হে মোর দূর্ভাগা স্বদেশ

আলী নাঈম
প্রবন্ধ
হে মোর দূর্ভাগা স্বদেশ

এক দুর্ভাগ্যপীড়িত দেশের দুর্ভাগ্যপীড়িত সময়ের মানুষ আমরা। রাষ্ট্রীয় শাসন কি সামাজিক জীবন — কোথাও স্বাভাবিকতা নেই, স্বস্তি নেই। নিরাপদে শ্বাস নেওয়া কঠিন, বেঁচে থাকা দুঃসাধ্য। হয়তো এ পরিস্থিতি পৃথিবীজুড়েই।

কিন্তু পৃথিবীর অনেক দেশ বা জাতি যা করেনি, আমরা তা করেছিলাম। আমরা ভাষার জন্য লড়াই করেছিলাম, গণতন্ত্রের জন্য লড়াই করেছিলাম। দেশের স্বাধীনতার জন্য আমাদের পূর্বপুরুষ প্রাণ বিসর্জন দিয়েছিলেন। ৪৬ বছর পর সেই স্বাধীন দেশের মাটিতে বসেই আমরা ভাবতে বাধ্য হচ্ছি—কেমন দেশ, কেমন সমাজ তাঁরা চেয়েছিলেন? কোথায় তাঁদের প্রাণের দামে কেনা সেই স্বপ্নের স্বদেশ? সম্প্রতি বাংলাদেশে মৌলবাদ-জঙ্গিবাদের যে বিপদ জনজীবনকে বিষাক্ত করে তুলেছে, তার পরিপ্রেক্ষিতে এসব প্রশ্ন বারবার মনে হানা দিচ্ছে।

অনেক দিন ধরেই বিভিন্ন জঙ্গি মৌলবাদী গোষ্ঠীর হামলা, হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় আমরা বিচলিত বোধ করছিলাম। সর্বশেষ গুলশানে ঘটে যাওয়া হামলার বর্বরতা ও নৃশংসতা আমাদের পীড়িত করেছে। কিন্তু নৃশংসতা শুধু জঙ্গিরাই ঘটাচ্ছে, এমন নয়। নৃশংসতার শিকার হচ্ছে শিশুরা, শিকার হচ্ছে নারীরা। নারায়ণগঞ্জের সাগর, খুলনার রাকিব, সিলেটের রাজন তারই প্রমাণ। প্রতিদিন পত্রিকার পাতায় অসংখ্য নারীর নাম পাওয়া যাবে, যাঁরা নির্মম নির্যাতনের শিকার হচ্ছেন।

জঙ্গিগোষ্ঠীর হামলার শিকার হয়েছেন ভিন্ন মতের, ভিন্ন চিন্তার লেখক ও প্রকাশক। এদের হামলার শিকার হয়েছে ভিন্ন ধর্মের, এমনকি একই ধর্মের ভিন্ন মতধারার অনুসারীরা। কেউ ভিন্ন চিন্তা বা মত ধারণ করলে বা প্রচার করলেই তাকে আঘাত করা যায়, হত্যা করা যায়—এ মনোভাব নিঃসন্দেহে গণতান্ত্রিক সংস্কৃতির বিপরীত। দুঃখজনক হলো, এ ধরনের অগণতান্ত্রিক সংস্কৃতির চর্চা শুধু যে জঙ্গিরা করছে, তা তো নয়। আমাদের রাজনৈতিক-সামাজিক জীবনের সর্বত্র এ ধরনের সংস্কৃতির চর্চা প্রাতিষ্ঠানিক রূপ নিয়েছে প্রায়। আর গোটা সমাজ মননে বাড়ছে ভোগবাদী সমাজবিমুখতা এবং সাম্প্রদায়িক মৌলবাদী সংস্কৃতি। এ দুই ধারা আপাত বিপরীত কিন্তু মর্মে এক। আর সর্বোপরি, অবক্ষয়ের বিস্তার এখন সর্বব্যাপক, যা নিয়ে ভিন্নমত পোষণ করার কোনো সুযোগ নেই।

২.

প্রশ্ন আমরা আগেই তুলেছি, কেন এমন হচ্ছে? এ পরিস্থিতির দায় কার?

যেকোনো সমস্যার মুখোমুখি হয়ে, বিচারে নামার আগে দৃষ্টিভঙ্গি নির্ধারণ করা খুব জরুরি। এই দৃষ্টিভঙ্গির কেতাবি নাম দর্শন।

প্রচলিত অর্থে দার্শনিক না হলেও রবীন্দ্রনাথের দার্শনিক চিন্তার একটা গুরুত্বপূর্ণ দিক হলো তিনি অদ্বৈতবাদী দৃষ্টিভঙ্গিতে জগৎকে দেখতেন। ভারতের পরাধীনতার কারণ যেমন ব্রিটিশ শক্তির আগ্রাসন, ঠিক তেমনি তিনি মনে করতেন, আমাদের অন্তর্গত দুর্বলতাও এর একটা কারণ। রবীন্দ্রনাথ সেই দুর্বলতামুক্ত হওয়ার কথা বলতেন। আমাদের বর্তমান পরিস্থিতির বাহ্যিক কারণ অনুসন্ধানের সঙ্গে সঙ্গে অন্তর্গত কারণ অনুসন্ধানের চেষ্টা জরুরি। একটা বিশেষ উপলক্ষ সামনে রেখে আমরা সেই অনুসন্ধানের চেষ্টা করছি।

আমাদের বর্তমান উপলক্ষ ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর।

৩.

২৯ জুলাই বিদ্যাসাগরের ১২৫তম মৃত্যুদিবস। ১৮৯১ সালের ২৯ জুলাই তাঁর জীবনাবসান হয়েছিল। বিদ্যাসাগর কে ছিলেন, বিদ্যাসাগর কী ছিলেন—দেশের শিক্ষিত মানুষের সামনে সে আলোচনা অর্থহীন। তাঁর মাতৃভক্তির গল্প মুখে মুখে প্রচলিত। তিনি ছিলেন বিরাট পণ্ডিত, বিদ্যার সাগর। তিনি দয়ার সাগর ছিলেন। হিন্দু সমাজের বিধবা নারীদের দুঃখ-যন্ত্রণা দেখে কাতর হয়ে বিধবা-বিবাহ প্রচলনের জন্য আন্দোলন করেছিলেন। কেউ হয়তো একটু অগ্রসর হয়ে বলবেন, বিদ্যাসাগর নারীশিক্ষা বিস্তারের জন্য আন্দোলন করেছিলেন, বাল্যবিবাহ ও বহুবিবাহ বন্ধের জন্যও আন্দোলন করেছেন। অর্থাৎ তিনি একজন সমাজ সংস্কারক। এসব কথা স্কুল-কলেজের পাঠ্যবইতেও পাওয়া যাবে। টেবিলের ওপর পা তুলে ইংরেজ সাহেবের নাকের সামনে চটিজুতা নাচানোর ঘটনাটিও হয়তো অনেকে জানেন। আর শিক্ষার্থীরা এও জানে যে তিনি বাংলা ব্যাকরণ রচনা করেছিলেন।

বিদ্যাসাগর সম্পর্কে লিখতে গিয়ে রবীন্দ্রনাথ লিখেছিলেন, “তাঁহার প্রধান কীর্তি বঙ্গভাষা। …বিদ্যাসাগর বাংলাভাষার প্রথম যথার্থ শিল্পী ছিলেন।” কিন্তু এটুকুতেই রবীন্দ্রনাথ থেমে ছিলেন না। তিনি আরো লিখেছিলেন : “বিদ্যাসাগরের চরিত্রে যাহা সর্বপ্রধান গুণ—যে গুণে তিনি পল্লী-আচারের ক্ষুদ্রতা, বাঙালি-জীবনের জড়ত্ব, সবলে ভেদ করিয়া একমাত্র নিজের গতিবেগ প্রাবল্যে কঠিন প্রতিকূলতার বক্ষ বিদীর্ণ করিয়া, হিন্দুত্বের দিকে নহে, সাম্প্রদায়িকতার দিকে নহে—করুণার অশ্রুজলপূর্ণ উন্মুক্ত অপার মনুষ্যত্বের অভিমুখে আপনার দৃঢ়নিষ্ঠ একাগ্র একক জীবনকে প্রবাহিত করিয়া লইয়া গিয়াছিলেন।… তিনি যে বাঙালি বড়োলোক ছিলেন তাহা নহে, তিনি যে রীতিমত হিন্দু ছিলেন তাহাও নহে—তিনি তাহা অপেক্ষাও অনেক বেশি বড়ো ছিলেন, তিনি যথার্থ মানুষ ছিলেন।” (চারিত্রপূজা) আর তাই, রবীন্দ্রনাথের ভাষায় : “দয়া নহে, বিদ্যা নহে, ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের চরিত্রে প্রধান গৌরব তাঁহার অজেয় পৌরুষ, তাঁহার অক্ষয় মনুষ্যত্ব; …।” তিনি আরো লিখেছিলেন : “আমাদের এই অবমানিত দেশে ঈশ্বরচন্দ্রের মতো এমন অখণ্ড পৌরুষের আদর্শ কেমন করিয়া জন্মগ্রহণ করিল, আমরা বলিতে পারি না।” আর সে কারণেই রবীন্দ্রনাথ ঘোষণা করছেন, “… বিদ্যাসাগর এই বঙ্গদেশে একক ছিলেন।”

বিদ্যাসাগরের অবদান নিয়ে গবেষক ঐতিহাসিকদের মধ্যে বিশেষ মতভিন্নতা নেই। বিদ্যাসাগরের তিনটি অবদান তারা চিহ্নিত করেন : (১) আধুনিক বিজ্ঞানভিত্তিক শিক্ষা-সংস্কৃতির সূচনা, (২) বিধবাবিবাহ চালু এবং নারীশিক্ষার বিস্তার, অর্থাৎ নারী অধিকার প্রতিষ্ঠা, এবং (৩) আধুনিক বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের ভিত্তি স্থাপন। এই সমগ্র অবদানের পরিপ্রেক্ষিতে, দু-একজন ব্যতিক্রম বাদে, প্রায় সকলেই মনে করেন যে পরাধীন ব্রিটিশ ভারতে যে নবজাগরণের সূচনা হয়েছিল, তার প্রাণপুরুষ ছিলেন বিদ্যাসাগর। তাঁরা মনে করেন, রামমোহনের হাত ধরে নবজাগরণের সূচনা হলেও বিদ্যাসাগরে এসে তা পূর্ণতা পেয়েছিল।

১৯৭০ সালে বিদ্যাসাগরের সার্ধশত জন্মবর্ষে আহমদ শরীফ লিখেছিলেন : “উনিশ শতকী বাঙলায় অনেক কৃতীপুরুষ জন্মেছিলেন, বিভিন্ন ক্ষেত্রে তাঁদের দান গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু সবকিছুর মূলে ছিলেন দুই অসামান্য পুরুষ। প্রথমে রামমোহন, পরে ঈশ্বরচন্দ্র। একজন রাজা, অপরজন সাগর। উভয়েই ছিলেন বিদ্রোহী। পিতৃ-ধর্ম ও পিতৃ-সমাজ অবজ্ঞাত ও উপেক্ষিত হয়েছে উভয়ের কাছেই। তাঁদের দ্রোহ ছিল পিতৃকূলের ধর্ম ও সমাজের, জাতি ও নীতির, আচার ও আচরণের বিরুদ্ধে।…

সেই যে বাঙলা গদ্যরীতির ‘জনক’ বলে তাঁর এক খ্যাতি আছে, সেই জনকত্বেই তাঁর স্থিতি। তিনি নতুন চেতনার জনক, সংস্কারমুক্তির জনক, জীবন-জিজ্ঞাসার জনক, বিদ্রোহের জনক, শিক্ষা ও সংস্কারের জনক, সংগ্রামীর জনক, ত্যাগ-তিতিক্ষার জনক। জনকত্বই তাঁর কৃতি ও কীর্তি। সমকালীন বাঙ্লার সব নতুনেরই জনক ছিলেন তিনি। তিনিই ছিলেন ঈশ্বর। …”

৪.

আজকের বাংলাদেশকে ধরা হয় ভাষা আন্দোলনের পরিণতি। অর্থাৎ পাকিস্তানি প্রায়-ঔপনিবেশিক শাসনের বিরুদ্ধে বাংলা ভাষাকে রাষ্ট্রভাষা করার দাবিতে যে আন্দোলনের সূচনা হয়েছিল, সেটাই ক্রমে ভাষাভিত্তিক জাতীয়তাবাদে রূপ লাভ করেছিল। আর এই ভাষাভিত্তিক জাতীয়তাবাদের ফসল বাংলাদেশ। ফলে অত্যন্ত যৌক্তিক কারণেই বাংলা ভাষার ইতিহাস আর বাংলাদেশের ইতিহাস খুব ঘনিষ্ঠভাবে সম্পর্কিত হয়ে আছে। বাংলা ভাষার এই বাংলাদেশে বিদ্যাসাগরকে কীভাবে স্মরণ করা হয়?

“কি দুঃখ কি লজ্জা যে, ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের মৃত্যুশতবর্ষপূর্তির দিনটি প্রায় অলক্ষ্যে এসে চলে গেল। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বঙ্গসাহিত্যের অধ্যাপককেন্দ্রিক একটি সারস্বতগোষ্ঠীর ঘরোয়া আলোচনা সভার এবং একটি দৈনিক ‘সংবাদ’-এর মেয়েদের পাতায় ও ড. আনিসুজ্জামানের একটি রচনাতে ছাড়া তাঁকে আর কেউ আর কোথাও স্মরণ করেছেন বলে আমার জানা নেই।” (হায়াৎ মামুদ; নষ্ট বঙ্গে ঈশ্বরচন্দ্রের প্রব্রজ্যা; সাহিত্য প্রকাশ, ফেব্রুয়ারি ১৯৯৪) এ কথাগুলো লিখেছিলেন বিশিষ্ট প্রাবন্ধিক হায়াৎ মামুদ, ১৯৯১ সালে ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের মৃত্যুশতবর্ষে। হায়াৎ মামুদ এখনো বেঁচে আছেন। আজ তিনি কী লিখবেন, জানি না।

ভাষা আন্দোলনের একটা বিশেষ মুহূর্ত হলো একুশে ফেব্রুয়ারি। ওই একুশে ফেব্রুয়ারিকে ঘিরে প্রতিবছর বাংলাদেশে বাংলা একাডেমি প্রাঙ্গণে বইমেলা বসে। কৌতূহলী পাঠক খুঁজে দেখতে পারেন, বাংলা একাডেমিতে কিংবা বাংলা একাডেমির বইমেলায় বিদ্যাসাগরের স্মরণ কোনোভাবে করা হয় কি না। শুধু তাই নয়, দেশের কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ে বিদ্যাসাগরের কোনো স্মারক আয়োজন আছে কিনা সেটাও অনুসন্ধান করে দেখা যেতে পারে। যতদূর জানা যায়, তেমন কিছুই নেই।

আসলে শুধু শতবর্ষ বা একটা বিশেষ উপলক্ষেই বিদ্যাসাগরকে স্মরণ করার বিষয় নয়। কিন্তু বিশেষ উপলক্ষেই যেখানে তাঁকে স্মরণ করা হয় না, সাধারণভাবে স্মরণ করা অসম্ভব নয় কি?

১৯৯৭ সালে ‘মীজানুর রহমানের ত্রৈমাসিক পত্রিকা’র বিদ্যাসাগর সংখ্যায় (এপ্রিল-জুন) গবেষক মোহাম্মদ আবদুল হাই জানাচ্ছেন যে পাকিস্তান আমলে শাসকগোষ্ঠী বিদ্যাসাগরকে বিদ্যাসাগরকে চিহ্নিত করেছিল ‘ব্রিটিশপোষ্য’ বাংলাভাষাকে ‘সংস্কৃতায়ন’ করার প্রধান পুরোধা হিসেবে। তিনি আরো লিখেছেন : “স্বাধীনতা-উত্তর বাংলাদেশে বিদ্যাসাগর আমাদের আলোচনা-সমালোচনায় নতুন কোন মাত্রা লাভ করে নি। লেখক-গবেষক-শিক্ষার্থীদেরও বিদ্যাসাগরকে নিয়ে তেমন উৎসাহ নেই। বাংলাদেশের বিশ্ববিদ্যালয়সমূহে বিগত ছাব্বিশ বছরে এমফিল, পিএইচডি পর্যায়ে যতগুলি গবেষণামূলক কাজ হয়েছে তাতে বিদ্যাসাগর স্থান লাভ করেন নি। ভাষা ও সাহিত্যের গবেষণা প্রতিষ্ঠানের মুখপত্র, সাহিত্য-সংকলন, দৈনিক পত্রিকার সাহিত্য সাময়িকী ইত্যাদি কাঙ্ক্ষিত ক্ষেত্রে বিদ্যাসাগরকে নিয়ে আলোচনা খুব একটা চোখে পড়ে না।” তিনি আরো বলছেন, “স্বাধীনতা-উত্তর বাংলাদেশের শিক্ষাঙ্গন ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানেও বিদ্যাসাগর কদাচিৎ স্থান লাভ করেছেন। বাংলাদেশের প্রাথমিক, মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক শ্রেণী থেকে শুরু করে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে সংকলনকর্তারা বিদ্যাসাগরকে স্বাধীনতা-পূর্বকালের চেয়ে বেশী গুরুত্ব দিতে সক্ষম হন নি।” তাঁর ওই লেখা থেকে জানা যায় যে সে সময় পর্যন্ত বিদ্যাসাগরের ওপর চারটি গ্রন্থ এবং পাঁচটি শিশুতোষ গ্রন্থ প্রকাশিত হয়েছে। এ সংখ্যার খুব একটা উন্নতি গত দুই দশকে হয়নি, সামগ্রিক পরিস্থিতিও খুব বেশি পাল্টায়নি।

মোহাম্মদ আবদুল হাইয়ের লেখা থেকে আরো জানা যায় যে ‘বিদ্যাসাগর সোসাইটি অব বাংলাদেশ’ নামক একটি সংগঠন গড়ে উঠেছিল। কিন্তু ওই সংগঠনের কাজ বা অস্তিত্বের আর কোনো হদিস পাওয়া যায় না।

৫.

আমাদের নারীরা, বাংলাদেশের মেয়েরা কি বিদ্যাসাগরকে স্মরণ করেন? উত্তরে এ কথা বলা কি অন্যায় হবে যে, রামমোহন-বিদ্যাসাগর না জন্মালে বাংলার মেয়েদের জীবন এবং সর্বোপরি পুরো সমাজের চেহারা অন্য রকম হতো? রামমোহনের সতীদাহ প্রথা বন্ধ কিন্তু নিছক সতীদাহ বন্ধ নয়। আসলে সেটা ছিল নারীকে মানুষ হিসেবে প্রতিষ্ঠা করার সূচনা বিন্দু। তার পরের কাজটুকু করেছিলেন বিদ্যাসাগর। তিনি কলকাতা এবং এর আশপাশে নারীশিক্ষার জন্য একের পর এক স্কুল প্রতিষ্ঠা করেছেন। তিনি আধুনিক গণতান্ত্রিক বিজ্ঞানভিত্তিক শিক্ষা চালুর মাধ্যমে পুরুষদের এবং সমাজের দৃষ্টিভঙ্গি পরিবর্তনের কাজ করেছেন। তিনি বিধবাবিবাহ চালু, বহুবিবাহ বন্ধের সামাজিক আন্দোলনের মাধ্যমে নারীকে মানুষের মর্যাদায়, মানবিক অধিকারে প্রতিষ্ঠা করার কাজটি করেছেন।

এসব কাজ করতে গিয়ে বিদ্যাসাগর অকাতরে অর্থ ব্যয় করেছেন, এমনকি ঋণগ্রস্ত পর্যন্ত হয়েছেন। নারীর ওপর এসব অন্যায়ের প্রতিকার করতে গিয়ে তিনি প্রায় একা হয়ে গিয়েছিলেন। আজকে আমরা যখন মুসলিম নারী জাগরণের অগ্রদূত হিসেবে রোকেয়াকে চিহ্নিত করি। রামমোহন-বিদ্যাসাগর পথ তৈরি করে না গেলে এই রোকেয়া কেমন করে কোথা থেকে আসতেন?

এখানে রোকেয়াকে স্মরণ করা হয়, গতানুগতিকভাবে হলেও করা হয়, কিন্তু বিদ্যাসাগরকে করা হয় না।

৬.

বাংলাদেশে সাম্প্রদায়িকতা, মৌলবাদ, জঙ্গিবাদের উত্থানে শিক্ষিত মানুষ উদ্বিগ্ন। সমাজে মৌলবাদী মানসিকতা বাড়ছে—এমন অভিযোগও তারা করেন। এ অভিযোগ বর্তমানের শাসকরাও করেন। কিন্তু এর পেছনে নিজেদের ভূমিকাটি শিক্ষিত মহল কিংবা শাসকগোষ্ঠী কেউই দেখতে পান না। দেশে একটি আধুনিক সেক্যুলার বিজ্ঞানভিত্তিক শিক্ষাব্যবস্থা চালু করা যায়নি শাসকদের অনীহার কারণে। আমরা ব্যক্তিজীবনে এবং সমাজে সেক্যুলার ইহজাগতিক গণতান্ত্রিক সংস্কৃতির প্রসার ঘটাতে পারিনি। যার লক্ষণ আছে রোকেয়াকে স্মরণ করা আর বিদ্যাসাগরকে স্মরণ না করার মধ্যে। আসলে শুধু বিদ্যাসাগর নয়, এমন আরো বহু উদাহরণ দেওয়া যাবে। আমরা বিদ্যাসাগর নামক আতশ কাচের ভেতর দিয়ে সমাজের রোগগুলোকে দেখার চেষ্টা করেছি মাত্র।

১৯৯৭ সালে চিন্তক আহমদ ছফা লিখেছিলেন : “ঘোষণা দিলেই একটি রাষ্ট্র ধর্মনিরপেক্ষ হয়ে যায় না। একটি দরিদ্র কৃষিপ্রধান দেশ কিছুতেই এক সঙ্গে সাম্প্রদায়িকতা পরিহার করতে পারে না। সে একটা সুদীর্ঘ প্রক্রিয়ার ব্যাপার। বাঙলাদেশের বুদ্ধিজীবীদের এই প্রক্রিয়া শুরু করতে হবে। আমি, ‘শুরু করতে হবে’- এই বাক্যটি জোর দিয়ে উচ্চারণ করছি।” (আহমদ ছফা, শতবর্ষের ফেরারি : বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, ১৯৯৭)

১৯৯৭ সাল মানে বাংলাদেশের স্বাধীনতার ২৬ বছর অতিক্রান্ত। তখনো ছফা বলছেন ‘শুরু করতে হবে’। আর আজ ২০১৬ সালে, স্বাধীনতার রজতজয়ন্তী যখন সমাগত তখনো আমাদের ছফার কথার পুনরাবৃত্তিই করতে হবে।

৭.

রামমোহন রায়কে স্মরণ করতে গিয়ে রবীন্দ্রনাথ লিখেছিলেন : “যে জাতির মধ্যে স্বদেশীয় মহাপুরুষ জন্মান নাই সে জাতি কাহার মুখ চাহিবে- তাহার কী দুর্দশা! কিন্তু, যে জাতির মধ্যে মহাপুরুষ জন্মগ্রহণ করিয়াছেন কিন্তু তথাপিও যে জাতি কল্পনার জড়তা- হৃদয়ের পক্ষাঘাত-বশত তাঁহার মহত্ত্ব কোনোমতে অনুভব করিতে পারে না, তাহার কী দুর্ভাগ্য!” এবং তিনি খেদের সাথে বলছেন : “আমাদের কী দুর্ভাগ্য!”

বহু বছর আগে আমাদের হয়ে রবীন্দ্রনাথ আক্ষেপ করেছিলেন, তিনি বাঙালির মানুষ হওয়া নিয়ে আক্ষেপ করেছিলেন, তিনি আক্ষেপ করেছিলেন হে মোর দুর্ভাগা স্বদেশ বলে।

তাঁর সেই আক্ষেপ আজো আমাদের বহন করতে হচ্ছে।

আলী নাঈম। লেখক ও সংবাদকর্মী। জন্ম ও বেড়ে ওঠা ঢাকার নাখালপাড়ায়। স্কুলজীবন থেকেই পাঠাগার আন্দোলনের সঙ্গে সম্পৃক্ত। কলেজজীবন থেকে ছাত্ররাজনীতিতে সক্রিয়। বিজ্ঞান সংগঠন গড়ে তোলা, দীর্ঘদিন যাবৎ পত্রিকা সম্পাদনার কাজসহ বিভিন্ন ধরনের সামাজিক-সাংস্কৃতিক কাজে সম্পৃক্ত। ছাত্রজীবন শেষে বামপন্থী রাজনীতির সাথে...

এই বিভাগের অন্যান্য লেখাসমূহ

নারীর আপন ভাগ্য জয় করিবার: নারীজাগৃতি ও রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের কবিতা।

নারীর আপন ভাগ্য জয় করিবার: নারীজাগৃতি ও রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের কবিতা।

নবজাগরণের সঙ্গে নারীর জাগরণ, নারীর মর্যাদা ও সুরক্ষা, এবং নারীমুক্তি ওতপ্রোতভাবে জড়িত। ভারতে এই নবজাগরণের…..