ধ্যানমগ্ন সুরের বাহাস

ইবনে শামস
কবিতা
Bengali
ধ্যানমগ্ন সুরের বাহাস

প্রচ্ছন্ন অন্ধকার

আলো, এক উজ্জ্বল দৈত্য আধুনিক দুনিয়ার৷ নিজেরে এই জঞ্জাল থেকে লুকাইবো এমন জায়গা নাই কোন৷ উৎকৃষ্ট ফুল ফুটে এমন অন্ধকারের খোঁজে চুরমার করেছি জীবনের সমস্ত বন্ধন৷

চোখের ব্যাথা নিয়ে, প্রচ্ছন্ন অন্ধকারের খুঁজে নিজেরে কুণ্ঠিত কইরা তুলতেছি আরো। দেনাদারের ডরে যে ঋণগ্রস্ত ঘরকোণো হয়ে আছে, তার মতোন আলো থেইকা তুলে নিতেছি নিজের দেহ ও দস্তুর।

ধ্যানমগ্ন সূরের বাহাস 

আমার অন্তর মাঝে জ্বলছে আগুন
ধিকি ধিকি, নেভার নাম নিবে না সে
সখা, তুমি আইবা যদি, রেখো ধ্বনি মাঝে বরফগুন।

আকাশনদে ভাসছে স্বরূপ, আমি তবু পাইনা খুঁজে
জলাধারে অশ্রু জমায়ে, চাইয়া আছি রুক্ষ চোখে
পথে পথে কামনাকূপ, পাড়িতে দেয় বাঁধা
কতো সূর যাচ্ছে মারা, সখা, দেও হৃদে দ্যাখা

আমার অঙ্গমাঝে বইছে গরল, মরা বিনে ছাড়বে না
সখা, আইসো যদি এই অন্তরে, রেখো কণ্ঠে আবে হায়া

শোক

মরদেহ দ্যাখতে এসে
আমার ভেতরটা চুপ মেরে যায়, একেবারে শান্ত যেনো কখনো কোন আলোড়ন ছিলোনা সেখানে।

শুনেছিলাম, কোন মৃতমানুষের সামনে চিৎকার করে কাঁদতে নেই কারণ যেই দেহকে দ্যাখে আমরা কাঁদি সে তার কোন ফল ভোগ করেনা- যতো কিছু বয়ে যায় সব সেই আত্মার উপর যা আমরা কখনোই দ্যাখিনি।
– শোকটাও হতে হয় অদৃশ্য; মাতমে কোন শোক নেই যেমন নেই দেহের কোন মৌলিকত্ব।

চুপচাপ কিছুটা সময় পার হয়ে যায় অতপর
ভাতের মারের ফুলে উঠার মতোনই হৃদয়ের উপরিতলে এসে স্পন্দিত হয় স্মৃতি।

নাম জপো

কবিতার এতো এতো মাস্টার— দেখলেই
আমার কিছুটা শূন্যতা উড়াতে ইচ্ছে করে

কাবিলের মতো—

হরিণের চোখের দিকে ছুটছে অন্ধকার
ফুলের মাতম ছিঁড়ে খাচ্ছে হন্তারক হাত

স্কুল ফেলে গেছো মাস্টার— আমারই
বন ঘিরে রেখেছো সূত্রপাতের অহমে

বেত হাতে কার বুকে রাখছো চোখ
তুমি খাচ্ছো কবিতার নাম করে আঙুর।

এতো এতো মাস্টার কবিতার— কিছুটা
অন্ধকার জড়াতে ইচ্ছে করে দেখলেই

ফিরেস্তার মতো—

গ্রীবা থেকে ঝরছে অজুহাতের পাপ

জগতের সমস্ত অনুসঙ্গই তো কবিতা—

এই যেমন আমার ভালো লাগে পটেটো ক্রেকার্স আর তোমাদের গুলির শব্দ, ফেলানির চিৎকার৷ নারীর শরীর
কিংবা মদ৷ পাশাপাশি ধর্ষণ তোমাদের নিত্যকার অভ্যেস৷

নেকাব খুললেই উড়ে যাচ্ছে হাওয়াদের মাতম৷ উড়ে গিয়ে কি
বসবে লজ্জার উপর?

জগতের সকল অনুসঙ্গই কবিতার—

এই যেমন আমার ভালো লাগে ফুলেদের জীবন আর তোমাদের ফুলেদের লাশ, ফ্যাসিবাদ, আগুনের হুল্লোড়
বিস্তীর্ণ জমি পুড়িয়ে দেয়া দীর্ঘশ্বাস আর মানুষের হাততালি ।

খাঁচা খুলে দিলেই কস্তুরি মৃগ দু’জাহান। দৃষ্টিবিভ্রমে খুন হয়ে
যাবে কি জাহান্নুমের দারোগা?

মগজ থেকে ঝরতেছে মাইগ্রেনের ঘাম

ঢের ঘুমানোর পর নয়
হঠাৎ ঘুম ভেঙে গেলে
আমার কথা বলতে ইচ্ছে করে

যা ঘুম হয়নি; তা কথা বলা দিয়ে পুষিয়ে দিতে
কার সাথে কথা বলা যায়?

‘আমি এক ব্যর্থ চ্যাপলিন’ কিংবা ঈশ্বররে শার্ট ভিজে যাচ্ছে
একটা কবিতার বই৷ তার একপাশে ভারত; ভারত পার হলে
পাকিস্তান৷ অন্যপাশে বঙ্গোপসাগর৷ আমার যুদ্ধ পছন্দ না
তাই দেশ থেকে মুখ ফিরিয়ে নিই৷ সমুদ্রের দিকে যাই।

বালু আর পানি একসাথে আমার পায়ের নিচে; ওদের আমি
আমার অঙ্গে মিলাইতে চাই। শুয়ে থাকি৷ আমার পিছনে কিছু
ভাল্লুক, কিছু নেকড়ে এবং তারও পিছে কতোগুলা দাঁড়কাক
আয়েস করে খাচ্ছে মানুষের মাংশ।

কতোগুলা বই আমি একসাথে রাখে, এই যেমন ধরুন
‘এই মৃত্যু উপত্যাকা আমার দেশ নয়’ তার উপর ‘তিন মিনিট বাইশ সেকেন্ডে বিপ্লব আসেনা’ তাদের পাশে বসে থাকতে দেখি ‘রোহিণীর জন্যে একটা রাষ্ট্র’ এবং ‘আমি এক ব্যর্থ চ্যাপলিন৷

ডাক্তার, আমার উপর দয়া করুন; যন্ত্রণা হচ্ছে খুব।
ওখানে না, এইখানে— এই যে এইখানটা তে৷ ওভাবে
তাকাবেননা ডাক্তার, ক্ষতরা ভয় পায়না; ভয় দেখায়।
যদিও আঘাতটা পিঠেই করেছিলো তবু জখমটা বুকে।

এইখানে; আপনি কি যন্ত্রণাটা কমাতে পারবেন?

ছুরিটা আমি দেখি মতো লাগান; আঘাত হোক অপারেশনের
কিংবা খুনের; আমার চোখের সামনে করলে ভালো লাগবে।
শান্তি লাগবে৷ কাটার সামনেই ফুলকে ছিঁড়তে হয়৷ কাটা ছাটাই করে ফুল ছিঁড়াতে শিশুদের আনন্দ; পুরুষদের না
কিংবা সাহসীরা এই কাজ করেনা। এই দেখুন, রক্তের মতো
কণ্ঠ আমার কেমন মিলিয়ে যাচ্ছে ছুরির ধারালো প্রেমে।

ডাক্তার আমাকে ঘুম পাড়িয়ে অস্ত্রোপাচার করিয়োনা; ক্ষমা
করবোনা৷ এইটা দেহ না; ক্ষতদের গোরস্থান। তুমি আর কতো ক্ষয়ের ভয় দেখাবে?

সামনে সমুদ্র
সমুদ্রের মাঝেও গজাচ্ছে কাঁটা চামচের মতো কাঁটাতার।

আমার ভালো লাগেনা কাঁটাতারে ঝুলন্ত লাশ কিংবা ফুল
ডাক্তার, ক্ষত চিনোনা? কিসের ডাক্তার তুমি? পিঠে নয়
ক্ষত আমার বুকে। ছুরিটা এবার চালিয়ে দাও

ধেয়ে আসছে ভাল্লুকের দল
নেকড়েরা মেতেছে নতুন রক্তের খোঁজে
কাকেরা খুঁজে লাশ

ছুরিটা এবার বুকে পৌঁনে পাঁচ ইঞ্চি ডুকিয়ে সরলরেখা
আঁকার মতো টেনে নাও নাভি অবধি— ওখানে ঝিঁঝিপোকা
ঘুমায়— ওদের ঘুম ভেঙে দাও— ওরা ওড়ে যাক ওদের
আলোতে; আমি অন্ধকারে ঘুমাবো এবার।

আমার পাশে কারা যেন ডাক ছাড়ে— রক্তের মতো অমন
স্বাদ ও স্বস্তি আর কোথায়?

ইবনে শামস। কবি। জন্ম ১৯৯৬ খ্রিস্টাব্দ, বাংলাদেশের চট্টগ্রাম জেলার আনোয়ারা উপজেলায়। লেখাপড়া করছেন উদ্ভিদবিজ্ঞান বিষয়ে। প্রকাশিত বই: 'স্বর্গের গালিচায় আগুন' (কাব্যগ্রন্থ, ২০১৮), 'পুরনো শরাব' (অনুবাদ কাব্যগ্রন্থ, ২০২০), 'হেলেন এবং তার আত্মহত্যাপ্রবণ গোলাপগুলো' (গল্পগ্রন্থ, ২০১৯), 'অন্তর্গত অসুখ' (কাব্যগ্রন্থ, ২০২০)।

এই বিভাগের অন্যান্য লেখাসমূহ

কবুতর

কবুতর

অগ্নিকাণ্ড আমার চৌহদ্দিতে ধ্বংসস্তুপের ভীড় পুনর্বার নুয়ে পড়া অতীতের তীর জীবনের মাঝপথে রেখে যায় সম্পর্কের…..