নারীমুক্তি বিষয়ক এলোমেলো গদ্য

সাঈদা মিমি
নারী, মুক্তগদ্য
Bengali
নারীমুক্তি বিষয়ক এলোমেলো গদ্য

আমি নারী এটা বুঝতে অনেক সময় লেগেছে আমার। ততদিনে তারুণ্য আসি আসি করছে। এতটা তো সময় লাগার কথা নয়! তাহলে? আসলে, আমার বেড়ে ওঠার পরিমণ্ডল ছিলো ভিন্ন। তারচেয়েও বড়ো বিষয় হচ্ছে, উনিশ’শ সাতাত্তর -আটাত্তরে আমি নারী অবমাননার এইরকম রূপ দেখিনি যা এখন দেখতে পাই। পিতৃতান্ত্রিক পরিবার হলেও নারীদের সম্মান দেখানোর চমৎকার শিক্ষা আমাদের সমাজে ছিলো। যদিও আমি গনহারে বলবো না যে তখন নারী নির্যাতন হতো না। নারী তখনও নির্যাতিত হতো। যেমন, স্বামীর গৃহে নির্যাতন,  পরিবারের হাতে গঞ্জনা, এরকম ছিলো অনেক পরিবারেই। কিন্তু তার মাত্রা অসুখে পরিণত হয়নি। তখন ধর্ষণ কথাটাই আমরা শুনতে পেতাম না। এখন, একজন মেয়ে শিশু বয়ঃসন্ধির অনেক আগেই শিখে ফেলে ধর্ষণ কী!

দুই

আমাদের পরিবার রক্ষনশীল ছিলো কিন্তু নারীশিক্ষায় পরিবারগুলি অগ্রণী ভূমিকা রাখতো। নারীদের পোষাকও ছিলো দারুণ সুন্দর। স্বাধীনতা পরবর্তী সময়ের অনেক ছবিতে আমরা ছোট হাতার ব্লাউজের সাথে ফ্যাশনেবল শাড়ি পরা নারীদের দেখেছি। তখন তো পুরুষদের তাদের আঁচল ধরে টানাটানি করতে দেখিনি বা শুনিনি! নারী আন্দোলনের মতন ব্যাপারগুলি ঘটছে বলে শুনিনি। তখনও বিবিধ নারী সংগঠন ছিলো  বটে। কিন্তু পুরুষদের অসম্মান করে নারীরা বাণবাক্য ছুঁড়ে দিতো না। নারী পুরুষের পারস্পরিক সম্মান এবং ভালোবাসার বিষয়টি প্রধান ছিলো।  সে যুগে নারী পুরুষ কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে কাজ করতো। এবং সত্যিটা এই যে, এখনো নারী পুরুষ কাঁধে কাঁধ মিলিয়েই কাজ করে। কিন্তু ত্রিশ পঁয়ত্রিশ বছর আগের সেই সভ্য জগতটা বদলে গেছে। কি কারনে জানিনা, আমাদের সমাজে প্রবেশ করেছে এক অন্ধকার যুগের ছায়া।

তিন

যখন সভ্যতার উত্থানে বিশ্ব এগিয়ে যাচ্ছে তখন আমরা আমাদের সামাজিক জীবনে অদ্ভুত সব অন্ধকার যোগ করছি। ধর্মীয় কাঠামোর পরিবর্তন হয়েছে। তবে কি আমাদের বাবা, দাদা, পরদাদারা ধার্মিক ছিলেন না? অবশ্যই ধার্মিক ছিলেন। গোড়া ধার্মিক হয়েও তারা সামাজিক, পারিবারিক জীবনের ওপর শোষণের পরকাষ্ঠা ছুঁড়ে দেননি।  শোষণ কথাটাই যথাযথ লাগছে। তারা শাসন করতেন কিন্তু শোষণ করতেন না। অন্যের ধর্মকে তারা শ্রদ্ধা করতেন। এই সময়ে এসে এই শ্রদ্ধাবোধ আমি দেখতে পাইনা। তারুণ্যের বিপুল অপচয় দেখি চারপাশে। বিশাল এক তরুণ সমাজ হাহাকারের মধ্য দিয়ে চলছে। তাদের চোখে নির্দিষ্ট কোনো স্বপ্ন নেই। মিডিয়া বা ইন্টারনেটকে তারা ব্যবহার করছে অর্থহীন কাজে। রাজনীতির সংগা জানার আগেই তারুণ্যের আরেকটা অংশ জড়িয়ে গেছে অপরাজনীতির সঙ্গে। অনেকেই বলবেন, এসব কথা আমি কেনো বলছি? এসবের সাথে নারী অধিকারের সম্পর্ক কোথায়? সম্পর্ক আছে।

চার

তরুণ তরুণীরা পরিবার থেকে শেখা শুরু করে আর সেই শিক্ষা পূর্ণতা পায় সামাজিক জীবনের স্পর্শে। সংস্কৃতি,  রাজনীতি,  বিচারব্যবস্থা,  পারিবারিক মূল্যবোধ এই সবকিছুর মধ্যে যখন অপ প্রত্যয় ঢুকে যায় তখন শুরু হয় নির্মম এক অবক্ষয়। চুরি, ডাকাতি,  খুন, ধর্ষণ ইত্যাদি বেড়ে যায়। নারী ক্রমশ সম্মান হারাতে থাকে। নারীকে বিভিন্নভাবে ভোগ্যপন্য বানিয়ে প্রদর্শন করা হয়। সে সমাজ ব্যবস্থার মধ্যে একশ্রেণির নারীবাদের উত্থান ঘটে যারা নারীদের রক্ষায় যতটা না কাজ করে তারচেয়ে বেশি কাজ করে পুরুষের দিকে কাদা ছোঁড়াছুড়ি করতে। তাতে আসলে কার কি লাভ হয়? পুরুষতান্ত্রিক সমাজ ব্যবস্থায় পুরুষের ভূমিকা প্রধান থাকবে সেটাই স্বাভাবিক। কিন্তু সবকিছুর জন্য কেবল পুরুষকেই গালমন্দ করার পক্ষপাতি আমি নই। সৃষ্টির শুরু থেকে আজ পর্যন্ত নারী পুরুষ একসাথে সমাজ উন্নয়নে কাজ করেছে। আমি আশা করতে পারি ভবিষ্যতেও তারা একসাথে কাজ করবে। আমি মনে করি, বিষয়টি আরও সফলভাবে হতে পারে যদি নারীবাদ, পুরুষবাদ বাদ দিয়ে মানবতাবাদের জন্য নারী পুরুষ একত্রে কাজ করে তবেই।

পাঁচ

মানবতার পক্ষের মানুষেরা কেবল দেশকে নিয়ে ভাবনার সূযোগ পায়। ফলে একটা জনগোষ্ঠীকে এগিয়ে নেয়ার জন্য নারী পুরুষ একসাথে এগিয়ে আসে। উন্নত হতে শুরু করে একটা দেশ। কেননা, দেশের বিশাল এক জনগোষ্ঠী কাদা ছোঁড়াছুড়ি বাদ দিয়ে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে যখন উন্নয়নমূলক কাজ করা শুরু করে, তখন আরও অধিক জনগণ এবং সরকার তাদের পাশে এসে দাঁড়ায়।  এর বড়ো নমুনা হচ্ছে চীন। চীনের কথা না হয় বাদই দিলাম। আমাদের আশেপাশের দেশ যেমন, ভুটান উন্নয়নশীল একটি দেশ যারা সম্পুর্নভাবে তাদের দেশের প্রতি ডেভোটেড। পাহারঘেরা এই দেশটি পনেরো বছর আগেও ছিলো অশিক্ষিত একটি দেশ যেখানে উন্নত প্রযুক্তির ব্যবহার তো ছিলোই না, সামান্য টেলিভিশনের ব্যবহারও ছিলো স্বপ্নাতীত। সেই দেশ এখন প্রযুক্তির যোগ্য ব্যবহার শিখে গেছে। ধর্মের সাথে মানবতা যোগ করে তারা হয়ে উঠেছে ভারসাম্যপূর্ণ, শিক্ষিত  একটি দেশ। তাহলে? আমরা কি পারিনা এখান থেকে শিক্ষা নিতে পারিনা? কি নেই আমাদের? যোগ্যতার প্রশ্ন যদি আসে তাহলে বলতেই হয়, বিশ্বের দরবারে নিজেদের জন্য একটা যায়গা করে নিয়েছি আমরা।  সেই যায়গাটাকে আরও সম্মানিত এবং পাকাপোক্ত করতে আমাদের নারী পুরুষের একসাথে কাজ করা উচিত। মানবতার জয় হোক।

সাঈদা মিমি। জন্ম ২৯ ফেব্রুয়ারী ১৯৬৮। ছাত্রজীবন থেকে লেখালেখি শুরু। প্রকাশিত কাব্যগ্রন্থ সব নিয়ে গ্যাছে এক সময়ের লুটেরা বাতাস ফারাও কুমারী একজন মৃতের ডায়েরী শুশুনিয়া পাহাড় ঔরঙ্গজেবের নীল ঘোড়া (গল্পগ্রন্থ) কীর্তনখোলা (প্রকাশিতব্য কাব্যগ্রন্থ) পেশাগত জীবনে একজন ফ্রি ল্যান্সার সাংবাদিক।

এই বিভাগের অন্যান্য লেখাসমূহ