা হাতপা ছড়িয়ে মেঝেতে বসে আছে। চোখ থেকে পানি গড়িয়ে পড়ছে অঝোরে। বস্তির মহিলা ওকে ঘিরে আছে।

আজ ঠেলাগাড়ি নিয়ে তমিজউদ্দিনও তাড়াতাড়ি ফিরে এসেছে। বিন্তি খেতে ভালোবাসে তাই ওর একজন এক ঠোঙ্গা কদমা এনেছে। কদমার ঠোঙ্গাটা মেঝেতে পরে আছে।

বস্তির সবাই যার যার ঘরে ফিরে গেলো।রাত হয়ে এলো, বিন্তির কোন খবর নেই। বস্তির কেউ কেউ ওদের পরামর্শ দিলো পুলিশের কাছে যেতে। কিন্তু কেউ সাথে যেতে চাইলো না। তমিজউদ্দিন আর জমিলা বুঝতে পারছে না কি করবে। স্তব্ধ হয়ে বসে আছে। একসময় তমিজউদ্দিন জমিলা আনা খাবার থেকে কিছুটা খেলো। জমিলাকে সাধলো। ওর খেতে ইচ্ছে করছে না। খাবার কথা ভাবতেই গলা দিয়ে তেতোপানি উঠে এলো। খাবার থেকে চোখ ফিরিয়ে মুখে আঁচলচাপা দিয়ে গুনগুন করে কান্না শুরু করলো।

কাঁদতে কাঁদতে জমিলা ঝিমিয়ে গেলো। খুঁটিতে হেলান দিয়ে চোখ বন্ধ করে বসে আছে। সুবেহ সাদেকের সময়, গলির মোড়ের মসজিদ থেকে আজানের শব্দ ভেসে আসতেই ধরফর করে উঠে দাঁড়ালো। তমিজউদ্দিনকে বললো,

: বিন্তির বাপ, বিন্তি ডাকতাছে আমারে, আমি যাইতাছি।

: কই যাস বউ, আমি তো হুনি নাই, তুই হুনলি কোনথে?

: হ, আমারে ডাকছে, আমি যাইতাছি।

তমিজউদ্দিন উঠে দাঁড়ানোর আগেই জমিলা বের হয়ে গেলো, ওর পেছনে যেতে যেতে ডাকছে।কে শোনে কার কথা, এলোমেলো পা ফেলে জমিলা মাঝ রাস্তা দিয়ে হেঁটে যাচ্ছে। তমিজউদ্দিন দৌড়ে গিয়ে ওকে ধরলো। তারপর বুকের মধ্যে জড়িয়ে ধরে ঘরে নিয়ে এলো। একগ্লাস পানি খাইয়ে মেঝেতে বসিয়ে দিলো। জমিলা হাঁটুর মধ্যে মাথা রেখে বসে আছে। কতক্ষণ জানে না।

জমিলা মেঝে তে শুয়ে আছে। মাঝে মাঝে বিন্তিকে ডেকে ডেকে কেঁদে উঠছে। তমিজউদ্দিন বাইরে গেছে। এমন সময় বস্তির বাইরে বেশ লোকজনের কথা শোনা যাচ্ছে। কথা বলতে বলতে বেশ কিছু মানুষ জমিলার বাসার দিকে এগোচ্ছে। মানুষগুলো একেবারে দরজার সামনে এসে থেমে গেলো , ওদের পেছনে বস্তির নারী-পুরুষ একটা দল। সবার আগে বেগমসাহেব ঘরের মধ্যে ঢুকলো, পেছনে অনেক পুলিশ। ঢুকেই জমিলার মাথাটা বুকের মধ্যে নিয়ে টেনে নিয়ে একটু কাঁদলো। কতকী বললো। কিছু কথা জমিলার কানে গেছে আর কিছু যায় নি। যে টুকু বুঝলো তা হলো বেগমসাহেবের ফ্ল্যাটের পেছনে কংক্রিটের ওপর বিন্তিকে পাওয়া গেছে। ওপর থেকে পড়ে গেছে তাই মাথাটা থেতলে গেছে। ওখানে সে কিভাবে গেলো, কেউ বলতে পারে না। বিন্তি মারা গেছে, এখনতো আর কিছু করার নেই। সাহেব-বেগমসাহেবের মন অনেক বড় , তারা জমিলাকে খুব ভালোবাসে, তাই দয়া করে কিছু টাকা দিতে এসেছে। জমিলার সামনে একতাড়া নোট রেখে দিলো। পরামর্শ দিলো গ্রামে ফিরে যেতে, চাষবাস করে জীবনযাপন করতে। দরকার হলে আরো টাকা দেবে।

সাহেব-বেগমসাহেব চলে গেলো, সাথে পুলিশরাও। তখন জমিলা মেঝেতে বসে আছে, টাকাগুলো সামনে ছড়ানো। বস্তির কয়েকজন মহিলা বেড়ার গায়ে হেলান দিয়ে দ এর মতো বসে আছে। ওদের চকচকে চোখ টাকার দিকে। একটা মাছি ভন ভন করে উড়ছে। ঊড়ে উড়ে টাকার উপর বসছে আবার উড়ে যাচ্ছে। মাছি ভন ভন শব্দে জমিলা মাথার মধ্যে আগুন ধরে গেলো। হঠাত ওর কি হলো, এক ঝাপটা দিয়ে মাছিটাকে মেরে ফেললো। তারপর মরা মাছিটাকে হাতের তালুতে নিয়ে চিৎকার করে কেঁদে উঠলো। চোখের জল গড়িয়ে পড়ছে মরা মাছিটা গায়ে। সামনে বসে থাকা মহিলাও কেঁদে উঠলো যার যার গোপন দুঃখের কথা মনে করে। টাকাগুলো জমিলার পায়ের কাছে লুটোপুটি খাচ্ছে পোষা বেড়ালের মতো।

শেলী সেনগুপ্তা। কবি, গল্পকার ও শিশু সাহিত্যিক। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বাঙলা ভাষা ও সাহিত্যে স্নাতকোত্তর ডিগ্রির পর পেশাগত জীবনে কলেজে অধ্যাপনা করেছেন। বর্তমানে অবসর গ্রহণ করে লেখালিখি ও সংসার দেখাশুনা করে সময় কাটান। শেলী সেনগুপ্তা তার ভাবনায় ও রচনায় কাব্য...

এই বিভাগের অন্যান্য লেখাসমূহ

বালির বেহালা

বালির বেহালা

বুড়িমাসি বলেন,জীবনটা বালির ঘর গো।ঢেউ এলে ধুয়ে যায় জীবনের মায়া।তবু বড় ভালবাসা ওদের দাম্পত্যে।রোদের চাদরের…..

তদন্ত

তদন্ত

  এক ড্রইং রুমে বসে রয়েছে সদ্য কিশোর উত্তীর্ণ তরুণ গোয়েন্দা সজীব। সামনের টেবিলে ছড়িয়ে…..