শেলী জামান খান
কবিতা
Bengali

যুদ্ধ চাই না চাই না আর কোন মহাযুদ্ধ

ঘুম থেকে উঠেই যুদ্ধ দেখি…
যুদ্ধ দেখি ধূমায়িত চায়ের কাপে,
প্রতিদিন টেলিভিশনের রঙ্গিন পর্দায়,
আল জাজিরা, সিএনএন কিংবা বিবিসির খবরে।
ইদানিং আমার নিউইয়র্কের সকালগুলো এভাবেই শুরু হয়।

যদিও মাঝেমধ্যেই খবরগুলো দ্রুত বদলে যায়।
নতুন কোন আবিস্কারের কাহিনী,
কিংবা কোন ধনকুবেরের চমকপ্রদ ডিভোর্স কেলেঙ্কারীতে
সেখানে জায়গা করে নেয় আরও টাটকা নতুন কিছু খবর।

এই মূহুর্তে খবরের সিংহভাগ দখল করে আছে যুদ্ধবাজ রাশিয়া।
দেশে দেশে প্লাকার্ড, ব্যানার হাতে নিরিহ জনগণ।
পোস্টারে হিটলারি গোঁফে শোভিত পুতিনের মুখ।
তারও পেছনে পুড়ে যাওয়া, ধূমায়িত বাড়িঘর।
পুত্রের ঝলসানো শরীর কোলে নিয়ে ক্রন্দনরত অসহায় কোন পিতা!

জীবাণুযুদ্ধ শেষ হতে না হতেই শুরু হয়েছে আরেকটি যুদ্ধের দামামা।
হয়তো এটা তৃতীয় মহাযুদ্ধের পটভূমি, হয়তোবা আরেকটি মহাযুদ্ধের অশনিসংকেত!
হৃদয় রুদ্ধ হয়ে আসে।
মানবতা আড়মোড়া ভেঙ্গে পাশ ফিরে শোয়!
প্রতিবাদের ভাষা পড়ে থাকে নির্বাক!

নিরাপত্তা পরিষদ বরাবরের মতই ব্যস্ত শান্তি আলোচনায়!
স্টপ ওয়ার!
স্টপ ইনোভেশন!
যুদ্ধ নয়, শান্তি চাই!

এমনি যুদ্ধবিরোধী বার্তা লেখা প্লাকার্ড হাতে উঁচিয়ে,
আমরা দল বেঁধে জড়ো হই ‘ডাইভারসিটি চত্বর’এ
সভা শেষে ‘ইত্যাদি রেস্টুরেন্ট’ এ বসে চা খাই, সাথে গরম গরম ডালপুরি।
বন্ধুদের সাথে হাগ বিনিময় করে সন্ধ্যায় বাড়ি ফিরে আসি।

শীতার্ত রাতে কম্ফোটারের নিচে সুখনিদ্রা যাই।
কেউ কেউ সঙ্গমে শান্তি খুঁজি।
নিশ্চিত জীবনের নিশ্চয়তায় ফের সকাল হয় আমাদের জনপদে।
কেবল কাঁটার মত অষ্টপ্রহর বুকে বিঁধে থাকে
ইনকিউবিটরের ভেতর যুদ্ধাক্রান্ত মুমূর্ষু শিশুদের মুখ!

ক্ষমতাধরদের নজরদারীতে একাই লড়ছে ইউক্রেন।
টুইটারে বিলাপরত প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির জেলেনস্কির অসহায় মুখ।
কলমযুদ্ধে শোচ্চার বুর্জোয়া সাংবাদিকগণ।
আমজনতার সাধ্য কী যুদ্ধ বন্ধ করে।

হে পরাশক্তিধর রাষ্ট্রনেতাগণ! তোমরা বন্ধ কর এই যুদ্ধ যুদ্ধ খেলা,
বন্ধ কর আমজনতার জীবন নিয়ে অবহেলা!
এমনিতেই জীবাণুযুদ্ধে পরাস্ত এই পৃথিবী!
আমরা চাই না আর কোন মহাযুদ্ধ। পৃথিবী আজ বড় ক্লান্ত!
যুদ্ধে যুদ্ধে এই ছোট্ট গ্রহটি আজ বড় শ্রান্ত!

এই প্রবাসেও একুশ আসে

এই প্রবাসেও একুশ আসে, আসে বাহান্ন।
একুশ আমার দীপ্ত শপথ, রৌদ্রজ্জল অপরাণ্হ!
একুশ আমার মাথা উঁচু করে দাঁড়াবার দিন।
একুশ এলেই শ্রদ্ধা ভরে স্মরণ করি আমার মাতৃঋণ!

বাংলা আমার ‘ মা’ বলে ডাকা প্রথম উচ্চারণ!
যদিও দূরপ্রবাসে যাপন করি অভিবাসী জীবন।
ভীনভাষার এই ভীনদেশেতে, মাতৃভাষাকে বাঁচিয়ে রেখেছি প্রাণের উত্তাপে।
বাংলায় বলি, বাংলায় লিখি, ওরা বলে ‘ডায়াসপোরা’ আমাদের লেখনীকে।

লিঙ্গুয়া ফ্রাঙ্কার এই শহরে বাঙালি পেলেই বাংলায় কথা বলি,
ইংরেজি রেখে বাংলায় করি চিঠি চালাচালি।
ভালোবাসি সেও বাংলায়,
বাংলায় করি অঙ্গিকার।
এই প্রবাস জীবনেও,
বাংলাকেই করেছি অহঙ্কার!

গলার মালা করেছি বাংলা বর্ণমালা,
নতুন প্রজন্মের কাছে গল্প করি আমাদের ছেলেবেলা।
শেকড়ের খোঁজ জানাই ওদের, আঁচলে বাঁধা মাটিতে।
বাংলার সোঁদাগন্ধ দেই না ওদের ভুলিতে।

একুশের প্রভাতে আজও যাই প্রভাতফেরিতে…
সাদা শাড়ি, কালো পাড়ে, লাল গোলাপ হাতে।
গলায় পরি বর্ণমালা, কণ্ঠে তুলি যপমালা…
“আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি,
আমি কি ভুলিতে পারি!
আমি কি ভুলিতে পারি! “

শীত ঘুমেই কাটছে জীবন

শীত ঘুমেই কাটছে জীবন
এলো নতুন একটি বছর,
তারপর আরও একটি বছর!
২০২২ এখন!

শীতের কনকনে হীমেল বাতাস
বাইরে ওতপাতা দাপুটে ডেল্টা এবং ওমিক্রন!
ঘোলাটে চোখে আবারও দীর্ঘ শীতঘুম!

সোশ্যাল ডিসটেন্স,
আইসোলেশন,
লকডাউন,
ভারী ভারী শক্ত শব্দগুলো
মাথায় জট পাকিয়ে কিলবিল করে!

ভীষণ একটা লম্বা শীতঘুম!
লং উইন্টার হাইবার নেশন!
যেন অনন্তকাল ধরে আছি পড়ে।
এক অন্ধকার ঘরে!
এক বিষাদ সময়ে!

মহামারীটা ঠিক কবে যেন শুরু হয়েছিল?
ঠিক কবে যেন?
মাথাটাও ঠিকঠাক কাজ করে না।
মাথার ভেতরে কেবলই ফিসফাস,
কেবলই ষড়যন্ত্র!
হবে না! আর পাবে না সেই স্বাধীন, স্বপ্নীল জীবন।

এখন কেবলই ঘুম। কেবলই অপেক্ষা!
অপেক্ষা চারদেয়ালের ভেতর!
কিসের জন্য যেন অপেক্ষা?

অপেক্ষা দিনবদলের!
মুক্তবাতাসে, কড়া রৌদ্দুরে ছুটে বেড়ানোর অপেক্ষা!
কেবলই স্বপ্ন দেখি।
স্বপ্নে দেখি, সেইসব ফানুস ওড়ানোর দিন!

কবীর সুমনের মতই, আমিও খুব করে চাই…!
খুউব করে চাই হারানো দিনগুলো আবারও ফিরে পেতে!

চাই সেই “দলাদলির দিন”
চাই সেই, “গলাগলির দিন!”
চাই সেই, “হঠাৎ অকারণে হেসে ওঠার দিন”!
হঠাৎ পথে দেখা বন্ধুকে জড়িয়ে ধরে বলতে চাই,
“বন্ধু, কী খবর বল?
কত দিন দেখা হয় নি… ”

২০২০, ২১, ২২
একেকটা বছর আসছে, যাচ্ছে।
কেবলই হারিয়ে যাচ্ছে সময়!
আমি, এবং আমার ভেতরের চির কিশোর আমিটা,
কান পেতে রয়!
আবারও জেগে ওঠার প্রতীক্ষায়!

(ভাবসূত্র: কবীর সুমন)

এসো শীত-বরষায়

ছেলেঃ
খিচুড়ি খাবে ?
তবে আমার বাড়ি এসো ।
শীত-বর্ষা রাতে,
বকুল তলার, ছাউনি তলে,
মাটির চুলোয় আগুন জ্বেলে,
বসবো দু’জনে
আমার আঙ্গিনাতে।

মেয়েঃ
কে? কে তুমি?
ঠিক এমনি করে,
সে যে ডাকতো আমায়।
সুদূর অতীত থেকে, শতবর্ষ আগে।
আজও ভেসে আসে ঐ সুদূরের ডাক।
“এসো! এসো! আমার ঘরে এসো। আমার ঘরে।”
ভেসে আসে ওই সুর,
কোন সেই জন্ম, জন্মান্তর থেকে!

ছেলেঃ
একা আমি –
যেটুকু পারি গুছিয়ে করি ।
খুঁত ধরো না ।
তুমি এলে চালের খুদে
খিচুড়ি রাঁধবো প্রাণের জলে।
খিচুড়ি খাবে?
চলে এসো এক শীত-বর্ষা রাতে!

মেয়েঃ
আহা…!
লাকড়ির উনুনে গনগনে লাল আগুন।
মাটির হাঁড়ির আধখোলা মুখ
টগবগে লাভার মত ধূমায়িত ইষৎ হরিৎ খিচুড়ির আভাস।

ছেলেঃ
সাথে বেগুন ভাজা, লঙ্কা পোড়া দেবো।
গুড়ের চা, পায়েস, টাঙ্গাইলের চমচম,
যতখুশি খাবে।

মেয়েঃ
মনে পড়ে, কড়াইয়ে ঝলসানো গোল বেগুনের চাকতি,
তার পাশেই শুকনো মরিচের আলিঙ্গনের আকুতি!
ঠিক পাশেই বসা ক্ষুধার্ত এক তরুনের আবছায়া মুখ।
সে যে আমার রান্না বড় ভালোবাসতো!

ছেলেঃ
ছাদে যাবে ? আমার ছাদে?
আমার ছাদে বাগান আছে।
মাথার উপর আকাশটানা ছাদ আছে।
একজোড়া পায়রা আছে।
হিংসুটে এক চাঁদ আছে।
একটু আপোষ করে নিও।

মেয়েঃ
প্রাণ করে উঠল আনচান,
মানসপটে ভেসে ওঠল
একটি খোলা ছাদবাগান,
ভালোবেসে দিয়েছিলেম “নন্দন কানন” তার নাম।
তখনও আকাশে চাঁদ ছিল,
বাতাসে ফুলের সুবাস ছিল,
ছাদের কোনে বাকবাকুম কূ’জন ছিল।
আর…! আর একজোড়া মুগ্ধ চোখ ছিল।

ছেলেঃ
আমিতো তোমার অতীত নই,
আমি যে বর্তমান।
ওগো মেয়ে, আমি ছায়া নই, মায়া নই,
আমার আছে কায়া।
কেন মিথ্যে খুঁজে ফেরো ন্যাপথলিনের পুরনো গন্ধ?
হাতরে ফেরো ফেলে আসা পুরনো স্মৃতি।

মেয়েঃ
জানেন আমার ঈশ্বর!
কতবার জন্ম নিয়েছি
কতবার হয়েছি জাতিস্মর!
তাইতো কেবলই মনে পড়ে যায়
নানা জন্ম, জন্মান্তরের কথা!

ছেলেঃ
আগের জন্মের না পাওয়া সব সুখ,
না পাওয়া ভালোবাসা,
এই জন্মে সব পুষিয়ে দেব।
কথা দিলাম।
আসবে?

মেয়েঃ
কথা দিলে?
আগের জন্মের না পাওয়া সব সুখ,
না পাওয়া ভালোবাসা,
এই জন্মে সব পুষিয়ে দেবে?
কথা দিলে?

ছেলেঃ
কথা দিলাম!
আসবে? আসবেতো??

মেয়েঃ
কথা দিলাম। আসবো!
আসবো, অধীর কামনায়!
কোন এক শীত-বর্ষায়।

(ভাবসূত্রঃ কবি পূর্ণ পাত্র)

শেলী জামান খান। লেখক ও সাংবাদিক। জন্ম বাংলাদেশের পুরনো ঢাকায়। ছোটবেলা কেটেছে চাকুরিজীবী বাবার সাথে বিভিন্ন মফস্বল শহরে।উচ্চতর শিক্ষাজীবন ঢাকা ইডেন কলেজ ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে। বর্তমানে তিনি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নিউইয়র্কে বসবাস করেন। প্রকাশিত বই:

এই বিভাগের অন্যান্য লেখাসমূহ

ঝরা পাতা

ঝরা পাতা

  চারিদিকে কোলাহল শূণ্যতা করেছে গ্রাস, বেদনা বিধুর অতৃপ্ত বাসনায় হাহাকার, অজান্তে নীরবতা তোমার স্পর্শে…..