ভয়ঙ্কর অল্পবিদ্যা

মতিয়ূর রহমান
প্রবন্ধ
Bengali
ভয়ঙ্কর অল্পবিদ্যা
দায়িত্ব নিলেই দায়িত্ব, না নিলে  কিছুই না । এই লেখাটা ব্যক্তিগত পাণ্ডিত্য ফলাবার জন্য নয় । তাই শুরুতেই কথাটা একদম স্পষ্টভাবে বলছি -ওই জিনিসটা আমার বিন্দুমাত্র নেই ।
আমি মনেপ্রাণে বিশ্বাস করি সেই সমাজ, পরিমন্ডল ও আবেষ্টনীই হল উৎকৃষ্ট যেখানে সবসময় বাবার উপর বাবা মেলে এবং পণ্ডিতের উপরেই পণ্ডিত ।
” বন দেশের  যামঘোষ নৃপতি”-  র পরিবেশ, পরিমণ্ডল ও আবেষ্টনীতে আমার ভয়ানক দমবন্ধ লাগে, তাই তা অসহ্যও ।
বাংলাভাষা, বর্তমান শিক্ষা ও ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য মনে হল ক’টি কথা বলা দরকার।
হয়তো আমার চোখে পড়েনি কিন্তু অন্যকেউ যদি কোথাও এ বিষয়ে কিছু বলে থাকেন বা লিখে থাকেন আমি তাঁদেরকে আমার শ্রদ্ধা ও কৃতজ্ঞতা জানালাম।
প্রতিদিন যে সমস্ত লেখা দেখি বা বলা যায় দেখতে হয় তার মধ্যে এমন সব বোমা থাকে যা শুধু চোখের দেখাটি দেখলেই পিলে চমকে যায় । একটা বিশেষ সংকটও তৈরি হয় এবং প্রশ্নও জাগে-
“কোনটা বাংলাভাষা ?  বিশেষকরে  লেখার ক্ষেত্রেই   ৷ “
আমি যেটা জানি সেটা, না আমার শুভানুধ্যায়ীরা যেটা জানে সেটাই !  তাই এই লেখা । তার বাইরে অন্য কোন অভিপ্রায় নেই বাবুমশাইরা ।
সবকিছু মারাত্মক রকমের ঘেঁটে গেলে লোকে বলে – ” ঘেঁটে – ঘ ” । কদিন আগে বিশ্ববিদ্যালয়ের এক অধ্যাপিকা এই মাধ্যমে এই বিষয়ে আক্ষেপ করেছেন । সেদিনই ঠিক হয়েগেল এ বিষয়ে এই অক্ষম কিছু লিখবে ।  যাইহোক  ‘র’ আর ‘ড়’ যখন মারাত্মকভাবে ঘেঁটে যায় তখন গলা দিয়ে আর শব্দ বার হয়না । কেবল ঘড়ঘড়ানিটাই ওঠে এবং জনগণ তা বুঝতেও পারে ।
শুধু ‘র’ বা ‘ড়’ নয় এই জাতীয় অন্যান্য বর্ণ, যেমন –  ‘ণ ‘  ‘ ন’,  ‘ত’  ‘ৎ’, ‘জ’ ‘য’ কিম্বা ‘শ’ ‘স’ ও ‘ষ’ ইত্যাদি বর্ণগুলো যখন ঝড়ের কুটোর মতো প্রবলভাবে পাক খেতে খেতে একে অপরের সাথে গুঁতোগুঁতি করে স্রেফ ইচ্ছেমতো যেখানে সেখানে বসেপড়েই শব্দ তৈরি করে তখন মনেহয় ভাষার কুম্ভীপাক নরকেই পাক খাচ্ছি  ।
ইদানীং আমি কেমন আছি বা কী করছি অনেকেই তার খোঁজখবর নেন । একদিন রাতজেগে লিখছি এক শুভাকাঙ্ক্ষী ‘ইনবক্সে’ খোঁজ নিলেন –
–  ” খেএছেন ?  “
আমি –  কী ?
শুভাকাঙ্ক্ষী –   ভাত খাওআ হয়েছে কীনা যানতে চাইছি ।
আমি –  এই রে খেয়েছে !
শুভাকাঙ্ক্ষী  –  কীছু কী বললএন ?
আমি –  কিছুই না, ও অন্যকথা । মনেমনে বিড়বিড় করলাম – খাবো আর কীভাবে বাক্যের ঘূর্ণিঝড়ে হাত-পা যে ঠান্ডা হয়ে যাচ্ছে ! প্রকাশ্যে লিখলাম- বলুন, আপনি কী বলছিলেন ।
শুভাকাঙ্ক্ষী –  না, বোলছি যে, ঝরের মধ্যে বারি ফিড়লেন কখোন ?
আমি –   বারি ?  কই আজ তো কোন বারিপাত হয়নি! ঝড় অবশ্য হয়েছে ।
শুভাকাঙ্ক্ষী – তাই তো বোলছি, জা গরম, রাতে যদি ঝড়ঝড় করে বিস্টি হয় তো বাঁচি ।
আমি –   চিন্তা করবেন না । বাঁঁচবেন, অবশ্যই বাঁচবেন। ‘ঝড়ঝড়’ করে বৃষ্টি যদি নাও হয় ‘ঝরঝর’ করে ঝড় উঠবে এবং ‘করকর’ করে বাজও  পড়বে ।
শুভাকাঙ্ক্ষী  – ঠীক আছে, রাত যাগবেন না, তাড়াতারি সুয়ে পরুন ।
ভাবলাম শুয়ে তো পড়বোই কিন্তু যে ভাষায় কথা হচ্ছে তাতে কোনদিনই কি আর উঠে দাঁড়াতে পারব !
বাংলা বর্ণমালার জনক প্রাতঃস্মরণীয় বিদ্যাসাগর মহাশয় স্বরবর্ণ ও ব্যাঞ্জনবর্ণ উভয়ের জন্য যে বর্ণগুলি নির্ধারণ করেছিলেন তা বিনা কারণে করেছেন বলে যারা মনে করে আমার ধারণা তারা বিদ্যার সাগরের থেকেও বেশি বিদ্বান ।
বাংলা বর্ণমালার প্রতিটি বর্ণের একক এবং সম্মিলিত সঠিক প্রয়োগের উপর দাঁড়িয়ে আছে প্রামাণ্য বাংলাভাষার  শব্দভাণ্ডার ও তার লিখিত রূপ ।
শব্দের সুনির্দিষ্ট অর্থের জন্য নির্দিষ্ট বর্ণের উপস্থিতি একান্তভাবে জরুরী । নির্দিষ্ট বর্ণটিকে বাদ দিয়ে তার জায়গায় অন্য বর্ণ বসলে বা বসালে কাঙ্ক্ষিত শব্দটির ছুটি হয়ে যায় এবং  সেই স্থানে অবতীর্ণ হয় সম্পূর্ণ ভিন্ন ও নতুন এক শব্দ । যার ফলে বাক্যের অর্থ এগারোটার ডানদিক থেকে সরে  বারোটার দিকে চলে যাবেই । অর্থ বদলানো সেই বাক্যের জন্য ভাষার বারোটা বাজে কিনা তা অবশ্য আমি বলতে পারব না ! কেননা আমি পণ্ডিত না।  তবে পণ্ডিত ও সুধীজনে অবশ্যই তা বলতে পারবেন ।
বর, বড় / পড়া,পরা/ জোর, জোড়  – এইরকম অজস্র সাধারণ শব্দে – নির্বিচারে ‘র’ -এর স্থানে ‘ড়’ অথবা ‘ড়’ এর স্থানে ‘র’ বসালে কিম্বা অন্যকোন শব্দেও সুনির্দিষ্ট বর্ণের স্থানে সম বা প্রায় সম উচ্চারণের অন্য বর্ণটি বসলে বা বসালে তার ফলাফল হয় মারাত্মক ।
গায়ের জোরে তৈরি সে সংকর ফল (Hybrid fruit) পুরোপুরি অখাদ্য ও পরিপাকের অযোগ্য। ভগবান শংকর তা হজম করতে পারবেন কিনা তা ভগবানই জানেন। দেখুন তো নিম্নোক্ত বাক্যটি হজম করা যায় কিনা –
” পাখিরা নীর বাঁধে এবং ডিম পারে ।”
যমের অরুচি এক লেখক ( ঠিক আমারই মতো ) এই সেদিন একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন তুলেছে  –
” জমালয়ে কেন মানুস যীবন্ত অবস্থায় জেতে পাড়বে না ?  “
উত্তর দিলাম  –  কোন অসুবিধা নেই, পথঘাট একেবারেই সোজা । সটান চলে যাওয়া যায়। যেভাবে এগোচ্ছ ঠিক সেভাবে নাক বরাবর অগ্রসর হলেই নির্ভুলভাবে পৌঁছে যাবে সেখানে ।
যাদের মাতৃভাষা বাংলা এবং যারা নিজেদেরকে মোটামুটি শিক্ষিত লোক ভাবে তাদের লেখায় বারংবার এই সমস্যা দেখা দিলে যতটুকু ভাষাবোধ জন্মেছে তার গাত্রে একটা প্রদাহ হয়। তখন মনেহয় তথাকথিত অশিক্ষিত জনেরা অপভাষায় কথা বললেও তারা কিন্তু ভাষাদূষণ করতে সক্ষম নয় । তারা শুধু মুখেই বলে কিন্তু কোথাও কোন আঁচড় কেটে তা পাকা  করে না । তারসাথে একথাও মনে হল  যে, তথাকথিত শিক্ষিতজনেরা কলম দিয়ে একটি প্রামাণ্য ভাষা এবং তার  লেখাতে বলাৎকার করতে একেবারে বিশেষভাবে পারঙ্গম। মানে বিশেষভাবে বিজ্ঞ । কোন সন্দেহ নেই এইসব হাজার হাজার নির্দয় নব বিদ্যাসাগরেরা অচিরেই আসল দয়ার সাগর বিদ্যাসাগরের নামটাই ভুলিয়ে ছাড়বে । ইত্যবসরে সে কাজ বেশ সুচারুভাবে এগিয়েছেও ।
প্রাত্যহিক জীবনে অনেকেই নিশ্চয়ই তা টের পান বা পাচ্ছেন ।
এমন একটা বিষয় নিয়ে এবারের লেখা যে বহুলোক এবার আদর করে আমাকে তাদের ‘খোকার মামা’ বা তারও বেশি কিছু বললেও বলতে পারে । জনগণের বাকি অংশ বিশেষ কারণেই যারা সেটা বলতে পারবে না তারা  ‘পোড়ারমুখো’ টাইপের কিছু একটা ভালোমন্দ সম্বোধন যে করবে সে বিষয়ে আমি একেবারেই নিশ্চিত, যাকে বলে  damn sure .
যে যা পারে বলুক তাতে কিছু যায় না- আসেও না। শুধু একটি কথা –  কুঁজো বলে চিৎ হয়ে শয়ন করার ইচ্ছাটি কি একেবারেই ত্যাগ করব ?  বিশেষত চিৎ শয়নের আরাম ও উপকারিতা সম্পর্কে দু’চার কথা যখন বলে গেছেন বাপ- ঠাকুরদায় ।  অধমের কলমেও অনেক বিকৃতি ও অনেক বাঁক । তবে ভরসা এই যে, অষ্টবক্র মুনিও উপদেশ দিতেন । ধরেনেওয়া যেতেপারে এ তেমনই এক ইচ্ছে , কুঁজোর চিৎ হয়ে শয়ন করার ভয়ঙ্কর বিপজ্জনক ইচ্ছে ।
যতদূর স্মরণ করতে পারি মাত্র চার দশক আগে এই রাজ্যে মাধ্যমিক পরীক্ষার্থীর সংখ্যা ছিল চল্লিশ হাজারের একটু এদিক ওদিক । আজকের দিনের তুলনায় সংখ্যাটির সামনে একটি ‘মাত্র’ শব্দের উল্লেখ থাকা আবশ্যিক ছিল । আমরা সবাই জানি এ বছর এই রাজ্যে মাধ্যমিক পরীক্ষার্থী সংখ্যা দশ লাখ ছেষট্টি হাজার । সেদিনের তুলনায় সাতাশ গুণেরও বেশি ।
ক্রমবর্ধমান পরিসংখ্যান বলছে পরিবারে, সমাজে, রাজ্যে ও দেশে শিক্ষার হার বেড়েছে ও বাড়ছে দ্রুত ও ব্যাপকভাবে । তার সাথে শিক্ষিত মানুষজনের সংখ্যা ব্যাপক হারে বেড়েছে কিনা বা বাড়া উচিত ছিল  কিনা এবং সেই প্রশ্ন থাকা উচিত কিনা তা অবশ্য বলতে পারেন দেশের  মানুষ ।
আজকাল এমন কোন বাড়ি বা পরিবার নেই যেখানে মাধ্যমিক, উচ্চমাধ্যমিক কিম্বা বিশ্ববিদ্যালয়ের ডিগ্রিধারী মানুষ নেই । ঘোরাফেরার নিত্যদিনের যে জগৎ ও বৃহত্তর সামাজিক অঙ্গনের পরিসরেই তো এমনটাই দেখি। সবারই ডিগ্রি আছে ।
কিন্তু সেই শিক্ষাটি কেমন এবং তার স্বরূপটিই বা কী তা বুঝতে চাইলে একটা অভ্যন্তরীণ গোলযোগ শুরু হয়  ভেতরে ভেতরে ।
রাস্তাঘাটে, অফিস-আদালতে, স্কুল-কলেজে, সমাজে, সোস্যাল মিডিয়াতে    ও ব্যক্তিগত পরিসরেই যা দেখি তাতে মনেহয় এতএত সব ডিগ্রিধারীর মাঝে এমনটিই বা হয় কীভাবে  !
বাংলা মাধ্যমে যারা শিক্ষা নিল তাদের তো ভাষাটা দেখতে, শুনতে, লিখতে ও পড়তে হয়েছে । তাহলে এমন হয় কী করে আর কীভাবে  ?
বিদ্যের জাহাজ হয়েগেছি এমন ভাবনা কোনদিনও ছিলনা এবং  নিকট ভবিষ্যতে হওয়ারও বিশেষ কোনো সুযোগ- সুবিধা আছে বলে মনেও করি না ।
এত এত বছর পরও বিদ্যালয় পাঠক্রমের সেই কবিতাটা কোথায় যেন একটা হাতুড়ি পেটাতে থাকে ।
সুকুমার রায়ের কবিতা –
” ষোল আনাই মিছে “
মনে পড়বে নিশ্চয়ই সবার –
” বিদ্যে বোঝাই বাবুমশাই চড়ি সখের বোটে,
মাঝিরে কন, ” বলতে পারিস সূর্যি কেন ওঠে ?”
অনেকেই জানেন বিখ্যাত এই কবিতাটি ।  তাই বিদ্যাবুদ্ধির গরিমা নেই । থাকা উচিতও না ।
আমি মনেকরি ওটি আকাট মূর্খের একেবারে নিজস্ব সম্পত্তি । তার ভাগীদার কোনদিনই ছিলাম না, ভবিষ্যতেও হব না ।
বিশেষত প্রবল তো বটেই, ছোটখাটো ঝড় উঠলে কী করে বাঁচাতে হয় সেটা যখন জানিনা তাহলে আর কীইবা জানি ! ধরা যেতেপারে কিছুই জানিনা এবং বস্তুত তা-ই – সত্যিই তো কিছুই জানি না  ।
জীবনটা যেখানে কেবল চারি আনা, অষ্ট আনা অথবা বারো আনাই নয় একেবারে ষোল আনাই মিছে সেখানে ওইসব কথা বলা পুরোপুরি আহাম্বকি ছাড়া আর কিছু না ।
তবুও এতসব কথা মাথায় রেখেই কিছুকথা মনেহয় বলা দরকার । না বললে যেন ভীষণ এক অপরাধবোধ কাজ করে ।
একটা জিনিস বিশেষভাবে লক্ষ্য করেছি তাহল –  মানুষ, তা সে যেমন মানুষই হোক আর তার শিক্ষা-দীক্ষার স্তর যাহোক বা যেমন হোকনা কেন – সে কিন্তু তার মনেমনে বিশেষ এক আকাঙ্ক্ষাকে লালনপালন করে । আকাঙ্ক্ষাটি আর কিছুই না, সে চায় আমি নিজে যা হইনা কেন আমার সন্তান যেন মস্তবড় বিদ্বান আর পন্ডিত হয় । তার অজানা যেন না থাকে কোন বিষয় বা কোনো কিছুই ।
ভালো কথা, এ তো সেই কোনকালে কবি ভারতচন্দ্র রায়গুণাকরের  অন্নদামঙ্গল কাব্যের মাঝি ঈশ্বরী পাটনীর মনেরই কথা  –
“আমার সন্তান যেন থাকে দুধে-ভাতে” – সন্তান দুধে-ভাতে থাকবে কিম্বা জ্ঞানে-গুণে ও মানে-সম্মানে মস্ত বড় হবে এ-তো জনকজননীর চিরকালের আকাঙ্ক্ষা। এব্যাপারে সব মা-বাবাই তো একেকজন ঈশ্বরী পাটনী । সন্তানকে জ্ঞানীগুণী এবং বড়মানুষ রূপে দেখতে চাওয়াতে তো কোন দোষ নেই । কিন্তু প্রশ্ন হল – এই কোটি কোটি ঈশ্বরী পাটনীর আরো কোটি কোটি সন্তানকে জ্ঞানীগুণী বা দিগ্ গজ করবে কে বা কারা ? কে দেবে তাদের সাঁতারের শিক্ষা ?  যে আদৌও সাঁতারটি জানে না, সেই  ?
এই পৃথিবীতে মানুষ ছাড়া কোটি কোটি জীবের ততোধিক কোটি কোটি  অপত্য জন্মাবার পরেপরেই তারা  জীবধর্মটি আয়ত্ত করে ফেলে বিনা শিক্ষায় এবং বিনা গুরুতেই । কিন্তু মানুষ হল একমাত্র ব্যতিক্রম  যার জীবধর্ম, সংসারধর্ম, অধ্যাত্মধর্ম ,
জীবনদর্শন ও নির্দিষ্ট বিষয়ভিত্তিক বিদ্যা বা জ্ঞান সবকিছুর জন্য তার চাই গুরু বা শিক্ষক ।
শিক্ষাদানের সেই কাজটি পিতামাতার দ্বারা হতেপারে। অন্য কারো দ্বারাও হতেপারে । যার দ্বারাই হোকনা কেন সে যদি অযোগ্য আর স্বল্প বিদ্যার  হয় তাহলে তার তৈরি শিক্ষার্থীটি হবে অদক্ষ কুম্ভকারের হাতে তৈরি মাটির কলসির মতো তোবড়ানো ও ট্যারা বাঁকা । যে পরিমাণ জল তার বহন করার কথা ছিল তা সে কিছুতেই বইতে পারবে না।
ব্যক্তির বা সমষ্টির জীবনে শিক্ষা প্রথাগত শিক্ষার বাইরে থেকেও আসতে পারে যদি তার চারপাশের সমাজ ও পরিবেশটি হয় সুশিক্ষিত । অর্থাৎ সে কেবল দেখেই শিখে যাবে  অনেককিছু । আর উল্টোটি হলে তার ফলাফলও হবে উল্টোই  ।
মোদ্দা কথা হল একটি সমাজের বেশিরভাগ মানুষ যদি অল্প জানে আর ভুল জানে তাহলে পিতামাতার  সেই মহার্ঘ আশা-আকাঙ্ক্ষা ও স্বপ্নটি পূরণ হওয়ার আর কোনো রাস্তা থাকে না। সংকীর্ণ হতে হতে তা ক্রমশ হয়ে  যায় সংকীর্ণতম । তাই স্বপ্নটিও থেকে যায় চির অধরা ।
আমার মতো ‘ফেবু’ সাহিত্যিকদের কথা নাহয় ছেড়েই দিলাম কিন্তু যারা জাতির মেরুদণ্ডকে সোজা আর শক্ত করবে বলে চালক, পরিচালক ও গুরু হয়েছে এবং যারা ঘুমালে শিক্ষা ও সংস্কৃতির গতিশীল যানটি চৌপট হবে তাদের ভাতঘুমটি ভাঙাবে কে ?
ভুলে ভরা দিস্তা দিস্তা খাতায় নম্বর পড়ছে কিলো কিলো কারণ সেই বানান সঠিক না বেঠিক তা যিনি খাতা কাটছেন (খাতা দেখছেন বা পরীক্ষা করছেন তা নয়, আজকের ভাষায় ‘খাতা কাটা ‘। ঘাস কাটার মতো ব্যাপার আরকি!  ) তিনিও জানেন না । আর অভিধান দেখে বানান কাটার চেয়ে ঘোড়ার জন্য ঘাসকাটা অপেক্ষাকৃত কম ক্লেশকর । তার উপর সেকাজ করলে পরীক্ষার ফল প্রকাশও আর সেবছরে হবে না ।
ইতিহাস, ভূগোল ও বিজ্ঞান ইত্যাদি  বিষয়ের কথা নাহয় বাদ দেওয়া গেল। অনেকের মতামত হল সেখানে নাকি বানান ভুল করলেও কিছু আসে যায় না। কিন্তু আমি মনেকরি সেখানে যদি সে ক্ষমার অযোগ্য ভুলটি লেখে তাহলে সঠিকটা কবে আর কোথায় সে লিখবে ?
সে নাহয় হল – কিন্তু বিষয় যখন  ” মাতৃভাষা বাংলা ” ?  নিচের দিকের কথা নাহয় বাদ দেওয়া গেল কিন্তু যাকে বলে ‘স্ট্যান্ডার্ড’ বা ক্লাসটি যদি হয় অনার্স কিম্বা এম.এ  এবং পরীক্ষার খাতাতে যদি দেখা যায় কুরুক্ষেত্রের লাসের মতো ভুল বানান ও ভুল শব্দরা সব রক্তাক্ত হয়ে নিঃশব্দে পড়ে আছে তখন করণীয় কী ?
ভুল আমারও হয় । ভুল হয়না কার ?
কিন্তু ভুলগুলো একেবারেই অনাথ হবে কেন ! তারও তো একটা মা-বাপ থাকা উচিত  !
শব্দ বদলে যাওয়া ভুল বানানকে লঘু করে দেখলে ভাষাটা আর ভাষা থাকে না । যারা বলেন – ভাষা হল বহতা নদী । এমনি বইতে বইতে সে তার জায়গা করে নেবে । তাদের কাছে আমার প্রশ্ন – পাখির বাসা যদি ‘ নীর ‘ হয়  এবং জলও যদি ‘নীর’ হয়  তারপর   ‘বই পরা’ ও ‘ জুতো পরা’ যদি শুদ্ধ হয় তাহলে বাংলাভাষার শব্দভাণ্ডারের জন্য যে উচ্চস্বরের শিল্পসাহিত্য ও সংগীত অদ্যাবধি সৃষ্টি হয়েছে তা আর সম্ভব হবে তো  ?  অবশ্য কাজ চলার মতো মাত্র গুটিকয়েক শব্দ শিখে জাতি যদি রামগড়ুরের ছানা হতে চায় তাহলে বলার আর কিছুই রইল না ।
কালাপাহাড়ি কাজকর্ম যে এই প্রথম আমরা করছি তা তো  নয় !
শেষকথাটি হ’ল  –
কোনভাবে যদি চিৎ হয়ে শোয়া আদৌ সম্ভব না হয় তবু্ও একজন কুঁজোর এটা মনেরাখা উচিত যে – চিৎ হয়ে শয়নটি কাকে বলে ।
অন্যথায় কুব্জের শয়নটি যদি আদর্শ বলেই গ্রহণযোগ্যতা পায় তাহলে  সুস্থদের মেরুদণ্ডের ঋজুতা নিয়েও প্রশ্ন উঠবে ।
জানি আমার ভুল ধরার জন্য এখন  এক কোটি চোখ এই লেখাটি স্ক্যান করবে ।
সেইসব চোখের মালিকদের উদ্দেশে বলি –  আমি সর্বাঙ্গ সুন্দর নই ।  তবে সোজা হয়ে শোয়ার ইচ্ছাটি আমার প্রবল । আসুন । রাস্তা যে বা যাঁরা দেখাবেন তাঁকে বা তাঁদেরকেই গুরু বলেই মানব সঠিকটি শিখব বলেই  ।
(নোট: সম্পাদনা পর্ষদ থেকে এই লেখা কোনো সম্পাদনা করা হয় নি। লেখার ভাষা ও বানানরীতি লেখকের একান্ত নিজের)

 মতিয়ূর রহমান। লেখক, প্রাবন্ধিক ও অধ্যাপক। জন্ম ভারতের পশ্চিমবঙ্গে। তিন দশকের বেশি সময় ধরে ভারতের পশ্চিমবঙ্গের সরকার পোষিত কলেজের উদ্ভিদ বিজ্ঞানের শিক্ষক। জীববিজ্ঞানের বিভিন্ন বিষয়, জীববৈচিত্র্যের সংকট ও পরিবেশ বিষয়ক নানা দিক ও নানা বিষয়ের গবেষণামূলক নিবন্ধ লেখক। আবার সমাজ,...

এই বিভাগের অন্যান্য লেখাসমূহ

নারীর আপন ভাগ্য জয় করিবার: নারীজাগৃতি ও রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের কবিতা।

নারীর আপন ভাগ্য জয় করিবার: নারীজাগৃতি ও রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের কবিতা।

নবজাগরণের সঙ্গে নারীর জাগরণ, নারীর মর্যাদা ও সুরক্ষা, এবং নারীমুক্তি ওতপ্রোতভাবে জড়িত। ভারতে এই নবজাগরণের…..