বিষ

দেবাশিস মুখোপাধ্যায়
গল্প
Bengali
বিষ

জগাই সাপুড়ে।সাপের খেলা দেখায়। এ গ্রাম -ও গ্রাম থেকে সাপ ধরার ডাক এলে সাপ ধরতে যায়। অভাব নেই ওর।অবশ্য ও বেশি চায়ও না।বাবা বলতো, বেশি চাইলেই মনে অশান্তি।ওর মোটা আয় হয়, ওষুধ কোম্পানির লোক সাপের বিষ কিনতে এলে। সেইজন্য ওর ঘরে বিষধর সাপও রাখা থাকে। কেউটে,গোখরে, চন্দ্রবোরাদের নিয়েই ওর যাপন । তবে ঐ বিষাক্ত সাপগুলো বাক্সে ভরে শক্ত করে বেঁধে রাখে। বাবার হাত ধরেই এ পেশায় ও। নিরক্ষর জগাই জানে এ পেশায় প্রতিযোগিতা নেই।তাই আয়ের ব্যাপারে নিশ্চিন্ত ও।
জগাই একাই থাকে। বিয়ে করা হয় নি। “করবো ,করবো “করে অনেক বসন্ত পেরিয়ে এসেছে ও। বন্ধুরা জোর করে মাঝে মাঝে। আসলে ব্যস্ত জগাইয়ের ফুরসৎ নেই।সাপ ধরার পরেই আছে গ্রামের মানুষের সেবা।বাবা বলত : “মানুষই ভগবান।তাই মানুষের পাশে থাকিস।দেখবি কখনো অসুবিধা হবে না”। হাসপাতালে রোগী ভর্তিতে তাই জগাই যেন বিপদতাড়ণ। হাসপাতালের সবাই চেনে জগাইকে। বড়ো বড়ো ওষুধ কোম্পানির লোকজন আসে যে ওর কাছে।
হঠাৎ একদিন পাশের গ্রামের এক মেয়ের সম্বন্ধ নিয়ে এলো বন্ধু বিলু । বাবা নেই মেয়েটার।মা বাতের রোগে শয্যাশায়ী।মেয়েটা বাড়ি বাড়ি কাজ করে সংসার চালায়। দেখতে বেশ।তাই অনেকের কু নজর আছে মেয়েটার ওপর। শুনে জগাই প্রথমে রাজি হতে চায় না।কারণ জানে ,ওর এই মধ্য যৌবনে অল্প বয়সী বিয়ে করা মানে সমস্যাকে নিমন্ত্রণ করে ঘরে আনা।বেশ তো আছে ও শান্তিতে ! বন্ধুদের কথা ও উড়িয়ে দেয়। কিন্তু বন্ধুরাও ছাড়বার পাত্র নয়।জগাই একা একা থাকে,এটা ওদের ভালো লাগে না। ওদের মতো জগাইয়েরও তো একটা সংসার হতে পারে ! বন্ধুদের দলে যোগ দেয় পাশের বাড়ির ঝর্ণা বৌদি।পুরুষ মানুষ একা থাকবে কেন? বুড়ো বয়সে দেখবে কে নিজের লোক না থাকলে? ক্রমাগত চাপে জগাই একসময় রাজি হয়। সকলের বিপদে আপদে যে মানুষটা ঝাঁপিয়ে পড়ে,তার সুখে সকলেই খুশি। অতঃপর একটা শুভ দিনে নতুন মানুষ ঘরে এলো জগাইয়ের।বউ চাঁপা বেশ মিষ্টি দেখতে।ভারী বুকের শরীরে একটা মাদকতা আছে যেন !
জগাইয়ের সংসার বেশ ভালোই কাটছিল। সকালে পান্তা খেয়ে বেড়িয়ে যায় কাজে। দুপুরে আবার দুজনে একসাথে খাওয়া। বিকেলে কোন সময় ডাক এলে যায়। নাহলে বউয়ের সাথে গল্প করেই কাটায় সময়।জগাইয়ের জীবনে বেশ ভালোলাগা এখন। সারা দিন মন পড়ে থাকে বাড়িতে।বউয়ের মুখ মনে পড়ে খুব।একেই কি ভালোবাসা বলে? বন্ধুরা মুচকি হেসে বলে , এ রোগের নাম লাভেরিয়া ‌!
জগাইও ওদের হাসিতে যোগ দেয়। মনে মনে ওর প্রার্থনা, এমনি করে যায় যদি দিন যাক্ না।
কিন্তু মানুষ ভাবে এক, ঈশ্বর করেন আর এক।মাস ছয়েক যেতে না যেতেই চাঁপার ব্যবহারে পরিবর্তনটা চোখে পড়তে লাগলো।আগের মতো সে ভালোবাসা আর নেই যেন !
চাঁপার শরীর আগের মতো সুরে গায় না আর। পাশের বাড়ির ঝর্ণাবৌদি একদিন এক ভয়ের খবর দিল।জগাই কাজে বেড়োলে চাঁপাও সেজে গুজে বেড়িয়ে পড়ে।পাড়ার লোকেরা বলে, দত্তদের বাগান বাড়িতে যায়। দত্তদের ছোটো ছেলে পাপানের সাথে নাকি চাঁপার বাজে সম্পর্ক আছে।জগাইয়ের মাথা ঘুরে যায়।দেওয়াল ধরে বসে পড়ে।ভেতর থেকে একটা কি যেন বেড়িয়ে আসতে চাইছে !টলতে টলতে এগিয়ে যায় বাড়ির দিকে।
ওর মাসতুতো দাদার কথা মনে পড়ে। বৌদি ঐরকম অভিসারে যেত দাদা অফিস বেড়োলেই। শেষে একদিন ছোট্ট ছেলেকে ফেলে পালায় বৌদি। দাদা সেই থেকে লজ্জায় ঘেন্নায় কুঁকড়ে থাকে।মেশেও না কারো সাথে।জগাই কিন্তু কিছুতেই মেনে নেবে না এ বিশ্বাসঘাতকতা। এর শেষ দেখে ছাড়বে।
পরদিন যথারীতি খেয়ে দেয়ে বের হলো কাজে।এদিক ওদিক একটু ঘুরে বাড়ি ফিরে এলো।দেখলো , চাঁপা নেই। ঘরে তালা ঝুলিয়ে অভিসারে।আগুনজ্বলা বুকে ও গিয়ে পৌঁছাল দত্তদের বাগান বাড়িতে। পাঁচিল টপকে ভেতরে ঢুকে সোজা কোণের ঘরটার দিকে এগিয়ে চললো। ভেতরে চোখ যেতেই আঁতকে উঠলো ও। চাঁপা ও পাপানের নগ্ন শরীর সুখ মন্থনে।শিৎকারের আওয়াজে আলিপ্ত আনন্দ ঢেউয়ে ওরা যেন। বুকে বিস্ফোরণ জগাইয়ের। ছিটকে ঢুকলো ঘরে। ওরা যেন ভুত দেখছে ওকে দেখে।হিড়হিড় করে টানতে টানতে নিয়ে চললো চাঁপাকে বাড়ির দিকে। সকলে দেখে বুঝলো সব। পাড়ার মধ্যে এক বিবাহিতা স্ত্রীর ঐ শরীরলালসা কেউই ভালো ভাবে নেয়নি।জগাইয়ের মতো মানুষের জীবনে কেন বিশ্বাসঘাতকতার বিষ ঢালছে চাঁপা?
রাতে জগাই শুলো মেঝেয় সাপের বাক্স গুলোর পাশে। বাক্সগুলো ঠিক করে দেখে নিলো ও। এমনিতে দড়ি দিয়ে শক্ত করে বাঁধা আছে।কাল ওষুধ কোম্পানির লোক আসবে। একবুক জ্বালা নিয়ে জগাই জেগে রাইল রাতজাগা তারার মতো। চাঁপা শুয়ে বিছানায়। ঘুমিয়ে গেছে বোধহয়।জগাইয়ের বড়ো অসহায় লাগতে থাকে।কি করবে ও এখন? কোথায় যাবে? নিশুতি রাতে ও ঘর ভাঙগার শব্দ শুনতে লাগলো চোখের জলে।
ভোরের দিকে কখন ঘুমিয়ে পড়েছে খেয়াল করে নি। হঠাৎ একটা কিসের কামড় পায়। জ্বালা করছে সারা শরীর।অবশ হয়ে আসছে যেন। উঠে বসে দেখলো, কেউটে সাপের বাক্সটা খোলা।জগাই বুঝলো ও নিশ্চিত মৃত্যুর কোলে।মুখ দিয়ে গ্যাজলা বের হচ্ছে। ঘরের দরজা খোলা। বুঝলো ,চাঁপা ওর মৃত্যুর আয়োজন সম্পূর্ণ করে পালিয়েছে। কেউটের মিশকালো শরীরটা এঁকে বেঁকে এগিয়ে চলেছে দরজার দিকে। ঘোলাটে চোখে জগাই দেখল আস্তে আস্তে সাপের মুখটা চাঁপার মুখে বদলে যাচ্ছে।

দেবাশিস মুখোপাধ্যায়। কবি। জন্ম ভারতের পশ্চিমবঙ্গরাজ্যের কলকাতার কুলটিতে এবং বর্তমান নিবাস হাওড়ার বাগনান। তাঁর কবি জীবন শিশুকাল থেকে। কলকাতার ইন্দ্রাণী পত্রিকায় ১৯৮৩ সালে দশম শ্রেণিতে লেখাপড়াকালীন তাঁর প্রথম কবিতা প্রকাশ হয়। প্রকাশিত বই: কবিতার একখণ্ড মুখ, আজকাল পরশুর গল্প, শূন্য কিন্তু শূন্য নয়, ভূমিকা প্রেমের...

এই বিভাগের অন্যান্য লেখাসমূহ

বালির বেহালা

বালির বেহালা

বুড়িমাসি বলেন,জীবনটা বালির ঘর গো।ঢেউ এলে ধুয়ে যায় জীবনের মায়া।তবু বড় ভালবাসা ওদের দাম্পত্যে।রোদের চাদরের…..

তদন্ত

তদন্ত

  এক ড্রইং রুমে বসে রয়েছে সদ্য কিশোর উত্তীর্ণ তরুণ গোয়েন্দা সজীব। সামনের টেবিলে ছড়িয়ে…..