সার্টিফিকেট

সুদীপ ঘোষাল
ছোটগল্প
Bengali
সার্টিফিকেট

এক

গ্র্যাজুয়েট হওয়ার পরে আমি সার্টিফিকেট তুলতে পারি নি, নিজের অবহেলায়।চাকরির ব্যাপারে, সার্টিফিকেট প্রয়োজন হল।বন্ধু রঞ্জু বলল,তোর সবকাজে অবহেলা।তিনদিন ছুটি নিয়ে সার্টিফিকেট নিয়ে চলে আয়।আমি আর দেরি না করে তিনদিনের ছুটি নিয়ে লিলুয়া চলে এলাম।এখানে আমার জীবনের অনেকটা সময় কেটেছে।এখন লিলুয়ার বাড়িতে মেজদা,বৌদি আর ভাইপো থাকে।লিলুয়ার পটুয়াপাড়ায় কুড়িবছর আগে, আমরা ঘরভাড়া নিয়ে থাকতাম বাবার চাকরিসূত্রে।ভাড়া বাড়ির সামনে একটা কুলগাছ ছিল। টালির চাল। তখন চোর ডাকাতের উপদ্রব ছিল খুব। আমার বাবা সন্ধে হলেই দরজা জানলা বন্ধ করে দিতেন। আমরা চার ভাই। কিন্তু বড়দা গ্রামের বাড়িতে কাকাবাবুর কাছে থাকতেন। বাবার কাছে থাকতাম আমরা তিনভাই। বিশ্বকর্মা পুজোতে ঘুড়ি ওড়াতাম। দোলে রঙ মাখতাম উল্লাসে। তখন আকাশ এত খোলা ছিল, পুকুর ছিল। শীতকালে পুকুরের জল শুকিয়ে গেলে আমরা মাঠ তৈরি করে খেলতাম। ঝুড়ি, কোদাল নিয়ে পুকুরের তলা সমান করে ক্রিকেট খেলার পিচ বানাতাম। কবাডির কোর্ট বানাতাম দাগ দিয়ে। সকালে ছুটির দিনে কবাডি খেলতাম ছেলেমেয়ে একসাথে। একটা মেয়ের তনু নাম ছিল।তার সঙ্গে আমি কবাডি খেলতে পারতাম না। কত বন্ধু। তাদের সঙ্গে পড়াশুনোয় চলত কম্পিটিশন। কিন্তু বাইরে বন্ধু। বিকেলে ক্রিকেট খেলতাম। শটিবনের জঙ্গল ছিল পুকুরের পাড়জুড়ে। সেখানে লুকোচুরি খেলতাম। মনে পড়ছে, পাইস্যারের কথা।
লিলুয়াশহরের পটুয়াপাড়ায় আমাদের বাসা ছিল।পটুয়াপাড়ার আমার বন্ধু সৈকত, তার স্কুলবেলায় বিজ্ঞানের স্যারকে খুব ভালবাসত।আমারও স্যারকে খুব ভালো লাগতো। আমাদের অন্য বন্ধুরা বলত, পাগলা স্যার। সৈকতের খুব রাগ হত। সে বলত, এইরকম পাগল হাজার হাজার প্রয়োজন আমাদের শিক্ষার জন্য।বিজ্ঞান স্যারের নাম ছিল পাই স্যার। মার্চ মাসে বিজ্ঞানী আইন স্টাইনের জন্ম। এই বিজ্ঞানীর জন্মদিনে খুব মজা করে বিজ্ঞান বোঝাতেন স্যার। তিনি একবার বলেছিলেন, ছোটবেলায় আমরা সৌরজগতের গ্রহগুলো কে সূর্যের থেকে কত দূরে শিখেছিলাম। পৃথিবীর থেকে সূর্য পনেরো কোটি কিলোমিটার দূরে। কিন্তু মুশকিল হল এই‘পনেরো কোটি কিলোমিটার’–টা কতদূর তার ধারণা আছে নাকি আমাদের? তোমার স্কুল আর মামার বাড়ির দূরত্ব কত, বলতো সৈকত।সৈকত বলল, স্যার তিন’কিলোমিটার হেঁটে স্কুল যেতে মিনিট কুড়ি লাগে। একশো কিলোমিটার দূরে মামার বাড়ি যেতে বাসে ঘন্টাখানেক লেগে যায়। অমর বলল, আমার মামা দিল্লিতে থাকেন। কলকাতা থেকে দিল্লীর দূরত্ব দেড় হাজার কিলোমিটার – প্লেনে যেতে লাগে ঘন্টা দেড়েক কি দুয়েক। স্যার বললেন,তাহলে দেখ, এই একশোকিলোমিটার বা দেড় হাজার কিলোমিটার দূরত্বের সাথে আমাদের অভিজ্ঞতা দিয়ে একটা সম্পর্ক তৈরি হল। কিন্তু পনের কোটি?সেটা কত বড় সংখ্যা তা বুঝি নাকি? সুতরাং, সূর্য থেকে পৃথিবীর দূরত্ব আমাদের কাছে একটা মুখস্থ করার সংখ্যা হিসেবেই রয়েগেল, অনুভূতি বা‘ইনটুইশন’–এ সাথে যুক্ত হল না। আবার এই দূরত্বের সাপেক্ষে পৃথিবী কত বড়, সূর্যই বা কত বড়, তাও মনের মধ্যে ছবি হয়ে রইল না!এই ধরণের নতুন তথ্যকে আমাদের অনুভূতির সাথে যুক্ত করা যায় অনেকভাবে। যেমন, একটা উড়োজাহাজ যার কলকাতা থেকে দিল্লী যেতে এক-দেড় ঘন্টা লাগে, তার কতক্ষণ লাগবে একই বেগে পৃথিবী থেকে সূর্য যেতে? উত্তরটা সহজেই দূরত্বকে গতিবেগ দিয়ে ভাগ করে পাওয়া যাবে – প্রায় সতের বছর! আবার ব্যাপারটাকে অন্যভাবেও ভাবা যায়। ধরা যাক, পৃথিবীর সাইজ একখানা পাঁচ সেন্টিমিটার ব্যাসের রাজভোগ কি রসগোল্লার মত। তাহলে এই স্কেলে সূর্য কত বড় আর কত দূরে হবে? অমর বলল,অঙ্কটা চট করে কষতে পারব ঐকিক নিয়ম লাগিয়ে।স্যার বললেন, হ্যাঁ পৃথিবীর ব্যাস মোটামুটি ১২,৮০০ কিলোমিটার,সেটাকে ছোট করে ৫ সেন্টিমিটার করে নাও। তাহলে পনেরো কোটি কিলোমিটার হবে ‘৫ সেন্টিমিটার X ১৫ কোটি / ১২,৮০০’ সমান প্রায় ৬০০ মিটার। এবার কিন্তু সৌরজগত সম্বন্ধে আমাদের একটা ধারণা তৈরি হল। মনে মনে একটা ছবি বানিয়ে নিলাম যে আমার টেবিলের উপরের রসগোল্লাটা পৃথিবী, আর মিনিট পাঁচ–ছয় হেঁটে গেলে সূর্যকে পাব। কিন্তু সূর্য তো বিন্দু নয়! তার ব্যাস প্রায় চোদ্দ লাখ কিলোমিটার। তাহলে আবার ঐকিক নিয়মে দেখে নেব যে আমাদের উদাহরণে সূর্য হবে প্রায় সাড়ে পাঁচ মিটার মানে মোটামুটি একখানা বড়সড় ঘরের মত। ঘরের মত চৌকো নয় অবশ্য, মোটামুটি গোলাকার।এইভাবে তিনি বিজ্ঞান বোঝাতেন সহজ করে। তারপর যখন বারো ক্লাসে পড়ি তখন স্যার একবার স্কুল ল্যাবরেটরিতে ক্লাস নিলেন। স্যার সিরিয়াস হয়ে পড়াচ্ছেন। প্রায় কুড়ি মিনিট পরে ক্লাসে সকলেই হাসতে শুরু করেছে। সৈকত ও তার বন্ধুরা তো হাসছেই। তার সঙ্গে হাসছেন, পাই স্যার।আমরা অবাক হয়ে হাসছি।হাসির কলরবের শব্দ পৌঁছে গেল হেড মাষ্টারমশাইয়ের ঘরে। তিনি একটি শক্ত লাঠি নিয়ে এলেন মারার জন্য।তিনি চিৎকার করছেন আর বলছেন, বাঁদরামি হচ্ছে। এটা স্কুল। স্কুলে হাসি। ঘরে ঢুকে পড়ে হেড মাষ্টার মশাই ও হাসতে লাগলেন। সৈকতরা অবাক। কি ব্যাপার হলো।এদিকে পাই স্যার হাসতে হাসতে এগিয়ে চলেছেন একটা মোটা কাঁচের বোতলের দিকে। তিনি দেখলেন বোতলের মুখ খোলা। লেখা আছে বোতলের গায়ে নাইট্রাস অক্সাইড। স্যার বন্ধ করলেন ঢাকনা।তারপর দশমিনিট পরে হেডস্যারকে বললেন, স্যার লাফিং গ্যাসের বোতল খুলে ফেলেছে কেউ। তার ফলে এই হাসি।অমর বললো,স্যার হাসতে হাসতে পেটে খিল ধরে গেছে।কে যে বোতলটা খুলেছিলেন তা আজ পর্যন্ত জানা যায় নি…।পাই স্যারের বাড়ি গেলেই তিনি পরাণের পান্তুয়া খাওয়াতেন। তিনি আমাদের বাড়িতেও পড়াতেন। তিনি আমাকে বলতেন, তোর কি পাখির পেট নাকি। খা পরাণের পান্তুয়া। আরও দুটো নে। আমি বলতাম, না না আর নেব না। প্রত্যেকদিন তিনি আমাদের পান্তুয়া খাওয়াতেন। মনে পড়ে আজও লিলুয়ার কথা। এটা শহর নয়। গ্রামের মতই।জায়গাটার নাম পটুয়াপাড়া।এই পাড়ায় মাটির পুতুল বিখ্যাত ছিল। দুটো পুতুল কিনলেই মাসি বলতেন, নে নে আরবএকটা নে। এটার দাম লাগবে না। মাটির পুতুল নিয়ে আনন্দে ঝুলন সাজাতাম। পুজো দিতাম। পরাণদার পান্তুয়া ছিল প্রসাদ। তার লোভেই আমরা ঝুলন সাজাতাম প্রতিবার।

দুই

দাদার সঙ্গে গল্প করতে গিয়ে রাত বারোটা বেজে গেল। দাদাকে বললাম,বীরবাহাদুর কেমন আছেন? দাদা বললেন,ওর ছেলেরা এখন পটশিল্পীর কাজ করে। আমার মনে পড়ল,পটুয়াপাড়া আসলে মফস্বল, গ্রামে পরিবেশ ।কয়েকঘর পটুয়াশিল্পী বাস করতেন এখানে।মাথায় ঝাঁকড়া চুলের বীরবাহাদুর বলেছিলেন, আমরা, পটুয়ারা অনেকে সঙ্গীত সহযোগে পটচিত্র দেখিয়ে জীবিকা নির্বাহ করি। গানের তালে তালে দর্শক-শ্রোতাদের পটচিত্রের আখ্যানভাগ বুঝিয়ে দিই।রামায়ণ,মহাভারত আর বেদ,উপনিষদের কিছু কাহিনী নিয়ে রচিত আমাদের পটচিত্র। এখন সাময়িক ঘটনার কিছু ছবি আমরা আঁকি। প্রথম যখন বাবার সঙ্গে গিয়ে পটুয়াপাড়া গ্রামের একজন শিক্ষিত লোকের সঙ্গে পরিচয় হল। তিনি বললেন, যশোর ও খুলনা অঞ্চলে পটুয়াদের গাইন’ নামে অভিহিত করা হয়। অবিভক্ত বাংলায় ঢাকা, ময়মনসিংহ, নোয়াখালী, সিলেট, ফরিদপুর, যশোর, খুলনা, বরিশাল, রাজশাহী এবং দিনাজপুর অঞ্চলে পটুয়ারা বসবাস করত। সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার পটভুমিতে দেশবিভাগের পর অধিকাংশই পশ্চিমবঙ্গে চলে যায়। যারা থেকে যায় তাদের পেশায়ও পৃষ্ঠপোষকতার অভাবে ভাটা পড়ে। বর্তমানে নরসিংদী, মুন্সিগঞ্জ, খুলনা, যশোর ও জামালপুর অঞ্চলে কদাচিৎ দুএকজন পটুয়া বা গাইন শ্রেণীর শিল্পীর সাক্ষাৎ মেলে। পটুয়ারা বিভিন্ন মেলা, ধর্মীয় উৎসব-অনুষ্ঠান এবং গ্রামে-গঞ্জে পটচিত্র বিক্রয় করে। হিন্দুদের মধ্যে অনেকে বিভিন্ন দেবদেবীর পট পূজা-অর্চনার জন্য সংরক্ষণ করে।পটুয়াদের একটি বড় অংশ বেদে সম্প্রদায়ভুক্ত। তাদের বিবাহাদি সামাজিক অনুষ্ঠান হিন্দু-মুসলিমরা একসাথে পালন করে। তাদের সামাজিক জীবনযাপন একইরকম।তিনি আরও বললেন, পটুয়া শব্দের আক্ষরিক অর্থ যারা “পট” (ছবি) আঁকে। পট অঙ্কন গ্রামবাংলার প্রাচীন লোকশিল্প। এর কিছু নিদর্শন এখনো বেঁচে আছে । যামিনী রায় প্রাশ্চাত্যের অঙ্কনরীতিতে পারঙ্গম হলেও পটশিল্পকে নিজের অভিব্যক্তির মাধ্যম হিসাবে তুলে নিয়ে পটশিল্পকে প্রাশ্চাত্যের কাছে বিখ্যাত করেন। কিন্তু যামিনী রায় পটুয়া নন। পটুয়ারা একটি পেশাভিত্তিক লোকগোষ্ঠী যাদের প্রধান পেশা বংশানুক্রমে নিজেদের বিশেষ রীতিতে পট অঙ্কন ও প্রদর্শন বা বিক্রয় করা।
আমরা ছোটবেলায় দেখতাম বীরবাহাদুর কাকু একটা গোটানো দলিলের মত পটচিত্র বগলে বাড়ি বাড়ি ঘুরতেন। একটা বাড়িতে সুর করে তিনি রামায়ণের কাহিনী বর্ণনার সঙ্গে সঙ্গে ছবি দেখাতেন গোল গোটানো বান্ডিল থেকে। নানরকম ছবি তাতে আঁকা।রাবণ ভিখারী সেজে সীতাকে উড়িয়ে নিয়ে যাচ্ছেন লঙ্কায়। দুটো ঘোড়া সহযোগে পুষ্পকরথের ছবি। জটায়ু বাধা দিচ্ছে আর রাবণ তাকে তরবারি সহযোগে আঘাত করছেন। জটায়ুর ডানা কাটা দেখে আমার কান্না আসত। কখনও সখনও মা মাসিরাও কেঁদে ফেলতেন কাকুর করুণ সুরের আবেগে। বীরবাহাদুরের পটকাহিনীর বিষয়গুলো ছিল, রাজনৈতিক, ঐতিহাসিক, ধমীয়, সামাজিকএবং পরিবেশগত। উদাহরণস্বরূপ বলা যেতে পারে বিষয়নিরপেক্ষ পটগুলির মধ্যে যে কোনও ধরনের নর ও নারীর ছবি অথবা শিল্পচিত্র দেখা যায় এবং সামাজিক পট বলতে বোঝায় সামজিক সচেতনতা বৃদ্ধির জন্য যে পটচিত্র গুলি অঙ্কণ করা হ্য় সেইগুলি। যেমন পোলিও টীকাকরণ অভিযান, ম্যালেরিয়া দূরীকরণ, সাম্প্রদায়িক সম্পৃতী, বৃক্ষরোপন, এইডস সন্মন্ধীয় সচেতনতা বৃদ্ধি, মানবাধীকার ও নারীনিগ্রহ বিরোধী সচেতনতা বৃদ্ধি সঙ্ক্রান্ত পটচিত্রগুলি। আমাদের গ্রামে চলতি সমস্যাগুলেো নিয়েও বীরবাহাদুর পট আঁকত। বীরবাহাদুরকে জিজ্ঞেস করেছিলাম, পট কি গো? বীরবাহাদুর বলেছিলেন,পট মানে কাপড় গো। ন্যাকড়া যাকে বলো
–কি কি বিষয়ের উপর তোমার পট আঁকা আছে কাকু?
–পৌরাণিক বিভিন্ন গল্প ও গাথা এই পটের উপজীব্য। সেগুলি হল রাবন বধ, সিতা হরণ, রাজা হরিশ্চন্দ্র, কৃষ্ণলীলা, দুর্গালীলা, সাবিত্রী-সত্যবান, মনসা মঙ্গল, চন্ডীমঙ্গল, ধর্মমঙ্গল, আনন্দ মঙ্গল, কালকেতু ফুল্লরা ইত্যাদি।ঐতিহাসিক পটের উপজীব্য যা এর নাম থেকেই প্রকাশিত তা হল ঐতিহাসিক ঘটনাবলী। যেমন- দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ, আজাদ্ হিন্দ্ বাহিনী ও নেতাজী সুভাষ চন্দ্র বসু, আণবিক বোমাবর্ষ
–আঁকার পদ্ধতি কি রকম?
— কাপড়ের জমিন তৈরির পর অঙ্কনকাজ শুরু হয়। এক্ষেত্রে বিভিন্ন দেশজ রঙের ব্যবহার উল্লেখযোগ্য; যেমন: ইটের গুঁড়া, কাজল, লাল সিঁদুর, সাদা খড়ি, আলতা, কাঠ-কয়লা ইত্যাদি। পটটিকে কয়েকটি অংশে ভাগ করে কাজ করা হয় এবং রংয়ের প্রকারের মধ্যে লাল, নীল, হলুদ, গোলাপী, বাদামী, সাদা এবং কালো ব্যবহৃত হয়। মাটির হাঁড়ি উপুর করে কেরোসিন লম্ফের উপর ধরা হয়। কালো মোটা স্তর চেঁচে কালি করা হয়।
পট দেখানোর পরে পটুয়া বীরবাহাদুর বাড়ি গিয়ে ঝোলা নামিয়ে বসতেন। তিনি গিন্নিকে ডেকে বলেছিলেন, কই গো রাজুর মা এক গেলাস জল দাও কেনে। রাজুর মা বলে, আজ কতদূর যেয়েছিলে। পটুয়া বলেন, আজ ভাতারের পাশে শুষনা গেরামে গেয়েছিলাম গো। বড্ড খাটুনি হল।
— গিন্নি একটা গামছা দিয়ে পিঠ মুছিয়ে দাও না ক্যান।
গিন্নি একটু পরে গামছা এনে ঘাম মুছে দেন আদরে,শ্রদ্ধায়।
বীরবাহাদুর কাকুর ছেলে রামবাহাদুর পটের ছবি আঁকা শিখছে। সে বড় তুলি দিয়ে এখন কাগজে ছবি আঁকছে রাজা, ঋষি আর রাক্ষসের। বীর বলেন, ভালো করে শিখে নে আঁকাটা।নিজে আঁকতে পারলে খরচ বাঁচবে। তা না হলি চিত্রকরের বাড়ি যেতে হবে। পয়সা লাগবে বিস্তর। ছেলে রাম বলে, দেকো দিকিনি বাবা এটা রামের ছবি বটে? বীর বলে, একদিনে কি হবে রে? সময় লাগবে।এখন যতদিন বেঁচে আছি আমার কাছে শিখে লেগা। রাম বলে, তুমি রঙটা দাও গা। আমি চান করে আসি।গান গেয়ে রোজগার করা চাল আর আলু সেদ্ধ হতে বিকেল গড়িয়ে যায়। একবারে খেয়ে নেয় তিনজনে পেটভরে কারণ রাতে মুড়ি আর গুড় ছাড়া কিছু জোটে না। বীরবাহাদুর বলে, শিল্পীরা চিরকাল ভিকিরি কেনে গো গিন্নি। গিন্নি বলেন, তাই তো হয় গো।শিল্পিরা হল সাধক। সাধকরা কি কখনও টাকা পয়সার পরোয়া করে না।
বীরবাহাদুর কাকু বলেন, ঠিক বলেচিস তুই। পটের কাহিনী, তাই তো বলে গো।
বীরবাহাদুর বলেছিলেন,পট শব্দটি সংস্কৃত পট্টি থেকে এসেছে। বর্তমানে এই শব্দটিকে , ছবি আঁকার মোটা কাপড় বা কাগজের খন্ড ইত্যাদি অর্থেও ব্যবহার করা হয়। পটের উপর তুলির সাহায্যে রং লাগিয়ে বস্তুর রূপ ফুটিয়ে তোলাই পট চিত্রের মূলকথা ।এতে কাহিনী ধারাবাহিক ভাবে চিত্রিত হতে থাকে । অন্তত আড়াই হাজার বছর ধরে পটচিত্র এ মহাদেশের শিল্প জনজীবনের আনন্দের উৎস, শিক্ষার উপকরণ এবং ধর্মীয় আচরণের অংশ হিসেবে ব্যবহৃত হয়ে এসেছে ।বাংলাদেশের পটচিত্রের মধ্যে গাজীর পট ও পশ্চিমবঙ্গের পটচিত্রের মধ্যে কালীঘাটের পট উল্লেখযোগ্য । পট মূলত দুই ধরনের রয়েছে। যথা জড়ানো পট, এ ধরনের পট ১৫-৩০ ফুট লম্বা এবং ২-৩ ফুট চওড়া হয়।চৌকো পটগুলো আকারে ছোট হয়।কাপড়ের উপর গোবর ও আঠার প্রলেপ দিয়ে প্রথমে একটি জমিন তৈরি করা হয়। সেই জমিনের উপর তুলি দিয়ে বিভিন্ন চিত্র অঙ্কিত হয়। আর এক রকমের চট দিয়ে কাগজের পেছনে আঠা দিয়ে আটকানো হয়। আমরা যখন ওয়াল ম্যাগাজিন, জোয়ার প্রকাশ করি তখন প্রথম ছবি কাকু এঁকে দিয়েছিলেন দয়া করে।
ছোট থেকে কাকুকে আমরা তুমি সম্বাধনে অভ্যস্ত ছিলাম। কাকু বলতেন, আপনি আপনি বলবি না। কেমন পর পর মনে হয় রে। তোরা আমাকে তুমি বলেই সম্বোধন করবি।
আমি জিজ্ঞাসা করলাম, ইতিহাস নিয়েও কি তোমাদের কাজ হয় কাকু?
কাকু বলেন, ঐতিহাসিক পটের উপজীব্য যা এর নাম থেকেই প্রকাশিত তা হল ঐতিহাসিক ঘটনাবলী। যেমন- দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ, নেতাজী সুভাষ চন্দ্র বসু, আণবিক বোমাবর্ষণ,ক্ষুদিরামের বিদায়। বাঘাযতীনের জাহাজ প্রভৃতি।
কাকু আরও বলেন, জমিন তৈরির পর অঙ্কনকাজ শুরু হয়। এক্ষেত্রে বিভিন্ন দেশজ রঙের ব্যবহার উল্লেখযোগ্য; যেমন: ইটের গুঁড়া, কাজল, লাল সিঁদুর, সাদা খড়ি, আলতা, কাঠ-কয়লা ইত্যাদি। পটটিকে কয়েকটি অংশে ভাগ করে কাজ করা হয় এবং রংয়ের প্রকারের মধ্যে লাল, নীল, হলুদ, গোলাপী, বাদামী, সাদা এবং কালো ব্যবহৃত হয়।
কাকুকে আমি আবার প্রশ্ন করলাম, তোমাদের শুরুর ইতিহাস তুমি জানো কি?
কাকু বলেন, আমাদের কোন চাষের জমি ছিল না । আড়াই হাজার বছর আগে থেকে বংশ পরম্পরায় আমরা এই শিল্পে যুক্ত।পটুয়ারা কেবল চিত্রশিল্পীই ছিলেন না, ছিলেন একাধারে কবি, গীতিকার ও সুরকার। সাধারণত পারলৌকিক ও ধর্মীয়ভাব মিশ্রিত বিষয় নিয়ে পট নির্মিত হলেও পটুয়ারা বিষয় নির্বাচনে রক্ষণশীল ছিলেন না। কর্মে ও চেতনায় তারা ছিলেন অসাম্প্রদায়িক, বলা যেতে পারে ধর্মনিরপেক্ষ। সমাজের নানা অন্যায় অবিচার পটুয়াদের পটে চিত্রিত হয়েছে দ্রোহের হাতিয়ার হিসেবে। গ্রাম-বাংলার হাট-বাজার, পথে-ঘাটে বিভিন্ন লোকালয়ে পট দেখিয়ে গান গেয়ে, গল্প বলে তারা মানুষকে জ্ঞান ও আনন্দ বিলাতেন, বিনিময়ে জীবনধারনের মতো অর্থ উপার্জন করতেন। সে-কারণে তাঁদের বলা হত ভবঘুরে চিত্রকর। তাঁদের নীতিজ্ঞান ছিল উঁচু পর্যায়ের। সমাজে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি বজায়ে রাখতে পটশিল্পীরা ছিলেন সদা সচেষ্ট, যার পরিচয় পাওয়া যায় তাঁদের ছবি ও গানে। পটুয়ারা কেবল লোকরঞ্জকই ছিলেন না, ছিলেন লোকশিক্ষকও।
পটুয়াপাড়ার আকাশে বাতাসে এক ধর্মীয় চেতনা সদা জাগ্রত। তারা এখনও বিশ্বাস করেন, ভগবান আছেন। তিনি অন্যায় মার্জনা করেন না, জাতিভেদ বা বর্ণভেদ করলে মানুষকে শাস্তি দেন। মৃত্যুর পর মানুষের অন্যায়ের বিচার করা হয় কিভাবে তার চিত্র পটশিল্পীরা এওনও আঁকেন। তারা মনেপ্রাণে বিশ্বাস করেন, মৃত্যুর পরেও আর একটি জীবন আছে। তাই বেঁচে থাকতে জীবনে দান, ধ্যান,দয়া,ধর্ম করা উচিত।

তিন

দাদা বললেন,তুই খুব স্মৃতিকাতর ছেলে।সবকিছু মনে আছে দেখছি।যা এবার শুয়ে পড় গিয়ে।সকাল সকাল উঠতে হবে। আমি বললাম,বেশ।যাচ্ছি।
পরেরদিন সকালেই, আমি হাওড়া নরসিংহ দত্ত কলেজে পৌঁছে গেলাম।ট্রেনে,বাসে যেতে সাড়েদশটা বেজে গেল।দেখলাম গেটের ভিতরে দুদিকে সিকিউরিটি গার্ড বসে আছেন।
একজন সিকিউরিটি গার্ড বললেন,কি চাই?
আমি বললাম,সার্টিফিকেট নিতে হবে। আগে নিতে পারিনি।
সিকিউরিটি বললেন, দেখি আপনার মার্কশীট আর আ্যডমিট কার্ড।
সবকিছু প্রমাণপত্র দেখিয়ে আমি কলেজের ভিতরে গেলাম।
কলেজের ভিতরে গিয়ে আবেদনপত্র জমা দিয়ে আমি অপেক্ষা করতে লাগলাম।এই অবসরে আমার কলেজস্মৃতি মনে পড়ল। দীর্ঘ কুড়িবছর পরে সেই কলেজের সিঁড়িতে দেখলাম স্মৃতিগুলো থমকে আছে অতীতের থাম ধরে। আমার কাঁচাপাকা চুল সহসা কালো হয়ে ফুটে উঠল । কি করি, কোনটা আগে দেখি পড়িমরি করে ছুটলাম রসায়নাগারে। এখানে লাফিং গ্যাসের বোতল খুলে গেছে, আমরা সকলে হাসছি, এমনকি শিক্ষকমহাশয় পর্যন্ত হাসছেন। তারপর, গ্রন্থাগারের দরজা খুলে মৌন হলাম। সারি সারি বই সাজানো, আব্দুল স্যার গম্ভীর হয়ে পড়ছেন। মায়ামাখানো অপূর্ব দৃষ্টিতে তিনি তাকিয়ে আছেন আমার দিকে। ঘন্টা পড়তেই চমকে দেখি কেষ্টদা বলছেন,কেমন আছিস বাছা।অনেকদিন পরে এলি। এতদিন কি করছিলি,তোর নাম মনে পড়ে না তবে মুখটা ভুলিনি। আসবি প্রতিবার কলেজে প্রাক্তন ছাত্রদের নিয়ে ‘ফিরে দেখা ‘হয়। আমি কি করব ভেবে পাচ্ছি না। মনে হল আমার ক্লাসের বন্ধু রা ক্লাসে ছোটাছুটি করছে টিফিনের সময়ে। তারপর সায়েন্স শিক্ষক ভূপেনবাবুর ক্লাস। দেখে দেখে পড়া বলা, আড়ালে গল্পের বই পড়া। আড়াল করতাম বই দিয়ে। আবার ঘন্টার ঢং শব্দে চমকে উঠি। ফিরে আসি বাস্তবের মাটিতে। সেই বটগাছতলা,সেই কলেজ,পুকুর আছে। শুধু নেই আমার পুরোনো শিক্ষকমহাশয়রা। চাকরির নিয়মে তারা প্রাক্তন হয়েছেন। তবু এই কলেজের ইঁট, কাঠ,পাথর কত চেনা কত আফিরে ফিরে দেখতাম ছোটবেলার পুকুরটাকে। বন্ধুরা সব বড় হয়ে গেছে। কেউ আর পাত্তা দেয় না। সেই পাই স্যার,সৈকত,বিশ্বকর্মা পুজো আমার মনে বিষাদের বাজনা বাজায়।

চার

পরাণদার বাড়ির সামনে মিষ্টির দোকানে আবার একবার গেলাম। সেখানে পান্তুয়ার দোকানের বদলে মোমোর দোকান দিয়েছে পরাণদার ছেলে। পরাণদা বুড়ো হয়েছেন এখন। আমাকে দেখে বললেন, কে তুমি চিনতে পারলাম না তো। আমি পরিচয় দিলে তিনি আমাকে আনন্দে জড়িয়ে ধরলেন। বললেন আমাকে, পাই স্যার নেই তো কি হয়েছে, আমি তোমাকে পান্তুয়া খাওয়াব। আমি বললাম, না তুমি এখন বুড়ো হয়েছ। আর তোমাকে কাজ করতে হবে না। পরাণদাকে প্রাণভরা ভালোবাসা জানিয়ে চোখে জল নিয়ে বাইরে এসেছিলাম। এখনকার ছেলেরা কেউ আমাকে চেনে না। পরের দিন বিকেলবেলা পরাণদা তার বাড়িতে আমাকে ডাকলেন। থালায় চারটে পান্তুয়া। খেলাাম তৃপ্তি করে। শেষে তিনি কাগজের ঠোঙায় অনেকগুলো পান্তুয়া হাতে ধরিয়ে দিয়ে বললেন, এটা তুমি বাসায় গিয়ে খেও। আমার আনন্দ হবে। ইতস্তত হাতে আমি ঠোঙা ধরে একশ টাকার নোট বের করেছিলাম। পরাণদা বললেন, ভালবাসায় টাকাপয়সার স্থান নেই। আমার এখন টাকার অভাব নেই। তোমাকে পান্তুয়া খাইয়ে আমি যে কতটা আনন্দ পেলাম তা আর কেউ বুঝবে না। পরাণদার এই কথা শুনে আমি আর কথা বলতে পারলাম না। ধরা গলায় বললাম, আসছি। এখনও পটুয়াপাড়ায় আমি সময় পেলেই চলে যাই পুকুরের পাড়ে। বসে থাকি শটিবনের ধারে। জঙ্গলের এক বুনো গন্ধে পরাণদার কথা মনে পড়ে।এই পুকুরে খেলার সঙ্গিদের মনে পড়ে। বুকটা চিন চিন করে ওঠে। মন উদাস হয়। অতিতের এই পুকুর পাড়ে আমার বয়স, আমার স্মৃতি থমকে রয়েছে ছোট ছোট ছেলেমেয়েদের চিরন্তন খেলায়। আমি পুকুড়ের পাড়ে বসে আমার ছোটবেলার খেলা খেলি আপনমনে।পন। পুরোনো স্মৃতির মোড়কে, নব নব সুরে আমি ভাবনায় আপ্লুত। বসে আছি কলেজে প্রায় তিনঘন্টা। এই তিনঘন্টায় টাইম মেশিনে মনে হল আমার ছেলেবেলটা ঘুরে এলাম। এবার চেতনা জাগ্রত হতেই হঠাৎ সিকিউরিটি গার্ড, এসে আমাকে বললেন, প্রিন্সিপ্যালস্যার, একবার ডাকছেন আপনাকে। আমি ধীরগতিতে নতুন স্যারের ঘরের দিকে পা বাড়ালাম মন্ত্রমুগ্ধ হয়ে। স্যার বললেন,আগাামীকাল আসবে। আমরা সার্টিফিকেট কলকাতা ইউনিভার্সিটিতে পাঠিয়ে দিয়েছি।আগামীকাল আমি লিখে দেব,ইউনিভার্সিটি থেকে সার্টিফিকেট তুলে নিও।আমার মন একটু খারাপ হল। ভাবলাম আজকে কাজটা হলে আনন্দ পেতাম। আমি আবার লিলুয়া দাদার বাড়িতে ফিরে এলাম।পরেরদিন নবউদ্যমে আবার কলেজ গেলাম। প্রায় তিনঘন্টা পরে লিখিত অনুমতি পেলাম, সার্টিফিকেট তোলার। তাড়াতাড়ি একটা ওলাউবে ওয়েবে, ট্যাক্সি ভাড়া করে ইউনিভার্সিটি পৌঁছালাম।তখন দুপুর। কর্মিদের টিফিন পিরিয়ড। তারপর সমস্ত কাজ সেরে দোতলায় উঠে আবেদন জমা দিলাম। ওনারা একমাস সময় নিলেন।
আমি আবার ফিরে এলাম হাওড়া স্টেশনে।দাদাকে মোবাইলে একটা ফোন করে বললাম,আমার কাজ হয়ে গেছে।আমি গ্রামে ফিরে যাচ্ছি। দাদা বললেন,সাবধানে যাস,আবার আসিস কিন্তু একদিন।

সুদীপ ঘোষাল। গল্পকার। জন্ম ভারতের পশ্চিমব্ঙ্গরাজ্যের কেতুগ্রামের পুরুলিয়া গ্রামে। প্রকাশিত বই: 'মিলনের পথে' (উপন্যাস)। এছাড়াও কয়েকটি গল্প ও কবিতার বই আছে।

এই বিভাগের অন্যান্য লেখাসমূহ

পটচিত্র

পটচিত্র

  সৌম দাদুর কাছে থাকতে ভালোবাসত। গ্রামের নাম পাঁচুন্দি।আশেপাশে প্রচুর গ্রাম।সবাই সকলের খবর রাখে।সৌমদীপ এখানকার…..