জলে জঙ্গলে (পর্ব-৩)

মাসুদ আনোয়ার
উপন্যাস, ধারাবাহিক
Bengali
জলে জঙ্গলে (পর্ব-৩)

{ আগের পর্ব পড়ুন এখানে ]

তিন

একে একে মুসল্লিরা বেরিয়ে আসছে মসজিদ থেকে। আমি দাঁড়িয়েআছি স্থানুর মতো। প্রত্যেক মুসল্লির মুখের দিকে তীক্ষ্ম নজরবুলাচ্ছি। কাপ্তাই বড় মসজিদের ইমাম গোলাম মাওলার চেহারাস্মরণ করছি। ঘোর কালো রঙের লোকটা, মাথায় সাদা রঙেরপাগড়ি প্যাঁচানো। গাল ভরা দাঁড়িতে, জোড়া ভুরু। কম আলোরবৈদ্যুতিক বাতি জ্বলছে মসজিদের বাইরে। আবছা আঁধারেলোকগুলোকে ঠিক মতো ঠাহর করা যাচ্ছে না। যেখানে দাঁড়িয়ে আছি, সেখান থেকে প্রত্যেকটা লোককেই একরকম দেখা যায়।

লোকগুলোও এক নজর তাকাচ্ছে আমার দিকে। পরক্ষণেই আগ্রহহারিয়ে চোখ ফিরিয়ে নিচ্ছে। কেউই একবার কাছে এসে জানতেচাইছে না, আমি কে, এখানে কী চাইছি।

হতাশ হচ্ছি না। জানি, গোলাম মাওলা মসজিদের ইমাম, একেবারে সবার শেষেই বেরোবেন। ইমাম যখন, পরহেজগারমানুষ। দু’রাকাত নামাজ তো বেশিই পড়বেন।

বেরোতে থাকা মুসল্লির সংখ্যা কমে এসেছে। এখন কিছুক্ষণপরপর একজন দু’জন করে বেরোচ্ছে। গোলাম মাওলা এখনোবেরোচ্ছেন না। একটু একটু উদ্বিগ্ন হয়ে উঠতে শুরু করেছি।শীতের সন্ধে। ভেতরে একটা মোটামুটি গরম গেঞ্জি আর তারওপরে শার্ট। উত্তুরে বাতাস বইছে। জেঁকে বসতে শুরু করেছেপাহাড়ী শীত। চোখের সামনে ভেসে উঠছে একটা ঘর, খাট আরগরম লেপ বা কম্বল। সেটা জানি পাওয়া যাবে। তবে তার আগেপেতে হবে গোলাম মাওলাকে। কিন্তু তাঁকে যদি না পাই, তাহলে…ভাবতেই পারছি না।

উদ্বেগটা আস্তে আস্তে ভয়ের দিকে মোড় নিচ্ছে। গোলাম মাওলারসাথে দেখা হয়েছিল বছর তিনেক আগে। তখন শুনেছিলাম, উনিবড় মসজিদের ইমাম। এর মধ্যে আর দেখা সাক্ষাৎ হয়নি, কোনোখোঁজখবরও নেইনি। আচ্ছা, এমন যদি হয়, উনি আর বড়মসজিদের ইমাম নন, অন্য কোনো মসজিদে চলে গেছেন, তাহলেকী হবে? ভাবতেই পারছি না।

চারদিকে তাকালাম ভীত চোখে। রাস্তায় লাইটপোস্টের ঘোলাটেআলো। সে আলোতে মনে হচ্ছে, এই সন্ধ্যারাতেই ঘুমিয়ে পড়েছেএলাকাটা। ছোট ছোট বাড়ি-ঘরের মতো, বুঝতে পারছি না এসবআসলে কী? নিশ্চয় মানুষের ঘর-বাড়ি। কারা থাকে এখানে? টিমটিম করে জ্বলছে বিজলী বাতি। ভয় পাচ্ছি, তবে ভালোও লাগছে।জীবনে এই দ্বিতীয়বারের মতো বৈদ্যুতিক বাতি দেখা।

মসজিদ থেকে এখন মুসল্লি বেরোচ্ছে না আর। সম্ভবত আর কেউনেই। হতাশা আর দুশ্চিন্তায় ভেঙে পড়তে যাচ্ছি, ঠিক এসময়আরেকজন বেরোল। বিড় বিড় করে সুরেলা গলায় কিছু বলছে।দোয়া-দরুদ পড়ছে মনে হয়। লোকটা কাছে এলে ইমাম সাহেবেরকথা জিজ্ঞেস করব ভাবছি। কিন্তু গলা শুকিয়ে আসছে। মুখ দিয়েকথা বেরোবে কিনা কে জানে? তোতলা তো। দুশ্চিন্তা, ক্রোধ, নার্ভাসনেস–এসব ক্ষেত্রে মুখ দিয়ে কথা বেরোতে চায় না। এইমুহূর্তে আমি নার্ভাসনেসে ভুগছি।

মনে মনে ‘ভ্-ভ্-ভ্’ মানে ভাইয়া বলার চেষ্টা করছি, এসময়লোকটা সামনে এসে দাঁড়াল। একনজর তাকিয়ে আমার মুখটাদেখে নিয়ে বলল, ‘ছোটভাই, আপনি কাকে চান?’

আচমকা সব সঙ্কোচ কেটে গেল। মুখ খুলে গেল অনায়াসে।সালাম দিয়ে বললাম, ‘ভাই, আমি ইমাম সাহেবের কাছে এসেছি।উনি আমার আত্মীয়, মামাতো বোনের জামাই।’

হাসি অনেক দেখেছি, কিন্তু কাপ্তাইয়ের ভেতর বাজারে মসজিদেরসামনে রাস্তার ঘোলাটে আলোর মধ্যে দাঁড়ানো লোকটার ওইহাসির মতো অমন আন্তরিক ও উৎফুল্ল হাসি খুব বেশি দেখেছিবলে মনে করতে পারি না। বিজলী বাতির মতো উজ্জ্বল হাসিরছটা ছড়িয়ে লোকটা যে দিক থেকে এসেছে, সেদিকে রওনা হলো।আমি বুকের ভেতর পাখির পালকের মতো হালকা বোধ করতেশুরু করলাম। দুশ্চিন্তা কেটে গিয়ে…..হঠাৎ একটা কথা মনেপড়তেই ডাকলাম, ‘ভাইয়া…’

লোকটা জায়গায় দাঁড়িয়ে গিয়ে আমার দিকে ফিরল। তখনো মুখেসে হাসিটা লেগে আছে। ‘বলেন, ছোটভাই।’

‘আচ্ছা, ইমাম সাহেবের বাড়ি কি সন্দ্বীপ?’ আমি একটু নিশ্চিতহতে চাইলাম।

‘না তো!’ হাসি ম্লান হয়ে গেল লোকটার। ধীরে ধীরে হেঁটে এলআমার কাছে। ‘ওনার বাড়ি তো মরিয়ম নগর। আপনি কোনমসজিদের ইমাম সাহেবের কথা বলছেন?’

‘জী, কাপ্তাই বড় মসজিদের ইমাম।’

‘কাপ্তাই বড় মসজিদের ইমাম! আচ্ছা, ওনার নাম বলেন তো?’

‘গোলাম মাওলা। বাড়ি সন্দ্বীপ…’ আবার হতাশায় মিইয়ে এলগলা। ‘আমি শুনেছি, উনি কাপ্তাই বড় মসজিদে…’

‘দাঁড়ান দাঁড়ান। কী নাম বললেন? গোলাম মাওলা? কালো করেলোকটা? বেশি কালো?’

মিলে যাচ্ছে! আবার পরাণে পানি আসতে শুরু করল আমার।‘হ্যাঁ, হ্যাঁ, বেশি কালো….উনি আমার…..’

আবার সে আগের অনাবিল হাসির আভাস দেখা গেল লোকটারমুখে। ‘আরে ওটা বলবেন না? চিনি ওনাকে। উনি আমারসাথীভাই। আমরা এক পীরসাহেব হুজুরের মুরিদ। কিন্তু উনি তোবড় মসজিদের না, সুইডিস্ট মসজিদের ইমাম।’

‘সুইডিস্ট মসজিদ! ওটা কোথায়?’

‘বাইরে। মানে রিসিপশন গেটের বাইরে।’

‘আমি চিনি না।’

আতঙ্কে হাত-পা কুঁকড়ে আসতে চাইছে। এই প্রবল শীতের রাতেএই বিশাল কাপ্তাই শহরে আমি কোথায় খুঁজে পাব সুইডিস্টমসজিদ!

‘এখান থেকে টেক্সিতে যাওয়া যাবে।’ লোকটা যেন বুঝতে পারলআমার মনের ভাব। ‘দুই টাকা নেবে।’

‘দুই টাকা! আমার কাছে আছে মাত্র এক টাকা। তাইলে বাকি একটাকা কোথায় পাই?’ আমি বলতে চাইনি। কিন্তু কথাগুলো যেননিজের উদ্যোগে বেরিয়ে গেল মুখ থেকে।

লোকটা এক মুহূর্ত তাকাল। তারপর ফের হাসল তার সে অনাবিল হাসিটা।

ওর গায়ে একটা গরম কোট। মাথা ঢাকা সাদা পাগড়িতে। গলায়মাফলার। কাপ্তাইয়ের পাহাড়ী শীতের মোকাবিলা করার যথাসম্ভবআয়োজন। কোটের ভেতরে একটা হাত ঢোকাল। খানিকক্ষণহাতড়ে বের করে আনল একটা টাকা। হাসিমুখেই বলল, ‘ছোটভাই, আপনি আমার পীরভাইয়ের বড়কুটুম। আপনাকে তোআর পানিতে পড়তে দিতে পারি না। নিন, আরেক টাকা আমিদিচ্ছি। টেক্সিঅলাকে বলবেন, সুইডিস্ট মসজিদের ইমাম সাহেবেরবাসার সামনে নামিয়ে দেয়ার জন্যে। নিন…’

হতাশা ও অনিশ্চয়তাবোধ এতটা চরমে পৌঁছেছিল যে, ভদ্রতাকরে হলেও ‘না’ বলার অবস্থা ছিল না। টাকাটা নিলাম। একবারভাবলাম, ধন্যবাদ দিই। তাও মুখ দিয়ে বেরোল না।

একটা টেক্সি যাচ্ছিল পাশ দিয়ে। হাত উঁচিয়ে থামাল ওটাকেলোকটা। তারপর বলে দিল আমাকে নিয়ে সুইডিস্ট মসজিদেরসামনে নামিয়ে দিতে। বলল, ‘টেক্সি থেকে নেমে কাউকে জিজ্ঞেসকরলেই দেখিয়ে দেবে ইমাম সাহেবের বাসা। যান ছোটভাই, আল্লাহ হাফেজ। গোলাম মাওলা সাহেবকে আমার সালামদেবেন। আমার নাম ছিদ্দিক, মোহাম্মদ ছিদ্দিক উল্লাহ। নামবললেই উনি চিনবেন।’

সুইডিস্ট মসজিদের সামনে নেমে একজনকে জিজ্ঞেস করতেগোলাম মাওলার বাসা দেখিয়ে দিল। নক করলাম, সাথে সাথেখুলে গেল দরজা, যেন কেউ একজন দাঁড়িয়েছিল দরজার ঠিকসামনেই। আমার মামাতো বোন, শাজু বু’। আমাকে দেখেইদু’চোখ কপালে উঠে গেল। ‘কীরে দুলু? তুই? তুই কোত্থেকে এলিরে? বাসা চিনলি কেমনে? আয় আয়, ভেতরে আয়।’

এই হলো শাজু বু’। ছোটবেলা থেকেই এই মহিলাকে দেখে আসছিএমনি আন্তরিক। আমার নানাবাড়িতে মেয়েদের মধ্যে সবচেয়েশান্তশিষ্ট আর ভদ্র। আগে একবার বিয়ে হয়েছিল বাড়ির কাছেরএক ছেলের সাথে। কিন্তু শয়তান লোকটা এমন ভালো মেয়েটাকেচিনতে পারেনি। অনেক কষ্ট দিত শুনেছি। আমরা তখন ছোট।বড় হয়ে জেনেছি এসব কথা। গোলাম মাওলার সাথে বিয়ে হওয়ারকথাও আমার মনে নেই। শাজু বু’র চেয়ে বয়সে অনেক বড়লোকটা। তারও দ্বিতীয় বিয়ে। দুই ছেলে রেখে মারা গিয়েছিল তারবউ।

শাজু বু’র উষ্ণ অভ্যর্থনার জবাব দিলাম হাসিমুখে। পায়ে হাতদিয়ে একটা সালামও করে ফেললাম। বললাম, ‘দুলাভাইকোথায়?’

শাজু বু’ বলল, ‘তোর দুলাভাই মসজিদে। নামাজ পড়াতে গেছে।তুই হাত-মুখ ধোও। ভাত খাবি। ক্ষিধে পেয়েছে তো?’

ক্ষিধে অবশ্য পেয়েছে বটে। তবে সেটা নিয়ে এখন আর মাথাঘামাচ্ছি না। সন্ধে থেকে যে চরম অনিশ্চয়তায় সময় কাটছিল, এখন তা কেটে যেতেই ভীষণ ফুরফুরে লাগছে। শাজু বু’র সবচেয়ে ছোটটাকে গাল টিপে দিয়ে বললাম, ‘কেমন আছিস রেব্যাটা?’

ব্যাটার বয়স মাত্র বছর দেড়েক। উপভোগ করতে পারল নাআদরটা। ভ্যাঁ করে গাল ছেড়ে দিয়ে প্রবল প্রতিবাদ জানাল।

শাজু বু’ মেয়েলি আলাপ জুড়ে দিল। কে কেমন আছে না আছে, এসব জবাব দিতে হলো বিশদ ভাবে।

শাজু বু’কে নিয়ে আমার এক গভীর স্মৃতি আছে। আমারশৈশবের অনেক কষ্টের সে স্মৃতি। সে স্মৃতি শাজু বু’র আছে কি নাজানি না। তবে যদি কখনো শৈশবের ফেলে আসা সে বাগানটায়বেড়াতে যাই, কষ্টের সে স্মৃতিটাও এসে ছুঁয়ে দেয় আমাকে।

স্মৃতির আয়নায় অনেক ধুলো জমে গেছে। ফুঁ দিয়ে পরিষ্কার করেনিতে হয় মাঝে মধ্যে। তবুও অনেক কিছু অস্পষ্ট, অপ্রতিভাত।কিন্তু একটা কিশোরী মেয়ের কোলে একটা কান্নারত শিশুকে আমিকিছুতেই ভুলতে পারি না। মেয়েটা বাচ্চাটাকে কোলে নিয়ে বাড়িথেকে বেরিয়ে বিলের দিকে চলে যাচ্ছে। বুকের সাথে জড়িয়ে ধরাবাচ্চাটার পিঠের ওপর একহাতে চাপড় দিতে দিতে বলছে, ‘কাঁদেনা দুলু, কাঁদে না ভাই…কাঁদে না…. কাঁদে না….’

বাচ্চাটা কিছুতেই থামছে না। এক নাগাড়ে কাঁদছে গলা ছেড়ে। ওওর মায়ের কাছে যেতে চায়। মায়ের কোলে বসতে চায়। কিন্তু তাকেজোর করে মায়ের কাছ থেকে দূরে সরিয়ে দেয়া হয়েছে। ওর মাওকিছু বলছে না। একটা লালশাড়ি পরে মাথায় বিরাট ঘোমটাটেনে বসে আছে। তার হাতে মেহেদি, পায়ে আলতা। চার পাশেঅনেক মহিলা।

কিন্তু এই স্মৃতিটাকে আমি ভুলে থাকতে চাই। আমার সতেরোবছরের জীবনে সবচেয়ে নির্মম স্মৃতি এটা। পাঁচ বছরের ওইশিশুকে আমি মাঝে মাঝে বুঝতে চাই। জানতে চাই, ওর পৃথিবীটাকতোটা এলোমেলো হয়ে গিয়েছিল তখন। কিন্তু মানুষের অনেকঅপারগতার মধ্যে সম্ভবত এটাও একটি যে, ও যেমন সাত বছরেদাঁড়িয়ে সত্তুরের প্রজ্ঞাকে ছুঁতে পারে না, তেমনি সত্তুর বছর বয়সেগিয়ে সাত বছরের আবেগকেও অনুভব করতে পারে না।

ঘন্টা খানেক পরে গোলাম মাওলা এলেন। খুব লম্বা করে একটাসালাম দিলাম দুলাভাইকে, ‘আসসালামু আলাইকুম………….’

তার চেয়ে লম্বা করে সালামের জবাব দিলেন তিনি, ‘ওয়ালাইকুমুসসালাম ওয়া রাহমাতুল্লাহে ওয়া বারাকাতুহু…..’ অভ্যর্থনা জানালেন, ‘আরে দুলাল মিয়া যে! তুমি কই থিকা? কখন আইলা?’

দুলাভাইয়ের সাথে একত্রে বসে ভাত খেলাম। শালা-দুলাভাইহালকা পাতলা ঠাট্টা-মশকরাও হলো। তার অনুরোধে ফুলকপিদিয়ে রাঁধা মাছের তরকারি দিয়ে দু’মুঠো ভাত বেশিও খেতে হলো।

মাসুদ আনোয়ার। লেখক ও সাংবাদিক। জন্ম – দীর্ঘাপাড়, সন্দ্বীপ, চট্টগ্রাম। পেশায় সাংবাদিক। লেখালেখির শুরু ছাত্রজীবন থেকে। মাধ্যম ছড়া, কবিতা ও উপন্যাস। লেখেন বড়-ছোট উভয় শ্রেণির পাঠকের জন্যে। প্রথম ছড়ার বই ‘হুক্কাহুয়া‘, প্রথম কিশোর উপন্যাস ‘কেউ জানে না‘। কিশোর গল্প সঙ্কলন...

এই বিভাগের অন্যান্য লেখাসমূহ