ডায়াবেটিসকে রুখে দিন

জুঁই ইয়াসমিন
প্রবন্ধ, বিজ্ঞান
Bengali
ডায়াবেটিসকে রুখে দিন

আপনার কি টাইপ-২ ডায়াবেটিস আছে? আপনি কি প্রিডায়াবেটিক? অথবা আপনার পরিবারে কি ডায়াবেটিসের ইতিহাস আছে? আপনি কি ভেবে বসে আছেন যে, এ থেকে বাঁচার কোনো উপায় নেই? তাহলে ভুল ভাবছেন। “ডায়াবেটিস একটি জীবনব্যাপী অসুখ” এই ধারণাটি ইতোমধ্যে পুরনো হয়ে গেছে যা আমরা অনেকেই জানি না। সাম্প্রতিক গবেষণা বলছে ডায়াবেটিসকে আর নিয়ন্ত্রণ নয়, নির্মূল করা সম্ভব।

অসংখ্য মানুষ শুধুমাত্র তাদের খাদ্য তালিকায় পরিবর্তন এনে নিজেদেরকে ডায়াবেটিস থেকে মুক্ত করতে পেরেছেন, অনেকে ডায়াবেটিসের ভয়াবহতা থেকে রেহাই পেয়েছেন আর অনেকে তাদের প্রিডায়াবটিক অবস্থা থেকে সারাজীবনের জন্য বেরিয়ে আসতে পেরেছেন। এই খাদ্যাভ্যাস পরিবর্তন তাদেরকে ওজন কমাতেও সাহায্য করেছে।

ডায়াবেটিস আসলে আমাদের শরীরের ইনসুলিন ও রক্তের গ্লুকোজের সমস্যা। এসময় রক্তের গ্লুকোজ বেড়ে যায়। ঠিক কী কারণে একজন ডায়াবেটিক রোগীর গ্লুকোজের মাত্রা বেড়ে যায় তা নির্ভর করে তার কী ধরনের ডায়াবেটিস হয়েছে তার উপর। তবে, সকল প্রকার ডায়াবেটিসের ক্ষেত্রেই দেখা যায়, যে ব্যক্তিটির ডায়াবেটিস হয়েছে তিনি হয় পর্যাপ্ত ইনসুলিন উৎপাদন করছেন না অথবা ইনসুলিনকে সঠিকভাবে ব্যবহার করতে পারছেন না। টাইপ-১ ডায়াবেটিসের ক্ষেত্রে রোগীর প্যানক্রিয়াস অটোইমিউনিটি (যেখানে শরীরের নিরাপত্তা ব্যবস্থা নিজেই শরীরের কোষগুলোকে আক্রমণ করে) বা অন্য কোন কারণে এতটা নষ্ট হয়ে যায় যে, পর্যাপ্ত পরিমাণ ইনসুলিন উৎপাদন করতে পারে না। টাইপ-২ ডায়াবেটিসের ক্ষেত্রে ইনসুলিন একদম ঠিকঠাক তৈরি হয় কিন্তু দেহের কোষগুলো সঠিকভাবে ব্যবহার করতে পারে না।

রক্তে অতিরিক্ত গ্লুকোজ থাকা ক্ষতিকর। কারণ, এতে রক্তনালীগুলো মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে অনেক রোগের কারণ ঘটায়। অন্যদিকে, গ্লুকোজগুলো রক্তে থাকলেও তা দেহকোষে ঢুকতে পারে না বলে দেহের কোষগুলো খাদ্যের অভাবে ভোগে। দীর্ঘসময় এঅবস্থা চলতে থাকলে শরীরে নানাবিধ জটিলতা সৃষ্টি হয়ে থাকে।

খুব অল্পমাত্রার ইনসুলিন জীবনের জন্য ঝুঁকিপূর্ণ। কিন্তু অতিরিক্ত ইনসুলিনও একটি বড় সমস্যা যা টাইপ-২ ডায়াবেটিসের হলমার্ক। ইনসুলিন মূলত প্যানক্রিয়াস থেকে উৎপন্ন হয়ে রক্তের গ্লুকোজকে দেহকোষে প্রবেশে সাহায্য করে। তবে, শুধুমাত্র গ্লুকোজের সঠিকমাত্রা নিয়ন্ত্রণ নয়, সেই সাথে পেশির ক্ষয় রোধ করে। এছাড়া, ইনসুলিন হলো চর্বি গুদামজাতকারী হরমোন। অর্থাৎ এটি শরীরে চর্বি সঞ্চয় করে বিশেষ করে যখন রক্তে গ্লুকোজের মাত্রা বেশি থাকে। এবং এসময় সে শরীরকে কোনো প্রকার চর্বি খরচ করতে দেয় না।

এখন, কীভাবে বুঝবেন যে আপনার রক্তের গ্লুকোজ বেড়ে গেছে। আপনি যদি না জেনে থাকেন তবে বলতে চাই যে খুব সহজেই আপনি তা জানতে পারেন। আপনি আপনার চিকিৎসকের সহায়তা নিতে পারেন অথবা একটি ভালো মানের রক্তের গ্লুকোজমিটার দিয়ে আপনি বাসায় বসেই বের করে ফেলতে পারেন রক্তে আপনার গ্লুকোজের মাত্রা। এক্ষেত্রে আপনাকে যা করতে হবে তা হলো:

১.   প্রথমত হাত পরিষ্কার করে নিয়ে একটি টেস্ট স্ট্রিপ আপনার গ্লুকোজমিটারের নির্দিষ্ট স্থানে প্রবেশ করান।
২.  যেকোন আঙ্গুলে যন্ত্রের সূঁচালো অংশটি রেখে অন্যপাশ থেকে চাপ দিলে শরীর থেকে কিছু রক্ত বের হবে।
৩.  টেস্ট স্ট্রিপটি দিয়ে একফোঁটা রক্ত শুষে নিতে হবে।
৪.  কয়েকসেকেন্ড পর গ্লুকোজমিটার আপনাকে একটি রিডিং দেবে।

এইবার নীচের তালিকানুযায়ী আপনার রিডিংটি মিলিয়ে নিন। তালিকাটি আমেরিকান ডায়াবেটিস অ্যাসোসিয়েশন থেকে নেয়া হয়েছে।

স্বাভাবিক রক্তগ্লুকোজ: সারারাত খালি পেটে থেকে যদি গ্লুকোজের মাত্রা ১০০ মি.গ্রা./ডেসি. লি. (৫.৬ মি. মোল/লি.)-এর থেকে কম হয় এবং খাওয়ার ১-২ ঘণ্টা পর যদি এটি ১৪০ মি.গ্রা./ডেসি. লি. (৭.৮ মি. মোল/লি.) এর কম হয়।

প্রিডায়াবেটিস: সারারাত না খেয়ে থেকে সকালে যদি ১০০-১২৫ মি.গ্রা./ডেসি. লি. (৫.৬-৬.৯ মি. মোল/লি.) হয়।

ডায়াবেটিস: সারারাত না খেয়ে থেকে সকালে যদি ১২৬ মি. গ্রা./ডেসি. লি. (৭.০ মি. মোল/লি.) বা এর বেশি এবং খাবার ১-২ ঘণ্টা পর ২০০ মি.গ্রা./ডেসি. লি. (১১.১ মি. মোল/লি.) বা এর বেশি হয়।

তবে, মনে রাখতে হবে যে, একবার টেস্ট করে ডায়াবেটিস সম্পর্কে নিশ্চিত হওয়া যাবে না। এক্ষত্রে চিকিৎসকের সাহায্য নেয়া উচিত। তিনি আরো কিছু টেস্ট করে বিষয়টি নিশ্চিত করতে পারবেন। আর আপনি যদি ইতোমধ্যে লো-কার্ব বা কম শর্করাযুক্ত খাবার খেয়ে অভ্যস্ত হন তবে আপনার ক্ষেত্রে রিডিংটা অন্যরকম হবে। সেটা পরে একসময় অন্য কোথাও আলোচনা করা যাবে।

ডায়াবেটিক রোগীর রক্তের গ্লুকোজকে স্বাভাবিক মাত্রায় রাখতে সমস্যা হয়। গ্লুকোজ বেড়ে যায় বলে তাদের রক্ত বেশি মিষ্টি হয়ে যায় কারণ ।

আমাদের রক্তে দু’জায়গা থেকে গ্লুকোজ আসে। এক, লিভার এবং দুই, খাবার থেকে। লিভার বা যকৃত থেকে যে গ্লুকোজ আসে তা আমরা খুব একটা নিয়ন্ত্রণ করতে পারি না। কিন্তু খাবার থেকে আসা গ্লুকোজের ক্ষেত্রে পারি, কারণ আমরা আমাদের দৈনন্দিন খাদ্যাভ্যাসকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারি।

আমাদের খাবারের তিনটি প্রধান উপাদান হলোজ্জকার্বোহাইড্রেট বা শর্করা, প্রোটিন বা আমীষ এবং ফ্যাট বা চর্বি। তবে, বেশিরভাগ খাবারই এই তিনের সংমিশ্রণে তৈরি। যে খাবারটিতে যে উপদানটি সবচেয়ে বেশি থাকে সেই খাবারকে ঐ উপাদানের নামে শ্রেণিকরণ করা হয়।

কার্বোহাইড্রেট

যে খাবারগুলো ভেঙে গ্লুকোজে পরিণত হয় তাদের কার্বোহাইড্রেট বা সংক্ষেপে কার্ব বলে। এই গ্লুকোজ যখন রক্তপ্রবাহে মেশে তখন তাকে রক্ত সুগার বলে। খাবারে যত বেশি কার্ব থাকবে তত বেশি সুগার রক্ত প্রবাহে মিশবে এবং রক্তে সুগারের মাত্রা বেড়ে যাবে।

যদিও খুব কম লোক বলবে যে, সুগার সমৃদ্ধ খাবার স্বাস্থ্যকর, তথাপি এমন অনেক খাবার আমরা খাই যা অন্যান্য বিবেচনায় স্বাস্থ্যকর হলেও চিনিতে ভরপুর যেমন- ফল, বিশেষ করে মিষ্টি স্বাদের ফল যাতে প্রচুর চিনি আছে। অনেকে এটাও জানেন না যে, শর্করা জাতীয় খাবার যেমনজ্জভাত, রুটি, আলু, মুড়ি, নুডলস, পাস্তা, কেক, পাউরুট প্রভৃতি খাওয়ার পর হজম হয়ে খুব দ্রুত চিনি তৈরি করে। একটি আলু খাওয়া মানে ৩-৪ চামচ চিনি খাওয়ার সমান।

গ্লাইসেমিক ইনডেক্স

কোনো একটি খাবার খাওয়ার পর গ্লুকোজ খেলে যতটা রক্ত-গ্লুকোজ বৃদ্ধি পেত সেই তুলনায় এর রক্ত গ্লুকোজের পরিমাণ কতটা বৃদ্ধি পায় তার উপর নির্ভর করে তৈরি করা তালিকাকে গ্লাইসেমিক ইনডেক্স বলে। যেমন: গ্লুকোজের গ্লাইসেমিক ইনডেক্স ১০০ হলে ভাতের ৬৯।

প্রোটিন

ডিম, মাছ, মাংস, পনির, ডাল এগুলো হলো প্রোটিন সমৃদ্ধ খাবার। যদিও ভিন্ন ভিন্ন মানুষ ভিন্ন ভিন্ন প্রতিক্রিয়া দেখায় তবে খাবারে পরিমিত প্রোটিন (৩০ গ্রাম) রক্ত গøুকোজে খুব একটা প্রভাব ফেলে না।

চর্বি বা ফ্যাট

খাবারের চর্বি রক্তের গ্লুকোজে খুব কমই প্রভাব ফেলে। অবশ্য চর্বি কখনোই এককভাবে খাওয়া হয় না। সব সময় তা অন্য কোনো খাবারের সাথে খাওয়া হয়। যেমন, পনিরে ফ্যাট ও প্রোটিন কাছাকাছি মাত্রায় থাকে। এটি খুব বেশি গ্লুকোজ বাড়ায় না। তবে ফ্রেন্সফ্রাই, বাটারবন এগুলো মূলত কার্বোহাইড্রেট ও ফ্যাটসমৃদ্ধ। এগুলো খেলে এদের কার্বোহাইড্রেট অংশের কারণে রক্তে গ্লুকোজ বেড়ে যায়।

কীভাবে রক্ত-গ্লুকোজ নিয়ন্ত্রণ করব?

কেমন হয় যদি আমরা আমাদের খাদ্য তালিকা থেকে রক্তে গ্লুকোজের মাত্রা বাড়িয়ে দেয় এমন খাবারগুলো বাদ দিয়ে দেই। আপনি হয়তো ভাবছেন তাহলে খাবারের জন্য আর কিই-বা অবশিষ্ট থাকলো। কিন্তু, বিষয়টি ততটা জটিল না। আমরা সকল প্রকার সবজি, মাছ, মাংস এবং টক জাতীয় ফলগুলো খেতে পারি। এখন প্রচুরসংখ্যক টাইপ-২ ডায়াবেটিক রোগী এমন মিষ্টি ও কার্বজাতীয় খাবারকে বাদ দিচ্ছেন খাদ্য তালিকা থেকে। এবং এরা শুরুতেই উপলব্ধি করছেন যে তাদের রক্তে গ্লুকোজের মাত্রার উন্নতি হচ্ছে এবং যারা ইনসুলিন নিতেন তাদের ইনসুলিন নেয়ার পরিমাণও কমে যাচ্ছে এবং অনেকে ওজন কমিয়েছেন। সবচেয়ে বড় কথা তারা ভালো অনুভব করছেন এবং কর্মোদ্যম ফিরে পাচ্ছেন। সেই সাথে তাদের সার্বিক সুস্বাস্থ্যের লক্ষণগুলো স্পষ্ট হচ্ছে।

এই চিত্র দেখে অনেক ডাক্তারও কিন্তু প্রচলিত খাদ্য তালিকা থেকে বের হয়ে তাঁর ডায়াবেটিক রোগীদের তিনি কম কার্বোহাইড্রেট যুক্ত খাবার খাওয়ার পরামর্শ দিচ্ছেন। আমাদের দেশে ড. জাহাঙ্গীর কবির তাদের মধ্যে অন্যতম। কম কার্বোহাইড্রেটযুক্ত খাবার খাওয়া হলো রক্ত- গ্লুকোজ নিয়ন্ত্রণের সব থেকে সহজ উপায়। তবে, যদি আপনি ডায়াবেটিস এর জন্য কোনো ওষুধ সেবন করেন তবে খাদ্য তালিকায় পরিবর্তনের সময় আপনার চিকিৎসকের সাথে পরামর্শ করে ওষুধের মাত্রাটি পুনরায় ঠিক করে নিবেন। কারণ, কার্বোহাইড্রেট বাদ দিলে যেহেতু  রক্তের গ্লুকোজ অনেকাংশে কমে যাবে তাই ইনসুলিন আর আগের মতো লাগবে না। পরিমাণটা অনেক কমে যাবে এবং কারো কারো ক্ষেত্রে একেবারেই না লাগতে পারে।

ডায়াবেটিসকে রুখে দেয়ার পেছনের বিজ্ঞান

এ বছর (২০১৯) আমেরিকান ডায়াবেটিস এসোসিয়েশন বলছে, রক্ত- গ্লুকোজ নিয়ন্ত্রণে কার্বোহাইড্রেট কমিয়ে দেয়া সর্বাপেক্ষা কার্যকর উপায়। গবেষণা বলছে, কর্ম-কার্ব একটি নিরাপদ ও কার্যকর উপায় এক্ষেত্রে। এ গবেষণার মধ্যে অনেকগুলো আছে র‌্যান্ডোমাইজড কন্ট্রোল মেটা এনালাইসিস যা নির্ভরযোগ্য একটি গবেষণা টুল। ২০১৭তে পরিচালিত আর একটি মেটা-এনালাইসিস থেকেও দেখা যায় যে, কর্ম-কার্ব গ্রহণ টাইপ-২ ডায়াবেটিক রোগীর ওষুধের প্রয়োজন কমিয়ে দেয় এবং বিভিন্ন স্বাস্থ্যকর  লক্ষণগুলোর ইতিবাচক উন্নতি করে। এর মধ্যে আছেজ্জহিমোগ্লোবিন এ১সি, রক্তচাপ ও ট্রাইগ্লিসারাইড কমে যাওয়া এবং এইচ-ডি-এল কোলেস্টেরল বেড়ে যাওয়া ইত্যাদি।

সর্বশেষ ভারতা হেলথ কর্তৃক পরিচালিত ৩৩০ জন টাইপ-২ ডায়াবেটিক রোগীর ওপর কিটোজেনিক ও লো-কার্ব ডায়েটের নন-র‌্যান্ডোমাইজড  ট্রায়াল থেকে দেখা যায় ১ বছরের মধ্যে ৯৭ ভাগ মানুষ হয় ইনসুলিন ব্যবহার বন্ধ করেছেন নয়তো ইনসুলিনের মাত্রা কমিয়ে দিয়েছেন। আর সবচেয়ে সুখের বিষয় হচ্ছে ৫৮ ভাগ মানুষের মধ্যে ডায়াবেটিসের কোনো লক্ষণ ছিল না এক বছর পর অর্থাৎ তারা ডায়াবেটিস থেকে মুক্তি পেয়েছিল। দুই বছর পর্যন্ত তাদের আর ডায়াবেটিস ফিরে আসেনি যা প্রমাণ করে যে ডায়াবেটিসকে নিরাময় করা যায় এবং এটি একটি ক্রমবৃদ্ধিমান বা অনিরাময়যোগ্য রোগ নয়। বরং এটি খুব ভালোভাবে প্রমাণিত যে, সঠিক খাদ্যাভ্যাস ও জীবন যাপনের মধ্যে দিয়ে আমরা একে সম্পূর্ণ নিরাময় করতে পারি।

তবে, ইনসুলিন রেজিস্ট্যান্স থেকেই মূলত টাইপ-২ ডায়াবেটিস হয় বলে যতদিন পর্যন্ত একজন রোগীর ইনসুলিন রেজিস্ট্যান্স ঠিক না হয় ততদিন তাকে লো-কার্ব ডায়েট চালিয়ে যেতে হবে।

মাত্র ৫০ বছর আগেও টাইপ-২ ডায়াবেটিস কদাচিৎ হতো মানুষের। এখন বিশ্বের প্রায় প্রতিটি কোনায় এ রোগের সরব উপস্থিতি এবং খুব শিঘ্রই এ রোগে আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা দাঁড়াবে ৫০০ মিলিয়ন-এ। এটি একটি বিশ্বব্যাপী মহামারি।

টাইপ-২ ডায়াবেটিস দ্বারা কেউ আক্রান্ত হলে এতদিন ধরে বলে আসা হয়েছে যে, তারা আর কোনোদিন তাদের স্বাভাবিক স্বাস্থ্যে ফিরে যেতে পারবেন না। এটি একবার হলে আর কোনদিন ভালো হবে না। তাই, রোগীদের দেখানো হতো কীভাবে তারা সারাজীবন ধরে একে অ্যানেজ করবে। কিন্তু, দুঃখজনক যে একজন রোগী যতই ভালো অ্যানিজ করুক না কেন তার ওষুধের মাত্রা দিনে দিনে শুধু বৃদ্ধি পায় আর সেই সাথে বৃদ্ধি পায় রোগের জটিলতা যেমনজ্জদৃষ্টিশক্তি কমে যাওয়া, কিডনি নষ্ট হওয়া, ক্ষত না শুকানো এবং কগনিটিভ কার্যক্ষমতা কমে যাওয়া। আর অনেকের ক্ষেত্রে এগুলো পুরোপুরি অন্ধ হয়ে যাওয়া, কিডনী ফেইলিউর ও ডায়ালাইসিস, অঙ্গহানি, স্মৃতিভ্রংশ এবং মৃত্যুতে গড়ায়।

কিন্তু, আশার কথা হচ্ছে এখন টাইপ-২ আক্রান্ত ব্যক্তিরা পুনরায় তাদের স্বাভাবিক স্বাস্থ্য ফিরে পেতে পারে। আমরা এখন জানি যে, টাইপ-২ ডায়াবেটিস এর হলমার্ক উচ্চ রক্ত গ্লুকোজ ও উচ্চ ইনসুলিন মাত্রাকে ঘুরিয়ে আবার স্বাভাবিক দশায় আনা যায়। রোগীকে আর ডায়াবেটিসকে অ্যানিজ করতে হবে না। শুধুমাত্র খাদ্যতালিকায় পরিবর্তন এনে একজন টাইপ-২ রোগী এখন ডায়াবেটিসকে সম্পূর্ণরূপে নিরাময় করতে পারে। অর্থাৎ তারা ওষুধ থেকেও মুক্তি পেতে পারেন।

রক্ত গ্লুকোজকে কমানো বা স্বাভাবিক পর্যায়ে নিয়ে আসা বা ওষুধ বাদ দেয়া মানে রোগের ক্রমাবনতি না হওয়া। ক্রমাবনতি না হওয়া মানে জটিলতা সৃষ্টি না হওয়া। তাই টাইপ-২ ডায়াবেটিস রোগীও সুস্থ ও দীর্ঘ জীবন উপভোগ করতে পারেন যখন তার পায়ের আঙুল, চোখের দৃষ্টি এবং কিডনীগুলো তার সঙ্গেই থাকবে।

আপনি যদি নিয়মিত ডায়াবেটিসের ওষুধ না খেয়ে থাকেন তাহলে ঠিক এই মুহূর্ত থেকেই আপনি আপনার অতীতের সুস্বাস্থ্যের দিকে যাত্রা শুরু করতে পারেন। আর যদি আপনি কোন প্রকার ডায়াবেটিসের ওষুধ সেবন করে থাকেন তবে কম শর্করাযুক্ত খাদ্য তালিকা অনুসরণ করার আগে অবশ্যই আপনার ডাক্তারের সাথে বসে আপনার ওষুধের ডোজটা ঠিক করে নেবেন। কারণ লো-কার্ব খাদ্য আপনার রক্ত গ্লুকোজ কম মাত্রায় বাড়বে তাই ওষুধের মাত্রাও কমাতে হবে।

নতুনদের জন্য লো-কার্ব খাদ্য তালিকা

লো-কার্ব খাদ্য তালিকায় শর্করা বা কার্বোহাইড্রেটের পরিমাণ কম থাকবে অর্থাৎ মিষ্টি জাতীয় খাবার, ভাত, রুটি, আলু, পাস্তা, নুডুলস এসব বাদ দিয়ে চর্বি বা তৈল এবং প্রোটিন সমৃদ্ধ প্রাকৃতিক খাবার আর সেই সাথে শাকসবজি ও ফলমূল কে রাখতে হবে। এ ধরনের খাবারের সব থেকে বড় সুবিধ হলো এক্ষেত্রে আপনাকে ক্যালরি মেপে খেতে হবে না কিংবা কোন বিশেষ কিছু ব্যবহার করতে হবে না। যা দরকার তা হলো প্রাকৃতিক খাবার খাওয়া এবং পরিতৃপ্তি সহকারে খাওয়া। তবে খাবারটি যেন প্রাকৃতিক অবস্থা থেকে খুব বেশি অন্য রকম না হয়। যেমন: মাংসের চর্বি না ফেলে বরং চর্বি সহ মাংস রান্না করে খাওয়া। এ ধরনের খাবারকে সাধারণত লো-কার্ব হাই ফ্যাট বা কিটো ডায়েট বলে।

কয়েক দশক ধরে আমরা বলে আসছি যে, চর্বি শরীরের জন্য ক্ষতিকর। সুতরাং সচেতন মানুষ মাত্র চর্বিকে এড়িয়ে চলতে থাকেন। এদিকে কম চর্বিযুক্ত খাবারগুলোকে মুখরোচক করবার জন্য এতে প্রচুর চিনি ব্যবহার করা হয় যা সচেতন-অসচেতন উভয় প্রকার মানুষই প্রচুর পরিমাণে খেতে শুরু করেন। আর এরপর থেকেই শুরু হয় স্থূলতার মহামারি। যদিও এতেই প্রমাণিত হয় না যে এটাই স্থূলতার কারণ তবে এইটা পরিষ্কার যে, লো-ফ্যাট বা কমচর্বি যুক্ত খাবার ওজন কমাতে পারে এবং এমনও হতে পারে যে কম চর্বিযুক্ত খাবার ওজন বৃদ্ধিতে অবদান রাখছে। এমন অনেক গবেষণা আছে যাতে দেখা যায় যে, প্রাকৃতিক চর্বিকে ভয় পাওয়ার কোনো কারণ নাই। বরং যখন আপনি লো-কার্ব খাচ্ছেন তখন চর্বি আপনার পরম বন্ধু। তাই কার্ব কমিয়ে দিয়ে আপনি নিজের রসনাকে পরিতৃপ্ত করতে প্রয়োজনীয় পরিমাণ চর্বি খেতে পারেন।

যখন আপনি সকল প্রকার চিনি এবং স্টার্চ বাদ দেবেন তখন আপনার রক্তের গ্লুকোজ আর বাড়বে না এবং গ্লুকোজ না বাড়লে ইনসুলিনও বাড়বে না। এক সময় চর্বি সঞ্চয়কারী ইনসুলিনের মাত্রা হ্রাস পাবে। ফলে, আপনার শরীরে চর্বি ভাঙা শুরু হবে। এতে করে আপনি কিছু না খেলেও ক্ষুধা অনুভব করবেন না। কারণ শরীরের প্রয়োজনীয় শক্তি সে শরীরের ভেতরে জমে থাকা চর্বি থেকে পাচ্ছে। এতে আপনার বাড়তি ওজনও কমে যাবে। এছাড়া লো-কার্ব এর সুবাদে পেট ফাঁপার সমস্যা, গ্যাস, এসিডিটি প্রভৃতিও ঠিক হয়ে যায় অনেকের ক্ষেত্রে। অনেকেই বলেন তাদের কগনিটিভ ক্ষমতা বেড়ে গেছে যেমন, ভালো চিন্তা করতে পারে, ভালোভাবে সমস্যা সমাধান করতে পারে, কোনো কিছুতে আগের চাইতে আরো গভীরভাবে মনোযোগী হয়ে কাজ করতে পারে ইত্যাদি।

মূলত যা করতে হবে তা হলো-

মাছ, মাংস, ডিম, শাকসবজি (যেগুলো মাটির উপরে জন্মে) এবং প্রাকৃতিক চর্বি (যেমন-বাটার) খেতে হবে এবং মিষ্টিজাতীয় ও স্টার্চি খাবারগুলো যেমন- চিনি, ভাত, রুটি, পাস্তা, আলু প্রভৃতি বাদ দিতে হবে।

শুধুমাত্র তখন খাবার খান যখন আপনি ক্ষুধার্ত এবং যখন মনে হচ্ছে যে আপনার পেট ভরে গেছে তখন খাওয়া বাদ দিয়ে দিন। এইটা খুবই সহজ একটি কৌশল। এতে আপনাকে ক্যালরি মেপে খাবার খেতে হচ্ছে না।

কারা লো-কার্ব ডায়েট ফলো করবেন না

যদিও বেশিরভাগ মানুষই নিরাপদে লো-কার্ব ডায়েট অনুসরণ করতে পারে তথাপি তিন ধরনের ব্যক্তির এ ধরণের ডায়েট অনুসরণ করার আগে কিছু প্রস্তুতির প্রয়োজন আর সেই সাথে প্রয়োজন বিশেষজ্ঞ পরামর্শ।

  • ডায়াবেটিক রোগী যারা ইনসুলিন খান বা নেন
  • যারা উচ্চ রক্তচাপের জন্য ওষুধ খান
  • যারা বাচ্চাকে বুকের দুধ পান করাচ্ছেন

এই তিন ধরনের বাদ দিয়ে অন্যরা নির্দ্বিধায় এই ডায়েট শুরু করতে পারেন।

যা খাবেন-

  • ২০ গ্রামের বেশি কার্ব খাওয়া যাবে না। আর সবজির মধ্যে দিয়েই এই কার্ব খাওয়া যায়।
  • পানীয়-এর মধ্যে চা, কফি খাওয়া যাবে তবে এতে চিনি যোগ করা যাবেনা। যারা র’চা বা ব্ল্যাক কফিতে অভ্যস্ত না তারা শুরুতে সামান্য দুধ ও ক্রিম দিয়ে নিতে পারেন। তবে, বাজারে যে ক্রিমারগুলো পাওয়া যায় এগুলো এড়িয়ে যাওয়াই ভালো। কারণ এতে প্রচুর পরিমাণে চিনি থাকে।

 

সম্পাদনা: শাহানাজ ইয়াসমিন

জুঁই ইয়াসমিন। লেখক ও গবেষক। পড়াশুনা করেছেন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং এ্যান্ড বায়োটেকনোলজি বিভাগে। পরবর্তীতে ইরাসমাস মুন্ডুস প্রোগ্রামের আওতায় 'ফুড সায়েন্স, টেকনোলজি ও নিউট্রিশন' স্নাতকোত্তর। বর্তমানে স্বাধীন স্বাস্থ্য প্রশিক্ষক হিসাবে কাজ করেন। স্বাস্থ্য ও মেডিসিন বিষয়ে নিয়মিত লেখালিখি করেন।

এই বিভাগের অন্যান্য লেখাসমূহ

গণতন্ত্র, সংবাদপত্রের স্বাধীনতা ও বাংলার নবজাগরণের দু একটি কথা

গণতন্ত্র, সংবাদপত্রের স্বাধীনতা ও বাংলার নবজাগরণের দু একটি কথা

একটি পরাধীন দেশ আর তার বাসিন্দাদের মনে স্বাধীনতার আকুতি আমরা দেখেছিলাম ব্রিটিশ শাসনাধীন ভারতে। এর…..

কবি চন্ডীদাস ও চন্ডীভিটে

কবি চন্ডীদাস ও চন্ডীভিটে

  কেতুগ্রামে যেখানে চন্ডীদাস বাস করতেন সেইস্থানটি চন্ডীভিটে নামে লোকমুখে প্রচারিত। চোদ্দপুরুষের ভিটে বাঙালির মনে…..

নারীর আপন ভাগ্য জয় করিবার: নারীজাগৃতি ও রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের কবিতা।

নারীর আপন ভাগ্য জয় করিবার: নারীজাগৃতি ও রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের কবিতা।

নবজাগরণের সঙ্গে নারীর জাগরণ, নারীর মর্যাদা ও সুরক্ষা, এবং নারীমুক্তি ওতপ্রোতভাবে জড়িত। ভারতে এই নবজাগরণের…..