নির্বাচন প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়

মাসকাওয়াথ আহসান
গল্প, পডকাস্ট, রম্য রচনা
Bengali
নির্বাচন প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়

উচ্চতর নির্বাচন প্রকৌশল বিজ্ঞানের ক্লাস চলছে। কীভাবে ভোটবিহীন নির্বাচন অনুষ্ঠানের মাধ্যমে মনপছন্দ প্রার্থীদের জিতিয়ে আনা যায়, সে ব্যাপারে নানা কৌশল তুলে ধরছেন শিক্ষক।

শিক্ষক বলেন, ভোটহীন নির্বাচনকে বৈধতা দেবার ক্ষেত্রে সবচেয়ে বড় বাধা হচ্ছেন নির্বাচন পর্যবেক্ষকরা। এই পর্যবেক্ষকদের মূর্তিতে রূপান্তরিত করতে হবে। সক্রেটিস-প্লেটো-এরিস্টোটলের মূর্তি হলে ভালো হয়। আপনি বলতে পারবেন, গণতন্ত্রের সূচনাকারী ব্যক্তিবর্গই নির্বাচন পর্যবেক্ষণ করেছেন। কেউ প্রশ্ন তুললে, জোর গলায় বলতে পারবেন, আপনি কী প্লেটোর চেয়ে গণতন্ত্র বেশী বোঝেন!

গল্পটির অডিও শুনতে পাবেন এখানে –

এক মেধাবী ছাত্র প্রিসাইডিং অফিসার বলেন; স্যার, আব্রাহাম লিংকনের মূর্তি হলেও ভালো হয়। বলতে পারবো, ভোট অফ দ্য পিপল, বাই দ্য পিপল, ফর দ্য পিপল। মানে যে ভোট জনগণের দ্বারা দেবার কথা; ওইটা জনগণের নামে জনস্বার্থে পোলিং অফিসারেরাই দিয়ে দেয়।

শিক্ষক খুশী হয়ে পিঠ চাপড়ে দিতে দিতে বলেন, নির্বাচন প্রকৌশলে এই ক্রিয়েটিভিটিটা খুবই জরুরী। আপনাকে দিয়ে হবে। আমি আপনাকে এই কোর্সে এ প্লাস দেবো।

প্রিসাইডিং অফিসার স্বপ্ন বিহ্বল হয়ে ঘুমের দেশে চলে যান। শিক্ষক বোর্ডে একটি বৃত্ত এঁকে বলেন, এটা হচ্ছে ইলেকশান ইঞ্জিনিয়ারিং সাইকেল। এই গোলাকৃতি চাকার সঙ্গে বাঁধা থাকে পুলিশ, কালোমানিক বাহিনী, হেলমেট-হাতুড়ি-লুঙ্গি বাহিনী। পুলিশ ও কালোমানিক বাহিনীর কাজ হচ্ছে, অপছন্দের প্রার্থীদের গুম ও গ্রেফতার করা। উল্লেখ্য, যে এই সাইকেলের চাকায় আদালতের বিচারক বাঁধা থাকতে হবে। যাতে অপছন্দের প্রার্থীদের জামিন আবেদন নাকচ করে কারাগারে প্রেরণ অপেক্ষাকৃত সহজ হয়। হেলমেট-হাতুড়ি-লুঙ্গি বাহিনীর কাজ হচ্ছে ভোটারদের ভোট কেন্দ্রে আসতে মৃদু বাধা প্রদান-ভীতি সৃষ্টি-অবশেষে ভোট কেন্দ্রে এসে জাল ভোট প্রদান।

কালো মানিক বাহিনীর এক ছাত্র গর্ব করে বলে, এই টিমওয়ার্ক সাইকেলে ছোট ছোট পাসে গণতন্ত্রকে গোলপোস্টের দিকে নিয়ে গিয়ে ভোট বিজয়ের গোলটি করে দেবার অনুশীলন আমাদের দীর্ঘদিনের। এই ইলেকশান ইঞ্জিনিয়ারিং সাইকেল নিয়ে একদম ভাববেন না স্যার। চলে আমগো সাইকেল হাওয়ার বুকে দুইলা দুইলা।

এবার শিক্ষক একটা পিরামিড আঁকেন বোর্ডে। পিরামিডের শীর্ষে লেখেন, রিটার্নিং অফিসার। পিরামিডের নীচের দুটি প্রান্তে লেখেন সুখি সাংবাদিক সমিতি (সুসাস) ও সরকারি সেবক সংঘ (সসেস)।

শিক্ষক বলেন, ইলেকশান ইঞ্জিনিয়ারিং-এর মাধ্যমে পছন্দের প্রার্থীকে জিতিয়ে আনতে সবচেয়ে বড় ভূমিকা রিটার্নিং অফিসারের। প্রথমে মনোনয়নপত্র বাছাইয়ের সময় পোকা বেছে অপছন্দের প্রার্থীদের মনোনয়ন বাতিল; কিছুই না দেখে পছন্দের প্রার্থীদের মনোনয়নপত্র ওকে করে দেয়া। দ্বিতীয় ধাপে থাকছে, পছন্দের প্রার্থীর প্রচারণার সময় নির্বাচনী আইন ভঙ্গ হলে তা দেখেও না দেখার ভান করা। আর অপছন্দের প্রার্থীর প্রচারণায় পান থেকে চুন খসলেই শোকজ করা ওরফে কারণ দর্শানো নোটিশ ঝেড়ে দেয়া। নির্বাচনের দিন অপছন্দের প্রার্থীরা রিগিং বা ভোট ডাকাতির অভিযোগ আনলে, খতিয়ে দেখা হবে বলে গম্ভীর হয়ে থাকা। এই ভোট-চুরি-ডাকাতির পরের ধাপে আসে ফল চুরি। গাছ থেকে যেভাবে ছোট বেলায় আম-লিচু চুরি করতেন; ঠিক ওইভাবেই ভোটের ফলাফল চুরি করে ব্যাগে ভরে কেন্দ্রীয় ফলাফল ঘোষণা থিয়েটার মঞ্চে পাঠিয়ে দিতে হবে।

একজন রিটার্নিং অফিসার বলেন, এই ফলাফল চুরি পর্যন্ত প্রতিটি ধাপই ক্লান্তি দায়ক। আমাদের মেন্টর প্রয়োজন। পছন্দের প্রার্থীর পক্ষে সাবেক সামরিক, বেসামরিক কর্মকর্তা ও বর্তমানের উচ্চ পর্যায়ের অভিজ্ঞ ডাকাতদের পিরামিডের মাঝের ধাপে রাখতে হবে স্যার। কারণ এরা ভোট ডাকাতির অভিজ্ঞতাসম্পন্ন লোক। তাদের ডেসপারেশান, বিবেকহীনতা, নির্লজ্জতা, মোসাহেবি এসব উচ্চ মূল্যবোধ দেখে শেখার বিষয়। নির্বাচনের আগের দিনগুলোতে উনারা এসে কমলা লেবু চিবাতে চিবাতে যদি একটু অভিজ্ঞতা বিনিময় করেন, ইতিহাসের কোন নির্বাচনের ফল চুরি উনারা কী কী ভাবে করেছিলেন।

শিক্ষক মুগ্ধ হয়ে বলেন, ফার্স্ট ক্লাস। এমন মেধাবি ছাত্রই তো চাই।

এক সুসাস বলেন, আমাদের ভূমিকা কী হবে স্যার।

শিক্ষক বলেন, আপনাদের কাজ তো আদি ও অকৃত্রিম। টিভি টকশোতে অপছন্দের প্রার্থীদের ডেকে নাস্তানাবুদ করবেন। পছন্দের প্রার্থীকে ডেকে মিষ্টি মিষ্টি প্রশ্ন করবেন। তাদের ওপর দেবত্ব আরোপ করবেন। যাতে নির্বাচনের আগেই পছন্দের প্রার্থীদের আপনারা বেসরকারিভাবে নির্বাচিত ঘোষণা করতে পারেন। নির্লজ্জ হতে পারবেন তো!

সুসাস বলেন,লজ্জা-ঘৃণা-ভয়; সব করেছি জয়; আমাদের নিয়ে ভাববেন না স্যার।

একজন সসেস অভিমানের স্বরে বলে, আমাদেরকে একেবারেই গুরুত্ব দিচ্ছেন না স্যার!

শিক্ষক বলেন, ইলেকশান ইঞ্জিনিয়ারিং-এর হট ডগে সসেস তো লাগেই। সসেজও লাগবে। তাই সরকারি সেবক জনতা (সসেজ) নামের বুড়ো ভাম সদস্যদের সক্রিয় করেন। বুড়োদের মুখে ইতিহাস বেশী মানায়। সসেজদের তাদের পছন্দের প্রার্থীদের পক্ষের ইতিহাসে লাগসই বা এপ্রোপ্রিয়েট ন্যারেটিভ তৈরী করতে হবে। তাদের এই ঐতিহাসিক গ্র্যান্ড ন্যারেটিভে খারিজি প্রথায় অপছন্দের প্রার্থীদের ভোটের আগেই জনমন থেকে খারিজ করে দিতে হবে। দেশপ্রেম-ধর্মপ্রেম মিশিয়ে ককটেল বা মিক্সার বানিয়ে সকাল বিকাল ভোটারদের খাওয়াবেন তারা।

সসেস আরো মন খারাপ করে বলেন, তাহলে তো দেখছি স্যার আমাদের কোন ভূমিকাই নেই।

শিক্ষক বলেন, আপনারা হচ্ছেন মুখরোচক গালাগাল বিশেষজ্ঞ। দিনমান নানা বয়সের অপছন্দের প্রার্থীদের গালাগাল করবেন। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে আপনাদের খুব পছন্দের কলতলাটিকে খিস্তি-খেউড়ে অনুপম করে তুলবেন। আর পছন্দের প্রার্থীদের কীভাবে তেল দিতে হবে, তা নিশ্চয়ই নতুন করে বলে দিতে হবে না।

ক্লাস শেষ হবার মুহূর্তে ছাত্ররা একে একে শ্রেণীকক্ষ থাকে বেরিয়ে যাবার সময় শিক্ষক এক রিটার্নিং অফিসারকে ডেকে বলেন, আমার ভোটপ্রার্থী ভাগ্নেটির দিকে খেয়াল রেখো বাছা। জীবনে কিছুই তো করতে পারলো না সে। এবার ভোটে জিতলে বেঁচে যাই। ভাগ্নেদায়গ্রস্ত এই মামাটির কথা ভুলে যেওনা হে মেধাবি।

মাসকাওয়াথ আহসান। লেখক, শিক্ষক ও সাংবাদিক। 'শিল্পের জন্য শিল্প নয়, সমাজ-রাজনৈতিক উত্তরণের জন্য শিল্প' এই ভাবনাটিই মাসকাওয়াথ আহসানের লেখালেখির প্রণোদনা। নাগরিক বিচ্ছিন্নতার বিচূর্ণীভাবনার গদ্য ‘বিষণ্ণতার শহর’-এর মাঝ দিয়েই লেখকের প্রকাশনার অভিষেক ঘটে। একটি পাঠক সমাজ তৈরি হয় যারা নাগরিক জীবনের...

এই বিভাগের অন্যান্য লেখাসমূহ

বালির বেহালা

বালির বেহালা

বুড়িমাসি বলেন,জীবনটা বালির ঘর গো।ঢেউ এলে ধুয়ে যায় জীবনের মায়া।তবু বড় ভালবাসা ওদের দাম্পত্যে।রোদের চাদরের…..

তদন্ত

তদন্ত

  এক ড্রইং রুমে বসে রয়েছে সদ্য কিশোর উত্তীর্ণ তরুণ গোয়েন্দা সজীব। সামনের টেবিলে ছড়িয়ে…..